:
Days
:
Hours
:
Minutes
Seconds
Author Picture
ইহতিশাম আহমদ

পরিচালক, সমালোচক

পেশা নাকি পছন্দ (পর্ব-১)

পেশা নাকি পছন্দ (পর্ব-১)

চলচ্চিত্রিক মানসিকতা-১ এর পর থেকে-

প্রায় সময়ই ফেসবুকের ইনবক্সে চলচ্চিত্র বিষয়ে আগ্রহী তরুণদের মেসেজ পাই। বিভিন্নজনের বিভিন্ন প্রশ্ন।  ‘ফ্রেম ঠিক হয় নাই বলতে কী বোঝায়? ফ্রেম কীভাবে ভুল হয়, একটু বলবেন?’ ‘ক্লোজ শটে হার্ড লাইট ব্যবহার করা উচিত নাকি সফট লাইট?’ অথবা ‘ভাই, শট ডিভিশন কাকে বলে, একটু যদি বুঝিয়ে বলতেন। অনেককে প্রশ্ন করছি। কেউই ঠিকমতো বলতে চায় না।’  অনেকে তো আবার ইংলিশ বা হিন্দি সিনেমার কোনো দৃশ্যের স্ক্রিন শট পাঠিয়ে জানতে চায় তার শর্টফিল্মে এ-জাতীয় লাইট করতে গেলে কী কী লাগবে? অথবা ভিলেনের এই কপাল থেকে রক্ত গড়িয়ে পড়ার মেকআপটা কীভাবে করতে হবে? ইত্যাদি ইত্যাদি।

প্রশ্নগুলো শুনে যে কেউই মানতে বাধ্য হবেন যে প্রশ্নকর্তার চলচ্চিত্রের প্রতি অনুরাগের অন্ত নেই। কথা সত্য। এমনকি যদি বলা হয়, সারা দিনে এরা নিজেদের আপন গার্লফ্রেন্ডকে যত না সময় দেয়, তারচেয়ে বেশি সময় চলচ্চিত্রকে দেয়, তো বাড়িয়ে বলা হবে না। নাটক-সিনেমার সাথে জড়িত থাকা যাবে না, এমন শর্ত দেওয়া গার্লফ্রেন্ডের সাথে এরা চোখ বন্ধ করে ব্রেকআপ করে ফেলে। ব্রেকআপের পর অবশ্য কষ্ট পায়। কিন্তু সিনেমার বিষয়ে তাদের নো কম্প্রোমাইজ। এরা সিনেমা খায়, সিনেমা পরে, সিনেমার সাথে ঘুমায়। এককথায়, এরা সিনেমাপাগল। প্রশ্ন হলো, এই সব সিনেমাপাগল তরুণ কি আমাদের চলচ্চিত্রের মন্দা ভাব কাটাতে পারবে? পারবে বাংলাদেশের জন্য কান, ভেনিস বা বার্লিনের মতো চলচ্চিত্র উৎসব থেকে স্বর্ণপদক জয় করে আনতে?

উত্তরটা অতি-অবশ্যই, না।

সমস্যা হলো, আমাদের এই সব তরুণ সিনেমা পাগলরা কি জানি কেন চলচ্চিত্র নির্মাণকে একটি মানসিক বিষয় হিসেবে ধরে নিয়েছে। মাঝে মাঝে মনে হয়, তারা যেন প্রতিজ্ঞা করেছে ফিল্ম মেকিং না শিখেই তারা অ্যাভেটার বা অ্যাভেঞ্জার্সের মতো ভয়াবহ সব সিনেমা বানিয়ে ফেলবে। ইদানীং অনেক শর্টফিল্ম নির্মাতাকে অ্যাকশন ফিল্ম বানাতে দেখি। থ্রিলার বা অ্যাকশন ছাড়া তাদের যেন কোনো কাহিনি মাথাতেই আসে না।

