অক্ষরবন্দী জীবন
পরম্পরা : বাবার কবি ও শিল্পীসত্তা
ঘনিষ্ঠজনদের নিয়ে লেখা দুরূহ কাজ। আজ এতকিছু বাদ দিয়ে আব্বার সাথে প্রথম স্কুলে যাবার স্মৃতি মনে পড়ছে। আর বারবার নিজেকে তাঁর সাথে মিলিয়ে নিচ্ছি। আমার স্কুলটা ছিল ক্যাম্পাসের পাশেই, গ্রামে- মঈন নগর প্রাথমিক বিদ্যালয়। সে স্কুলে ফরমালি ভর্তি হয়েছিলাম দ্বিতীয় শ্রেণিতে। কিন্তু প্রথম শ্রেণির ফাইনাল পরীক্ষায় অবতীর্ণ হয়েছিলাম মনে পড়ে। পরীক্ষায় হয়ত লিখতে হবে ২/৪ পৃষ্ঠা, কিন্তু বাবা আমার জন্য এক দিস্তা কাগজ দিয়ে ৪টা আলাদা পরীক্ষার খাতা বানিয়ে দিলেন, ব্রাউন মলাটসহ! প্রথম দিন পরীক্ষা দিতে যাচ্ছি, পথে আব্বার এক কলিগের সাথে দেখা। বাবা স্বভাবসুলভভাবে আমার পরিচয় দিলেন ‘এই আমার একমাত্র নন্দন’ বলে। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, তা ছেলে নিয়ে কোথায় যাচ্ছেন রইস সাহেব? ভদ্রলোক জানালেন, আজ তো স্কুল বন্ধ, পরীক্ষা কাল থেকে শুরু! আব্বা তখন খাতাটি গোল করে লুকিয়ে ফেললেন! এমনধারা অনেক নির্দোষ, জগতছাড়া ভুল করার পরম্পরা আমিও বজায় রেখেছি। আমি বাবার অবিমৃষ্যকারিতায় হাসতাম না, কিন্তু আমার মেয়েদের জন্য আমার এসব কাণ্ডকীর্তি উচ্চ মাত্রার হাসির খোরাক।
কাজী নজরুল ইসলামের পর বাবাই ছিলেন আমার চেনা একমাত্র কবি, একটা বয়স পর্যন্ত। সত্তর দশকের কোন এক পহেলা বৈশাখের দুপুরে তাঁর কবিতা রচনার স্মৃতি মনে পড়ে আমার। সেই রুদ্র বৈশাখীর কবিতাটি আমি নিজের মতো করে আত্মসাৎও করেছিলাম।
কোথাও ভ্রমণে গেলে বাবা লঞ্চ, ট্রেন, বাস থেকে অনেক বই কিনতেন। তালিকা বিচিত্র- শরৎচন্দ্র, নিমাই- ফালগুনীর চিতা বহ্নিমান বা প্রিয় বান্ধবী থেকে শুরু করে আমি সিআইএর এজেন্ট পর্যন্ত। এ ছাড়া লাইব্রেরি থেকেও বই আনতেন – রম্যানী বীক্ষ্য, বিদেশি ছোটগল্প সংকলন, নক্সী কাঁথার মাঠ কিংবা দেশে বিদেশে, চাচা কাহিনী। আমি ছোটবেলায় বড়দের বই পড়ে পড়ে ভেতরে ভেতরে ইঁচড়েপাকা হয়ে উঠছিলাম। আব্বার নিজস্ব সংগ্রহ থেকে নজরুল কাব্য সঞ্চয়ন পড়েছি।
স্কুলের বার্ষিক মিলাদে আমি মহানবীর জীবনী লেখার প্রতিযোগিতার জন্য নাম দিয়েছি, আর বাবা আমাকে প্রস্তুত করে দিলেন আরেকটা প্রতিযোগিতার জন্য। সেটার কারণে রোজ বিকেলে ব্যালকনিতে বসে ‘তোরা দেখে যা আমিনা মায়ের কোলে’ রেয়াজ করাতেন। বাবার সংগীতপ্রতিভার আর কোনো স্মৃতি মনে করতে পারি না, তবে তিনি অভিনয় করতেন, নাটকের প্যাণ্ডেল আর যবনিকায় আলপনা করতেন, শিরোনাম লিখে দিতেন রঙ তুলি দিয়ে।
তাঁর সুন্দর হাতের লেখায় রেলওয়ের খাতায় আস্ত একটা কবিতার পাণ্ডুলিপি দেখেছি- নাম ‘শেফালিকা’। (রেলওয়ের লিগ্যাল সাইজ খাতাটি তিনি পেয়েছিলেন তাঁর বাবার কাছ থেকে।) কয়েকটা কবিতার শিরোনাম- ‘মুক্তাগাছার পথে’, ‘ বিপিন পার্কে একদিন’ ইত্যাদি। কাজী নজরুল ইসলামের পর বাবাই ছিলেন আমার চেনা একমাত্র কবি, একটা বয়স পর্যন্ত। সত্তর দশকের কোন এক পহেলা বৈশাখের দুপুরে তাঁর কবিতা রচনার স্মৃতি মনে পড়ে আমার। সেই রুদ্র বৈশাখীর কবিতাটি আমি নিজের মতো করে আত্মসাৎও করেছিলাম। দীর্ঘ প্রবাস জীবনের অলস অবসরে তিনি একটা আত্মজীবনীও লিখতে শুরু করেছিলেন।
আমার লেখালেখিকে তিনি নিরুৎসাহিত করেননি, খুব একটা উৎসাহও দেননি, কিন্তু তিনি নিষেধ করলে হয়ত লেখালেখির ভূত অংকুরেই ঝরে পড়ত। আমি আমাদের ছোট্ট বাসায় বৈঠকখানার এক কোণে পাতা চেয়ার টেবিলে বসে ঘাড় গুঁজে আঁকিবুকি করতাম আর অতিথিদের কৌতূহলের জবাবে তিনি স্টার সিগারেটে টান দিয়ে ‘ও.. আছে..’ অর্থ্যাৎ ও আছে ওর জগত নিয়ে – এমন একটা ইংগিতময় সদাপ্রশ্রয়ী অসমাপ্ত বাক্য বলতেন।
মনে হয়, তৃতীয় বিশ্বের অন্যান্য শিশুদের মত অর্থ ঋণ নিয়ে যেমন জন্ম নিয়েছিলাম, তেমনিভাবে বিপুল কাব্য ঋণ নিয়েও জন্মাই; শোধ করে চলেছি কেবল।