অক্ষরবন্দী জীবন-১
বইয়ের গন্ধ
ছোটবেলায় সবচেয়ে আকর্ষণীয় বস্তু ছিল ‘আলিস্কো বিস্কুট’ আর ‘গল্পের বই’। এই জীবনে যত বই পড়বার কথা ছিল, তত বই যেমন আমার পড়া হয়নি, তেমনি ডাক্তারি নিষেধাজ্ঞায় বিস্কুট জাতীয় খাবারও কমিয়ে দিতে হয়েছে। তবে স্মৃতিরানি যথেষ্ট প্রতারণা করলেও অনেক বই পাঠের কথাই বেশ মনে করতে পারি। কিছু কিছু বই পাঠের পর ইদানিং পাঠ প্রতিক্রিয়া লেখার অভ্যাসও হয়েছে। বাসার বইপত্রের অধিকাংশই ছিল বাবা-মার বিয়ের ‘প্রীতি উপহার’– অধুনালুপ্ত সেকালের নভেল। আর লঞ্চ-স্টিমার যাত্রা বা রেলযাত্রায় বাবা কিনতেন আশুতোষ- নিমাই -ফাল্গুনীর চিতা বহ্নিমান কিংবা প্রিয় বান্ধবী। সে সব বই নাড়াচাড়া করতে করতে হয়তোবা পড়ে ফেলতাম আমি সিআইএ’র এজেন্ট নামের কোনো বই। আর প্রীতি উপহারের সেই তাক থেকে প্রথম পড়তে চেষ্টা করেছিলাম নজরুল কাব্য সঞ্চয়ন নামের বেগুনি রঙের কাপড়ে বাঁধাই করা নজরুলের বাছাই কবিতাই বই। ক্লাশ টু- থ্রিতে তো আর ‘তোরা সব জয়ধ্বনি কর,’ ‘ঐ খেপেছে পাগলি মায়ের দামাল ছেলে কামাল ভাই’ কিংবা বিদ্রোহীর মতো কবিতা নীরবে পাঠ করার সংযম অর্জিত হয়নি; সরব পাঠ শুনে বাসায় বেড়াতে আসা প্রতিবেশিনীরা মাকে বলতেন, ‘এইসব হার্ড কবিতা পড়ে তো ছেলের ব্রেন নষ্ট হয়ে যাবে আপা!’ হায়, মা যদি সেদিন তাদের কথা শুনতেন!
একবার মা গেছেন এক সামাজিক অনুষ্ঠানে; ফিরতে দেরি দেখে বাবা নকশী কাঁথার মাঠ খুলে কিছুটা সরাসরি পড়ে আর কিছু বা গল্পের মতো বলে আমাকে জাগিয়ে রেখেছিলেন রাতের আহার পর্যন্ত, আর সেই থেকে রুপাই-সাজুর কাহিনী হৃদয়-কাদায় রোপিত হয়ে গেল। আরেক বারের কথা খুব ভাল মনে পড়ে। বার্ষিক পরীক্ষার পর দেশের বাড়ি গেলাম। আমি সিক্সে উঠব। বাবা আমাকে নিয়ে ফিরে এলেন সে বছর আমাকে ক্যাডেট কলেজে ভর্তি পরীক্ষা দিতে হবে বলে সময় নষ্ট না করে পড়ার টেবিলে ফেরত পাঠাতে। মা থাকলেন ছোট ভাইটিকে নিয়ে। ফেরার পথে জামালপুর বাস স্ট্যান্ডের একটি লাইব্রেরি থেকে আমার ক্লাস সিক্সের পাঠ্য বই কেনা হল। দোকানি আব্বাকে বুঝিয়ে সুজিয়ে নোটবইসহ গছিয়ে দিল – এক একটা বইয়ের সাথে নোট বই বের করছে আর বলছে, ‘ইংরাজি বই কি নোট ছাড়া পড়ড়া-হাবো?’ বাংলা আর ইংরেজির দ্রুত পঠনের বই দুটো আমার পছন্দ হয়েছিল কিন্তু ইংরেজিটায় এত মুদ্রণ প্রমাদ ছিল যে সদ্য ইংরেজি পড়তে শেখা ছাত্রের জন্য তা ছিল খুবই পীড়াদায়ক। মা ফেরার আগ পর্যন্ত আর স্কুল খোলার আগ পর্যন্ত পেলাম এক অবকাশ কিংবা নিঃসঙ্গতা। হয়তোবা নিঃসঙ্গতাকে চিনলাম প্রথমবার। বাংলা আর ইংরেজিতে সচিত্র বর্ণ পরিচয়ের ‘বই’ লিখে ফেললাম মোম রঙে এঁকে! সুতো দিয়ে বাঁধাইও করা হল। রীতিমত লেখক