অবাক হচ্ছেন? যাদের রক্তে রক্তে সিনেমা, এমন কি পেশাব, পায়খানা, কফ, থুতু, এসিডিটি, গ্যাস, বীর্য সব কিছুতেই সিনেমা, তারা কোন যুক্তিতে ভালো ভালো সিনেমা বানাতে পারবে না? ভাই, উত্তেজিত হয়ে লাভ নেই। একটা প্রশ্নের উত্তর দেন, যে মানুষ বড় বড় দালানকোঠায় থাকতে পছন্দ করে, স্থাপত্যকলার দিক থেকে আকর্ষণীয় কোনো ভবন দেখলে যে তার মহাকর্মব্যস্ত জীবন থেকে কয়েকটা মুহূর্ত বের করে নিয়ে সেই ভবনটির দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে অথবা যে জীবনের প্রায় অর্ধেকটা সময় ব্যয় করেছে নিজের জন্য একটা ভালো বাড়ি বানানোর আয়োজনে, সেই মানুষ কি চাইলেই একটা পেট্রনাস টুইন টাওয়ার বানাতে পারবে? পারবে একটা জাতীয় সংসদ ভবন বানাতে? ঠিক আছে, এত সব বড় বড় স্থাপনার কথা না হয় বাদই দিলাম। বুকে হাত দিয়ে বলেন তো, সে কি আধুনিক সকল সুবিধাসম্পন্ন দশতলা একটা অ্যাপার্টমেন্ট ভবন বানাতে পারবে?

যারা কথার পিঠে কথা প্যাঁচাতে পছন্দ করেন, তাদের জন্য স্পষ্ট করে বলছি, আমি ভবন নির্মাণ করার কথা বলেছি, ভবন নির্মাণে অর্থ বিনিয়োগ করার কথা বলিনি। সিনেমার ভাষায় বিষয়টা এভাবে বলা যেতে পারে, আমি ভবন প্রযোজনার কথা বলছি না, ভবন নির্মাণ/পরিচালনার কথা বলছি। চিন্তায় পড়ে গেলেন তো? আমার আব্বা যে বাড়িটা আমার জন্য রেখে গেছেন, সেটা বানানোর জন্য তাকে কোনো সিভিল ইঞ্জিনিয়ার বা আর্কিটেক্টের শরণাপন্ন হতে হয়নি ঠিকই কিন্তু রাজমিস্ত্রির সাথে ব্যাপক পরামর্শ করতে হয়েছে এবং তার চাকরিজীবনের শুরু থেকে শেষ অবধি অনেক, অনেকবার সেটার মাঝে নানাবিধ পরিবর্তন সাধন করতে হয়েছে। আব্বা কলেজের টিচার ছিলেন, একবারে বড় করে বাড়ি বানানো তার পক্ষে সম্ভব ছিল না। তার সততার এই দিকটুকু আমাকে তার প্রতি শ্রদ্ধাশীল করে, গর্বিত করে, আবেগপ্রবণ করে। কিন্তু কোনোভাবেই আমাদের বাড়িটাকে চেহারা বা সুযোগ-সুবিধার দিক থেকে অসাধারণ কিছু বলবার সুযোগ আমি দেখি না।

জানি, আমার আত্মীয়দের অনেকেই আমার কথায় দ্বিমত পোষণ করবেন এবং আমাকে ভর্ৎসনা করে বলবেন, ‘তোমার বাবা তোমার জন্য যা বানিয়ে গেছে, তুমি আগে তা বানিয়ে দেখাও। তারপরে এত বড় বড় কথা বলো।’ উত্তরে বলব, ভাই অথবা আঙ্কেল, বিষয়টাকে সেন্টিমেন্টাল পর্যায়ে নিয়ে যাচ্ছেন কেন? যা ভালো, তা ভালো। আর যা খারাপ, তা খারাপ। এটা মেনে না নেওয়ার মানে হলো উটপাখির মতো গর্তে মুখ লুকিয়ে রাখা। আর বলতে পারেন, গর্তে মুখ লুকিয়ে রেখে কবে, কোথায়, কোন উটপাখিটা তার সমস্যার সমাধান করতে পেরেছে?

