ধূমপায়ী ফকির
মিথ্যুক মানুষ বেশ কল্পনাপ্রবণ হয়। এমন সব বিষয় ভাবতে পারে এবং সেটা উপস্থাপনের কৌশল জানে, অবিশ্বাস করলে গুনাহ হয়। দীপুর বাবা কিছুটা দুর্বল চিত্তের মানুষ। তার পক্ষে আর যা হোক, এই মুহূর্তে আশরাফুলকে অবিশ্বাস করা সম্ভব নয়। আশরাফুল দীপুর ছোট মামা, যে বিকম পাস করার পর দুই বছর ধরে চাকরি খুঁজছে। এক দিনের জন্য ফরিদপুর ঘুরে আসতে হবে শুনেই মামা জানিয়ে দিল, তার বন্ধুর বাবাকে রক্ত দিতে হবে এবং সেই ভদ্রলোক হয়তো বাঁচবে না। একই সাথে শাঁখারীবাজারে একটা স্কুলে মামার পড়ানোর কথা পাকাপাকি। আজ রাতেই নাকি তার ফোন আসতে পারে, আশরাফুল আবদুল্লাহ কাল সকাল থেকে আপনি স্কুলে আসেন। এই পরিস্থিতিতে কোনোভাবেই ঢাকা ছেড়ে যাওয়া উচিত হবে কি না, সে সিদ্ধান্ত সে আমার বাবার ওপরই ছেড়ে দিল। বাবা কোনো উত্তর না দিয়ে সরাসরি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, দীপু, তোমারে আমি পাঠাইতে চাই না কিন্তু বুঝতেই পারতেছ, তোমার মামার এই অবস্থায় কোনো উপায় নাই। তুমি এক দিনের জন্য যাও। আমি ভেতরে ভেতরে রাগে দিশেহারা হয়ে যাচ্ছি। আগামীকাল রাতে বন্ধুদের সারা রাত সিনেমা দেখার কথা। জিয়াদ আজ গুলিস্তান থেকে কিছু অ্যাডাল্ট মুভি জোগাড় করেছে। বাসায় কী কী বলে কাল রাতে না ফেরার অজুহাত দেব, তা-ও আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে কয়েকবার রিহার্সেল দিলাম, এই অবস্থায় এটা কী করল মামা! আর আমি কি জানি না সে কেন যেতে চাইছে না? উল্টো দিকের বাসার ঊর্মির এইচএসসি পরীক্ষা চলছে। এই অবস্থায় মামার প্রতিদিনের অবশ্যপালনীয় কাজ হচ্ছে ফার্মগেটে বিজ্ঞান কলেজের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা। ঊর্মি পরীক্ষা দিয়ে বের হলে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করে জানিয়ে দেওয়া, তোমার জন্য আমি বেকার বেকুব অপেক্ষারত। রাগে মাথার চুল ছিঁড়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে। বাবাকে কিছু না বলে ঘরে এলাম সাথে সাথে। মামাও পিছু পিছু এসেছে, শোন দীপু, দুলাভাই যখন এভাবে বলছে, নিশ্চয়ই বিষয়টা গুরুত্বপূর্ণ আর গুরুজনদের কথা না শুনলে ঠিক হবে না। তুই বরং যা আর তোর ভালো লাগবে। এত দিন পর ছোটবেলার পুরনো শহর দেখবি। আমি দাঁত কিড়মিড় করে বললাম, পুরনো শহর ধুয়ে আমি কি পানি খাব?
