তিনি বললেন (প্রথম পর্ব)
১.
পথহারা পথিককে পথ দেখিয়েই যুগে যুগে সর্বনাশ হয়েছে। কেউ পথ না দেখালে সে নিজেই নতুন পথ আবিস্কার করতো।
২.
সবার সঙ্গে ভাঁজ দিয়া চললে নিজের গায়ের ভাঁজ আর থাকে না, ভেঙে যায়। পরে সারাদিন ইস্তিরি দিয়ে ডলাডলি করলেও আগের ভাঁজে আসে না।
৩.
নিজের বিপক্ষে মানুষ চিরদিনই একা।
৪.
জ্ঞানীদের কাছাকাছি যাওয়া খুবই দরকার। কেননা খুব কাছে না গেলে তাদের কাণ্ডজ্ঞানহীনতা টের পাওয়া যায় না।
৫.
যারা মরে যাবো বলে বলে প্রতিদিন মুখে ফেনা তুলে ফেলে তাদের সহজে মৃত্যু হয় না। তারা সুদীর্ঘ আপত্তিকর জীবন কাটানোর পর বার্ধক্যে এসে সস্তা অসুখ দীর্ঘদিন যাপন করে তারপর মরে। তাই বন্ধু, মরতে চাইলে চুপচাপ মরে যান। কাউকে জানানোর দরকার নাই।
৬.
বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দুজনে মিলে কেবল একটাই ক্রিয়েটিভ কাজ করা সম্ভব আর তা হলো সন্তান উৎপাদন।
৭.
যারা নিজের রূপে মুগ্ধ তারা কখনোই জানতে পারে না যে আয়না তাদের সঙ্গে প্রতিনিয়ত প্রতারণা করছে।
৮.
যে কোনো ক্ষেত্রে উম্মতবেষ্টনি প্রকৃত-অর্থে ধাতু-তারল্যকেই হিজাবিত করে।
৯.
প্রতিটি মানুষ প্রকৃত-অর্থে নিজেকেই ভালোবাসে। আর কেবল বড় করে দেখে নিজের যন্ত্রণা। মানুষের এই আত্মরতি এবং স্বার্থপরতার জন্যই মানুষ সৃষ্টিশীল।
১০.
মানুষ চাইলে, চেষ্টা-সাধনা করলেই সবকিছু পায় না। অপার্থিব কিছুর কথা নাই বা বললাম, পার্থিব এমন জিনিশও আছে মানুষ পায় না।
১১.
কাম এবং প্রেম সকল প্রকার নৈতিকতার ওপরে। ইহাদের ডিভাইনও ভাবা যেতে পারে।
১২.
রবিনাথের সঙ্গে নজরুলের তুলনা দেয়া একপ্রকার সাম্প্রদায়িক মূর্খতা। প্রকৃত অর্থে এই দুইজনের মধ্যে কোনোরূপ তুলনাই হয় না। দুইজনই আপন জায়গায় দেদীপ্যমাণ। রবিনাথ সাহিত্যক্ষেত্রে একটা পরিব্যাপ্ত সময়ের জন্ম দিয়েছেন। আর নজরুল একটা অস্থির সময়ের পেট থেকে জন্ম নিয়েছেন।
১৩.
পৌঁছাতেই হবে কেনো? পৌঁছে গেলেই তো সব ফুরিয়ে গেলো।
১৪.
আমাদের বেশিরভাগ কবি-লেখকই পাড়ার ক্লাবের পুরস্কারের জন্যও লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে আর সংশ্লিষ্ট গোষ্ঠীর পায়ে পায়ে ঘোরে।
১৫.
একটা কুকুর বা বিড়ালকে লালন-পালন করতে যে-খরচ লাগে তার অর্ধেক খরচে একটা অনাথ শিশুর দায়িত্ব নেয়া যায়।
১৬.
বিশ্বাস মানুষকে আক্ষরিক অর্থে মুক্তিই দেয়। কিন্তু সংশয় মানুষকে গতি দেয়, সচল রাখে, এগিয়ে নিয়ে যায়। আর অবিশ্বাস মানুষকে পাথরে পরিণত করে।
১৭.
বাঙালিদের কাছে একমাত্র ভাতই হচ্ছে শুদ্ধ সুন্দর। জন্ম থেকেই নিয়মিত খেয়ে যাচ্ছি, ভাতে কখনো বিবমিষা জন্মে না। ভাত চিরদিনই সুন্দর।
১৮.
ঢাকা শহরের ফ্লাইওভারগুলি অন্তত বাঙলা সিনেমার কাজে লাগতেছে।
১৯.
ড্রোন আবিস্কার বাঙলাদেশি সিনেমার ডিরেক্টরদের জন্যে পরম প্রাপ্তি। ফলত ইহাদের বানানো সিনেমায় এরিয়াল শটের কারুকলার বাইরে আর কিছু থাকে না।
২০.
গ্রুপ-ছবিতে সবাই সুখি, হাসিখুশি। গ্রুপ-ছবি মূলতই একটা অনুষ্ঠান। প্রকৃত জীবন যাপিত হয় আসলে ফ্রেমের বাহিরে।
২১.