কাম প্রকাশক! বই পড়া আর আঁকাআঁকির বাইরে বায়োস্কোপ বানিয়ে বন্ধুদেরকে দেখাতাম- বড় একটা বাক্সের দুদিকে ছিদ্র করে পাটখড়িতে পেঁচিয়ে দেয়া হত রঙিন রঙিন ছবি। কারো কারো কাছ থেকে দশ পয়সা প্রবেশ মূল্যও নিয়েছি। সিনেমার ফিল্ম পেলে বাতির বিপরীতে আতস কাচে ধরে দেখতাম দেয়ালে সিনেমা দেখা যায় কীনা! কোনো কোনো দিন সলিমউদ্দিন বাবুর্চি এসে কলিজা ভুনা কিংবা গোলাপ জামের আয়োজন না করা পর্যন্ত বাবার হাতের আলু ভর্তা, ডিম আর ডালই ছিল সেই তপোবনের চর্ব-চোষ্য।
ক্লাশ সিক্স পর্যন্ত পড়েছি গ্রামের স্কুলে। একদিন মাস্টার আফাজউদ্দিন নামে এক তরুণ আমাদের ক্লাশে ক্লাশে এসে গল্প শোনালেন; আমাদের মাঝে বিক্রি করলেন দুঃখিনী মায়ের কান্না নামের নভেল। সেটাই ছিল জলজ্যান্ত একজন লেখককে সামনাসামনি প্রথম দেখা।
আমার নিজের সম্পত্তি ছিল গুটিকয়- একটা রূপকথার সংকলন আর ড. হাসান জামানের ছয়টা বর্গাকৃতি রঙিন শিশুতোষ বইয়ের সেট (চার খলিফার জীবনী, ঈদ আর রমজান নিয়ে সচিত্র বই)। এর পাশাপাশি বন্ধুর বাসা থেকে এনে পড়েছি বাঙ্গালীর হাসির গল্পের দুই খণ্ড। ছুটিতে ফুফার ঢাকার বাসায় বেড়াতে গেলে অরুণ- তরুণ ভাইদের রাশান বইয়ের বিশাল সংগ্রহ ঘাঁটাঘাঁটি করেও বেশ কিছু বই শিশুতোষ বই (মালাকাইটের ঝাঁপি, জ্যান্ত টুপি কিংবা নীল পাতা) পড়া হয়েছিল। আর বড়দের বইগুলো দেখে (দুনিয়া কাঁপানো দশ দিন) রোমাঞ্চিত হতাম। আমার ব্যক্তিগত সংগ্রহের বইগুলোর জন্য স্কুলের বন্ধু নয়ন- রহমান- মোশারফদের কাছ থেকে পাওয়া লাগসই প্রযুক্তিতে শিমুল কাঁটার গায়ে ইংরেজি এম এ এল অক্ষরগুলো খোদাই করে সীলমোহর বানিয়ে বইগুলোতে ছাপ দিয়ে রাখতাম। এম এ এল আর কিছু না- মোশতাক আহমদ লাইব্রেরি!
আজ এই অবসরে দুঃখিনী মায়ের কান্নার কথাও বলে ফেলি। ক্লাশ সিক্স পর্যন্ত পড়েছি গ্রামের স্কুলে। একদিন মাস্টার আফাজউদ্দিন নামে এক তরুণ আমাদের ক্লাশে ক্লাশে এসে গল্প শোনালেন; আমাদের মাঝে বিক্রি করলেন দুঃখিনী মায়ের কান্না নামের নভেল। সেটাই ছিল জলজ্যান্ত একজন লেখককে সামনাসামনি প্রথম দেখা। সে সময় আমাদের স্কুলের মাঠের সাজানো প্যাণ্ডেলে একদিন সারাক্ষণ পাইপ খেতে থাকা সৈয়দ আলী আহসানও এসেছিলেন সরকারি পরিচয়ে, তাঁর আসল পরিচয় জানা ছিল না সেদিন।
বইয়ের গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে ক্লাশ সেভেনে উঠে ক্যাডেট কলেজে ভর্তি হয়ে পেয়ে গেলাম অবিশ্বাস্য এক লাইব্রেরি! কিন্তু আফসোস, এই লেখার প্রথম লাইনটি আবারও বলতে হচ্ছে – সেখানে যত বই ছিল তার এক শতাংশও যদি পড়ে আসতে পারতাম!
পুনশ্চঃ আলিস্কো বিস্কুটের জন্য শোচনা আরও বেশি!
পরবর্তী পর্বে পড়ুন- প্রথম ঈদসংখ্যা