ফসিল
সুবোধ ঘোষ জন্মেছিলেন ১৯০৯ সালে, বিহারের হাজারিবাগে। মৃত্যু ১০-ই মার্চ, ১৯৮০। তার আদি নিবাস ছিল বাংলাদেশের ঢাকা জেলার বিক্রমপুরের বহর গ্রামে। বিচিত্র জীবনধারায় বয়ে যাওয়া সব গল্পের জনক তিনি। তার শ্রেষ্ঠ গল্পগুলোর মধ্যে ‘ফসিল’ অন্যতম। পুনর্পাঠে আজ পড়ুন ‘ফসিল’। -স.
নেটিভ স্টেট অঞ্জনগড়; আয়তন কাঁটায় কাঁটায় সাড়ে-আটষট্টি বর্গমাইল। তবুও নেটিভ স্টেট, বাঘের বাচ্চা বাঘই। মহারাজ আছেন; ফৌজ, ফৌজদার, সেরেস্তা, নাজারৎ সব আছে। এককুড়ির উপর মহারাজের উপাধি। তিনি ত্রিভুবনপতি; তিনি নরপাল, ধর্মপাল ও অরাতিদমন। চারপুরুষ আগে এরাজ্যে বিশুদ্ধ শাস্ত্রীয় প্রথায় অপরাধীকে শূলে চড়ানো হতো; এখন সেটা আর সম্ভব নয়। তার বদলে অপরাধীকে শুধু উলঙ্গ করে নিয়ে মৌমাছি লেলিয়ে দেওয়া হয়।
সাবেক কালের কেল্লাটা যদিও লুপ্তশ্রী, তার পাথরের গাঁথুনিটা আজও অটুট। কেল্লার ফটকে বুনো হাতীর জীর্ণ কঙ্কালের মত দুটো মরচে-পড়া কামান। তার নলের ভেতরে পায়রার দল স্বচ্ছন্দে ডিম পাড়ে; তার ছায়ায় বসে ক্লান্ত কুকুরেরা ঝিমোয়। দপ্তরে দপ্তরে শুধু পাগড়ি আর তরবারির ঘটা; দেয়ালে দেয়ালে ঘুঁটের মত তামা আর লোহার ঢাল।
সচিব আছে, সেরেস্তাদারও আছে। ক্ষত্রিয় তিলক আর মোগল তকমার অদ্ভূত মিলন দেখা যায় দপ্তরে। যেন দুই যুগের দুই জাতের আমলাদের যৌথপ্রতিভার সাহায্যে মহারাজা প্রজারঞ্জন করেন। সেই অপূর্ব অদ্ভূত শাসনের তাপে উত্যক্ত হয়ে রাজ্যের অর্ধেক প্রজা সরে পড়েছে দূর মরিসাসের চিনির কারখানায় কুলির কাজ নিয়ে।
সাড়ে-আটষট্টি বর্গমাইল অঞ্জনগড় — শুধু ঘোড়ানিম আর ফণীমনসায় ছাওয়া রুক্ষ কাঁকরে মাটির ডাঙা আর নেড়া নেড়া পাহাড়। কুর্মি আর ভীলেরা দু’ক্রোশ দূরের পাহাড়ের গায়ে লুকানো জলকুণ্ড থেকে মোষের চামড়ার থলিতে জল ভরে আনে — জমিতে সেচ দেয় — ভুট্টা যব আর জনার ফলায়।
প্রত্যেক বছর স্টেটের তসীল বিভাগ আর ভীল ও কুর্মি প্রজাদের মধ্যে একটা সংঘর্ষ বাধে। চাষীরা রাজভাণ্ডারের জন্য ফসল ছাড়তে চায় না। কিন্তু অর্ধেক ফসল দিতেই হবে। মহারাজার সুগঠিত পোলো টীম আছে। হয়শ্রেষ্ঠ শতাধিক ওয়েলারের হ্রেষারবে রাজ-আস্তাবল সতত মুখরিত। সিডনির নেটিভ এই দেবতুল্য জীবগুলির ওপর মহারাজার অপার ভক্তি। তাদের তো আর খোল ভুষি খাওয়ানো চলে না। ভুট্টা, যব, জনার চাই-ই।
তসীলদার অগত্যা সেপাই ডাকে। রাজপুত বীরের বল্লম আর লাঠির মারে ক্ষাত্রবীর্যের স্ফুলিঙ্গ বৃষ্টি হয়। এক ঘন্টার মধ্যে সব প্রতিবাদ স্তব্ধ, সব বিদ্রোহ প্রশমিত হয়ে যায়।
পরাজিত ভীলদের অপরিমেয় জংলী সহিষ্ণুতাও ভেঙে পড়ে। তারা দলে দলে রাজ্য ছেড়ে গিয়ে ভর্তি হয় সোজা কোন ধাঙড়-রিক্রুটারের ক্যাম্পে। মেয়ে মরদ শিশু নিয়ে কেউ যায় নয়াদিল্লী, কেউ কলকাতা,কেউ শিলং। ভীলেরা ভুলেও আর ফিরে আসে না।
শুধু নড়তে চায় না কুর্মি প্রজারা। এ-রাজ্যে তাদের সাতপুরুষের বাস। ঘোড়ানিমের ছায়ায় ছায়ায় ছোট বড় এমন ঠাণ্ডা মাটির ডাঙা, কালমেঘ আর অনন্তমূলের চারার এক একটা ঝোপ; সালসার মত সুগন্ধ মাটিতে। তাদের যেন নাড়ীর টানে বেঁধে রেখেছে এই মাটি। বেহায়ার মত চাষ করে, বিদ্রোহ করে আর মারও খায় — ঋতুচক্রের মত এই ত্রিদশার আবর্তনে তাদের দিনসন্ধ্যায় সমস্ত মুহূর্তগুলি ঘুরপাক খায়। এদিক ওদিক হবার উপায় নেই।
সংক্রান্তির দিনে মহারাজা গায়ে আলপনা আঁকা হাতির পিঠে আর জুলুস নিয়ে পথে বার হন — প্রজাদের আশীর্বাদ করতে। তার জন্মদিনে কেল্লার আঙিনায় রামলীলা গান হয় — প্রজারা নিমন্ত্রণ পায়। তবে অতিরিক্ত ক্ষত্রিয়ত্বের প্রকোপে যা হয় — সব ব্যাপারেই লাঠি। যেখানে জনতা আর জয়ধ্বনি, সেখানে লাঠি চলবেই আর দু’চারটে অভাগার মাথা ফাটবেই। চিড়ে আশীর্বাদ বা রামলীলা — সবই লাঠির সহযোগে পরিবেশন করা হয়; প্রজারা সেই ভাবেই উপভোগ করতে অভ্যস্ত।