ছবি কখনো সত্য কথা বলে না। ছবি মানেই একটা খণ্ডিত ফ্রেম, অনেকটা অন্ধের হাতি দর্শনের মতো ব্যাপার।
২২.
ছবির সৌন্দর্য মূলত একটা বিভ্রম। ছবিতে সবকিছু ছবির মতোই সুন্দর।
২৩.
অন্ধ এক অর্থে ভাগ্যবান। তাকে কদর্যতা আর দেখতে হয় না। পূর্বের নন্দিত স্মৃতি ছুঁয়ে সে বাঁচে। জন্মান্ধও ভাগ্যবান। কেননা সে ছুঁয়ে কল্পনা করে নেয় মাটি আর বৃক্ষের রং, পরজীবী গুল্মের রূপ।
২৪.
অসভ্য ছোটলোক বউয়ের ওপর রেগে গেলে চুলের মুঠি ধরে মারে। আর সভ্য ভদ্রলোক বউয়ের ওপর রেগে গেলে বাজার থেকে দুইকেজি ছোটমাছ এনে বউকে কাটতে দেয়।
২৫.
ইংরেজি অবশ্যই জানার দরকার আছে। তবে ইংরেজি জেনে নিজেকে বিরাট কিছু মনে করা, বাঙলা বলাটাকে লজ্জাজনক মনে করা আসলে একটা কলোনিয়াল আচরণ।
২৬.
ধর্মবিশ্বাস যুক্তি দিয়ে চলে না, চলে ভক্তি দিয়ে। যাদের ধর্মান্ধ বলা হয়, তারা অন্ধ নয়, তারা মূলত ভক্ত। সবকিছুকে একই পাল্লায় মাপার প্রবণতাই মূলত অন্ধত্ব।
২৭.
কবির কোনো প্রেমিকা থাকে না। কবির নারী মূলতই বাগীশ্বরী।
২৮.
যারা গুহায় বা বনে চলে যান তারাও আপন মহিমা প্রচারের নিমিত্তেই যান। সিদ্ধার্থ গৌতম, তিনিও আপন মহিমা প্রচার করেছেন, অন্যথায় তাকে কেউ অনুসরণ করতো না।
২৯.
প্রতিভাবানরা অলস হয় প্রকৃতির খেয়ালে। কারণ তারা অলস না হলে প্রতিভাহীনরা বেকার হয়ে যেত। অলস না হলে একজন প্রতিভাবান যা কাজ করতো সেই কাজ প্রতিভাহীনরা একশোজন মিলে করে।
৩০.
ওই অর্থে মায়ের তেমন কোনো আশ্রয় থাকে না। কিন্তু সন্তান মায়ের আশ্রয়ে থাকে।
৩১.
ভিন্নমত সহ্য না করলেই নেতা হওয়া যায়। আর সহ্য করলে কর্মী হয়ে থাকতে হয়।
৩২.
শিল্প-সাহিত্যের ক্ষেত্রে কানামামা মানে মিডিওকার কোনো কালেই কোনো অর্থ তৈরি করে না।
৩৩.
‘নাই মামার চেয়ে কানা মামা ভালো’ এই কথার ভিত্তিকে শুরু থেকেই ‘দুষ্ট গরুর চেয়ে শূন্য গোয়াল ভালো’ এই কথাটা নড়বড়ে করে দেয়।
৩৪.
চীনারা সব মাল বানায়। আর বাঙলাদেশ চায়না মালও বানায়।
৩৫.
চীনারা উন্নতি করতে পেরেছে কারণ তাদের নাক বোঁচা। আর আমরা বাঙলাদেশিরা পারি নাই কারণ আমাদের ‘নাক উঁচা’।
৩৬.
অসৎ কখনো ভালো শিল্পী-সাহিত্যিক হতে পারে না। এই জাতীয় কথা মূলত আবেগের কথা। এই ক্ষেত্রে সততা-অসততা প্রদীপের ওপরে নিচে আলো-অন্ধকারের মতো। প্রদীপের নিচের অন্ধকার প্রদীপকে কখনো জাস্টিফাই করে না, ম্লানও করে না।
৩৭.
অক্ষমের আশ্রয় মূলত দিবাস্বপ্নের জগত।
৩৮.
সন্দেহ আর ঈর্ষা এই দুই জিনিশ প্রেম আর দাম্পত্য সম্পর্কের লাবণ্য।
৩৯.
ডায়ালগ মানে কথা চালাচালিই মূলত চিন্তার ক্ষেত্রকে প্রলম্বিত করে।
৪০.
‘যত মত, তত পথ’ এইটা রামকৃষ্ণ পরমহংসের উদারনৈতিক দর্শনের কথা। তবে তিনি নিজে সব পথকে সঠিক মনে করতেন না। কারণ সব পথ একই সঙ্গে গন্তব্য হয় না।
৪১.
বেড়ানোর জায়গা বরাবরই সুন্দর। কিন্তু বসবাসের জায়গা কখনো-সখনো ক্লান্তিকর।
৪২.
কথিত মিডিয়া কাউকে রাক্ষস বানায় না, কেবল ঘুমন্ত রাক্ষসকে জাগায়। যে রাক্ষস—সে আদি থেকেই রাক্ষস।