নন্দিতা আর আমার মান্টো
মান্টোকে আমি ছোটোবেলা থেকেই চিনি। যখন ইশকুলে পড়ি। তার প্রথম যে গল্পটা আমাকে হন্ট করে সেই গল্পের নাম ‘খোল দো’ মানে খুলে দাও। এই গল্প বড়বেলায়ও আমি অনেকবার পড়েছি। এই গল্পের পিতা চরিত্রের সিরাজউদ্দিনের আবোধ যন্ত্রণা আর চিৎকারে আমার একবার মনে হয়েছিলো আল্লার আরশ কাঁপছিলো।
দেশভাগের কোনো কথা উঠলেই আমার মান্টো আর ঋত্বিক ঘটককে একসঙ্গে মনে পড়ে। মান্টোর অনেক পরে আমি ঋত্বিককে চিনেছি। যদিও আগেই ‘তিতাশ একটি নদীর নাম’ দেখেছি টেলিভিশনে। কিন্তু ঋত্বিক আমাকে প্রথম হন্ট করে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়, যখন সিনেমাকে কেবল দেখার জন্যে দেখি না, বোঝার জন্যেও দেখতে শুরু করেছি। ‘সুবর্ণরেখা’, ‘কোমলগান্ধার’, ‘যুক্তি তক্কো গপ্পো’ ইত্যাকার সিনেমায় দেশভাগের যে-যন্ত্রণা ঋত্বিক ছড়িয়ে দিয়েছিলো প্রথমত নিজের যন্ত্রণা। এই জায়গায় এসে আমি মান্টো আর ঋত্বিকের মধ্যে ভয়ানক মিল খুঁজে পাই। যদিও কম বয়সেই মান্টোর যক্ষা ধরা পড়েছিলো, তথাপি তিনি যক্ষার কারণে মারা যাননি। তিনি মরে ছিলেন খুব সম্ভবত লিভারের দুরারোগ্য কোনো অসুখে। এবং সেই অসুখকে ত্বরান্বিত করেছিলো তার মাত্রাতিরিক্ত মধ্যপান। যার জন্যে তাকে রিহাবেও পাঠানো হয়েছিলো। যদিও মান্টো সাফিয়াকে বিবাহের আগে থেকেই মদ খেতেন, কিন্তু সেই খাওয়ার মাত্রা ছাড়িয়ে যায় দেশভাগের পর, যখন মুম্বাই থেকে তাকে লাহোরে চলে আসতে হয়। এই যে ছেড়ে আসার যন্ত্রণা তা ভুলে থাকার জন্যেই মাত্রাতিরিক্ত মদ খাওয়া। ঋত্বিক আর মান্টোর এই জায়গাতেই মিল।
মান্টো হচ্ছেন সেই অমর কথাশিল্পী, যিনি নিজের এপিটাফ লিখে গিয়েছিলেন, ‘এই সমাধিতে টন-টন মাটির তলায় শুয়ে আছে সেই গল্পকার, যে ভাবছে, খোদা, নাকি সে নিজে, কে বেশি ভালো গল্পকার?’ কিন্তু ধর্মান্ধদের ভয়ে মান্টোর পরিবার তাঁর সমাধির এপিটাফে এই কথা খোদাই করার সাহস পায়নি।
মান্টো দুইপর্বে তিনবার করে মোট ছয়বার বিচারের মুখোমুখি হন। দেশভাগের আগে ভারতে ‘ধুয়ান’, ‘বু’ আর ‘কালি সালওয়ার’ এই তিনটি গল্পের জন্য। আর ১৯৪৭ সালের পর পাকিস্তানে ‘খোল দো’, ‘ঠান্ডা গোশত’ ও ‘উপার নিচে ডারমিয়া’ এই তিন গল্পের জন্য। ‘ঠান্ডা গোশত’ গল্পের মামলায় তাকে জরিমানাও গুনতে হয়েছিল। অতি বিরক্ত হয়ে কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে শেষপর্যন্ত মান্টো বলেছিলেন, তিনি গল্পকার, পর্নোগ্রাফার নন। জানা যায়, তার সেইসব দুর্দিনে ফয়েজ আহমদ ফয়েজের মতো কবি পর্যন্ত পাশে দাঁড়াননি, কৌশলে পাশ কাটিয়েছেন।
মান্টো হচ্ছেন সেই অমর কথাশিল্পী, যিনি নিজের এপিটাফ লিখে গিয়েছিলেন, ‘এই সমাধিতে টন-টন মাটির তলায় শুয়ে আছে সেই গল্পকার, যে ভাবছে, খোদা, নাকি সে নিজে, কে বেশি ভালো গল্পকার?’ কিন্তু ধর্মান্ধদের ভয়ে মান্টোর পরিবার তাঁর সমাধির এপিটাফে এই কথা খোদাই করার সাহস পায়নি।
অবশেষে বহুল প্রতীক্ষিত নন্দিতা দাসের ‘মান্টো’ (২০১৮) সিনেমাটার এইচডি প্রিন্ট দেখে ফেললাম। লিট ফেস্টে যাই না বলে নন্দিতাকে দেখতে না পাওয়ার যন্ত্রণা খানিকটা লাঘব হলো।
