:
Days
:
Hours
:
Minutes
Seconds
পৃথিবীর বাইরে থেকে আমি ফোন ধরতে পারি না
প্রচ্ছদ: রাজিব রায়

কবিতাগুচ্ছ

পৃথিবীর বাইরে থেকে আমি ফোন ধরতে পারি না

পৃথিবীর বাইরে থেকে আমি ফোন ধরতে পারি না 

ট্রেন আসবে
তাই অপরিচিত ইস্টিশনে
বসে ছিলাম চারশো বছর
আরো চারশো বছর বসে থাকতাম
কারণ ট্রেন আসবে, আমি জানতাম
কিন্তু
হাঠাৎ কে
ঘোষণা করলো
‘ট্রেন আসবে না?’
আমি কোনোদিন ট্রেন না-আসার খবর জানতে চাই নাই
আসুক বা না-আসুক
চিরদিন নিজেরে বলে গেছি, ‘ট্রেন আসবে’
এখন
অপরিচিত এই ইস্টিশনে আমি
কী কারণে থাকবো, কীসের অপেক্ষায়?
সকল যেতে চাওয়া লোক চলে গেছে
অন্য পথ অন্য পরিবহনের খোঁজে
খোঁজ পেয়েও গেছে
পৌঁছে গেছে
বৃষ্টিভেজা কামিনীফুলের কাছে
চালতাফুল
কামরাঙাফুল
নিমফুল
জলপাই ফুলের কাছে
আর বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে
আর আমি অর্থহীন ইস্টিশনে
‘কোথাও যাবার নেই’ এমন কয়েকটা মানুষের কাছে
যাদের আলাদা আলাদা কোনো নাম নাই
যাদের সকলেরই একই নাম
‘পাগল’
আমি পাগলের পাশে
পাগল হতে চেয়ে
পাগল হতে না পেরে
প্রথমে শহরে
পরে শহরের পাশের গ্রামে
পরে গ্রামের পাশের বিজনে
বসে থাকি
বসে বসে আম্মাকে ভাবি
ভাবি, কোন মুখে বাড়ি ফিরে যাই
যখন আমার বাড়ি ফিরতে লজ্জা লাগছে খুব
তখন দূর থেকে কারা আমারে দেখে ফেলে
আর ধরে নিয়ে যায়
চোর সন্দেহে মারধর করে
আমার জুতা খুলে নেয়
বলে, আমি জুতা চোর
আমার জামা খুলে নেয়
বলে, আমি জামা চোর
আমার চোখ খুলে নেয়
বলে, আমি চোখ চোর
একে একে তারা আমার
হাত, পা, জিব, চুল, নাক, কান
স্মৃতি ও স্বপ্ন খুলে নিয়ে
কোথায় যেন ফেলে দেয়
আমি জানি না!

পৃথিবীতে
আমার ছেলে আমাকে খোঁজে, পায় না
বউ আমাকে খোঁজে, পায় না
আব্বা আমাকে ফোন করেন
আম্মা আমাকে ফোন করেন
পৃথিবীর বাইরে থেকে
আমি ফোন ধরতে পারি না

 

একদিন ফুলের গন্ধ পাবো না 

মৃত্যু নিয়ে শেষ কবিতা অক্ষরে লেখা সম্ভব হবে না, জেনে গেছি।
মৃত্যু নিয়ে শেষ কবিতাটা হবে স্বয়ং আমার মৃত্যুদিন।
দিনটি আমার মরা জীবনকে এমনভাবে ঘিরে রাখবে
যেন সে দিন নয় বরং একটা নিষ্ঠুর কফিন।
অথচ আমি এইরকম একটা দিনের ভিতর দিয়ে দৌড়ে গেছি ইশকুলে,
ইশকুল থেকে আম্মার দিকে। আর সন্ধ্যা নেমেছে।
আকাশে প্রচুর তারা নিয়ে জেগেছে চাঁদ সেগুনগাছের মাথায়।
আর আমি শিউলিফুলের গন্ধের ভিতর বসে ডালিমফুল ঝরা দেখে কষ্ট পেয়েছি।
বই খুলে একটানা পড়ে গেছি ‘ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না…।’

 