কয়েক দিন আগে এক ছেলের সাথে তর্ক হচ্ছিল বাংলাদেশের একজন বিখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতাকে নিয়ে। ছেলেটার দাবি, তিনি অসাধারণ একজন চলচ্চিত্র নির্মাতা। প্রশ্ন করেছিলাম, পাশাপাশি দুটি হলে যদি তার সিনেমা এবং থ্রি ‘ইডিয়েট’ বা ‘রং দে বাসন্তি’র মতো সিনেমা চালানো যায়, তবে কোন সিনেমাটা মানুষ বেশি দেখবে? এ দেশের সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষদের ইংরেজি ভাষা নিয়ে সমস্যা আছে, তাই আমি শুধু হিন্দি সিনেমার প্রসঙ্গই তুলেছিলাম। ছেলেটা বেশ ক্ষিপ্ত হয়েই আমাকে জবাব দিয়েছিল, বাংলাদেশের সিনেমাটাই বেশি লোক দেখবে। সেই সাথে পারলে সে আমার নামে দেশদ্রোহের মামলা ঠুকে দেয়, এমন অবস্থা। এ রকম পরিস্থিতিতে খুব অভদ্রের মতো আমার তাকে জিজ্ঞাসা করতে হয়েছিল, এই পরিচালকের এখন পযর্ন্ত বানানো একটা সিনেমার নাম বলো, যেটা কান ফেস্টিভ্যালে গিয়ে দর্শক ও সমালোচকদের মাঝে আলোচনার ঝড় বইয়ে দিতে পেরেছে বা পারবে? শটিবনে তো শেয়ালও রাজা। আমার মাথাব্যথা সুন্দর বনের বাঘ নিয়ে।

সাংবাদমাধ্যমের সাথে জড়িত আছি। তাই জানি, দেশের মধ্যে কীভাবে সেলিব্রেটি পরিচালক হওয়া যায়। আর যে সমস্ত সিনেমা কোনো হলে প্রদর্শিত হয় না, কিন্তু ঝুড়ি ভর্তি করে পুরস্কার পায়, তাদের নিয়ে আলাচনা না হয় না-ই করি। কারণ, মাঠে খেলা হবে, ক্লাসে পড়াশোনা হবে, বিছানায় দাম্পত্য প্রেম হবে আর হলে সিনেমা প্রদর্শিত হবে- এটাই রেওয়াজ। যে কলেজের ছাত্ররা ক্লাসে থাকে না, সেই কলেজ কতটা মানসম্মত অথবা যে দম্পতির বিছানায় প্রেম হয় না, সে দম্পতির সংসার কতটা সুখের, তা খুব সহজেই অনুমান করা যায়।

আবারও বলছি, কাহিনিটা আবেগীয় ব্যাপার, মানসিক ব্যাপার, কিন্তু সেই আবেগকে সেলুলয়েডের ফিতায় বা ডিজিটালি তুলে আনাটা স্রেফ এবং স্রেফ টেকনিক্যাল ব্যাপার। ঠিক যেমন পছন্দের একটি বাড়ি বানানো বা সেখানে বাস করা আবেগীয় একটি ব্যাপার। কিন্তু সেই বাড়িটি নির্মাণ করা যান্ত্রিক বা টেকনিক্যাল একটি ব্যাপার।

এখানে বলে রাখি, আমার আব্বার বানানো বাড়িটা আমার কাছে এই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বাড়ি। কিন্তু সেটা শুধুই আমার কাছে। এর সেন্টিমেন্টটা অন্য রকম, বলে বোঝানো যাবে না। কিন্তু এই বাড়িকে আমি আহসান মঞ্জিল বা লালবাগ কেল্লার সাথে তুলনা করবার মতো আহাম্মকি কখনোই করব না। আলোচনা লম্বা হয়ে যাচ্ছে, আমার মূল প্রসঙ্গ চলচ্চিত্র, বাসাবাড়ি নয়। তারপরও এত ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে বলছি, কারণ, যেখানে সেন্টিমেন্ট কাজ করে, সেখানে আমরা সহজে কোনো কিছু মানতে চাই না। তালগাছটা আঁকড়ে ধরে থাকতে চাই। মোদ্দা কথায় আসি, ভালো কোনো স্থাপনা বানাতে গেলে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে চার বছরের গ্র্যাজুয়েশন করাটা যেমন জরুরি, তেমনি ভালো সিনেমা বা সুন্দর বনের বাঘ-মার্কা কোনো সিনেমা বানাতে গেলেও চলচ্চিত্র নির্মাণের খুঁটিনাটিটা জানা খুব জরুরি। আবেগ দিয়ে সিনেমা দেখা যায়, সিনেমা হলে বসে প্রেমিক বা প্রেমিকার হাতে হাত রেখে প্রেম করা যায়, কিন্তু সিনেমা বানানো যায় না।

