পরিচালনা সমাচার (পর্ব-১)
চলচ্চিত্রিক মানসিকতা : চলচ্চিত্রের কাহিনী (পর্ব-২) এর পর থেকে-
যদি প্রশ্ন করা হয় একজন চলচ্চিত্র পরিচালক হতে গেলে সর্বনিম্ন কয়টি বা কি কি গুন থাকা দরকার? জানি অধিকাংশই স্মার্টলি বলবেন- ক্রিয়েটিভিটি। কেউ কেউ অবশ্য বাংলা ভাষার প্রতি সম্মান প্রদর্শন পূর্বক বলবেন- সৃজনশীলতা। আর যারা চলচ্চিত্র বিষয়ে কিছু কিছু জানেন তারা কাহিনি, ক্যামেরা ওয়ার্ক, লাইটিং, কাস্টিং, মিউজিকের ব্যবহার, সেট ডিজাইন ইত্যাদি ইত্যাদি অনেক কিছুর কথাই বলবেন। কিন্তু আমি নিশ্চিত সেই অনেক কিছুর তালিকায় ‘ম্যানেজিং পাওয়ার’ বা ‘ব্যবস্থাপনার দক্ষতা’ এবং ‘তীক্ষ্ণ ব্যবসা বুদ্ধি’ এই দুটো গুণের কথা কোন ভাবেই থাকবে না। অথচ শুধু এই দুটো গুণ দিয়েই আপনি চমৎকার একটি সিনেমা বানিয়ে ফেলতে পারবেন। বিশ্বাস হচ্ছে না তো? ব্যাখ্যা করছি।
প্রথমেই ম্যানেজিং পাওয়ার বা ব্যবস্থাপনার দক্ষতা বলতে আমি কি বোঝাতে চাই তা স্পস্ট করি। অনেকেই ম্যানেজারী বলতে শুধু দোকানের গদিতে বসে টাকা পয়সার হিসাব রাখা এবং মাঝে মাঝে একে তাকে ধমক দেয়াকে বোঝেন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে একজন ম্যানেজারকে মূলতঃ তার অধীনস্থদের মাঝে ডিসিপ্লিন বজায় রাখাসহ কিভাবে কি করলে কাজকর্ম নিখুঁততর এবং দ্রুততর হয় তা নিশ্চিত করতে হয়। আর এটা করার জন্যে তার অন্যকে নিজের চাহিদাটুকু বুঝিয়ে বলার এবং রাজি করানোর বিশেষ ক্ষমতা থাকতে হয়। ম্যানেজিং পাওয়ার বা ব্যবস্থাপনার দক্ষতা বলতে আমি মূলতঃ এই বুঝিয়ে বলার এবং রাজি করানোর ক্ষমতাটাকেই বোঝাচ্ছি।
এবার মূল আলোচনায় আসা যাক। একটি চলচ্চিত্র বানানোর জন্যে সবার প্রথমে কি দরকার? সৃজনশীলতার ভক্তরা বলবেন একটি ভাল কাহিনি বা স্ক্রীপ্ট। কিন্তু নাটক বা চলচ্চিত্র বানানোর জন্যে মাঠে ময়দানে যাদের পরিশ্রম করার অভিজ্ঞতা আছে তারা বলবেন- বাজেট। অভিজ্ঞদের কথায় গুরুত্ব দেয়াটাই যুক্তি সংগত। সেক্ষেত্রে প্রশ্ন দাঁড়াচ্ছে, কেউ কেন শুধু শুধু আপনাকে তার এতগুলো টাকা দেবে যদি আপনি সেই লগ্নীকৃত অর্থ থেকে বেশ ভাল একটা লাভ পাওয়ার সুযোগ না দেখাতে পারেন? এবং এই লাভটুকু যে নিশ্চিত ভাবে হবেই সেটাও তাকে ব্যাখ্যা করে বোঝাতে হবে। হাজার হোক টাকার পরিমাণটা তো বেশ বড়। সুতরাং এখানে ব্যবসা বুদ্ধি আর কাউকে বোঝানো বা ম্যানেজ করা দুটোই জরুরী।
আপনি যখন চলচ্চিত্রের কাহিনি দাঁড় করাচ্ছেন তখন নিঃসন্দেহে আপনি একজন সৃজনশীল মানুষ। আপনি শিল্প নিয়ে কাজ করছেন। কিন্তু যখন আপনি কোন চরিত্রের জন্যে কোন অভিনয় শিল্পী ভাল হবে বা কোন নায়ক বা নায়িকাকে নিলে আপনার সিনেমা বাজেটের মধ্যে থাকবে, সিনেমা হিট করবে, এসব নিয়ে চিন্তা ভাবনা করবেন, তখনও কি আপনি নিজেকে একজন সৃজনশীল মানুষ বলে দাবী করবেন?
