নতুনদের কবিতা নিয়ে পুরনো কথা
১.
আগে আগে আমি বলে নিই কবিতা বলতে আমি কী বুঝি। আমার কাছে কবিতা হলো ছায়া; মানে ইঙ্গিত। ছায়া দেখে রূপ বুঝে নেয়াটাই একজন পাঠকের কাজ। আমার কাছে কবিতা হবে কম্প্যাক্ট, নির্মেদ। পাঠকের জন্য পর পর স্পেস থাকবে, অহেতুক উপমা-অলংকারে জরজর হবে না। দীর্ঘ বা ধারাবাহিক ন্যারেটিভেরও দরকার নাই। কবিতা হলো একটা অভুতপূর্ব জগতের দরজা। কবির কাজ সেই দরজা তৈরি করা। পাঠক কবি নির্মিত দরজা দিয়ে ঢুকে ঘুরে ঘুরে বানিয়ে নেবেন আপন জগত। দ্বিতীয় কথা, উক্ত আলোচনায় আমি ছন্দ, ব্যাকরণ এইসব কখনোই বিচার করবো না। তবে সংক্ষেপ করে বলতে গেলে একজন চিত্রকলার ছাত্র হিশেবেই বলি, আমরা ততোদিন পর্যন্ত বিমূর্ত বা ডিসটর্ট ফর্মের কোনো ছবি আঁকিনি যতোদিন না ওই ফর্মটাকে নিখুঁত ভাবে আঁকতে শিখেছি। তার মানে ফর্ম ভাঙার অধিকার তারই তৈরি হয়, যে ফর্মটাকে আদি ও আসল আকারে নির্মাণ করতে জানে।
অনেকেই মনে করেন কবিতা ধ্যানের বিষয়। ওহি নাজিল হওয়ার মতো ব্যাপার। কিন্তু আমি তা মনে করি না। কবিতার প্রথম লাইনটা সহসা আসতেই পারে, সেটা হাটে, বাজারে, কমোডে বসা কালে, সঙ্গমকালে, স্নানের সময়, যেকোনো সময়, যেকোনো অবস্থাতেই আসতে পারে। তার জন্য ধ্যানের দরকার হয় না। কবি মানেই ঘোরগ্রস্থ। স্বভাবধ্যানী। যে ধ্যান জানে, সে সবসময়, সকল অবস্থাতেই ধ্যানে থাকে। কবিতা আসলে তথাকথিত ধ্যানের বিষয় নয়। কবিতা ভাত খাওয়া, প্যান্ট পরা, জুতা পরা, দাঁত মাজার মতোই দৈনন্দিন বিষয়।
সংক্ষেপ করে বলতে গেলে একজন চিত্রকলার ছাত্র হিশেবেই বলি, আমরা ততোদিন পর্যন্ত বিমূর্ত বা ডিসটর্ট ফর্মের কোনো ছবি আঁকিনি যতোদিন না ওই ফর্মটাকে নিখুঁত ভাবে আঁকতে শিখেছি। তার মানে ফর্ম ভাঙার অধিকার তারই তৈরি হয়, যে ফর্মটাকে আদি ও আসল আকারে নির্মাণ করতে জানে।
২.
আজ আমি যাদের কবিতা নিয়ে লিখতে বসেছি তাদের অধিকাংশেরই জন্ম গত শতাব্দীর নব্বই দশকের শুরুতে। এরা একুশ শতকের দ্বিতীয় দশকে লেখালেখি শুরু করলেও এদের ঠিক দ্বিতীয় দশকের কবি বলা যাবে কিনা বুঝতে পারছি না। অবশ্য এদের কয়েকজনকে উক্ত দশকের শেষার্ধের কবি হিশেবে চিহ্নিত করা যাবে বৈকি। তবে পাঠোত্তর আমি মনে করি, তৃতীয় দশকেই এরা কবিতায় পূর্ণতা পাবে। যদিও এদের মধ্য থেকে বেশ কয়েকজনের বইও ইতোমধ্যে প্রকাশ পেয়েছে। এদের অনেকের কবিতা আমার ইতঃপূর্বে পড়ার সৌভাগ্য হয়েছে, আবার অনেকের কবিতা এই প্রথম এইখানে পড়েছি। এত এত নতুন কবির এত এত কবিতা একসঙ্গে পড়ার অনুভূতি প্রকাশ করার ভাষা আসলেই আমার নাই। আর এত স্বল্প পরিসরে বিস্তারিত আলোচনার অবকাশও নাই। তাই নির্দিষ্ট কারো কবিতা আলোচনা এ নয়। এ আসলে একটা আনন্দপাঠের পর, সব মিলিয়ে কয়েকছত্র ভালোমন্দ বলার প্রয়াস। তবে অবশ্যই পাঠক এবং আলোচ্য কবিদের কাছে নিবেদন এই যে আমি কখনোই অথরিটি নই। আমি কেবল আমার ভালো লাগা মন্দ লাগা নিয়ে আমার মত দেবো। আর ভিন্ন মত নিশ্চয়ই আছে। আমি কখনোই চূড়ান্ত নই। তাই এটা বিচার নয়, কেবল পাঠানুভূতি। আর এইসব একান্তই আমার মতামত। ভাই কিংবা বন্ধু হিশেবে কথা বলা।
৩.