রাতে খাবার টেবিলে বসে মামার প্রিয় দুলাভাই আম্মাকে উদ্দেশ করে আমার যাওয়ার কথা বলতেই সে কেমন নড়েচড়ে বসল। একমাত্র ভাই এই কাজটি পারবে না শুনে এই প্রথমবারের মতো তাকে বিরক্ত হতে দেখলাম। উপায় নেই শুনে বলল, কত দিন হলো ওই শহরটা ছেড়ে এসেছি, কত স্মৃতি আমাদের। ভালো হলো বাবুর সাথে আমিও একদিন যেয়ে ঘুরে আসি। মানে বিপদ একা আসে না, যাওয়া এরাই প্রায় ফাইনাল করে দিল, তার ওপর বাড়ি থেকে বের হয়েই একটা সুখটান দেব, সেই উপায় রইল না। ভালো মানুষের মূল্য সৃষ্টিকর্তা বোঝে। বিপদের হাত থেকে আপাত রক্ষা পেলাম রাহার সুবাদে। আম্মার যাবার কথা শুনে আমার একমাত্র বোন রাহা মুহূর্তে খাওয়া থামিয়ে দিল । আমার দুদিন পর প্রিটেস্ট পরীক্ষা আর তুমি এই অবস্থায় ফরিদপুর যাচ্ছ, তোমার এত বড় ধেড়ে ছেলে একা যাবে বলে।
রাহার অভিযোগের পর এই বাড়িতে কোনো কথা থাকে না। এই মেয়ে এখনো তার ইতিহাস জানে না। যেন কখনোই না জানে, সে জন্য সব রকমের চেষ্টা আমরা করি। বছরখানেকের রাহাকে যখন আনা হয়েছিল, আমি তখন ক্লাস ওয়ানে পড়ি। আমাকে বলা হলো, এই তোমার বোন, তোমার সাথে খেলবে বলে আমরা বোন এনেছি কিন্তু বোনের সব দায়িত্ব তোমার। বোন যেন কখনো ব্যথা না পায়। তুলতুলে রাহা তখন থেকেই এ বাড়ির মূল চরিত্র। তার আবদার-অভিযোগের ওপর সংসার চলে, তাতে আমার প্রশ্রয় দেওয়া হিংসেও রয়েছে। তবে এই মুহূর্তে সেটা আমার জন্য পরিত্রাণই হলো। উভয়সংকটে পড়ে বাবার মুখের দিকে আম্মার দৃষ্টিপাত বলে দিচ্ছে তার যাওয়া হচ্ছে না। তিনি আশ্বস্ত করলেন, রাবেয়া, ভয় পেয়ো না, ছেলে বড় হয়েছে আর ও কাল যাবে, পরশুই ফিরে আসবে। জননী-জন্মভূমির যাওয়া হচ্ছে না শুনে স্বস্তি পেলাম, তবে কেন যে আমাকে এত জরুরি নিয়োগপত্রের মতো ওখানে যেতে হবে, তার কারণটা এখনো জানি না। রাতে মোটামুটি এক দিনের কাপড়চোপড় নিয়ে ইউনিভার্সিটির ব্যাগটা গুছিয়ে রেখেছি।
ছোট মামা তখন মাত্র ইন্টারমিডিয়েটে ভর্তি হয়েছে রাজেন্দ্র কলেজে। চুরি করে করে সিগারেট খায়। পুরোটা খেতে পারে না। অর্ধেক খায়, বাকি অর্ধেক ফেলে দিয়ে পেয়ারা, লেবু, মান্দারগাছের পাতা চিবোয়। এসব কোনোটা হাতের কাছে না পেলে ঘাসও চিবিয়েছে। তো সেই সময় তার অর্ধেক ফেলে দেওয়া সিগারেট কুড়িয়ে কোমরে লুঙ্গির ভেতর গোঁজা ম্যাচ বের করে ওই লোককে আমরা কয়েকবার আগুন ধরাতে দেখেছি। সেই থেকে আমি আর মামা তাকে আড়ালে ডাকি ধূমপায়ী ফকির। আমার নিরীহ পিতা এই নাম কীভাবে জানলেন!