তবে অঞ্জনগড় থেকে দয়াধর্ম একেবারে নির্বাসিত নয়। প্রতি রবিবারে কেল্লার সামনে সুপ্রশস্ত চবুতরায় হাজারের ওপর দুঃস্থ জমায়েত হয়। দরবার থেকে বিতরণ করা হয় চিড়ে আর গুড়। সংক্রান্তির দিনে মহারাজা গায়ে আলপনা আঁকা হাতির পিঠে আর জুলুস নিয়ে পথে বার হন — প্রজাদের আশীর্বাদ করতে। তার জন্মদিনে কেল্লার আঙিনায় রামলীলা গান হয় — প্রজারা নিমন্ত্রণ পায়। তবে অতিরিক্ত ক্ষত্রিয়ত্বের প্রকোপে যা হয় — সব ব্যাপারেই লাঠি। যেখানে জনতা আর জয়ধ্বনি, সেখানে লাঠি চলবেই আর দু’চারটে অভাগার মাথা ফাটবেই। চিড়ে আশীর্বাদ বা রামলীলা — সবই লাঠির সহযোগে পরিবেশন করা হয়; প্রজারা সেই ভাবেই উপভোগ করতে অভ্যস্ত।
লাঠিতন্ত্রের দাপটে স্টেটের শাসন আদায় উসুল আর তসীল চলছিল বটে, কিন্তু যেটুকু হচ্ছিল, তাতে গদির গৌরব অটুট রাখা যায় না। নরেন্দ্রমণ্ডলের চাঁদা আর পোলো টিমের খরচ! রাজবাড়ির বাপেরকেলে সিন্দুকের রূপো আর সোনার গাদিতে হাত দিতে হয়। আর, সিন্দুকও খালি হতে থাকে।
অঞ্জনগড়ের এই উদ্বিগ্ন অদৃষ্টের সন্ধিক্ষণে দরবারের ল-এজেন্টের পদে নিযুক্ত হয়ে এল একজন ইংরেজী আইননবিস উপদেষ্টা। আমাদের মুখার্জীই এল ল-এজেন্ট হয়ে। মুখার্জীর চওড়া বুক — যেমন পোলো তেমনি স্টেটের কাজে অচিরে মহারাজার বড় সহায় হয়ে দাঁড়ালো। ক্রমে মুখার্জীই হয়ে গেল ডি ফ্যাক্টো সচিবোত্তম, আর সচিবোত্তম রইলেন শুধু সই করতে।
আমাদের মুখার্জী আদর্শবাদী। ছেলেবেলার ইতিহাস-পড়া ডিমোক্রেসীর স্বপ্নটা আজও তার চিন্তার পাকে পাকে জড়িয়ে আছে। বয়সে অপ্রবীণ হলে সে অত্যন্ত শান্তবুদ্ধি। সে বিশ্বাস করে — যে সত্সাহসী সে কখনো পরাজিত হয় না, যে কল্যাণকৃৎ তার কখনো দুর্গতি হতে পারে না।
মুখার্জী তার প্রতিভার প্রতি পরমাণু উজাড় করে দিল স্টেটের উন্নতির সাধনায়। অঞ্জনগড়ের আবালবৃদ্ধ চিনে ফেলল তাদের এজেন্ট সাহেবকে, একদিকে যেমন কট্টর অন্য দিকে তেমনি হমদরদ। প্রজারা ভয় পায় ভক্তিও করে। মুখার্জীর নির্দেশে বন্ধ হলো লাঠিবাজি। সমস্ত দপ্তর চুলচেরা অডিট করে তোলপাড় করা হলো। স্টেটের জরীপ হলো নতুন করে; সেন্সাস নেওয়া হলো। এমন কি মরচে পড়া কামান দুটোকেও পালিস দিয়ে চকচকে করে ফেলা হলো।
ল-এজেন্ট মুখার্জীই একদিন আবিষ্কার করল অঞ্জনগড়ের অন্তর্ভৌম সম্পদ। কলকাতা থেকে জিওলজিস্ট আনিয়ে সার্ভে ও সন্ধান করিয়ে একদিন বুঝতে পারে মুখার্জী — এই অঞ্জনগড় রত্ন, এর গ্রানিটে গড়া পাঁজরের ভাঁজে ভাঁজে অভ্র আর অ্যাসবেস্টসের স্তূপ। কলকাতার মার্চেন্টদের ডাকিয়ে ঐ কাঁকুরে মাটির ডাঙাগুলিই লাখ লাখ টাকায় ইজারা করিয়ে দিল। অঞ্জনগড়ের শ্রী গেল ফিরে।
আজ কেল্লার এক পাশে গড়ে উঠেছে সুবিরাট গোয়ালিয়রী স্টাইলের প্যালেস। মার্বেল, মোজেয়িক,কংক্রীট আর ভিনিসিয়ান সার্সীর বিচিত্র পরিসজ্জা! সরকারী গ্যারেজে দামী দামী জার্মান লিমুজিন সিডান আর টুরার। আস্তাবলে নতুন আমদানী আইরিশ পনির অবিরাম লাথালাথি। প্রকাণ্ড একটা বিদ্যুতের পাওয়ার হাউস — দিবারাত্র ধক্ ধক্ শব্দে অঞ্জনগড়ের নতুন চেতনা আর পরমায়ু ঘোষণা করে।
সত্যই নতুন প্রাণের জোয়ার এসেছে অঞ্জনগড়ে। মার্চেন্টরা একজোট হয়ে প্রতিষ্ঠা করেছে — মাইনিং সিণ্ডিকেট। খনি অঞ্চলে ধীরে গড়ে উঠেছে খোয়াবাঁধানো বড় বড় সড়ক, কুলির ধাওড়া, পাম্প-বসানো ইঁদারা, ক্লাব, বাংলো, কেয়ারী-করা ফুলের বাগিচা আর জিমখানা। কুর্মি কুলিরা দলে দলে ধাওড়া জাঁকিয়ে বসেছে। নগদ মজুরী পায়, মুরগি বলি দেয়, হাঁড়িয়া খায় আর নিত্য সন্ধ্যায় মাদল ঢোলক পিটিয়ে খনি অঞ্চল সরগরম করে রাখে।
মহারাজা এইবার প্ল্যান আঁটছেন — দুটো নতুন পোলো গ্রাউণ্ড তৈরী করতে হবে; আরো বাইশ বিঘা জমি যোগ করে প্যালেসের বাগানটাকে বাড়াতে হবে। নহবতের জন্য একজন মাইনে-করা ইটালীয়ান ব্যান্ডমাস্টার হলেই ভাল।