সিনেমা সম্পূর্ণ টেকনিক্যাল একটা ব্যাপার। একটি উপন্যাস মানসিক ব্যাপার হতে পারে। একটি পেইন্টিং হয়তো মানসিক ব্যাপার হতে পারে। হয়তো বলছি এ কারণে যে কালার, কম্পোজিশন, পারসপেক্টিভ এই সব না বুঝলে পেইন্টিং পাহাড়সম কঠিন একটা বিষয়। তবে অনেক শিল্পীই এই পৃথিবীতে আছেন, যারা কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত না হয়েও কালজয়ী পেইন্টার হয়েছেন। সুতরাং সবার কাছে না হলেও অনেকের কাছেই পেইন্টিং একটি মানসিক ব্যাপার, যা মনের আবেগ থেকে উৎসারিত। সংগীত, নৃত্য বা অভিনয়ের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। কিন্তু সিনেমা কোনোভাবেই মানসিক ব্যাপার নয়। এটি একটি সমন্বিত ব্যাপার, যেখানে বেশ কিছু যন্ত্রপাতির মধ্য দিয়ে কাহিনির আবেগকে দর্শকের কাছে তুলে ধরতে হয়। আবারও বলছি, কাহিনিটা আবেগীয় ব্যাপার, মানসিক ব্যাপার, কিন্তু সেই আবেগকে সেলুলয়েডের ফিতায় বা ডিজিটালি তুলে আনাটা স্রেফ এবং স্রেফ টেকনিক্যাল ব্যাপার। ঠিক যেমন পছন্দের একটি বাড়ি বানানো বা সেখানে বাস করা আবেগীয় একটি ব্যাপার। কিন্তু সেই বাড়িটি নির্মাণ করা যান্ত্রিক বা টেকনিক্যাল একটি ব্যাপার।

সমস্যা হলো, আমাদের এই সব তরুণ সিনেমা পাগলরা কি জানি কেন চলচ্চিত্র নির্মাণকে একটি মানসিক বিষয় হিসেবে ধরে নিয়েছে। মাঝে মাঝে মনে হয়, তারা যেন প্রতিজ্ঞা করেছে ফিল্ম মেকিং না শিখেই তারা অ্যাভেটার বা অ্যাভেঞ্জার্সের মতো ভয়াবহ সব সিনেমা বানিয়ে ফেলবে। ইদানীং অনেক শর্টফিল্ম নির্মাতাকে অ্যাকশন ফিল্ম বানাতে দেখি। থ্রিলার বা অ্যাকশন ছাড়া তাদের যেন কোনো কাহিনি মাথাতেই আসে না। এমন অনেকেই মাঝে মাঝে আমার সাথে যোগাযোগ করে, আমার সাথে এই নিয়ে দেখা করবার জন্য সময় চায়। আমি তাদের সাথে দেখা করি। ধৈর্য নিয়ে তাদের গল্প শুনি, শুটিং প্ল্যান শুনি। সেই সাথে তাদের চাহিদামাফিক পরামর্শ দেওয়ার চেষ্টা করি।

আমাদের দেশে মিডিয়াতে কর্মরত তিন ধরনের মানুষ আছে। এক, যারা আপনাকে সময়ই দেবে না। কারণ, তারা প্রচণ্ড ব্যস্ত তাদের পেশাগত কর্মকাণ্ড নিয়ে। দুই, যারা আপনাকে সময় দেবে এবং খুব রসিয়ে রসিয়ে জানাবে এই জগৎ কতটা কঠিন এবং সেই সাথে আপনাদের অন্য কোনো পেশা বেছে নেওয়ার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ পরামর্শ দেবে। স্পষ্টতই বোঝা যায়, এদের হাতে কাজ কম এবং এরা প্রতিদ্বন্দ্বী বাড়াতে চায় না। ৩য় ধরনটি আমার মতন, নতুনদের সময় ও সহযোগিতা দেয়। বুঝতেই পারছেন, আমরা মিডিয়াতে সেমি বেকার টাইপের মানুষ। তাই বনের মোষ তাড়ানোর সময় আমাদের হাতে আছে। অনেকেরই আবার নাটক-সিনেমা না বানাতে পেরে মনের দুঃখ ভুলবার জন্য কিছু মুরিদ তৈরি করে ছোট পরিসরে সেলিব্রেটি হওয়ার চেষ্টা করে।

 

চলবে…

 


অলংকরণ: রাজিব রায়

Meghchil   is the leading literary portal in the Bengali readers. It uses cookies. Please refer to the Terms & Privacy Policy for details.