প্রিয় মৃণাল, বিদায়
মৃণাল সেন চলে গেলেন। তবে ৯৫ বছর কম সময়ও নয়। তারপরও তার চলে যাওয়ার ধাক্কা সামলে উঠতে আমার কেমন যেনো লাগছে। ভেবেছিলাম একশো পার করে আরো দীর্ঘ হয়ে দিক চক্রবালের দিকে চলে যাবেন।
সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেন আর ঋত্বিক ঘটক। এইটা হচ্ছে তাদের বয়সের ক্রম। আমার অন্য রকম বাঙলা সিনেমা বলতে এই তিনজনের সিনেমাই মাথার মধ্যে ছিলো। সবার আগে চলে গেলেন ঋত্বিক, কেননা তিনি আত্মবিধ্বংসী ছিলেন। তারপর গেলেন সত্যজিৎ। আর আজ সকালে চলে গেলেন মৃণাল, জীবনকে সমস্তই দেখে গেলেন, দুই শতাব্দীর এপাশ ওপাশ পরিভ্রমণ করে গেলেন।
যদিও এই তিনজন একই সঙ্গে সিনেমা বানানো শুরু করেন, মানে সত্যজিতের ‘পথের পাঁচালি’ আর মৃণালের ‘রাতভোর’ একই বছর ১৯৫৫ সালেই মুক্তি পায়, তথাপি সত্যজিৎকে মৃণাল সমীহ্ করতেন। কারণ সত্যজিৎ নিজের আর অন্যদের মাঝখানে একটা অদৃশ্য দেয়াল তুলে রাখতেন। সেটা পার্সোনালিটি, কিংবা ব্যস্ততার হতে পারে। আর ঋত্বিক যেহেতু জাতপাত, দেয়াল-ইমারত মানতেন না ফলত তার যাতায়ত সবখানেই ছিলো। ঋত্বিকের নাগরিকের কাজ যদিও ১৯৫৩ সালেই শেষ, তথা সেইটে মুক্তি পেতে অনেক বছর লেগে গিয়েছিলো।
ঋত্বিক আর মৃণাল ছিলেন বন্ধু। তুইতোকারি সম্পর্ক। এই দুইজন শুরুতে মার্ক্সবাদী মতাদর্শে দীক্ষিত ছিলেন এবং এবং বলা যায় অনেক ক্ষেত্রে সক্রিয়ও ছিলেন। তবে ঋত্বিকের বুকের ভিতর ছিলে দেশভাগের যন্ত্রণা। ফলত তার সিনেমায় সরাসরি শ্রেণিচেতনার বিষয়টা আসে নাই। যেটা মৃণালের অধিকাংশ সিনেমায় এসেছিলো। এই কারণে আমি আমার বন্ধু শশীকে বলেছিলাম। মৃণালকে আমি রেখেছি ৩ নম্বরে পছন্দের ক্রমে। কারণ সিনেমায় সরাসরি মতাদার্শিক প্রপাগান্ডা আমার ভালো লাগে না, যে কারণে আইজেনস্টাইনের মতো ফিল্মমেকারও আমার অতো প্রিয় তালিকায় নাই। যদিও নম্বরে আমার সত্যজিৎকে রাখার কথা ছিলো, কিন্তু আমি রেখেছি ঋত্বিককে। কারণ সিনেমার বাহিরে তার লাইফস্টাইল, তার আত্মবিধ্বংসী একরোখা, গোঁয়ার যাপন আমাকে বেশি হন্ট করেছিলো।
সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেন আর ঋত্বিক ঘটক। এইটা হচ্ছে তাদের বয়সের ক্রম। আমার অন্য রকম বাঙলা সিনেমা বলতে এই তিনজনের সিনেমাই মাথার মধ্যে ছিলো। সবার আগে চলে গেলেন ঋত্বিক, কেননা তিনি আত্মবিধ্বংসী ছিলেন। তারপর গেলেন সত্যজিৎ। আর আজ সকালে চলে গেলেন মৃণাল, জীবনকে সমস্তই দেখে গেলেন, দুই শতাব্দীর এপাশ ওপাশ পরিভ্রমণ করে গেলেন।
তো মৃণালের দুটি সিনেমা আমার সব থেকে প্রিয় একটার নাম আমার ভুবন (২০০২), এর পরে তিনি আর সিনেমা বানাননি বা বানাতে ইচ্ছে করেনি বা পারেননি, কারণ তখন তার বয়স ৭৯ বছর। এই সিনেমাটা আমার এত ভালো লেগেছিলো যে আমি অনেকবার এই টা দেখেছি। এখনো ইউটিউবে এর গান বা অংশ টেনে দেখি। এই সিনেমার স্ক্রিপ্ট অসাধারণ। এর গল্পে মানুষের অন্তর্গত যে যন্ত্রণা তা আমাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিলো অনেকদিন। নন্দিতা দাস, শাশ্বত চ্যাটার্জি বা কৌশিক সেনের অসামান্য অভিনয় ভোলার মতো নয়।
অন্যটা ‘ইন্টারভিউ’ (১৯৭১)। শশী কোনোদিন আমার কাছে জানতে চেয়েছিলো আমি মৃণাল সেনের ‘ইন্টারভিউ’ সিনেমাটা দেখেছি কিনা। তাকে আমি বললাম, ‘হুঁ, বেশ কয়েকবার দেখেছি বোধ হয়। নিজেকে শুধু সিনেমার শেষ দৃশ্যের রঞ্জু মনে হয়েছে। আর কিছু না পেরে মনে মনে ইনকিলাব জিন্দাবাদ বলে পাথর ছুড়ে ভেঙে ফেলি ম্যানিকুইনের কাচের পাহারা। তার মাথা থেকে খুলে নিই ক্যাপ, গলা থেকে খুলে নিই টাই, কোট খুলে নিই, টেনে ছিঁড়ে খুলে নিই পরনের প্যান্ট—তাকে আপাদমস্তক নেংটা করে দিই। আমার কখনো সাহেব হওয়ার বাসনা ছিলো না বলে টাই পরতে শিখিনি, টাইয়ের নটও বাঁধতে হয়নি।’ তো এই হলো আমার মৃণাল সেনের সিনেমা দেখার অভিজ্ঞতা।
তারপর তার ‘আকালের সন্ধানে’, ‘একদিন প্রতিদিন’, ‘ক্যালকাটা ৭১’, ‘পদাতিক’ ইত্যাদি আমার প্রিয় সিনেমা। ‘আকালের সন্ধানে’ সিনেমায় স্মিতা পাতিলের অভিনয় কিংবা ‘পদাতিকে’ ধৃতিমান চ্যাটার্জির অভিনয় চোখে লেগে আছে এখনো। তার নানা সিনেমায় ব্যবহৃত অনেক গণসংগীত আমাকে খুব হন্ট করতো।
আমার মনে হয় মৃণাল সেনের চলে যাওয়ার পর বাঙলা সিনেমার খুব শক্তিশালী একটা সময়কালের অবসান ঘটলো।