অক্ষরবন্দী জীবন-১১
তিন টুকরো হুমায়ূন
‘প্রীতি উপহার’–এর পর থেকে-
হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে আমার তিন টুকরো গল্প আছে।
এক.
’৮৩-’৮৪র দিকে সম্ভবত তিনি দেশে ফিরলেন। সে সময় সাপ্তাহিক ‘বিচিত্রা’য় তাঁর বই নিয়ে আলোচনা বের হতো। আমি তখন কলেজে পড়ি। তখন তাঁর ‘এই বসন্তে’, ‘একা একা’, ‘অন্যদিন’, ‘সৌরভ’—এসব বই বেরুচ্ছে। ‘বিচিত্রা’র সুলুকসন্ধানে আমি সোজা বাংলাবাজার চলে যেতাম। ‘নসাসে’র আজীবন গ্রাহক (সদস্য নং ১৩) হওয়ায় কমিশন পেতাম। অনেক সময় দেখা যেত রিভিউ হলেও বইটা তখনো আসেনি বাঁধাই হয়ে। এমনই এক হুমায়ূনোন্মাদনার কাল গেছে কৈশোরে।
’৮৪র শেষ দিকে প্রিয় লেখককে একটা চিঠি লিখেছিলাম। সে চিঠির মুন্সিয়ানাপূর্ণ ভাষ্যে আমি যে ’৭৮ সাল থেকে তাঁর ‘তোমাদের জন্য ভালোবাসা’ দিয়ে শুরু করে সর্বশেষ বইটাও পড়েছি, এই তথ্য জানাতে ভুলিনি। ’৪৮-এ তার জন্মসালের সঙ্গে সালমান রুশদীর ‘মিডনাইট চিলড্রেন’ মিলিয়ে কী একটা পাণ্ডিত্যও জাহির করেছিলাম। উদ্দেশ্য একটাই— লেখক আমার বৈদগ্ধ্যে মুগ্ধ হয়ে চিঠির জবাবটা যেন অবশ্যই দেন। চিঠি এল দ্রুতই, নিউজপ্রিন্টের কাগজের মাথায় রসায়ন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় লেখা। চিঠিটা আজও যত্ন করে রেখেছি কিন্তু এখন হাতের কাছে নেই। চিঠি পড়ে বুঝলাম তাঁর সবই যে আমার পড়া সেটা ঠিকই ধরেছেন, তিনি ‘অভিভূত’ হয়েছেন আর ডিপার্টমেন্টে গিয়ে গল্প করার দাওয়াতও পেলাম; কিন্তু আমি যা মুখচোরা! পুনশ্চ: দিয়ে লিখলেন, ‘চিঠির ভেতর ঠিকানা লেখা খাম দেওয়াটা কি এক ধরনের অভদ্রতা নয়, যেন ভাবা—এক টাকার জন্যে আমি চিঠি লিখব না!’ চিঠি পেয়ে খুশি হলেও একটু অফ হয়েও গেলাম। আর লিখিনি তাঁকে।
দুই.
‘৮৬ সালে মেডিকেলে ফার্স্ট ইয়ার। ’৮২-’৮৩ থেকেই উন্মাদ সম্পাদক আহসান হাবীবকে কার্টুন পাঠাই। উন্মাদ পত্রিকা তখন সাময়িকভাবে বন্ধ। আহসান ভাই তখন ‘বিচ্ছু’, ‘আঙুল’ এসব অদ্ভুত আকৃতি-প্রকৃতির কিছু কার্টুন পত্রিকা বের করেন আর আমার কার্টুনও মাঝে-সাঝে বের হয়। এরপরই ‘কার্টুন’ ম্যাগাজিন বের হতে শুরু করে। আসহাব উদ্দীন আহমদ তো তাঁর ‘ধার’ বইয়ের নতুন সংস্করণে রনবী’র পাশাপাশি রোকন-এর দুটো কার্টুন ছেপে দিলেন। যা হোক, ’৮৬-র অক্টোবরের দিকে আহসান ভাইয়ের সঙ্গে প্রথম দেখা করতে গেলাম তাঁদের আজিমপুরের নিউ পল্টন লাইনের বাসায়।বাসায় ঢুকেই অবাক! ড্রয়িং রুমের ফ্লোরে বসে টি টেবিলে রাখা নিউজপ্রিন্টে লিখছেন স্বয়ং হুমায়ূন আহমেদ! (আমার জানা ছিল না যে ওঁরা এক বাসায়ই থাকেন)। দু প্যারা লেখা হয়েছে বিখ্যাত গুটি গুটি হরফে; স্মৃতি যদি প্রতারণা না করে তাহলে তিনি তখন ‘কোথায় কেউ নেই’ লিখতে শুরু করেছেন। বাকরুদ্ধ আমি কোনোমতে আগমনের উদ্দেশ্য বললাম; সেদিন থেকেই আমি তার কাছে কার্টুনের লোক, সাহিত্যের নই। সোফায় বসে বসে চোরা চোখে সাধারণ বসার ঘরটা দেখছি (তিনি কিন্তু মাটিতেই বসা)। বুক শেলফ নয়, শো-কেসে সাজানো তাঁর প্রত্যেক বইয়ের ৫-৭ টা করে কপি। বাহ! আমি তো সবকটাকেই চিনি!