আলোচ্য কবিরা অনেকেই কবিতাকে জীবনযাপন থেকে উৎসারিত মনে করেন। তারা জীবন, পারিপার্শ্বিক সত্য, স্মৃতি ও স্বপ্নের কাছে চিঠি লিখেন। তাদের অনেকের কবিতায় গল্প আছে। বর্ণনায় ধারাবাহিকতা আছে। আছে চিত্ররূপময়তা। ফলত পাঠককে বেশি ভাবতে হয় না, কবির আঁকা ছকের মধ্যেই ঘুরেটুরে তৃপ্তি বা ক্লান্তি নিয়ে বেরিয়ে যেতে হয়। এরা অনেকেই অনেক চক্রমিত যন্ত্রণার কথাও নির্লিপ্ত, অলস এবং সরলভঙ্গিতে বলে গেছেন, যেনো বা কোনোভাবে বলে-টলেই চলে যেতে হবে অন্যকাজে। তারপর শব্দের বাহুল্য কেমন চোখে লাগে মাঝে মাঝে।
এদের অনেকের কাছে কবিতা কখনো হেঁয়ালি হলেও তাদের কবিতায় ঢুকে হারিয়ে যাই ঘোরের গোলকধাঁধায়। এরা কেউ কেউ শব্দের সুষম ব্যবহার জানেন, জানেন কবিতায় মিথের ব্যবহার। আর তার কবিতার চিত্রকল্পগুলিও অসাধারণ। আবার কেউ কেউ শব্দের ব্যবহার শিখছেন বলে মনে হলো। কেউ কেউ শব্দ ব্যবহারে খুবই অসতর্ক। যখন পড়ি, ‘পথফুল বিক্রেতা শিশুরা’ তখন মনে হয় এই কবি আরেকটু সতর্ক হলে হয়তো লিখতেন ‘ফুল বিক্রেতা পথশিশুরা’। কিংবা যখন পড়ি ‘শেষরাতে দূরে থেকে সুর ভেসে আসে কানে-/‘ঘুমের চাইতে ইবাদত উত্তম’ তখন মনে হয় এই কথাটা পৃথিবীর কোথাও ভিন্ন ভিন্ন ভাষায় ঘোষিত হয় না। সারা পৃথিবীতেই আরবিতেই হয়, ‘আসসালাতু খাইরুম মিনান নাউম।’ কবি আরেকটু ভাবলে হয়তো এইভাবেই লিখতেন।
অনেকেই মনে করেন কবিতা ধ্যানের বিষয়। ওহি নাজিল হওয়ার মতো ব্যাপার। কিন্তু আমি তা মনে করি না। কবিতার প্রথম লাইনটা সহসা আসতেই পারে, সেটা হাটে, বাজারে, কমোডে বসা কালে, সঙ্গমকালে, স্নানের সময়, যেকোনো সময়, যেকোনো অবস্থাতেই আসতে পারে। তার জন্য ধ্যানের দরকার হয় না। কবি মানেই ঘোরগ্রস্থ। স্বভাবধ্যানী। যে ধ্যান জানে, সে সবসময়, সকল অবস্থাতেই ধ্যানে থাকে। কবিতা আসলে তথাকথিত ধ্যানের বিষয় নয়। কবিতা ভাত খাওয়া, প্যান্ট পরা, জুতা পরা, দাঁত মাজার মতোই দৈনন্দিন বিষয়।
কেউ কেউ পঙ্ক্তি তৈরিতেও অসতর্ক। যখন পড়ি, ‘হঠাৎ মনে পড়ে নবমশ্রেণির রোকসানা বেগম।’ তখন আমার আল মাহমুদের ‘কবিতা তো মক্তবের মেয়ে চুলখোলা আয়েশা আক্তার’ মনে পড়ে যায়। কারো কবিতায় দাঁড়িয়ে থাকেন জীবনদাশ। ‘কার্তিকের শীত’ বা ‘অঘ্রাণের হিম’ জাতীয় ফ্রেইজগুলি পড়লে তার কথা মনে পড়ে যায়। তিনিতো আমাদের রক্তের ভিতর। কিন্তু তাকে অতিক্রম করা যাবে না, এটা ভুল কথা। অতিক্রম করা মানে তার চেয়ে ভালো লেখা বা খারাপ লেখা এইজাতীয় কিছু নয়, এর মানে হলো তার মতো না লেখা। আর তার চেয়ে ভালো লেখার বা খারাপ লেখার বিষয়টা মাথার মধ্যে আনাটাই ভুল। যেহেতু তিনি তার সময়ের দেদীপ্যমান।
