দস্যু বাহরাম ও দস্যু বনহুর
১.
রূপকথা-উপকথা ধরনের বই দিয়ে পাঠাভ্যাস শুরুর কিছুকাল পরে নতুন ধরনের বই পেলাম : দস্যু বাহরাম। বাহাত্তর সালে। ক্লাস ফোরে পড়ি তখন।
এই অ্যান্টি-হিরোকে ভালো লেগে গেল ভীষণ। সমাজ-ও আইন-বহির্ভূত বীর সে, যে দল গঠন করেছিল দুষ্টের দমন ও অসহায়ের পরিত্রাণের জন্য। শ্বাপদসংকুল সুন্দরবনের গহীনে ছিল তার প্রধান আস্তানা। ধনীর সম্পদ কেড়ে নিয়ে বিলিয়ে দিত সে গরিব-দুঃখীদের মাঝে।
‘দস্যু বাহরাম’, ‘বন্দিনী সুফিয়া’, ‘শত্রুর কবলে বাহরাম’, ‘সীমান্ত ভীতি বাহরাম’, ‘রণরঙ্গিনী সুফিয়া’ এরকম ছিল একেক খণ্ডের নাম। মোহাম্মদ আবুল কাসেম ছিলেন এই সিরিজের লেখক।
ওসমানিয়া বুক ডিপো থেকে সিরিজটি বের হতো। এক হতে আঠারো খণ্ড পর্যন্ত বের হয়েছিল। এরপর, শুনেছিলাম যে লেখক প্রয়াত হওয়ায়, এটির ধারাবাহিকতা বন্ধ হয়ে যায়। বইটির প্রথম খণ্ড প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৬৫ সালে। শশধর দত্তর বিখ্যাত দস্যু মোহন সিরিজের অনুসরণে এই সিরিজ রচিত হয়েছিল বলে কথিত আছে। মোহন সিরিজ আমার তেমন পড়া নাই, একটা কি দুটা খণ্ড পড়া হয়ে গিয়েছিল অন্যান্য বইয়ের ফাঁকে। বাহরাম সিরিজটি খুব জনপ্রিয় হয়েছিল। তবে সিরিজটি বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর নতুন আরেকটা সিরিজ এসে সেই স্থানটি শুধু দখলই নয়, বিপুল বিস্তার করে ফেলল : সেটি হলো রোমেনা আফাজ-বিরচিত দস্যু বনহুর সিরিজ।
কিন্তু সেই দস্যুযুগল : বাহরাম ও বনহুর, আমার কৈশোরের স্মৃতিতে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে রয়েছে। সেই অন্যায়বিরোধী ও মজলুমবান্ধব নায়ক-কিংবা-প্রতিনায়কগণ, যারা আমার মধ্যে সেইকালে ‘দস্যু’ হবার প্রণোদনা জোগাত, রোমাঞ্চকর অভিযানে আহ্বান জানাত, অন্যায়ের বিরুদ্ধে ও নিপীড়িতের পক্ষে সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করত।
২.
ছেলেবেলায় দস্যু বনহুর পড়তে দস্যু বাহরামের চাইতে বেশি মনোরম লেগেছিল এর ভাষার কারণে। বাহরামের কাহিনি লেখা ছিল সাধু ভাষায়। উপরন্তু ‘করতঃ’ –ও অন্যান্য খটোমটো শব্দে বিরক্ত লাগত। আর বনহুর লেখা হয়েছিল সাবলীল চলিত রীতিতে। তবু দস্যুকাহিনী হিসাবে বাহরামের সাথেই ছিল প্রথম প্রণয়। কিন্তু লেখকের মৃত্যুর কারণে আঠার নম্বর খণ্ডেই যেহেতু সিরিজটি শেষ বা অসমাপ্ত রয়ে গেল, তাই তখন নতুন প্রেমিক বনহুরের মায়ায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়লাম।
চেনাবলয় হতে তখন বনহুর সিরিজের বই দুই-একটা পড়বার পর আর পাচ্ছিলাম না। এমন সময় এক কুক্ষণে আমার কয়েক বছরের বড় মামার জমানো টাকার অবস্থান জেনে ফেলে বিনা দ্বিধায় চক্ষুদান করে ফেললাম। চল্লিশ টাকা। টাকার অঙ্কে তাচ্ছিল্য করবার কিছু নাই। এটা ১৯৭৪ সালের কথা। সেই সময়কালে ও সেই বয়সে এ অনেক টাকা।
দস্যু বনহুরের প্রতি খণ্ডের দাম তিন টাকা। কমলাপুর স্টেশনের ক্যামলট বুক স্টল হতে তের খণ্ড বই কিনে ফেললাম। অবশিষ্ট এক টাকায় একটি নবারুণ পত্রিকা। রাজকীয় সম্পদ যেন অর্জন করে ফেলেছি, এমন সন্তোষ নিয়ে বইগুলো বাসায় নিয়ে গেলাম। তারপর বইগুলো নিয়ে চলতে লাগল ভূরিভোজ। বন্যার কারণে তখন স্কুল বন্ধ। তাই কয়েকদিন ধরে বুঁদ হয়ে রইলাম বনহুরের প্রেমে।
ক্রমে-ক্রমে সিরিজের একশ নম্বর খণ্ড পর্যন্ত পড়েছিলাম। বই তারপরেও ক্রমাগত প্রকাশিত হচ্ছিল। কিন্তু আমার কাছে ততদিনে এই সিরিজ পানসে লাগতে শুরু করেছে। পাঠকের মৃত্যু না হলেও তখন মুমূর্ষু দশা; এই সিরিজের প্রতি ক্ষুধামন্দা ও রুচিহীনতা দেখা দিয়েছে। মাসুদ রানায় আসক্ত হয়েছি তখন প্রবলভাবে। সে যে আরও অনেক বেশি সুপক্ক ও সুস্বাদু মনো-আহার্য।
কিন্তু সেই দস্যুযুগল : বাহরাম ও বনহুর, আমার কৈশোরের স্মৃতিতে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে রয়েছে। সেই অন্যায়বিরোধী ও মজলুমবান্ধব নায়ক-কিংবা-প্রতিনায়কগণ, যারা আমার মধ্যে সেইকালে ‘দস্যু’ হবার প্রণোদনা জোগাত, রোমাঞ্চকর অভিযানে আহ্বান জানাত, অন্যায়ের বিরুদ্ধে ও নিপীড়িতের পক্ষে সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করত।
ওইসবের চর্চা হিসাবে সেই বয়সের পক্ষে একটু সাহসী কিছু দুষ্টামি তখন করতাম : যেমন কাছাকাছি দুই বাড়ির এক ছাদ থেকে অন্য ছাদে লাফিয়ে যাওয়া, কমলাপুর স্টেশনের নিকটস্থ ব্রিজটির লৌহস্তম্ভ বেয়ে ওঠা-নামা, মার্শাল আর্টের খানিক কসরত ইত্যাদি। তবে মূল বিষয়টি আপন মনের কল্পলোকে ও সমবয়সী কয়েকজনের সাথে ভাব বিনিময়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল।
তবু, এইসব ছিল আমার মনোলোকের নিবিড় উপাদান, যা কখনও পুরোপুরি হারিয়ে যায় না।
এরপরে পড়ুন- কাজী আনোয়ার হোসেন