ঢাকার সিনেমা ইতিহাসে ‘মেহেরজান’
রুবাইয়াত হোসেন পরিচালিত তাঁর প্রথম সিনেমা এটি। ২০১১ সালে নির্মিত এই সিনেমার গল্প বিস্তৃত ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিকে ভিত্তি করে।
সিনেমাটিতে দেখানো হয়, এক পাক খানসেনার সাথে তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানের এক গ্রাম্য সম্ভ্রান্ত পরিবারের মেয়ের প্রেম (যার সূত্রপাত হয়- মেয়েটিকে অন্য পাকিস্তানী মিলিটারীবাহিনীর হাত থেকে রক্ষা করার মাধ্যমে)। এই প্রেম আর আট-দশটা প্রেম থেকে আলাদা, নিজের কিছু গুনেই। গল্পে মানব-মানবীর শারীরিক প্রেমের চেয়েও শাশ্বত হয়ে উঠেছে মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসা। উদাহরণস্বরূপ- পাক খানসেনাকে বলা হয়েছিল মুলক রক্ষা করতে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে, কিন্তু সে পূর্ব পাকিস্তানে এসে আবিষ্কার করে মিলিটারী কর্তৃক অসহায় সাধারণ মানুষের উপরে করা অবর্ণনীয় বাস্তবতা। তাই সে তাঁর অপারেশন না করে পালিয়ে যায়।
আবার, পূর্ব পাকিস্তানের মেয়েটিও খানসেনা হওয়া সত্ত্বেও সৈন্যকে আশ্রয় দিয়ে, সেবা-যত্ন করে সুস্থ করে তোলে এবং গ্রামের ‘মুক্তি’-দের থেকে আড়াল করে রাখে। পরিবারের চাপের মুখে আমরা তাঁকে জিগ্যেস করতে শুনি? -‘নিজের দেশের লোকেদের কাছে বেইমান, আমাদের লোকেদের কাছে পাকি খান সেনা, ওর কি দোষ?’ সিনেমার সাথে একাত্ম হয়ে গেলে, এটা যেন আমাদেরও প্রশ্ন হয়ে ওঠে।
সচরাচর মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক সিনেমাতে যেমন বাস্তবতার সামনে আমাদের দাঁড় করানো হয়, এইখানে তেমনটা পরিচালক ইচ্ছে করেই যেন করেন নি। যুদ্ধের কদর্যতা, ভয়াবহতা ও নৃশংসতার চিত্র সেই অর্থে এখানে পাওয়া যাবে না; কিন্তু যেকোনো যুদ্ধই যতোটা জাগতিক তাঁর চেয়ে অনেক বেশি মানসিক তথা মনস্তাত্ত্বিক, সেই বিচারে ফেললে এই সিনেমা মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের পটে আঁকা এক অসামান্য সৃষ্টি।
এ তো গেলো সিনেমার দর্শকের উপলব্ধি। কিন্তু, সিনেমাটার ভেতরে উঁকি দিয়ে দেখলে চিন্তার আরও কিছু দরজা খুলে যায়। একজন শান্তিপ্রিয় গ্রামের মোড়লস্থানীয় ব্যক্তির দৃষ্টিকোণ থেকে সিনেমাটাকে বুঝবার চেষ্টা করলে দেখা যাবে, এমন একজন মানুষ যে তাঁর পুরো জীবন গ্রামীণ সাধারণ মানুষের উপকারে আর ধর্মকর্মে নিজেকে ব্যাপৃত রেখেছেন। সিনেমার গল্পের প্রয়োজনেই তাঁকে বলতে শুনি বারবার -“ফাবিআইয়্যি আ-লা-ই রাব্বিকুমা তুকাযযিবান (অতএব তোমরা তোমাদের রবের কোন অনুগ্রহ অস্বীকার করবে?)। কিন্তু, ধর্মের নামে যে রাজনীতি তাঁকে তিনি সম্পূর্ণ বাতিল করে দেন। আমরা জানতে পারি, এক সময় তিনি মাওলানা ভাসানী ও শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হকের সাথে ওঠা-বসা করলেও তৎকালীন ধর্মভিত্তিক রাজনীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন না। দ্বিজাতিতত্বে আস্থা আছে কিনা এমন প্রশ্নের উত্তরে আমরা তার জবানিতে পাই, রক্তপাত না হওয়ার হুশিয়ারি।
সচরাচর মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক সিনেমাতে যেমন বাস্তবতার সামনে আমাদের দাঁড় করানো হয়, এইখানে তেমনটা পরিচালক ইচ্ছে করেই যেন করেন নি। যুদ্ধের কদর্যতা, ভয়াবহতা ও নৃশংসতার চিত্র সেই অর্থে এখানে পাওয়া যাবে না; কিন্তু যেকোনো যুদ্ধই যতোটা জাগতিক তাঁর চেয়ে অনেক বেশি মানসিক তথা মনস্তাত্ত্বিক, সেই বিচারে ফেললে এই সিনেমা মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের পটে আঁকা এক অসামান্য সৃষ্টি।
আর একটি কথা না বললে এই সিনেমার বিশ্লেষণ অসম্পূর্ণ থেকে যাবে, আর তা হলো- এই সিনেমাতে গল্প বলবার আঙ্গিক। খুব পারদর্শী না হলে এমন করে এমন সাহসী গল্প বলা যায় না। যুদ্ধের ফলে সৃষ্ট কিছু আপাতদৃষ্টির অগোচর বিষয় এই সিনেমার উপজীব্য। আর সেই বিষয়গুলোই যেমন সিনেমাতে একটা ভিন্ন মাত্রা যোগ করেছে একই সাথে সিনেমাটিকে করেছে কালের অতীত।
ধন্যবাদ – রুবাইয়াত হোসেনকে এমন চমৎকার একটি সিনেমা আমাদের উপহার দেবার জন্য। আরও ভালো ভালো কাজ দেখবার আশায় রইলাম।