’৮৪র শেষ দিকে প্রিয় লেখককে একটা চিঠি লিখেছিলাম। সে চিঠির মুন্সিয়ানাপূর্ণ ভাষ্যে আমি যে ’৭৮ সাল থেকে তাঁর ‘তোমাদের জন্য ভালোবাসা’ দিয়ে শুরু করে সর্বশেষ বইটাও পড়েছি, এই তথ্য জানাতে ভুলিনি। ’৪৮-এ তার জন্মসালের সঙ্গে সালমান রুশদীর ‘মিডনাইট চিলড্রেন’ মিলিয়ে কী একটা পাণ্ডিত্যও জাহির করেছিলাম। উদ্দেশ্য একটাই— লেখক আমার বৈদগ্ধ্যে মুগ্ধ হয়ে চিঠির জবাবটা যেন অবশ্যই দেন। চিঠি এল দ্রুতই, নিউজপ্রিন্টের কাগজের মাথায় রসায়ন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় লেখা। চিঠিটা আজও যত্ন করে রেখেছি কিন্তু এখন হাতের কাছে নেই।
এর মাঝে তাঁর এক কন্যা ছোট্ট খেলনা কাপে শরবত বানিয়ে এনেছে তাঁর জন্য, খেতেই হলো লেখায় ব্যস্ত বাবাকে আর ‘খুব ভালো হয়েছে মা’ বলতেও হলো। কিছুক্ষণ আহসান ভাইয়ের রুমে গল্প করে একসঙ্গে নিউমার্কেটের বইয়ের দোকানগুলোর সামনে তাদের মাটিতে বসা আড্ডায় যুক্ত হলাম। আহসান ভাইয়ের সঙ্গে ঘনিষ্টতার এক পর্যায়ে ‘৮৯ এ আমার প্রথম কবিতার বই বের হলো তাঁর ‘দিনরাত্রি’ প্রকাশনী থেকে। তিনি তখন বিয়ে করে কল্যানপুরবাসী। বই ছাপার সময়টাতেও হুমায়ূন আহমেদের শহীদুল্লাহ হলের বাসায় গিয়েছি একবার। এবারে তাঁর শেলফে দুনিয়ার বই! তারাশংকর পড়ছিলেন একবার দূরে দাঁড়িয়ে দেখলাম। কাছে যাই কী করে! একে তো অভদ্র তার ওপর কার্টুনিস্টের চ্যালা!
তিন.