আম্মাকে লেখা চিঠি

আম্মা,
ফোন করলেই আমি যে বলি—ভালো আছি,
তা সবসময় সত্য না
এই যে আমি মিথ্যা বলি
এই কথা আব্বাকে বলো না।
শুধু দোয়া করো
মানুষ যেনো আমাকে ভালোবাসে।
মানুষ আমাকে ভালোবাসে না—
এই কথা কীভাবে বলি,
বলতে লজ্জা লাগে।
তবু ,
এমনকী ভাতও কেড়ে নিতে চায়
পৃথিবী এমন জানলে আমি বাড়িতে
তোমার কাছে থাকতাম
মনু গাঙে মাছ ধরতে যেতাম
তুমি মাছ দেখে হাসতে
এই হাসির দাম আমার একশো একটা জীবনেও
রোজগার করতে পারবো না, জানি
অথচ এই পৃথিবীতে তুমি-আমি একই সকালে জাগি
তবু দেখা হয় না প্রতিদিন, দূরে থাকি
রোজগার করতে চেয়েছি অন্য কারো কারো হাসি
তারা হাসে নাই
কারণ আমি তাদের নিজের ছেলে না
বরং তারা দলবেঁধে নেমেছে আমার কবর খুঁড়তে
আম্মা, আমি তো এখনো মরি নাই
এরা কী আমাকে জীবন্তই কবর দিয়ে দিবে?
আম্মা, শোনো, চুলায় লাকড়ি দিতে দিতে তুমি যে কবিতা বলতে
ক্লাস ওয়ান-টু’র আমাকে
সেই কবিতার সৌন্দর্য় আমাকে এখনো ঘিরে রেখেছে
ফলে ভালো না-থেকেও বলি ভালো আছি
বলতে বলতে ভাবি,
বড় গাছের ছায়ায় ছোটো গাছ বাঁচে না, মরে
কিন্তু তুমিও তো বড় গাছ
কেমনে বাঁচালে

আম্মা, চিন্তা করো না
আজই হয়তো লিখব অমর একটি কবিতা
যে কবিতাটি কোনো কবরই মানে না
ভেঙে বেরিয়ে যায় চাঁদের দিকে
চিরকালের দিকে

ইতি
তোমার ইমদাদ

 

পাতাবাহারের নিচে একটা পাখির কবর 

১৯৯৪ সালের এক সোমবার সকালে
হঠাৎ
পৃথিবীকে আমার ভালো লেগে যায়।
আর আমি পথের পাশে একটা মরা শালিক
দেখি পড়ে আছে উড়ার ভঙ্গিতে
তারে কুড়িয়ে নিয়ে
একটা পাতাবাহারের নিচে
এই প্রথম কবর খুঁড়ি
পাখির কবর
পাখির কবরের পাশ দিয়ে একটা মেয়ে
শিউলি গাছের তলে
ফুল কুড়াতে এলে
আমি শিউলিফুল না
অচেনা এক ফুলের গন্ধে
কবর খুঁড়ি
পাখির কবর
পাখির ফিউনারেল
শেষ হলে
ভেবেছিলাম ফুলের নামটি জানতে চাইবো
কিন্তু চাইতে পারি নাই

অনেক বছর পরের কথা,
যখন আমার একচল্লিশ আর পৃথিবীকে ভালো লাগে না
ফুলের নামটি জানতে পারি
‘অবন্তিকা’
ডাকছিলো তার বর।
সাথে সাথে মনে হলো,
ফুলের নামটি না-জেনেই
আমি তারে বলতে পারতাম,
‘পাতাবাহারের নিচে একটা পাখির কবর।’

 

ছোটো পাখি উড়ে যায় বড় আকাশের দিকে 

সোনার পেয়ালা হয়ে নদী বসে থাকে
পাখির ছোটো ঠোঁটের কাছে।
বসে বসে ভাবে, পাখি তারে পুরোটাই গিলে নেবে।
পাখি আর কতটুকু পারে?
সাত ফোঁটা জল খেয়ে ছোটো পাখি
উড়ে যায় বড় অাকাশের দিকে।
আকাশ ভাবে, পাখির ডানায় বসে উড়বে সে অন্য কোনো আকাশে।
পাখি আর কতটু পারে?
১০০ গ্রাম আকাশ নিয়ে পাখি চলে যায়।
মাটিতে কাঙাল নদী আর আকাশে কাঙাল মহাকাশ
পাখির ছোটো চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে
যথাক্রমে বাষ্পাকুল হয়, মেঘাচ্ছন্ন হয়।

Meghchil   is the leading literary portal in the Bengali readers. It uses cookies. Please refer to the Terms & Privacy Policy for details.