অঞ্জনগড়ের মানচিত্রটা টেবিলের ওপর ছড়িয়ে মুখার্জী বিভোর হয়ে ভাবে, তার ইরিগেশন স্কীমটার কথা। উত্তর থেকে দক্ষিণ সমান্তরাল দশটা ক্যানেল। মাঝে মাঝে খিলান-করা কড়া-গাঁথুনির শ্লুস-বসানো বড় বড় ডাম। অঞ্জনা নদীর সমস্ত জলের ঢলটা কায়দা করে অঞ্জনগড়ের পাথুরে বুকের ভেতর চালিয়ে দিতে হবে — রক্তবাহী শিরার মত। প্রত্যেক কুর্মি প্রজাকে মাথা পিছু এক বিঘা জমি দিতে হবে বিনা সেলামীতে, আর পাঁচ বছরের মত বিনা খাজনায়। আউস আর আমন; তা ছাড়া একটা রবি। বছরে এই তিন কিস্তি ফসল তুলতেই হবে। উত্তরের প্লটের সমস্তটাই নার্সারী, আলু আর তামাক; দক্ষিণেরটায় আখ, যব আর গম। তারপর —
তারপর ধীরে একটা ব্যাঙ্ক, ক্রমে একটা ট্যানারী আর কাগজের মিল। রাজকোষের সে অকিঞ্চনতা আর নেই। এই তো শুভ মাহেন্দ্রক্ষণ! শিল্পীর তুলির আঁচড়ের মত এক এক এস্টিমেটে সে অঞ্জনগড়ের রূপ ফিরিয়ে দেবে। সে দেখিয়ে দেবে — রাজ্যশাসন লাঠিবাজি নয়, এও একটা আর্ট।
সত্যই নতুন প্রাণের জোয়ার এসেছে অঞ্জনগড়ে। মার্চেন্টরা একজোট হয়ে প্রতিষ্ঠা করেছে — মাইনিং সিণ্ডিকেট। খনি অঞ্চলে ধীরে গড়ে উঠেছে খোয়াবাঁধানো বড় বড় সড়ক, কুলির ধাওড়া, পাম্প-বসানো ইঁদারা, ক্লাব, বাংলো, কেয়ারী-করা ফুলের বাগিচা আর জিমখানা। কুর্মি কুলিরা দলে দলে ধাওড়া জাঁকিয়ে বসেছে। নগদ মজুরী পায়, মুরগি বলি দেয়, হাঁড়িয়া খায় আর নিত্য সন্ধ্যায় মাদল ঢোলক পিটিয়ে খনি অঞ্চল সরগরম করে রাখে।
একটা স্কুল, এইটাতে মহারাজার স্পষ্ট জবাব, কভি নেহি। মুখার্জী উঠলো; দেখা যাক; বুঝিয়ে বাগিয়ে মহারাজার আপত্তি টলাতে পারে কি না।
মহারাজা তাঁর গালপাট্টা দাড়ির গোছাটাকে একটা নির্মম মোচড় দিয়ে মুখার্জীর সামনে এগিয়ে দিলেন দুটো কাগজ — এই দেখ।
প্রথম পত্র — প্রবলপ্রতাপ দরবার আর দরবারের ঈশ্বর মহারাজ! আপনি প্রজার বাপ। আপনি দেন বলেই আমরা খাই। অতএব এ বছর ভুট্টা জনার যা ফলবে, তার উপর যেন তসীলদারদের জুলুম না হয়। আমরা নগদ টাকায় খাজনা দেব। আইনসঙ্গতভাবে সরকারকে যা দেয়, তা আমরা দেব ও রসিদ নেব। ইতি দরবারের অনুগত ভৃত্য; কুর্মি সমাজের তরফে দুলাল মহাতো, বকলম খাস।
দ্বিতীয় পত্র — মহারাজার পেয়াদা এসে আমাদের খনির ভেতর ঢুকে চারজন কুর্মি কুলিয়ে ধরে নিয়ে গেছে আর তাদের স্ত্রীদের লাঠি দিয়ে মেরেছে। আমরা একে অধিকারবিরুদ্ধ মনে করি এবং দাবী করি, মহারাজার পক্ষ থেকে শীঘ্রই এ-ব্যাপারের সুমীমাংসা হবে। ইতি সিণ্ডিকেটের চেয়ারম্যান, গিবসন।
মহারাজা বললেন — দেখছ তো মুখার্জী, শালাদের হিম্মৎ।
— হ্যাঁ, দেখছি।
টেবিলে ঘুঁসি মেরে বিকট চিত্কার করে অরাতিদমন প্রায় ফেটে পড়লেন — মুড়ো, শালাদের মুড়ো কেটে এনে ছড়িয়ে দাও আমার সামনে। আমি বসে বসে দেখি; দু’দিন দু’রাত ধরে দেখি।
মুখার্জী মহারাজাকে শান্ত করে — আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন। আমি একবার ভেতরে ভেতরে অনুসন্ধান করি, আসল ব্যাপার কি।
বৃদ্ধ দুলাল মাহাতো বহুদিন পরে মরিসাস থেকে অঞ্জনগড়ে ফিরেছে। বাকী জীবনটা উপভোগ করার জন্য সঙ্গে নগদ সাত টাকা এবং বুকভরা হাঁপানি নিয়ে ফিরেছে। তার আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গে কুর্মিদের জীবনেও যেন একটা চঞ্চলতা — একটা নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়েছে।
কুর্মিরা দুলালের কাছে শিখেছে — নগদ মজুরী কি জিনিস। ফয়জাবাদ স্টেশনে কোন বাবুসাহেবের একটা দশসেরী বোঝা ট্রেনের কামরায় তুলে দাও! বাস — নগদ এক আনা হাতে হাতে।
দুলাল বলেছে — ভাইসব, এই বুড়োর মাথায় য’টা সাদা চুল দেখছ, ঠিক ততবার সে বিশ্বাস করে ঠকেছে। এবার আর কাউকে বিশ্বাস নয়। সব নগদ নগদ। এক হাতে নেবে তবে অন্য হাতে সেলাম করবে।