অবশ্য আপনি যদি বাপের জমি বিক্রি করে সিনেমা বানাতে চান তো সেটা ভিন্ন কথা। সেই সাথে যে ব্যক্তি নায়িকা বা মডেলদের সাথে রাত্রি যাপনের জন্যে লাখ লাখ টাকা খরচ করতে রাজি আছেন তাদের কথাও আলাদা। তবে এই জাতীয় প্রযোজকদের সাথে কাজ করে আপনি আপনার কাংখিত চলচ্চিত্রটি বানাতে পারবেন কি না সেটাও প্রশ্ন সাপেক্ষ বিষয়।
তো, আপনি বাজেট পেয়ে গেছেন। এবার স্ক্রীপ্ট। আপনি লিখতে পারেন না তো কি হয়েছে, একজন ভাল স্ক্রীপ্ট রাইটার নিয়োগ দেন। টাকা তো আছেই। সেই সাথে আপনি কি ধরনের কাহিনি চাচ্ছেন সেটা বুঝিয়ে বলার ক্ষমতা তো আপনার আছেই। সুতরাং স্ক্রীপ্টও রেডি।
এবার আর্টিস্ট সংগ্রহ। চোখ বন্ধ করে ভাল একজন কাস্টিং ডিরেক্টর নিয়োগ দেন। সেই সাথে একজন এ্যাক্টিং বা অভিনয় সুপারভাইজার। কাস্টিং ডিরেক্টর আপনার চাহিদা মাফিক অভিনয় শিল্প সংগ্রহ করে দেবে। এবং এ্যাক্টিং সুপারভাইজার কোন ধারার অভিনয় হবে তা শিল্পীদের হাতে কলমে দেখিয়ে দেবে।
এবার, সেট কেমন হবে? একজন আর্ট ডিরেক্টরের সাথে কড়া একটা মিটিং করে ফেলেন। কি চান তা তো আপনি বোঝাতে পারেনই। বাকি থাকল সেট বানাতে কি পরিমাণ টাকা লাগবে সেই হিসাব নিকাশ। যেহেতু আপনি একজন কড়া ব্যবসা বুদ্ধি সম্পন্ন মানুষ সুতরাং সেটা নিয়েও কোন চিন্তা থাকছে না।
এমনি ভাবে ক্যামেরাম্যান, আলোক নির্দেশক, এডিটর সবার ক্ষেত্রেই একই কথা। বাজেট যেহেতু আছে আপনি ভাল মানের লোককেই নিয়োগ দেবেন। সেই সাথে আপনি যা চান, তা না পাওয়া পর্যন্ত তাদের খাটিয়ে নিতে থাকবেন। সিনেমা আপনা থেকেই দাঁড়িয়ে যাবে। অন্ততঃ নূন্যতম মান সম্পন্ন একটি সিনেমা তো দাঁড়াবেই।
অনেকেই নিশ্চয়ই নাক মুখ কুঁচকে ভাবছেন। এত সহজ? সিনেমা একটা শিল্প। আর শিল্প এত সহজে হয় না। ঠিকই বলেছেন, শিল্প এত সহজ নয়। তবে চলচ্চিত্র আসলেই কতটা শিল্প আর কতটা অন্য কিছু, তা বোধ হয় আমাদের একটু বুঝে দেখা দরকার।
শ্যুটিংয়ে প্রতিদিন স্পট বয়ের সাথে লাইটম্যানের ঝগড়া অথবা ক্যামেরা ক্রুর সাথে নায়কের ড্রাইভারের ভুল বোঝাবুঝি বা নায়িকার সামনে ঠিক সময় মত চাইনিজ খাবার বা মিনারেল ওয়াটার হাজির হয়নি কেন এই সব বিষয় সামাল দিতে হয়। এসব যদি শিল্পের চর্চা হয়ে থাকে তবে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন নিঃসন্দেহে এই দেশের সব চেয়ে সফল চলচ্চিত্র পরিচালক হওয়ার যোগ্যতা রাখতেন।