১৯৯০ এর এপ্রিলে চট্টগ্রাম বইমেলায় এলেন হুমায়ূন আহমেদ। আমাদের করিৎকর্মা সাহিত্য সম্পাদক আতিক এক বৃষ্টিমুখর হরতালের দিন সকালবেলা তাঁকে নিয়ে এলো ছাত্রসংসদে। আগের রাতে কনফার্ম হয়েছিল যে উনি আসছেন; রাতদুপুরে মেইন হোস্টেল, লেডিজ হোস্টেল ইত্যাদি সব দ্রষ্টব্য জায়গায় ব্রাউন পেপারে পোস্টার সাঁটা হলো। অনুষ্ঠানের আয়োজক ‘শাণিত’। বৃষ্টি উপেক্ষা করে ছাত্রসংসদ ভবন দর্শক-শ্রোতায় পূর্ণ হয়ে গেল। হুমায়ূন আহমেদ আর তাঁর সঙ্গী কবি নির্মলেন্দু গুণ দুজনেই দীর্ঘ ও চমৎকার বক্তব্য রাখলেন নিজেদের সাহিত্যজীবন নিয়ে। আমরা অভিভূত হয়ে গেলাম। মঞ্চের পেছনে আরেক নাটক চলছিল। রোমেলের নেতৃত্বে কয়েকজন আত্মস্বীকৃত অপরাধী অতিথিরা গাড়িতে ওঠার আগে আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চাইতে এল। এবারে হুমায়ূন আহমেদের অভিভূত হওয়ার পালা। ঘটনাটা বলি। আমাদের ফার্স্ট প্রফেশনাল পরীক্ষার আগে বা পরীক্ষার মৌসুমে (৮৮-৮৯) বিটিভিতে হুমায়ূন আহমেদের ‘বহুব্রীহি’ নামের ধারাবাহিক হাসির নাটক হতো, জনপ্রিয় হয়েছিল খুব সেটা বলাই বাহুল্য। একজন বোকা ডাক্তারের ভূমিকায় আফজাল হোসেন অনবদ্য ছিলেন। তো, একদিন ‘বহুব্রীহি’ নাটকে ডাক্তারের বোকামিটা মেইন হোস্টেলের টিভি রুমের নাটকের দর্শক হবু ডাক্তারদের কাছে রীতিমতো অপমানজনক মনে হলো! (আমি সেদিন নাটক দেখিনি বলে ইনসাল্ট বোধের পাঞ্চ লাইনটা ঠিক ধরতে পারিনি)।
যা হোক, তারা টিভি রুম থেকে বেরিয়ে এল; ব্যাপক হৈ চৈ শেষে নিচ তলার ডব্লিউ ব্লকের ৫/৬ নম্বর রুমে কিছু সিদ্ধান্ত কেলাসিত হলো। রোমেল- ইসমাইল-কৃষ্ণরা তো উত্তেজিত হয়ে নিজেদের শার্ট-প্যান্ট জুতো পর্যন্ত হুমায়ূন আহমেদের কুশপুত্তলিকা গড়ার কাজে উৎসর্গ করে দিল (কী অপরিসীম ভালোবাসা!)। সিদ্ধান্ত হলো, কাল ক্যম্পাসে ‘বহুব্রীহি’ নাট্যকারের বিরুদ্ধে মিছিল শেষে ঐতিহাসিক মোজাম্মেল চত্বরে তাঁর কুশপুত্তলিকা দাহ করা হবে। কুশপুত্তলিকার মুখটা আঁকার ভার পড়েছিল আমার ওপর। বিশেষ কষ্ট করতে হয়নি; ‘এলেবেলে’র প্রচ্ছদে আঁকা আমার কার্টুন-গুরু আহসান হাবীবের করা হুমায়ূন আহমেদের কার্টুনটিকে লাল-কালো-হলুদ রঙে একটু বড় করে আঁকতে হলো। সেই কুশপুত্তলিকা দাহের ছবি প্রিন্ট করে লেখককেও পাঠানো হয়েছিল। (কী নিষ্ঠুরতা!)। লেখক কষ্ট পেলেও পরবর্তী ‘এলেবেলে’ সংস্করণে এ বিষয়ে লিখে সঙ্গে একটা ছবি ছেপে তাঁর ঔদার্য ও রসবোধের পরিচয় দিয়েছিলেন।
পরের এক বইমেলায় আমার কার্টুন-গুরুর সঙ্গে দেখা হলে তিনিও দুঃখ করে চিটাগাং মেডিকেলের ছেলেদের বাড়াবাড়ি আচরণের কথা উল্লেখ করলেন। আমি ভদ্র ছেলের মতো চুপচাপ শুনে গেলাম। হুমায়ূন আহমেদকে অনুষ্ঠান শেষে আমার কবিতার বইটি একটা প্যাকেটে করে দিতে গেলাম। বললেন, ‘তুমি মোশতাক তো? তোমার বই আছে আমার কাছে।’ আমি কবিতাপ্রেমী এই লেখকের ব্যক্তিগত লাইব্রেরিতে একটি সংযোজন হতে পারার অহংকার নিয়ে তাঁদের জামান হোটেল হয়ে রেল স্টেশান পর্যন্ত সগর্বে এগিয়ে দিয়ে এলাম। এক ফাঁকে অটোগ্রাফও দিয়েছিলেন: ‘এই দিনতো দিন নয় আরো দিন আছে, এ দিনেরে নিয়ো তুমি সেই দিনেরো কাছে।’
চলবে…