সিণ্ডিকেটের সাহেবদের সঙ্গে দুলাল সামনে কথা চালায়। কুলিদের মজুরীর রেট, হপ্তা পেমেন্ট, ছুটি, ভাতা আর ওষুধের ব্যবস্থা — এ সব সে-ই কুর্মিদের মুখপাত্র হয়ে আলোচনা করেছে; পাকা প্রতিশ্রুতি আদায় করে নিয়েছে। সিণ্ডিকেটও দুলালকে উঠতে বসতে তোয়াজ করে — চলে এস দুলাল। বল তো রাতারাতি বিশ ডজন ধাওড়া করে দি। তোমার সব কুর্মিদের ভর্তি করে নেব।
দুলাল জবাব দেয় — আচ্ছা, সে হবে। তবে আপাতত কুলি পিছু কিছু কয়লা আর কেরোসিন তেল মফতি দেবার অর্ডার হোক।
— আচ্ছা তাই হবে। সিণ্ডিকেটের সাহেবরাও তাকে কথা দেয়।
দুলালের আমন্ত্রণ পেয়ে একদিন রাজ্যের কুর্মি একত্রিত হলো ঘোড়ানিমের জঙ্গলে। পাকাচুলে ভরা মাথা থেকে পাগড়িটা খুলে হাতে নিয়ে দুলাল দাঁড়ালো — আজ আমাদের মণ্ডলের প্রতিষ্ঠা হলো। এখন ভাবো কি করা উচিত। চিনে দেখ, কে আমাদের দুশমন আর কেই বা দোস্ত। আর ভয় করলে চলবে না। পেট আর ইজ্জত, এর ওপর যে ছুরি চালাতে আসবে তাকে আর কোন মতেই ক্ষমা নয়।
তারপর ধীরে একটা ব্যাঙ্ক, ক্রমে একটা ট্যানারী আর কাগজের মিল। রাজকোষের সে অকিঞ্চনতা আর নেই। এই তো শুভ মাহেন্দ্রক্ষণ! শিল্পীর তুলির আঁচড়ের মত এক এক এস্টিমেটে সে অঞ্জনগড়ের রূপ ফিরিয়ে দেবে। সে দেখিয়ে দেবে — রাজ্যশাসন লাঠিবাজি নয়, এও একটা আর্ট।
ভাঙা শঙ্খের মত দুলালের স্থবির কণ্ঠনালীটা অতিরিক্ত উত্সাহে কেঁপে কেঁপে আওয়াজ ছাড়ে — ভাই সব, আজ থেকে এ মাহাতোর প্রাণ মণ্ডলের জন্য, আর মণ্ডলের প্রাণ………।
কুর্মি জনতা একসঙ্গে হাজার লাঠি তুলে প্রত্যুত্তর দিল — মাহাতোর জন্য।
ঢাক ঢোল পিটিয়ে একটা নিশান পর্যন্ত উড়িয়ে দিল তারা। তারপর যে যার ঘরে ফিরে গেল।
ঘটনাটা যতই গোপনে ঘটুক না কেন, মুখার্জীর কিছু জানতে বাকি রইল না। এটুকু সে বুঝল — এই মেঘেই বজ্র থাকে। সময় থাকতে চটপট একটা ব্যবস্থা দরকার। কিন্তু মহারাজ যেন ঘুণাক্ষরেও জানতে না পান। ফিউডল দেমাকে অন্ধ আর ইজ্জত কমপ্লেক্সে জর্জর এই সব নরপালদের তা হলে সামলানো দুষ্কর হবে। বৃথা একটা রক্তপাতও হয়তো হয়ে যাবে। তার চেয়ে নিজেই একহাত ভদ্রভাবে লড়ে নেওয়া যাক।
পেয়াদারা এসে মহারাজাকে জানালো — কুর্মিরা রাজবাড়ির বাগানে আর পোলো লনে বেগার খাটতে এল না। তারা বলেছে — বিনা মজুরীতে খাটলে পাপ হবে; রাজ্যের অমঙ্গল হবে।
ডাক পড়ল মুখার্জীর। দুলাল মাহাতোকেও তলব করা হলো। জোড় হাতে দুলাল মাহাতো প্রণিপাত করে দাঁড়ালো। মেষশিশুর মত ভীরু, দুলাল যেন ঠক্ ঠক্ করে কাঁপছে!
— তুমিই এসব শয়তানী করছ ? মহারাজ বললেন।
— হুজুরের জুতোর ধুলো আমি।
— চুপ থাক।
— জী সরকার।
— চুপ! মহারাজা জীমূতধ্বনি করলেন। দুলাল কাঠের পুতুলের মত স্থির হয়ে গেল। মহারাজা বললেন— বিলাতী বেনিয়াদের সঙ্গে তোমার সম্পর্ক ছাড়তে হবে। আমার বিনা হুকুমে কোন কুর্মি খনিতে কুলি খাটতে পারবে না।
— জী সরকার। আপনার হুকুম আমার জাতকে জানিয়ে দেবো।
— যাও।
দুলাল দণ্ডবৎ করে চলে গেল। এবার আদেশ হলো মুখার্জীর ওপর। সিণ্ডিকেটকে এখুনি নোটিস দাও, যেন আমার বিনা সুপারিশে আমার কোন কুর্মি প্রজাকে কুলির কাজে ভর্তি না করে।
অবিলম্বে যথাস্থান থেকে উত্তর এল একে একে। দুলাল মাহাতোর স্বাক্ষরিত পত্র। — যেহেতু আমরা নগদ মজুরী পাই, না পেলে আমাদের পেট চলবে না, সেইহেতু আমরা খনি সাহেবদের কথা মানতে বাধ্য। আশা করি দরবার এতে বাধা দেবেন না। …..আগামী মাসে আমাদের নতুন মন্দির প্রতিষ্ঠা হবে। রাজ তহবিল থেকে এক হাজার টাকা মঞ্জুর করতে সরকারের হুকুম হয়।………আগামী শীতের সময়ে বিনা টিকিটে জঙ্গলের ঝুরি আর লকড়ি ব্যবহার করার অনুমতি হয়।
নোটিসের প্রত্যুত্তরে সিণ্ডিকেটেরও একটা জবাব এল — মহারাজার সঙ্গে কোন নতুন শর্তে চুক্তিবদ্ধ হতে আমরা রাজি আছি। তবে আজ নয়। বর্তমান চুক্তির মেয়াদ যখন ফুরোবে — নিরানব্বই বছর পরে।
— কী রকম বুঝছ মুখার্জী? অগত্যা দেখছি ফৌজদারকেই ডাকতে হয়। জিজ্ঞাসা করি, খাল-কাটার স্বপ্নটা ছেড়ে দিয়ে এখন আমার ইজ্জতের কথাটা একবার ভাববে কি না?