আপনি যখন চলচ্চিত্রের কাহিনি দাঁড় করাচ্ছেন তখন নিঃসন্দেহে আপনি একজন সৃজনশীল মানুষ। আপনি শিল্প নিয়ে কাজ করছেন। কিন্তু যখন আপনি কোন চরিত্রের জন্যে কোন অভিনয় শিল্পী ভাল হবে বা কোন নায়ক বা নায়িকাকে নিলে আপনার সিনেমা বাজেটের মধ্যে থাকবে, সিনেমা হিট করবে, এসব নিয়ে চিন্তা ভাবনা করবেন, তখনও কি আপনি নিজেকে একজন সৃজনশীল মানুষ বলে দাবী করবেন? কাজ হবে এখানে সৃজনশীলতা দিয়ে? নাকি এক্ষেত্রে লাভ-ক্ষতি উপলব্ধি করতে পারে এমন একটা মাথা দরকার?
আবার, আপনি যখন ঠিক করবেন কোন দৃশ্যে কি ধরনের ক্যামেরা অপারেশন হবে, তখন আপনি শিল্পের চর্চা করছেন, সন্দেহ নেই। কিন্তু কোন ক্যামেরায় কাজ করবেন, রেড নাকি এরি এলেক্সা নাকি সনি কোম্পানীর সিনে আল্ট্রা অথবা ক্যাননের মার্ক থ্রি ফাইভ ডি? তারপর রেজুলেশন কি হবে, ফোর কে নাকি টু কে? ‘র’ ফরমেটে শ্যুট করবেন কি করবেন না? বাংলাদেশে র ফুটেজ এডিটিং করার মত প্যানেল কয়টা আছে? সেখানে খরচ এবং সময় কত বেশি লাগবে? এই সব যখন বিবেচনা করবেন তখনও কি আপনি শিল্পের সাধনা করছেন? এসব তো প্রযুক্তি ও ব্যবসায়িক বিবেচনা। এখানে শিল্প কোথায়? সৃজনশীলতা কোথায়?
আরো আছে। ‘সেট’ কেমন হবে সেটা একটা শিল্প বিবেচনা। কিন্তু শ্যুটিং প্রক্রিয়াটি কি শিল্পের কোন বিবেচনার মধ্যে পড়ে? কয়েক‘শ লোক মিলে যখন হাজার হাজার ওয়াট লাইটের নিচে একের পর এক শট ক্যামেরায় বন্দী করতে থাকবেন, তখন শিল্প নিয়ে ভাববার চেয়ে বরং কোন শট মিস হয়ে গেল কিনা, এ্যাকশন বা ড্রেস কন্টিনিউটি ঠিক থাকছে কিনা অথবা সময় মত শ্যুটিং শেষ করতে পারবেন কিনা, এই তিন চিন্তাই মাথার মধ্যে ঘুরপাক খায়। আর এসবই ম্যানেজমেন্টের বিষয়। কোন ভাবেই শৈল্পিক কোন বিষয় নয়।
শ্যুটিংয়ে প্রতিদিন স্পট বয়ের সাথে লাইটম্যানের ঝগড়া অথবা ক্যামেরা ক্রুর সাথে নায়কের ড্রাইভারের ভুল বোঝাবুঝি বা নায়িকার সামনে ঠিক সময় মত চাইনিজ খাবার বা মিনারেল ওয়াটার হাজির হয়নি কেন এই সব বিষয় সামাল দিতে হয়। এসব যদি শিল্পের চর্চা হয়ে থাকে তবে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন নিঃসন্দেহে এই দেশের সব চেয়ে সফল চলচ্চিত্র পরিচালক হওয়ার যোগ্যতা রাখতেন।
চলবে….
প্রচ্ছদ : রাজিব রায়