ধুলো চিঠি
প্রতিটা সন্ধ্যার নিজস্ব কিছু গল্প থাকে। রং থাকে। কোনো কোনো সন্ধ্যায় বৃষ্টি নামে। গল্পগুলো হয়ে ওঠে কাগজের নৌকো। নভেম্বরের বৃষ্টি মাথায় নিয়ে স্বপন মামার চায়ের দোকানের সামনে এসে দাঁড়াই। চায়ের নগদ দাম মিটিয়ে আরেকটা সিগ্রেট বাকি করে টিএসসি থেকে বের হই। পকেটে হাত দিয়ে দেখি দেশলাই নেতিয়ে গেছে। অগত্যা আবার ফিরে এসে সিগ্রেট জ্বালাই। মাথার ওপর নভেম্বরের বৃষ্টি, সাথে খানিকটা গাঁজার উন্মাদনা। এই যে, এখন এখানে আছি। আবার মনে হলো নেই। গত কয়েক দিন আমার সাথে এসব কী হচ্ছে, ঠিক বুঝে উঠতে পারি না। মৃত মানুষ কি কথা বলে!
মৃত মানুষের কণ্ঠও কি এভাবে পুড়ে খায়? আমি ওকে মৃতই কেন বলছি! ও তো আছেই! নাকি সেলুলারে কোনো ভুল সংকেত!
ওই কবিতাটা তোর কণ্ঠে দারুণ যায়।
কোনটা?
ক্যামেলিয়া।
বহু দূর কোথাও থেকে বৃষ্টিতে সাঁওতাল মেয়ের হাসির মতো ভেসে আসছে পৃথার কণ্ঠ। বহু দূরই কেন হবে। এই তো এখানেই! গোলাকার কালো গাল উজ্জ্বল করা বৃষ্টি সাদা দাঁতের হাসি। সাথে ভারী লেন্সের চশমায় পৃথা যেন এখন জীবন্ত অবয়ব।
এই মুহূর্তে পৃথিবী সব আলো ভিড় করে পৃথার সাঁওতালি গালে। আমার ভেতর নেচে ওঠে অজস্র সাঁওতাল বালিকা। অচেতনে হাত চলে পৃথার মুখে, সাঁতরায়…। ঘোর কালো অন্ধকার কেটে আরও বেশি চকচক করে পৃথার গলার কালো তিল। হুটখোলা রিকশায় ঠোঁট ডাকে মেঘের গর্জনের মতো। সমস্ত পৃথিবী যেন থেমে যায়। কেউ না জানুক অথবা জানুক, ঠিক ব্যস্ত সড়কে আদিম উন্মাদনায় মেতে উঠেছে কেউ।
পৃথা কথা বলে।পৃথার হাত ধরে হেঁটে চলি নীলক্ষেত, টিএসসি হয়ে আবার শাহবাগ মোড়। পৃথা চশমা খুলে আমার বুকপকেটে রাখে। শাহবাগ মোড় আমার চোখে লাল-নীল-হলুদ হলেও পৃথার চোখে ঠিকই ঝাপসা। ও অন্ধের মতো হাতড়ে বেড়ায়, তারপর শক্ত করে হাত চেপে ধরে বলে, ‘এভাবে অনন্তকাল তোর হাত ধরে রাস্তা পার হতে চাই।’ পৃথার ঝাপসা চোখে ঘোর লাগা স্বপ্নের মতো সে কী নির্ভরতা। আমার পৃথিবী আরও লাল, আরও হলুদ, আরও সবুজ…
এই মুহূর্তে পৃথিবী সব আলো ভিড় করে পৃথার সাঁওতালি গালে। আমার ভেতর নেচে ওঠে অজস্র সাঁওতাল বালিকা। অচেতনে হাত চলে পৃথার মুখে, সাঁতরায়…। ঘোর কালো অন্ধকার কেটে আরও বেশি চকচক করে পৃথার গলার কালো তিল। হুটখোলা রিকশায় ঠোঁট ডাকে মেঘের গর্জনের মতো। সমস্ত পৃথিবী যেন থেমে যায়। কেউ না জানুক অথবা জানুক, ঠিক ব্যস্ত সড়কে আদিম উন্মাদনায় মেতে উঠেছে কেউ।
সভ্য পথচারীদের চোখেমুখে ধুলো ছিটিয়ে যেন বলতে চাই, ‘আমরাই সভ্য, তোমরা যান্ত্রিক অসভ্য!’ পৃথা ঠোঁট কামড়ে হাসে লাজুক চোখে। নিজের ঠোঁট কামড়ে ধরে বলে, ‘তোর ফাটা ঠোঁটের স্বাদ বড় নোনতা, পাগল করা ‘
‘খবরদার ঠোঁটে জেল দিবি না, আমি ভিজিয়ে দেব!’ পৃথা আমার ঠোঁট ভিজিয়ে দেয়। নিশ্বাসের শব্দে চাপা পড়ে শহরের সব যান্ত্রিক কোলাহল। আমার চোখেমুখে ঘোর জাগে, জাগতিক সব ঘোর।
ঘোরেই আমি থাকি। এ ঘোর কাটানো যাবে না। ঘোর কেটে গেলেই পৃথিবী অস্থির হয়ে উঠবে আবার। রক্তপাত হবে মানুষে মানুষে, শুরু হবে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, সাঁওতাল হারাবে তার আদি ভূমি…!
পৃথা, আমরা ভালো আছি! পৃথা, আমরা ভালো নেই!
আপাতত কেউ না জানুক, পৃথা মুঠোভর্তি ঘুমের ওষুধ খেয়েছিল। তারপর কেবলই ভাসছে অনন্তের দিকে, ইথারে….