নন্দিতার মান্টো আমার ভালো লেগেছে। সেটা হতে পারে নন্দিতার প্রতি আমার পক্ষপাত কিংবা সিনেমার কালারের কারণে। কিংবা নওয়াজুদ্দীন সিদ্দিকীর অভিনয়ের কারণে। মান্টোর ‘দাশ রুপাইয়া’ গল্প দিয়ে সিনেমা শুরু আর ‘টোবা টেক সিং’ গল্প দিয়ে শেষ। এই বিষয়টা ভালো লেগেছে। মাঝে আরো কয়েকটা গল্পের মূলাংশের ভিজুয়ালাইজেশনও অসাধারণ, ‘ঠান্ডা গোস্ত’, বিশেষ করে ‘খোল দো’ গল্পটার। তবে নন্দিতার কাছে আমি আরো বেশি কিছু আশা করেছিলাম। এই সিনেমার চিত্রনাট্য লিখেছেন নন্দিতা দাস নিজেই, তিনি চাইলে অন্য প্লটে সিনেমার কাহিনি বলতে পারতেন। কিন্তু তা তিনি কেনো করেননি আমার মাথায় ঢুকছে না। যারা ২০১৫-তে মুক্তি প্রাপ্ত পাকিস্তানে বানানো সারমাদ সুলতান খুরসাতের ‘মান্টো’ সিনেমাটা দেখেছেন তারা বুঝতে পারবেন সেই সিনেমার সঙ্গে এই সিনেমার গল্প বলার মিলগুলি। এই সিনেমার চিত্রনাট্য লিখেছেন শাহিদ নাদিম। সেই সিনেমাতেও দেশভাগকে মাঝখানে রেখে মান্টোর জীবনের শেষ ছয়/সাত বছরের গল্প। আর মধ্যে মধ্যে মান্টোর লেখা গল্প। নন্দিতার সিনেমাতেও তাই। যখন দেখি নন্দিতার সিনেমায় মান্টোর সঙ্গে ইসমত চুকতাই, কৃষন চন্দর ইত্যাদির সখ্যের বিষয়টা তেমনভাবে দেখানোই হয় না, তখন ভালো লাগে না। যখন দেখা যায় বন্ধু হিশেবে অশোক কুমারই প্রধান হয়ে ওঠে তখন খানিকটা বাড়াবাড়িই মনে হয়।
নন্দিতা চাইলে মান্টোর লেখক হয়ে ওঠার সময়টা মানে সেই মেট্রিকপাশের পর ১৬/১৭ বছর বয়স থেকে ভবঘুরে জীবন যাপন, মদ, জুয়া, গাঞ্জার আসর আর গণিকালয়ে কাটানোর সময়গুলি, কিংবা রাস্তায়, ফকিরদের আখড়ায়, মাজারে, কবরস্তানে ঘুরে কাটানো সময় নিয়ে বানাতে পারতেন অসাধারণ এক সিনেমা। ওই সময়টাকেই আমি সব থেকে উত্থান-পতন, টানাপোড়েন আর বৈচিত্রপূর্ণ মনে করি।
নন্দিতা চাইলে মান্টোর লেখক হয়ে ওঠার সময়টা মানে সেই মেট্রিকপাশের পর ১৬/১৭ বছর বয়স থেকে ভবঘুরে জীবন যাপন, মদ, জুয়া, গাঞ্জার আসর আর গণিকালয়ে কাটানোর সময়গুলি, কিংবা রাস্তায়, ফকিরদের আখড়ায়, মাজারে, কবরস্তানে ঘুরে কাটানো সময় নিয়ে বানাতে পারতেন অসাধারণ এক সিনেমা। ওই সময়টাকেই আমি সব থেকে উত্থান-পতন, টানাপোড়েন আর বৈচিত্রপূর্ণ মনে করি। একটা বায়োপিকে বার্নিং সময়কে দেখানোর জন্যে যতটা মেলোড্রামা থাকা দরকার ছিলো তা নন্দিতার মান্টোতে অনুপস্থিত। কিন্তু পাকিস্তানিটাতে একেবারেই ভরপুর।
ছোটোখাটো কিছু ভুল চোখে পড়ে, নন্দিতাকে ভালোবাসি বলে সেইসব বললাম না। কিন্তু শেষ একটা ভুল তথ্য আছে, তা হলো মান্টো মারা যান ৪৩ বছর বয়সে, নন্দিতার সিনেমায় বলা হয় ৪২ বছর। ১৯১২ সালের ১১ মে জন্মেছিলেন মান্টো। আর মৃত্যু ১৮ জানুয়ারি ১৯৫৫ সালে।
আরেকটা বিষয় ‘মান্টো’ সিনেমাটা দেখে মনে হয়েছে, এই সিনেমা বিষয়ে বলার তেমন কিছু নেই। কিন্তু মান্টো বিষয়ে বলার অনেক কিছু আছে। মান্টোর যদ্দুর জানি আড়াইশো মতো গল্প আছে। সব পড়ার জন্যে পাইনি। সব পড়তে চাই।
শেষ কথা হলো, মান্টোর জীবন কম্প্যাক্ট ছিলো না। কিন্তু নন্দিতার সিনেমা কম্প্যাক্ট, টান টান। আই লাভ মান্টো, আই লাভ নন্দিতা। আমার মনে হয়েছে সাদত হাসান মান্টোর বায়োপিক বানানো সম্ভব নয়।