বরুণের ছবি ঘন্টাধ্বনি শোনায়
আনিসুল হক বরুণ, মূলত মঞ্চের মানুষ। মঞ্চের কাজেই সে বেশি সপ্রতিভ, বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে বলেই আমার ধারণা। অভিনয় থেকে শুরু করে নির্দেশনা, পাণ্ডুলিপি রচনা, সেট, লাইট, প্রপস, কোরিওগ্রাফি। কোথায় নেই বরুণ। মঞ্চের সর্বত্রই তার পদচারণা। সুবচনের ‘রূপবতী’ নাটকের মহড়ার সময় তার কাজ ও চিন্তা ধারার সাথে সম্যক পরিচয় ঘটে। সবসময় নতুন নতুন চিন্তায় সে অস্থির থাকে। চিন্তাগুলো কাজে প্রতিফলন ঘটানোর সুযোগ যে সবসময় ঘটে তা না, যখন ঘটে তখন সেটা বিচিত্র চিত্রের মতো দেখার একটা বিষয় হয়ে দাঁড়ায়।
রূপবতী নাটকের কোরিওগ্রাফি আমাদের মঞ্চনাটকের একটি উত্তম নিদর্শন হয়ে ইতিহাস আশ্রিত হয়ে আছে। বিশেষত ‘মানবসৃষ্ট চলমান রথ’ কোরিওগ্রাফির কিংবদন্তির মর্যাদা লাভ করেছে, বরুণের এই কাজটি। বরুণের শরীরের ভাষা এবং তার প্রয়োগ সবসময় ভিন্নমাত্রা পায়। মঞ্চের পোকা তার মগজে হেঁটে বেড়ায়, দংশন করে চলে। তার সঙ্গে সাক্ষাত হলেই নিত্য নতুন ভাবনার কথা নিয়ে দীর্ঘ দীর্ঘ আলাপে সময় পার হয়ে যায়। সে কথা বলে সর্বাঙ্গ দিয়ে, তার কণ্ঠস্বরকে সংগত দেয় তার ভ্রূ কপাল চুল আর রাজহংসের মতো দীর্ঘ গলা। সবচেয়ে বেশি সংগত দেয় তার চোখ। বরুণের চোখ হলো ধারালো, অস্থির। তার চোখ খুঁজে বেড়ায় সুন্দরকে, সংবেদনশীলতাকে, সম্ভাবনাকে। তার সত্যান্বেষী চোখ। মঞ্চভাবনাকে মাথার মধ্যে নিয়েই, সে চোখদুটোকে কাজ লাগায় অঙ্কুশের মতো, দৃশ্য ফুঁড়ে নতুন দৃশ্য তুলে আনার কাজে।
বরুণ এখানেই সার্থক যে তার ছবিগুলো তাকে ফাঁকি দিতে পেরেছে, শিরোনামের শৃঙ্খলা ভাঙতে পেরেছে, ফ্রেমের চৌবাচ্চা থেকে সমুদ্রসীমায় পৌঁছাতে পেরেছে। তার ছবিগুলো একই সাথে ফটোগ্রাফি, পেইন্টিং, পোয়েট্রি। বরুণের ছবিগুলো বরুণের নিত্য অনুসন্ধানী চোখের নৃত্যরত মেঘের পায়রা। তার চোখের অস্থিরতার জন্য মানবজাতির নতুন দৃষ্টিভঙ্গির উদ্বোধন হলো। জয়তু বরুণ। তোমার চোখ আরও বিচিত্র হয়ে উঠুক প্রেমে ও ফ্রেমে।
এই কাজ সে নিয়ত করে চলেছে। চোখের অঙ্কুশকে সে ইদানিং ক্যামেরার লেন্সের মধ্য দিয়ে ব্যবহার করেছে। তার ফলশ্রুতিতে আমরা দেখছি কিছু নতুনতর স্থিরচিত্র। নামে স্থিরচিত্র কিন্তু কার্যকারণে তার তুলে আনা চিত্রগুলো অস্থির। দর্শকের চোখের ভেতর দিয়ে মাথার মগজের ভেতর নতুন বা মৌলিক কম্পনাঙ্ক তৈরি করে। কারণ এমন সব চিত্রকে সে স্থিরতা দিয়ে ছেঁকে তুলেছে, যে ছবি আমরা আগে দেখিনি বা দেখার মানসিকতা আমাদের মধ্যে ছিল না। বরুণ সেই ছবিকেই তুলে এনেছে। তার ক্যামেরার ব্যবহার পেশাদার চিত্রগ্রাহকের মতো না, আলাদা। সেই আলাদার রকমটা সৃজনশীল, অনুসন্ধানী। আমরা ক্যামেরা দিয়ে ছবি তুলি মানুষের, বস্তুর, প্রকৃতির। তার ছবিতে বস্তুত কোনো দৃশ্য নেই, আবার আছে, পুরোপুরি দৃশ্য না, দৃশ্যের একটা দূরবর্তী দৃষ্টিকোণ, অদৃষ্টও বলা যায়। তবে যাই বলি না কেন, সেটা পূর্ণাঙ্গ কোনো দৃশ্য নয়। তাহলে কিসের ছবি তুলে বরুণ, সেই ছবির আবার এক্সিবিশন হচ্ছে জয়নুল আর্ট গ্যালারিতে, ঢাকা ইউনিভার্সিটির চারুকলায়। ২৪ এপ্রিল থেকে শুরু হয়েছে, বিরতিহীনভাবে চলবে ৭ মে পর্যন্ত। দুই সপ্তাহ যাবৎ বরুণের এই অচেনা ছবির বা স্থির চিত্র বা অস্থির চিত্রের প্রদর্শনী চলবে।