এদের কারো কারো কবিতায় বিদেশি শব্দের ব্যবহার কখনোসখনো ভারসাম্য রাখতে ব্যর্থ হয়। ফলত কবিতাটাকে বানানো মনে হয়। মনে হয় ইচ্ছে করেই বাঙলা শব্দের পাশে ইংরেজি বা অন্য কোনো ভাষার একটা শব্দ জুড়ে দিয়ে একটা ফ্রেইজ তৈরি করেছেন। যা না করেও সহজে বাঙলা ভাষার শব্দ দিয়েই শব্দবন্ধটি তৈরি করা যেতো। আবার কারো কবিতায় বাঙলা শব্দের পাশে বিদেশি শব্দের ব্যবহার মোটেও তাল কাটে না। কয়েকটা কবিতা পড়লেই স্বকীয়তা চোখে পড়ে।
কারো কবিতায় দেখা যায় আঞ্চলিক ভাষার শব্দের প্রয়োগ। বাক্যেও প্রয়োজনে সব ধরনের শব্দই আসতে পারে। কিন্তু যখন প্রয়োজনের বাইরেও আবেগ বা এক্সপেরিমেন্ট করতে গিয়ে ইত্যাকার আপাত দুর্বোধ্য মানে সকল পাঠকের বোধগম্য নয় এই প্রকার শব্দের প্রয়োগ হয় তখন বিষয়টা বিরক্তি তৈরি করে। শব্দগুলি চোখাপেরেকের মতো লাগে। এবং কবিতার নিচে ফুটনোট অত্যাবশ্যক হয়ে দাঁড়ায়।
কারো কবিতায় কতিপয় বিষয় প্রতীক বা পার্সোনিফিকেশন হিশেবে আসতে পারতো, সেখানে সেইসব বিষয় এসেছে সরাসরি। যেনো প্রতিবেদন। বলতে গেলে প্রায় সকলেই সেই ষাটের দশকে যেমন উপমার ব্যবহার দেখেছি, সেখানেই আটকে আছেন। কেউ কেউ উৎরে যেতে গিয়ে হাংরিতে গিয়ে ঠেকেছেন।
এদের কারো কারো কাছে কবিতা হলো অচেতন থেকে উৎসারিত আলোর ছটা। খাতার মধ্যে জ্বলছে নিভছে। কারো কারো কবিতার সিঙ্গল শব্দের মধ্যেও যে ইমেজারি আমরা পেয়ে যাই তা আদিগন্ত হাহাকার তৈরি করে দেয়। মনে হয় এইসব কবিতা যথা অর্থে আধুনিক। পাঠকের জন্য প্রচুর স্পেস থাকে পরপর। ফলত পাঠকের ভাবনার একটা আলাদা জগত তৈরি হয় প্রতিটি কবিতার ভিতর। আবার কারো কারো কাছেও কবিতা হলো ইঙ্গিত। এইটা খুবই ভালো চিন্তা। এরা কবিতাকে ডিনোটেশনে পরিণত করে। কারো কাছে কবিতা একই সঙ্গে ভান, সংশয় এবং প্রত্যাদেশ হিশেবে ধারিত। যেনো এইসব বৈপরীত্যের ত্রিমুখী শৃঙ্গারেই এরা লিখেন কবিতাসকল। এদের কারো ইতিহাস চেতনা আমাদের নিয়ে যায় শতবছর থেকে হাজারবছর জীবনের বিপরীতে। গিয়ে দেখি অতীতের আভরণ পরে প্রকৃতঅর্থে চোখের সমুখে দৃশ্য হলো বর্তমান। কারো কবিতায় মিথ আর ইতিহাস থেকে উঠে আসছে চরিত্ররা। কিন্তু কখনো কখনো পরস্পর সম্পর্ক তৈরি করতে ব্যর্থ হচ্ছে।
এদের কারো কারো কাছে কবিতা হলো অচেতন থেকে উৎসারিত আলোর ছটা। খাতার মধ্যে জ্বলছে নিভছে। কারো কারো কবিতার সিঙ্গল শব্দের মধ্যেও যে ইমেজারি আমরা পেয়ে যাই তা আদিগন্ত হাহাকার তৈরি করে দেয়। মনে হয় এইসব কবিতা যথা অর্থে আধুনিক। পাঠকের জন্য প্রচুর স্পেস থাকে পরপর। ফলত পাঠকের ভাবনার একটা আলাদা জগত তৈরি হয় প্রতিটি কবিতার ভিতর।