মহারাজ আস্তে আস্তে বললেন বটে, কিন্তু মুখ-চোখের চেহারা থেকে বোঝা গেল, একটা আক্রোশ শত ফণা বিস্তার করে তাঁর মনের ভেতর ফুঁসে ফুঁসে ছটফট করছে।
মুখার্জী সবিনয়ে নিবেদন করে — মন খারাপ করবেন না সরকার। আমাকে সময় দিন, সব গুছিয়ে আনছি আমি।
মুখার্জী বুঝেছে দুলালের এই দুঃসাহসের প্রেরণা যোগাচ্ছে কারা। সিণ্ডিকেটের দুষ্ট উত্সাহেই কুর্মিসমাজের এই নাচানাচি। এই অশুভযোগ ছিন্ন না করে দিলে রাজ্যের সমূহ অশান্তি — অমঙ্গলও। কিন্তু কি করা যায়!
দুলালের আমন্ত্রণ পেয়ে একদিন রাজ্যের কুর্মি একত্রিত হলো ঘোড়ানিমের জঙ্গলে। পাকাচুলে ভরা মাথা থেকে পাগড়িটা খুলে হাতে নিয়ে দুলাল দাঁড়ালো — আজ আমাদের মণ্ডলের প্রতিষ্ঠা হলো। এখন ভাবো কি করা উচিত। চিনে দেখ, কে আমাদের দুশমন আর কেই বা দোস্ত। আর ভয় করলে চলবে না। পেট আর ইজ্জত, এর ওপর যে ছুরি চালাতে আসবে তাকে আর কোন মতেই ক্ষমা নয়।
দুলাল মাহাতোর কুঁড়ের কাছে মুখার্জী এসে দাঁড়ালো। দুলাল ব্যস্ত ভাবে বের হয়ে এসে একটা চৌকি এনে মুখার্জীকে বসতে দিল। মাথার পাগড়িটা খুলে মুখার্জীর পায়ের কাছে রেখে দুলালও বসলো মাটির ওপর। মুখার্জী এক এক করে তাকে সব বুঝিয়ে বলে। যেন একটা অভিমানের সুরে মুখার্জীর গলার স্বর ভেঙে পড়ে — একি করছো মাহাতো! দরবারের ছেলে তোমরা, কখনো ছেলে দোষ করে কখনো বাপ। তাই বলে পরকে ডেকে কেউ ঘরের ইজ্জত নষ্ট করে না। সিণ্ডিকেট আজ তোমাদের ভাল খাওয়াচ্ছে, কিন্তু কাল যখন তার কাজ ফুরোবে তখন তোমাদের দিকে ফিরেও তাকাবে না। এই দরবারই তখন দুমুঠো চিড়ে দিয়ে তোমাদের বাঁচাবে।
মুখার্জীর পায়ে হাত রেখে দুলাল বলে — কসম, এজেন্ট বাবা, তোমার কথা রাখব। বাপের তুল্য মহারাজা, তাঁর জন্য আমরা জান দিতে তৈরী। তবে ঐ দরখাস্তটা একটু জলদি জলদি মঞ্জুর হয়।
দ্বিতীয় প্রশ্ন বা উত্তরের অপেক্ষা না করে মুখার্জী দুলালের কুঁড়ে থেকে বেরিয়ে পড়ে — নাঃ, রোগে তো ধরেই ছিল অনেক দিন; এবার দেখা দিয়েছে বিকারের লক্ষণ।
স্নান আহার আর পোশাক বদলাবার কথা মুখার্জীকে ভুলতে হলো আজ। একটানা ড্রাইভ করে থামলো এসে সিণ্ডিকেটের অফিসে।
— দেখুন মিস্টার গিবসন, রাজা-প্রজা সম্পর্কের ভেতর দয়া করে হস্তক্ষেপ করবেন না আপনারা। আপনাদের কারবারের জন্য যে-কোন সুবিধা দরবারের কাছে আবেদন করলেই তো পেয়ে যাবেন।
গিবসন বললেন — মিস্টার মুখার্জী, আমরা মনিমেকার নই, আমাদের একটা মিশনও আছে। নির্যাতিত মানুষের পক্ষ নিয়ে আমরা চিরকাল লড়ে এসেছি। দরকার থাকে, আরো লড়বো।
— সব কুর্মি প্রজাদের লোভ দেখিয়ে আপনারা কুলি করে ফেলেছেন। স্টেটের এগ্রিকালচার তাহলে কি করে বাঁচে বলুন তো!
ঝোঁকের মাথায় মুখার্জী তার ক্ষোভের আসল কারণ ব্যক্ত করে ফেললো।
— এগ্রিবালচার না বাঁচুক, ওয়েল্থ্ তো বাঁচবে। এটা অস্বীকার করতে পারেন? গিবস বিদ্রুপের স্বরে উত্তর দেয়।
— তর্ক ছেড়ে কো-অপারেশনের কথা ভাবুন, মিস্টার গিবসন। কুলি ভর্তির সময় দরবার থেকে একটু অনুমোদন করিয়ে নেবেন, এই মাত্র। মহারাজাও খুশি হবেন এবং তাতে আপনাদেরও অন্য দিকে নিশ্চয় ভাল হবে।
— সরি, মিস্টার মুখার্জী! গিবসন বাঁকা হাসি হেসে চুরুট ধরালেন।
নিদারুণ বিরক্তিতে লাল হয়ে উঠল মুখার্জীর কর্মমূল। সজোরে চেয়ারটা ঠেলে দিয়ে দাঁড়ায় মুখার্জী। আর সেই মুহূর্তে অফিস ছেড়ে চলে যায়।
ম্যাককেনা এসে জিজ্ঞাসা করলেন — কি ব্যাপার গিবসন?