সকালবেলা বাবা আমার হাতে একটা খাম আর ঠিকানা দিয়ে বললেন, দীপু, তোমার নিশ্চয়ই ছোটবেলার তোমাদের সেই ‘ধূমপায়ী ফকির’-এর কথা মনে আছে? তার মুখে এই নাম শুনে আমার আর মামার আকাশ থেকে পড়ার অবস্থা। এটা অত্যন্ত গোপন নাম, যা শুধু আমরা দুজনই জানি। তিনি কীভাবে জানলেন! ছোটবেলায় ফরিদপুরের মাস্টারপাড়া কলোনিতে যখন থাকতাম, এক গরিব-টাইপ লোক আসত আমাদের বাসায়। আমরা মাঠে ফুটবল খেললে দাঁড়িয়ে দেখত। ছোট মামা তখন মাত্র ইন্টারমিডিয়েটে ভর্তি হয়েছে রাজেন্দ্র কলেজে। চুরি করে করে সিগারেট খায়। পুরোটা খেতে পারে না। অর্ধেক খায়, বাকি অর্ধেক ফেলে দিয়ে পেয়ারা, লেবু, মান্দারগাছের পাতা চিবোয়। এসব কোনোটা হাতের কাছে না পেলে ঘাসও চিবিয়েছে। তো সেই সময় তার অর্ধেক ফেলে দেওয়া সিগারেট কুড়িয়ে কোমরে লুঙ্গির ভেতর গোঁজা ম্যাচ বের করে ওই লোককে আমরা কয়েকবার আগুন ধরাতে দেখেছি। সেই থেকে আমি আর মামা তাকে আড়ালে ডাকি ধূমপায়ী ফকির। আমার নিরীহ পিতা এই নাম কীভাবে জানলেন আর এত দিন পর সেই ধূমপায়ী ফকিরের জন্য আমাকে এসব কাজ রেখে ফরিদপুর যেতে হবে, আমি এবার পুরোপুরি দমে গেলাম। বাবা বললেন, দীপু, সেই লোকটি মারা গেছে বছর দুই আগে। ওদের কিছু টাকা দরকার, তার মেয়েটা খুব অসুস্থ। মেয়েটার চিকিৎসা হচ্ছে না। ওরা এমন একটা জায়গায় থাকে যে কুরিয়ার যাবে না। তুমি গিয়ে থাকবা তোমার খালার বাড়িতে। শুধু একবার যেয়ে দেইখা আসবা আর ওর মায়ের হাতে টাকাটা দিবা।
এই মুহূর্তে সাদাসিধে পরহেজগার মানুষটাকে মনে হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে নিষ্ঠুর ও আশ্চর্যজনক মানুষ। যত দূর মনে পড়ে, ধূমপায়ী ফকিরকে তিনি পছন্দ করতেন না। কয়েকবার আমাদের সামনেই ধমক দিয়েছেন, রহমান, তোমারে না নিষেধ করছি এই দিকে ঘুরঘুর করবা না। রহমান মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকত আর প্রতিবারই বলত, জে স্যার, আর আসব না। কিন্তু রহমান আসত এবং মামার ফেলে দেওয়া অর্ধেক সিগারেট ধরিয়ে বাড়ির পেছন দিকে দাঁড়িয়ে সুখটান দিত।
আমি সকাল সকাল উঠে রওনা হলাম গাবতলী। যেতে যেতে ধূমপায়ী ফকিরের কথা মনে পড়ল, আহা বেচারা কবে মারা গেল, জানতেও পারলাম না। এমনই হয়, জীবনে যে কে কখন আসে আর চলে যায়, খুব কাছের মানুষ ছাড়া আমরা তার হিসাব রাখিনা, মনেও পড়ে না। ফেরির ছাদে দাঁড়িয়ে সুখটান দিতে দিতে কখন নদীর মাঝখানে চলে এলাম। মনে আছে, ছোটবেলায় এই নদী