কারো কারো কবিতা পড়ে মনে হয় এরা কবিতাকে শূন্যতা মনে করেন। কারো কবিতার ভিতর ঢুকতে গেলে ভাবনার চরাই-উৎরাই পার হতে হবে। কিন্তু কবিতা পড়ে তা মনে হয় না, সহজেই ধরা দেয়। সহজ, তুচ্ছ কিংবা খণ্ডিত ইমেজারি নিয়ে খেলতে ভালোবাসেন এই কবিগণ। বাহুল্য নেই বললেই চলে। কম্প্যাক্ট কবিতা। এমন নির্মেদ কবিতার বারান্দায় সারাদিন চুপ করে বসে থাকা যায়।
আলোচ্য কবিদের প্রত্যেকের কবিতার সঙ্গে একটা করে কবিতা ভাবনা আছে। এ ছাড়াও তাদের কবিতা পড়লেই বোঝা যায় এরা প্রত্যেকেই স্বকীয় স্বর বা নিজস্ব স্টাইল তৈরির কথা বলেছেন বা কবিতায় চেষ্টা করছেন। কিন্তু কারোরই এখনো ওই অর্থে নিজস্ব স্বর তৈরি হয়েছে বলে মনে হয় না। এদের অধিকাংশকেই সবিদশ অস্থির, যৌন অবদমনতাড়িত মনে হয়েছে কবিতা পড়ে। এই বয়সে এমনই হয়। এই বয়সে লেখা কবিতা পরিণত বয়সে অনেক কবিতালেখকই ডাস্টবিনে ফেলে দেয় বা পুড়িয়ে ফেলে। তবে আশার কথা হচ্ছে এদের মধ্যে চেষ্টা যা আছে তা নিরন্তর।
৪.
স্বকীয় স্বরটিকে আলাদা করে চিনবার চেষ্টা করাটা খুবই জরুরী। যে কবিতা স্বতঃস্ফূর্তভাবে আসে তাকে সেভাবেই বেড়ে উঠতে দেয়া উচিত। একদা বাহুল্য বাঙলা কবিতার একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হিশেবে আবর্তিত হয়েছিলো। কালে কালে সেই বাহুল্য ঝরে গেছে। তখন সমস্ত বাঙলা কবিতাতেই বাহুল্যের ছড়াছড়ি। বাহুল্য কখনো এখানে সদর্থক লাউয়ের ডগা হয়ে কবিতায় প্রলম্বিত হচ্ছিলো। জয়দেব, চণ্ডীদাস-সহ বাঙলা কবিতার সবিশদ ক্ষেতে কখনো বাহুল্যে কারো ক্লান্তি দেখা যায়নি। তাই বলে এখনো থলথলে চর্বিঅলা কবিতা লিখতে হবে তা কিন্তু নয়। জয়দেব-চণ্ডীদাস কবিতার ভিত্তি—রাস্তা অবশ্যই নয়। প্রত্যেকের রাস্তা প্রত্যেকের নিজেকেই তৈরি করতে হয় সময়ের কাছ থেকে উপাদান নিয়ে, ছেঁকে, মুছে। তবে এটা সত্য যে কখনো-সখনো চরম বাহুল্যহীনতা কবিতাকে রসকষহীন করে দেয়; আমি নিজে সুধীনদত্তের দুয়েকটা কবিতা ছাড়া বাকি কবিতার কোনো লাইনই মনে করতে পারি না। সুধীন বললেই সেই ‘একটি কথার দ্বিধা থর থর চুড়ে ভর করেছিলো সাতটি অমরাবতী’র কথাই মনে হয়। আর জীবনদাশের শত শত লাইন যখন তখন মাথার ভিতর উড়ে বেড়ায়, ঘুরে বেড়ায়, ঘুরে ঘুরে একা কথা কথা কয়। কবিতার নিজস্ব পরিভ্রমণ আছে। অথচ সেই সময় সুধীনদত্তরা জীবনদাশকে কবিই মনে করতেন না।
সবশেষে বলবো একসঙ্গে এত কবির কবিতা পড়ে মনে হয়েছে নিজের অজান্তেই ঢুকে গেছি কোনো এক অপরূপ স্বপ্নের দেশে। মুগ্ধ হয়ে পড়েছি আমি এই এদের কারো কারো কবিতা, এদের ক্ষমতা দেখে কখনো নিজেকে নিজের কাছে অসহায় মনে হয়েছে। মনে হয়েছে, হায়! যদি পেতাম আরেকটা জীবন—এইভাবে লিখে আসতাম।