— মুখার্জী, দ্যাট মংকি অব অ্যান অ্যাডমিনিস্ট্রের, ওকে মুখের ওপর শুনিয়ে দিয়েছি। কোন টার্মই গ্রাহ্য করিনি।
— ঠিক করেছ। শুনেছ তো ওর ঐ ইরিগেশন স্কিমটার কথা? সময় থাকতে ওই স্কিম ভণ্ডুল করে দিতে হবে, নইলে সাংঘাতিক লেবারের অভাবে পড়তে হবে। কারবার এখন বাড়তির মুখে, খুব সাবধান।
— কোন চিন্তা নেই। পোষা বিড়াল মাহাতো রয়েছে আমাদের হাতে। ওকে দিয়েই স্টেটের সব ডিজাইন ভণ্ডুল করবো।
পরস্পর হাস্য বিনিময় করে ম্যাককেনা বলেন — মাহাতো এসে বসে আছে যে; ওকে ডেকে নিয়ে এস, আর সেই কাজটা এবার সেরেই ফেল।
মুখার্জী সবিনয়ে নিবেদন করে — মন খারাপ করবেন না সরকার। আমাকে সময় দিন, সব গুছিয়ে আনছি আমি।
যেন একটা অভিমানের সুরে মুখার্জীর গলার স্বর ভেঙে পড়ে — একি করছো মাহাতো! দরবারের ছেলে তোমরা, কখনো ছেলে দোষ করে কখনো বাপ। তাই বলে পরকে ডেকে কেউ ঘরের ইজ্জত নষ্ট করে না। সিণ্ডিকেট আজ তোমাদের ভাল খাওয়াচ্ছে, কিন্তু কাল যখন তার কাজ ফুরোবে তখন তোমাদের দিকে ফিরেও তাকাবে না। এই দরবারই তখন দুমুঠো চিড়ে দিয়ে তোমাদের বাঁচাবে।
সিণ্ডিকেটের অফিসের পিছনের দরজার কাছে বসে ছিল মাহাতো। অফিসের একটা নিভৃত কামরায় মাহাতোকে নিয়ে গিয়ে গিবসন বলে — এই যে, দরখাস্ত তৈরি। সব কথা লেখা আছে এতে। সই করে ফেল; আজই দিল্লীর ডাকে পাঠিয়ে দেব।
সই করে মাহাতো। মাহাতোর পিঠ থাবড়ে ম্যাককেনা তাকে বিদায় দিল — ডরো মৎ মাহাতো, আমরা আছি। যদি ভিটে-মাটি উত্খাত করে, তবে আমাদের ধাওড়া খোলা থাকবে তোমাদের জন্য সব সময়, ডরো মৎ।
নিজের দপ্তরে বসে মুখার্জী শুধু আকাশপাতাল ভাবে। কলম ধরতে আর মন চায় না। মহারাজাকে আশ্বাস দেবার মত সব কথা ফুরিয়ে গেছে তার। পরের রথের সারথ্য আর বোধহয় চলবে না তার দ্বারা। এইবার রথীর হাতেই তুলে দিতে হবে লাগাম। কিন্তু মানুষগুলির মাথার ঘিলু নিশ্চয়ই শুকিয়ে গেছে সব। সবাই নিজের নিজের মূঢ়তায় — একটা আত্মবিশ্বাসের উত্কট কল্পনাতাণ্ডবে মজে আছে যেন। কিংবা সেই ভুল করেছে কোথাও।
মহারাজা আহ্বাণ, খাস কামরায়।
সচিবোত্তম ও ফৌজদার শুষ্কমুখে বসে আছেন। মহারাজা কৌচের চারিদিক পায়চারি করছেন ছটফট করে। মুখার্জী ঢুকতেই একেবারে অগ্ন্যুদ্গার করলেন।
নাও, এবার গদিতে থুথু ফেলে আমি চললাম। তুমিই বসো তার ওপর আর স্টেট চালিও।
হতভম্ভ মুখার্জী সচিবোত্তমের দিকে তাকায়। মুখার্জীর হাতে সচিবোত্তম তখুনি তুলে দিলেন একটি চিঠি। পলিটিক্যাল এজেন্টের নোট। — স্টেটের ইন্টার্নাল ব্যাপার সম্বন্ধে বহু অভিযোগ এসেছে। দিন দিন আরো নতুন ও গুরুতর অভিযোগ সব আসছে। আমার হস্তক্ষেপের পূর্বে, আশা করি, দরবার শীঘ্রই সুব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে সমর্থ হবে।
ফৌজদার একটু ভ্রূকুটি করে বললেন — এই সবের জন্য আপনার কনসিলিয়েশন পলিসিই দায়ী, এজেন্ট সাহেব।
ফৌজদারের অভিযোগের সূত্র ধরে মহারাজা চীত্কার করে উঠলেন — নিশ্চয়, খুব সত্যি কথা। আমি সব জানি মুখার্জী। আমি অন্ধ নই।
— সব জানি? এ কি বলছেন সরকার?
— থামো, সব জানি। নইলে আমার রাজ্যের ধূলোমাটি বেচে যে বেনিয়ারা পেট চালায়, তাদের এত সাহস হয় কোথা থেকে! কে তাদের ভেতর ভেতর সাহস দেয়?
মহারাজা যেন দমবন্ধ করে কৌচের উপর এলিয়ে পড়লেন। একটা পেয়াদা ব্যস্তভাবে ব্যজন করে তাঁকে সুস্থ করতে থাকে। সচিবোত্তম ফৌজদার আর মুখার্জী, ভিন্ন ভিন্ন দিকে মুখ ফিরিয়ে বোবা হয়ে বসে রইল।
গলা ঝেড়ে নিয়ে মহারাজা আবার কথা পাড়লেন — ফৌজদার সাহেব, এবার আপনিই আমার ইজ্জত বাঁচান।
সচিবোত্তম বলেন — তাই হোক্, কুর্মিদের আপনি সায়েস্তা করুন ফৌজদার সাহেব, আর আমি সিণ্ডিকেটকে একটা সিভিল সুটে ফাঁসাচ্ছি। চেষ্টা করলে কন্ট্রাক্টের মধ্যে এমন বহু ফাঁক পাওয়া যাবে।
মহারাজা মুখার্জীর দিকে চকিতে তাকিয়ে মুখ ঘুরিয়ে নিলেন। কিন্তু মুখার্জী এরই মধ্যে দেখে ফেলেছে, মহারাজার চোখ দুটো ভেজা ভেজা।