পার হয়ে ঢাকা গেলে ফিরে এসে স্কুলের বন্ধুদের কাছে হাতের কর গুনে গুনে বলতাম এই নিয়ে কতবার গেলাম। ঢাকা দেখা তখন আমার কাছে আমেরিকা দেখার মতো। আমি অবশ্য এখনো আমেরিকা দেখিনি। ফেরির গাড়ি তখন কম ছিল। রাহা আম্মার কোলে আর আমি বাবার হাত ধরে দৌলতদিয়ার ধুলোর ভেতর দিয়ে হেঁটে হেঁটে ঘাটে পৌঁছাতাম। জিন কোডের চিরাচরিত নিয়ম অনুযায়ী মেয়েরা বাবাভক্ত হয়। রাহা জিনকোড ভেঙে স্নেহ কোড উপেক্ষা করে এই বাড়ির সবাইকে তার অনুগত বানিয়ে ফেলেছে। সেই সময় সাধারণত লঞ্চে উঠে বাবা আম্মার কোলে রাহাকে বসিয়ে ঝাল-মুড়ি ধরিয়ে দিতেন। আমাকে নিয়ে যেতেন নিচের কেবিনে। আমি সুতো দিয়ে দুই ভাগ করে কাটা সেদ্ধ ডিম খেতে খেতে ঢেউ গুনতাম আর বাবা স্যাকারিন দেওয়া চা পিরিচে ঢেলে চুমুক দিত সুড়ুৎ সুড়ুৎ। আমার মুখের ভেতর ডিমের কুসুমের গুঁড়ো গুঁড়ো স্বাদ টের পাচ্ছি। এমনকি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি ডিমের সাদা অংশের নিচে পেপারের ছাপা কালো কালো অক্ষর লেগে আছে। আজ একাই যাচ্ছি, বাবাকে নিয়ে এলেও তিনি হয়তো আর ওভাবে চা খাবেন না। কত দ্রুত সব পাল্টে যাচ্ছে।
ফেরি ঘাটের কাছে চলে এসেছে। বাস রাজবাড়ীর কাছাকাছি যেতেই একটা পরিচিত ঘ্রাণ, পাট জাগ দেওয়ার। স্মৃতির আলাদা আলাদা ঘ্রাণ থাকে। এই ঘ্রাণ এক মুহূর্তে ছোটবেলায় নিয়ে গেল আমাকে। এখান দিয়ে যাবার সময় আমি প্রতিবার নাক উঁচু করে ঘ্রাণ নিতাম আর রাহা নিজের ছোট ছোট হাত দিয়ে নিজের নাক চেপে, মুখ বাঁকিয়ে বলত, উহু গন্ধ গন্ধ। শোভারামপুর, বসন্তপুর পার হয়ে নতুন বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছে গেলাম। এত দূর সরিয়ে নিয়ে আসায় কি ফরিদপুর শহরের আকার বড় হয়ে গেছে? বাস থেকে নেমে লক্ষ্মীপুর খালার বাড়ি গেলাম রিকশা নিয়ে। আম্মা ফোনে বলে রেখেছিল। দেখি মাটির চুলায় হাঁসের মাংস কসানো হচ্ছে। কড়াইয়ের ভেতর মসলা থেকে তেল ছেড়ে দিয়েছে। শীতে হাঁসের গায়ে তেল জমে। মফস্বলে শীতটা একটু আগে আসে আর যায় দেরিতে। দুপুরের খাবারের পর খালা বলল, ওই বাড়ি একা খুঁজে বের করা কঠিন হবে আমার জন্য, খাবাসপুরে লঞ্চঘাটার কাছে একটা কলুপাড়া আছে, তার পাশ দিয়ে ঢুকতে হবে। আমার সাথে যাবে খালাতো ভাই। তবে আমার চেয়েই ওর বোধ হয় আগ্রহটা বেশি। রেডি হয়ে ঘুরঘুর করছে।