এই জগত নিত্য পরিবর্তনশীল, এবং গতিশীল। কোনো কিছু স্থির না, এবং সবকিছুই দৃষ্টিভঙ্গির উপর নির্ভরশীল। আপাত এবং এই আপেক্ষিকতাকে স্থিরতা দিয়ে বাঁধা যায় না। বরুণ তাই করেছে। সে ক্যামেরা দিয়ে ছবি তুলে এনেছে, কিন্তু সেগুলো স্থির নয়, ছবির সামনে দাঁড়ালে একরকম, একটু দূরত্বে দাঁড়ালে তার আকারের ভিন্নতা ধরা পড়ে বা পড়ে না, তবে ছবির ভেতর যে আলো ও ছায়ার বুনন তার হ্রাসবৃদ্ধি ঘটে যায়। তার ছবি মাটি বা গাছ বা কাঠ বা পানি বা দেয়াল বা কোনো বস্তুর একটা সময়ের খণ্ডরূপ যা একটা অখণ্ড প্রতিমূর্তিকে বা প্রতিচ্ছায়াকে বা প্রতিধ্বনিকে বিমূর্ততার মধ্য দিয়ে কখনো বাষ্পীভূত কখনো বিচূর্ণীভূত করে তোলে। তার প্রতিটি ছবি একটি কবিতার রূপ ধারণ করে। কবিতা যেমন রচিত হয় আচ্ছন্নতার ভাষায়, প্রগাঢ় নৈঃশব্দের আস্তরণে একটা একটা শব্দের উত্তরণ হয়, তারপর শব্দের কোলাহল থেকে উঠে আসে নিরাবেগ নেশার কম্পন, নিঃশ্বাসের সাথে জড়িয়ে যায় একটি নৃত্যরত জ্যোৎস্নার কয়েকটি পালক। বরুণের ছবিগুলো তাই। স্পষ্ট কোনো প্রহেলিকার দৃশ্যকে নির্দিষ্ট করে না, অনির্দিষ্ট, কেবলই অনির্দিষ্টের প্রতীকী ছায়া, অস্পষ্ট থেকে অস্পষ্টতর, কিন্তু ভেতরে একটা ঘন্টাধ্বনি বাজতে থাকে, এই ধ্বনিটাই বরুণের ছবির জন্য বিশিষ্ট।
বরুণ তার প্রদর্শিত প্রতিটি ছবিকে শিরোনাম দিয়ে আটকাতে চাইছে, কিন্তু শাব্দিক শিরোনামে তার ছবি আটকে নেই, শিরোনামকে তুচ্ছ করে শিরোনামহীন অনির্দিষ্ট গন্তব্যের দিকে ছুটে গেছে, বরুণের প্রতিটি ছবি তাই মুক্ত। বরুণের ছবি আর বরুণের নেই, অরুণ আলোয় তারা নিজস্ব ডানায় উড়ে যাচ্ছে আকাশ থেকে আকাশে, সীমারেখার বাইরে অন্য কোনো আকাশে, অন্য কোনো মেঘের দেশে, অন্য কোনো বৃষ্টির বদ্বীপে। যে সামান্য ফ্রেমের কাঠখোট্টায় বন্দি করার চেষ্টায়, বরুণ যে ছবিগুলোকে অনেক কষ্টে রোদে পুড়ে কি বৃষ্টিতে ভিজে কি শীতে অবশ হয়ে তুলেছে, সেসব ছবি বন্দিত্ব বরণ করেনি, তাদের নবীনবরণ হয়েছে, তাদের মুক্তি ঘটেছে, তারা উন্মুক্ত। বরুণ এখানেই সার্থক যে তার ছবিগুলো তাকে ফাঁকি দিতে পেরেছে, শিরোনামের শৃঙ্খলা ভাঙতে পেরেছে, ফ্রেমের চৌবাচ্চা থেকে সমুদ্রসীমায় পৌঁছাতে পেরেছে। তার ছবিগুলো একই সাথে ফটোগ্রাফি, পেইন্টিং, পোয়েট্রি। বরুণের ছবিগুলো বরুণের নিত্য অনুসন্ধানী চোখের নৃত্যরত মেঘের পায়রা। তার চোখের অস্থিরতার জন্য মানবজাতির নতুন দৃষ্টিভঙ্গির উদ্বোধন হলো। জয়তু বরুণ। তোমার চোখ আরও বিচিত্র হয়ে উঠুক প্রেমে ও ফ্রেমে।
২৭.০৪.২০১৯
আরো পড়তে পারেন
Content not found!
Please add specific content.