সিংহের চোখে জল। এর পেছনে কতখানি অন্তর্দাহ লুকিয়ে আছে, তা স্বভাবত শশক হলেও মুখার্জী আন্দাজ করে নিতে পারে। সত্যিই তো, এ দিকটা তার এতদিন চোখে পড়েনি। তার ভুল হয়েছে। মহারাজার সামনে এগিয়ে গিয়ে সে শান্তভাবে তার শেষ কথাটা জানালো। — আমার ভুল হয়েছে সরকার। এবার আমায় ছুটি দিন। তবে আমায় যদি কখনো ডাকেন, আমি আসবই।
মহারাজা মুহূর্তের মধ্যে একেবারে নরম হয়ে গেলেন — না, না মুখার্জী, কি যে বলো! তুমি আবার যাবে কোথায়? অনেকে অনেক কিছু বলেছে বটে, কিন্তু আমি তা বিশ্বাস করি না। তবে পলিসি বদলাতেই হবে; একটু কড়া হতে হবে। ব্যাঙের লাথি আর সহ্য হয় না, মুখার্জী।
শীতের মরা মেঘের মত একটা রিক্ততা, একটা ক্লান্তি যেন মুখার্জীর হাতপায়ের গাঁটগুলোকে শিথিল করে দিয়েছে। দপ্তরে যাওয়া ছেড়ে দিয়েছে। সে শুধু বিকেল হলে, ব্রিচেস চড়িয়ে বয়ের কাঁধে দু’ডজন ম্যালেট চাপিয়ে পোলো লনে উপস্থিত হয়। সমস্তটা সময় পুরো গ্যালপে ক্ষ্যাপা ঝড়ের মত খেলে যায়। ডাইনে বাঁয়ে বেপরোয়া আণ্ডার-নেক হিট চালায়। কড় কড় করে এক একটা ম্যালেট ভেঙে উড়ে যায় ফালি হয়ে। মুখের ফেনা আর গায়ের ঘামের স্রোতে ভিজে ঢোল হয়ে যায় কালো ওয়েলারের পায়ের ফ্লানেল। তবু স্কোরের নেশায় পাগল হয়ে মুখার্জী চার্জ করে। বিপক্ষদল ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে অতি মন্থর ট্রটে ঘুরে ঘুরে আত্মরক্ষা করে। চক্ক শেষ হবার পরেও বিশ্রাম করার নাম করে না মুখার্জী। ক্যান্টারে ঘোড়া ছুটিয়ে সারা পোলো লনটাকে বিদ্যুদ্বেগে পাক দিয়ে বেড়াতে থাকে। রেকাবে ভর দিয়ে মাঝে মাঝে চোখ বুঁজে দাঁড়িয়ে থাকে — বুক ভ’রে যেন স্পীড পান করে।
খেলা শেষে মহারাজা অনুযোগ করেন — বড় রাফ খেলা খেলছো মুখার্জী।
অন্যান্য ধাওড়া থেকে দলে দলে কুলিরা দৌড়ে আসছিল। মাঝ পথেই দারোয়ানরা তাদের ফিরিয়ে দিয়েছে। —কাজে যাও সব, কিছু হয়নি। কেউ ঘায়েল হয়নি, মরেনি কেউ।
মার্চেন্টরা দল পাকিয়ে অন্ধকারে একটু দূরে দাঁড়িয়ে চাপা গলায় আলোচনা করছেন। গিবসন বলেন —মাটি দিয়ে ভরাট করবার উপায় নেই, এখনো দু’দিন ধরে ধসবে। হাজিরা বইটা পুড়িয়ে আজ নতুন একটা তৈরি করে রাখ। অন্তত একশো নাম কমিয়ে দাও।
সেদিনও সন্ধ্যের আগে নিয়মিত সূর্যাস্ত হলো অঞ্জনগড়ের পাহাড়ের আড়ালে। মহারাজা সাজগোজ করে খেলার মাঠে যাবার উদ্যোগ করছেন। পেয়াদা একটা খবর নিয়ে এল — চৌদ্দ নম্বরের পীট ধসেছে, এখনো ধসছে। নব্বই জন পুরুষ আর মেয়ে কুর্মি কুলি চাপা পড়েছে।
— অতি সুসংবাদ! মহারাজা গালপাট্টায় হাত বুলিয়ে উত্কট আনন্দের বিস্ফোরণে চেঁচিয়ে উঠলেন। —সচিবোত্তম কোথায়? কোই হ্যায়? শীগগির ডাক, সিণ্ডিকেটের দেমাক এইবার গুঁড়ো করবো।
— হুকুম করুন সরকার; একজন চাপরাশি এসে কাছে দাঁড়ায়।
চেঁচিয়ে ওঠেন মহারাজা। — সচিবোত্তম, তার মানে আমাদের বুড়ো দেওয়ান সাহেব, তাঁকে শীগগির একবার ডাক। সিণ্ডিকেটের দেমাক এইবার গুঁড়ো করবো।
সচিবোত্তম এলেন, কিন্তু মরা কাতলা মাছের মত দৃষ্টি তাঁর চোখে। বললেন — দুঃসংবাদ!
— কিসের দুঃসংবাদ?
— বিনা টিকিটে কুর্মিরা লকড়ি কাটছিল। ফরেস্ট রেঞ্জার বাধা দেয়। তাতে রেঞ্জার আর গার্ডদের কুর্মিরা মেরে তাড়িয়ে দিয়েছে।
— তারপর? — মহারাজার চোয়াল দুটো কড় কড় করে বেজে উঠল।
— তারপর ফৌজদার গিয়ে গুলি চালিয়েছে। ছর্রা ব্যবহার করলেই ভাল ছিল! তা না করে চালিয়েছে মুঙ্গেরী গাদা আর দেড় ছটাকী বুলেট। মরেছে বাইশ জন আর ঘায়েল পঞ্চাশের ওপর। ঘোড়ানিমের জঙ্গলে সব লাশ এখনো ছড়িয়ে পড়ে আছে।
মহারাজা বিমূঢ় হয়ে তাকিয়ে রইলেন খানিকক্ষণ। তাঁর চোখের সামনে পলিটিক্যাল এজেন্টের নোটটা যেন চকচকে সূচীমুখ বর্শার ফলার মত ভেসে বেড়াতে থাকে।
— খবরটা কি রাষ্ট্র হয়ে গেছে?