মেয়েটা এতক্ষণ আমার মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল, লক্ষ করিনি। দুর্বল কণ্ঠস্বরে প্রায় ফিসফিস করে বলল, রূপালী। মায়া হচ্ছে, রূপালী নামের সতেরো-আঠারো বছর বয়সী একটা মেয়ের এভাবে শুয়ে থাকার কথা না। অকারণে মেয়েটার জন্য খুব খারাপ লাগছে আমার হঠাৎ। মানুষের ব্রেন আসলে খুব আশ্চর্য একটা জিনিস। কখন যে সে মতিঝিল দাঁড়িয়ে এটিএম বুথ থেকে টাকা তুলতে গিয়ে ভাবতে ভাবতে ধোলাইখালের রড-সিমেন্টের কথা ভাবতে শুরু করে! আমিও রূপালীর মুখের দিকে তাকিয়ে ভাবতে শুরু করেছি, এই মেয়ে সুস্থ হয়ে উঠবে। ওর বিয়ে ঠিক হবে, ওর মা আবার বাবার কাছে টাকা চেয়ে পাঠাবে। নিজে হাতে এসে টাকা দিয়ে যাব, বড় ভাই-টাইপ একটা ভূমিকা নিয়ে বসতে পারি রূপালী নামের মেয়েটার বিয়ের সময়।
আমি আর কাজল বিকেলে রওনা হলাম, পকেটে টাকা। আমার হাতে সিগারেট আর কাজলের হাতে একটা লেইসের প্যাকেট ধরিয়ে দিয়েছি। নিজের পকেট থেকে লেইসের প্যাকেকটা অবশ্য ঘুষ হিসেবে কেনা। এই ছেলে যদি তার মায়ের কাছে সুখটানের কথা বলে, তাহলে ভালো হবে না। আমার ধারণা, কাজল ক্লাস এইটে পড়লেও বুদ্ধিমান ছেলে, সে বুঝে ফেলেছে। আমিও চাই সে বুঝুক। সব কথা মুখ দিয়ে বলতে স্বস্তি হয় না। কিছু বিষয় পাশের মানুষটির নিজ বুদ্ধি খরচ করে ধরে নিতে হয়। একটা রিকশা নিয়ে খাবাসপুর পর্যন্ত গেলাম। বেলা ছোট, আমরা অবশ্য পুরো সন্ধ্যা নামার আগেই বাড়িটা বের করে ফেললাম। ঠিক বস্তি না হলেও প্রায় ও রকমই একটা জায়গা। এক রুমের টিনের ঘর। অর্ধেক টেনে রাখা দরজার এ পাশ থেকেই বোঝা যাচ্ছে, এই বাড়িতে মৃত্যু অপেক্ষা করছে। চারপাশে স্যাঁতসেঁতে অন্ধকার। শ্যাওলা জমেছে আগাছার পাশে। চালের ওপাশে একটা বরইগাছ তার প্রশস্ত ডাল মেলে এ পাশে এসে হুমড়ি খেয়ে পড়েছে। দরজার সামনে দাঁড়ালে কাঁটাসমেত ডাল মাথার ওপর দোল খায়। ভেতরে একটা ৪০ পাওয়ারের হলদে বাতি জ্বলছে। দরজার পাল্লার ভেতর দিয়ে চিকন দুর্বল আলোর খানিকটা এসে পড়েছে উঠোনের ছায়ার ভেতর। এমন পরিস্থিতিতে ঠিক দরজায় নক করতে স্বস্তি হয় না। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে কড়া নাড়লাম। ঘোমটা টানা এক মহিলা, দরজার একটা পাল্লা খানিকটা সরিয়ে উঁকি দিল। নাম বলে জানালাম, ঢাকা থেকে এসেছি। ভদ্রমহিলা মাথার কাপড় আরো খানিকটা বোধ হয় নামিয়ে দিয়ে দরজা খুললেন। ভেতর থেকে একটা অস্বস্তিকর গন্ধ নাকে এসে ঠেকে। বাঁ দিকের চৌকিতে কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে মেয়েটা। প্রায় রাহার বয়সের। শরীরের মেদ-মাংস বিছানার সাথে মিশে যাওয়ার অপেক্ষা। রাহার মুখটা মনে পড়ে গেল। মানুষ খুব স্বার্থপর প্রাণী। চোখের সামনে মেয়েটার জন্য মায়া লাগবে, তা নয়, নিজের বোনের কথা মনে হচ্ছে। রাহা বড় হয়ে উঠেছে। ওর চেহারায় দিন দিন যত লাবণ্য বাড়ছে, মায়ের দুশ্চিন্তা বাড়ছে পাল্লা দিয়ে। একটু এগিয়ে না গেলে অভদ্রতা দেখায়।