— অন্তত সিণ্ডিকেট তো জেনে ফেলেছে। — সচিবোত্তম উত্তর দিলেন।
মুখার্জীকে ডাকলেন মহারাজা। — এই তো ব্যাপার মুখার্জী। এইবার তোমার বাঙালী ইলপ্ দেখাও; একটা রাস্তা বাতলাও।
একটু ভেবে নিয়ে মুখার্জী বলে — আর দেরী করবেন না। সব ছেড়ে দিয়ে মাহাতোকে আগে আটক করে ফেলুন।
জন পঞ্চাশ পেয়াদা সড়কি লাঠি লণ্ঠন নিয়ে অন্ধকারে দৌড় দিয়ে দুলালের ঘরের দিকে ছুটে চলে যায়।
মুখার্জী বলে — আমার শরীর ভাল নয় সরকার, কেমন গা বমি-বমি করছে। আমি যাই।
চৌদ্দ নম্বরের পিট ধসেছে। মার্চেন্টরা খুবই ঘাবড়ে গিয়েছে। তৃতীয় সীমের ছাদা ভাল করে টিম্বার করা ছিল না, তাতেই এই দুর্ঘটনা। উর্ধ্বোৎক্ষিপ্ত পাথরের কুচি আর ধূলোর সঙ্গে রসাতল থেকে যে একটা আর্তনাদ থেমে থেমে বেরিয়ে আসছে — বুম্ বুম্ বুম্। কোয়ার্সের পিলারগুলো চাপের চোটে তুবড়ির মত ধূলো হয়ে ফেটে পড়েছে। এরই মধ্যে কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে পীটের মুখটা ঘিরে দেওয়া হয়েছে।
রাত দুপুরে অন্ধকারের মধ্যে আবার চৌদ্দ নম্বর পীটের কাছে মোটর গাড়ি আর মানুষের একটা ভীড়। ফৌজদারের গাড়ির ভেতর থেকে দারোয়ানেরা কম্বলে মোড়া দুলাল মাহাতোর লাশটা টেনে নমালো। ঘোড়ানিমের জঙ্গল থেকে ট্রাক বোঝাই লাশ এল আরো। ক্ষুধার্ত খনির গহ্বরের মুখে লাশগুলি তুলে নিয়ে দারোয়ানেরা ভুজ্যি চড়িয়ে দিল একে একে।
অন্যান্য ধাওড়া থেকে দলে দলে কুলিরা দৌড়ে আসছিল। মাঝ পথেই দারোয়ানরা তাদের ফিরিয়ে দিয়েছে। —কাজে যাও সব, কিছু হয়নি। কেউ ঘায়েল হয়নি, মরেনি কেউ।
মার্চেন্টরা দল পাকিয়ে অন্ধকারে একটু দূরে দাঁড়িয়ে চাপা গলায় আলোচনা করছেন। গিবসন বলেন —মাটি দিয়ে ভরাট করবার উপায় নেই, এখনো দু’দিন ধরে ধসবে। হাজিরা বইটা পুড়িয়ে আজ নতুন একটা তৈরি করে রাখ। অন্তত একশো নাম কমিয়ে দাও।
ম্যাককেনা বলেন — তাতে আর কি লাভ হবে? দি মহারাজার কানে পৌঁছে গেছে সব। তা ছাড়া, দ্যাট মাহাতো, তাকে বোঝাব কি দিয়ে? কালকের সকালেই শহরের কাগজগুলো খবর পেয়ে যাবে আর পাতা ভরে স্ক্যাণ্ডাল ছড়াবে দিনের পর দিন। তারপর আসবেন একটি এনকোয়ারী কমিটি, একটা গান্ধিয়াইট বদমাশও বোধহয় তার মধ্যে থাকবে। বোঝ ব্যাপার?
সে রাতে ক্লাবঘরে আর আলো জ্বললো না! একসঙ্গে একশো ইলেকট্রিক ঝাড়ের আলো জ্বলে উঠল প্যালেসের একটি প্রকোষ্ঠে। আবার ডাক পড়ল মুখার্জীর।
অভূতপূর্ব দৃশ্য! মহারাজা, সচিবোত্তম আর ফৌজদার — গিবসন, ম্যাককেনা, মূর আর প্যাটার্সন! সুদীর্ঘ মেহগনি টেবিলে গোলাস আর ডিকেন্টারের ঠাসাঠাসি।
সুস্মিতবদনে মহারাজা মুখার্জীকে অভ্যর্থনা করলেন — মাহাতো ধরা পড়েছে মুখার্জী। ভাগ্যিস সময় থাকতে বুদ্ধিটা দিয়েছিলে।
গিবসন সায় দিয়ে বলে — নিশ্চয়, অনেক ক্লামজি ঝঞ্ঝাট থেকে বাঁচা গেল। আমাদের উভয়ের ভাগ্য ভাল বলতে হবে।
এ বৈঠকের সিদ্ধান্ত ও আশু কর্তব্য কি নির্ধারিত হয়ে গেছে, ফৌজদার সেটা মুখার্জির কানে কানে সংক্ষেপে শুনিয়ে দিল। নিরুত্তর মুখার্জী চমকে ওঠে, ফ্যাকাশে হয়ে যায় মুখ। তারপর শুধু হাতের চেটোয় মুখ গুঁজে বসে থাকে।
গিবসন মুখার্জী পিঠ ঠুকে বলে — এসব কাজে একটু শক্ত হতে হয় মুখার্জী, নার্ভাস হবেন না।
রাত দুপুরে অন্ধকারের মধ্যে আবার চৌদ্দ নম্বর পীটের কাছে মোটর গাড়ি আর মানুষের একটা ভীড়। ফৌজদারের গাড়ির ভেতর থেকে দারোয়ানেরা কম্বলে মোড়া দুলাল মাহাতোর লাশটা টেনে নমালো। ঘোড়ানিমের জঙ্গল থেকে ট্রাক বোঝাই লাশ এল আরো। ক্ষুধার্ত খনির গহ্বরের মুখে লাশগুলি তুলে নিয়ে দারোয়ানেরা ভুজ্যি চড়িয়ে দিল একে একে।
শ্যাম্পেনের পাতলা নেশা আর চুরুটের ধোঁয়ায় ছলছল করছিল মুখার্জীর চোখ দুটো। গাড়ির বাম্পারের ওপর এলিয়ে বসে চৌদ্দ নম্বর পীটের দিকে তাকিয়ে সে ভাবছিল অন্য কথা। অনেক দিন পরের একটা কথা।
লক্ষ বছর পরে, এই পৃথিবীর কোন একটা জাদুঘরে, জ্ঞানবৃদ্ধ প্রত্নতাত্ত্বিকের দল উগ্র কৌতূহলে স্থির দৃষ্টি মেলে দেখছে কতগুলি ফসিল! অর্ধপশুগঠন, অপরিণতমস্তিষ্ক ও আত্মহত্যাপ্রবণ তাদের সাব-হিউম্যান শ্রেণীর পিতৃপুরুষের শিলীভূত অস্থিকঙ্কাল, আর ছেনি হাতুড়ি গাঁইতা; কতগুলি লোহার ক্রুড কিম্ভূত হাতিয়ার। অনুমান করছে তারা, প্রাচীন পৃথিবীর একদল হতভাগ্য মানুষ বোধহয় একদিন আকস্মিক কোন ভূ-বিপর্যয়ে কোয়ার্স আর গ্রানিটের গহ্বরে সমাধিস্থ হয়ে গিয়েছিল। তারা দেখেছে, শুধু কতগুলি সাদা সাদা ফসিল, তাতে আজকের এই এত লাল রক্তের কোন দাগ নেই!
সমাপ্ত
অলংকরণ : রাজীব রায়