আমি বসার কথা ভাবছি, ভদ্রমহিলা টুল এগিয়ে দিলেন। চৌকির কাছে টুল টেনে বসলাম। কাজল বাইরে দাঁড়িয়ে। পকেট থেকে টাকার খামটা বের করে ভদ্রমহিলার হাতে দিয়ে বাবার কথা বললাম। তিনি আগের মতো মাথা নিচু করেই হাত বাড়িয়ে খামটা নিলেন। মেয়েটার দিকে ফিরে তাকিয়ে বললাম, তোমার শরীরের কী অবস্থা? কী যেন ভাই তোমার নামটা?
মেয়েটা এতক্ষণ আমার মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল, লক্ষ করিনি। দুর্বল কণ্ঠস্বরে প্রায় ফিসফিস করে বলল, রূপালী। মায়া হচ্ছে, রূপালী নামের সতেরো-আঠারো বছর বয়সী একটা মেয়ের এভাবে শুয়ে থাকার কথা না। অকারণে মেয়েটার জন্য খুব খারাপ লাগছে আমার হঠাৎ। মানুষের ব্রেন আসলে খুব আশ্চর্য একটা জিনিস। কখন যে সে মতিঝিল দাঁড়িয়ে এটিএম বুথ থেকে টাকা তুলতে গিয়ে ভাবতে ভাবতে ধোলাইখালের রড-সিমেন্টের কথা ভাবতে শুরু করে! আমিও রূপালীর মুখের দিকে তাকিয়ে ভাবতে শুরু করেছি, এই মেয়ে সুস্থ হয়ে উঠবে। ওর বিয়ে ঠিক হবে, ওর মা আবার বাবার কাছে টাকা চেয়ে পাঠাবে। নিজে হাতে এসে টাকা দিয়ে যাব, বড় ভাই-টাইপ একটা ভূমিকা নিয়ে বসতে পারি রূপালী নামের মেয়েটার বিয়ের সময়। রাহার বয়সী বলেই হয়তো মুহূর্তে একটা মায়া তৈরি হয়ে গেল মেয়েটার জন্য। আর আত্মীয় না হলেও এই বয়সী একটা মানুষের জীবনের এমন অপচয় খুব সহজভাবে নিতে পারার কথাও নয় আমার। আরো খানিকটা টুল টেনে আমি চৌকির কাছে সরে এলাম। রূপালী খুশি হলো বুঝেছি। এই বয়সী একটা মেয়ের কপালে হাত রাখা ঠিক হবে কি না, বুঝতে পারছি না। কাঁথার এ পাশ দিয়ে ওর রুগ্ণ হাতটা বের হয়ে আছে। আমি হাতের উল্টো পাশে হাত রাখলাম, ওর মুখে কী একটা মায়া। বললাম, রূপালী, আমরা সবাই তোমার পাশে আছি, দেখো তুমি দ্রুত সুস্থ হয়ে যাবে। কী বুঝল জানি না, আমার দিকে তাকিয়ে এক টুকরো হাসি দিয়ে সে ঘাড় ঘুরিয়ে তার মায়ের দিকে দেখার চেষ্টা করল। ভদ্রমহিলা কি ফুপিয়ে কাঁদছেন? মুখটা এমনভাবে ঢেকে রেখেছেন, দেখতে পাচ্ছি না। প্রায় মায়ের বয়সী মহিলা এই মৃত্যুপথযাত্রী একমাত্র সন্তান নিয়ে কীভাবে পার করছেন জীবন, খারাপ লাগছে ভেবে। আমি মিথ্যে একটা অভয় দিয়ে বললাম, খালাম্মা, চিন্তা করবেন না। আপনি প্রয়োজন হলে আবার জানাবেন বাবাকে। আমি আজ যাই, ভোরেই আবার ঢাকা ফিরতে হবে। মহিলা যে নিশব্দে কাঁদছিলেন, তার কণ্ঠ শুনে বুঝলাম। বললেন, বাবা, আপনি প্রথম আসছেন, একটু বসেন। ইতস্তত করলেও কিছু বলার নেই এই মুহূর্তে। বসে রইলাম। ঘরের এক পাশে কাচবিহীন একটা শেলফের মতো। তার ভেতর রূপালীর প্রিন্টের জামাকাপড় ভাঁজ করে রাখা। একটা পুরনো খেলনা গাড়ি। শেলফের ওপর সাদাকালো ছবি ধূমপায়ী ফকিরের। আমি রূপালীকে জিজ্ঞেস করলাম, রহমান চাচা কত দিন আগে মারা গেছেন? রূপালীর চোখ টলমল। সে একমুহূর্তের জন্য আমার দিক থেকে মুখ সরায়নি। উত্তর না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করল, দীপু ভাই, আপনার একটা বোন আছে না? আব্বা বলছিল। বুঝলাম, বাবার মৃত্যু নিয়ে ওর কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। আমি ওকে রাহার কথা বলছিলাম। এর মধ্যে রূপালীর মা ভেতরের দিকে একটা বারান্দামতো ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন।
এক হাতে মুড়ির বাটি, আরেক হাতে অর্ধেকটা কমলা। বুঝতে পারছি, এই ভাঙা কমলা নিয়ে তিনি লজ্জায় মাটির সাথে মিশে যাচ্ছেন কিন্তু আমি আর এই গুমোট পরিস্থিতি নিতে পারছি না। তিনি মুড়ির বাটিটা রাখার কিছু না পেয়ে চৌকির ওপরই নামালেন। অর্ধেকটা কমলা হাত বাড়িয়ে ধরেছেন আমার দিকে, সেই সুযোগে তাকালাম তার মুখের দিকে। কাঁদতে কাঁদতে ফুলে গেছে চোখ। আমার দিকে বাড়িয়ে দেওয়া হাতের ভেতর অর্ধেকটা কমলা। শীর্ণ হাত, নখগুলো ভোঁতা। মহিলার ডান হাতের ওপর একটা বড় দাগ দেখে চমকে উঠলাম। নিজের হাতে তাকালাম, একই রকম জন্ম দাগ। আমি এই আলোতে ঠিক দেখছি কি না, বিশ্বাস করতে পারছি না। রূপালীর মায়ের হাতটা ধরে দেখতে ইচ্ছে করছে। নিজের ইচ্ছে গোপন করতে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করলাম, আপনি এভাবে কাঁদবেন না, ও সুস্থ হয়ে উঠবে। তিনি বললেন, আপনে কত বড় হয়ে গেছেন, বাবা। ভেতরটা থরথর করে কাঁপছে আমার। ঠিক তখনই পকেটের মোবাইল বাজল। কাঁপা কাঁপা হাতে ফোন বের করলাম। মা ফোন করেছে, বাবু, তুমি ওই বাসায় গেছিলা? টাকাটা দিয়াই চইলা আসবা, কথা বাড়ানোর দরকার নাই। কথা শুনতেছ, বাবু? মা তার স্বভাবসুলভ কণ্ঠে কথা বলেই যাচ্ছেন। মাঝপথে ফোন কেটে ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম।