বাংলাদেশে চলচ্চিত্র নির্মাণ : স্বপ্নদোষ ও ভিক্ষাবৃত্তি
আমার বন্ধু রাসেল আহমেদ। প্রয়াত হয়েছে বছর হয়ে গেল। একটি সুস্থ ধারার এবং অসাম্প্রদায়িক বোধ সৃষ্টির লক্ষ্যে নির্মাণ করেছিল চলচ্চিত্র `নৃ’। বাংলাদেশের চলচ্চিত্র নির্মাণের প্রতিকূল আবহে রাসেল প্রথমে নিজের ভিটেবাড়ি বিক্রি করে নির্মাণকাজ শুরু করে। কাজ যখন অর্ধেক হয়েছে, তখন নির্মাণ জ্বালানিরূপী অর্থ প্রায় শেষ। রাসেল ভেবেছিল কাজটা শুরু হলে কোনো না কোনো গতি হবেই। কেউ না কেউ এগিয়ে আসবেই। বিশ্বাস থেকে স্বপ্ন দেখা শুরু হয়েছিল তার। সেই স্বপ্নদোষে অবশেষে বেছে নিতে হয় ভিক্ষাবৃত্তি। হ্যাঁ– ভিক্ষাবৃত্তিই তো ! এ দেশেও চলচ্চিত্রের মতো বিশাল আয়োজননির্ভর শিল্পে অর্থ লগ্নি হবে, যদি আপনি নষ্টদের খাতায় নাম লেখান। ভ্রষ্টদের সাথে মিশে কাজ করেন। যদি চলচ্চিত্রের উদ্দেশ্য হয় শুধু বিনোদিত হওয়া ও বিনোদিত করা।
কিন্তু রাসেল আহমেদরা চলচ্চিত্রকে বোধের জাগরণী হিসেবে বেছে নেন। চলচ্চিত্র তাদের কাছে শুধু বিনোদন নয়। কাজেই তাদের চলচ্চিত্রের ভাষা ও নন্দনতত্ত্ব স্বভাবতই ভিন্ন অথবা মেইনস্ট্রিমের ঠিক বাইরে না থাকলেও স্বতন্ত্র ধারায় প্রবাহিত। রাসেলদের নির্মাণস্বপ্ন তাই কখনোই মসৃণ হয় না। একটা সময় হাত পাততেই হয়। স্বপ্নদোষে ভিক্ষাবৃত্তি! তাতেও শেষ রক্ষা হয় না। ধারের বোঝা এতটাই অমানবিক হয়ে ওঠে– একটা সময়ে তা মানসিক আঘাত হানে অবিরত। সে আঘাতে মানবিক রাসেলরা অমানবিক পৃথিবীকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে চলে যায়।
একজন রাসেলই বর্তমান বাংলাদেশের সিনেমাশিল্প ও নির্মাণ আবহের নিখুঁত আখ্যান। এ দেশে সম্ভাবনাময় বহু তরুণ আছেন, যাদের বুকভরা স্বপ্ন। চলচ্চিত্র নির্মাণের স্বপ্ন। তাদের স্বপ্ন এবং গল্পগুলো হাজার-কোটি টাকা মূল্যের। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো, তারা অখ্যাত হওয়ার কারণে তাদের স্বপ্নগুলো মাথায় নিয়ে ঘুরতে হয় বছরের পর বছর। তারপর একদিন কবরে যেতে হয় স্বপ্নগুলো সাথে নিয়ে।
একজন রাসেলই বর্তমান বাংলাদেশের সিনেমাশিল্প ও নির্মাণ আবহের নিখুঁত আখ্যান। এ দেশে সম্ভাবনাময় বহু তরুণ আছেন, যাদের বুকভরা স্বপ্ন। চলচ্চিত্র নির্মাণের স্বপ্ন। তাদের স্বপ্ন এবং গল্পগুলো হাজার-কোটি টাকা মূল্যের। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো, তারা অখ্যাত হওয়ার কারণে তাদের স্বপ্নগুলো মাথায় নিয়ে ঘুরতে হয় বছরের পর বছর। তারপর একদিন কবরে যেতে হয় স্বপ্নগুলো সাথে নিয়ে। আর যারা সাহসী– তারা প্রতিকূলতার বিপরীতে যুদ্ধে নামেন। তাদের কেউ কেউ সফলও হন। বর্তমানে আমাদের মতো স্বপ্নদোষে দোষীরা চলচ্চিত্র নির্মাণ স্বপ্নে ভিক্ষাবৃত্তিতে নেমেছি। আর নির্মাণের পর নির্মিত চলচ্চিত্র নিয়ে হতে হয় ফেরিওয়ালা। প্রযোজক থেকে পরিবেশক ও প্রদর্শক পর্যন্ত সর্বত্রই নিগৃহীত এই স্বপ্নদোষে দোষীরা। তবু কি থেমে আছে তাদের স্বপ্ন! উত্তরটি হচ্ছে, না।
এই সময়েই গণ-অর্থায়নে নির্মিত হয়েছে চলচ্চিত্র ‘আদিম’। প্রদর্শিত হয়েছে চলচ্চিত্র ‘আহত ফুলের গল্প’। যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। নির্মাণযুদ্ধ। এ যুদ্ধে নাম লিখিয়েছি আমি নিজেও। লিখিয়েছেন ‘সাঁতাও’ নির্মাতা খন্দকার সুমন। কয়েক বছর ধরে ৪টি গল্প নিয়ে বিভিন্ন প্রযোজকের সাথে মিটিং করেছি। বোধে নাড়া দেওয়া গল্পগুলো কতটা বাণিজ্যিক হবে, প্রযোজকদের ভাবনা সেই দিকে। আমার গল্পকে এদিক-ওদিক করার প্রস্তাব করা হয়। আমি অনড়। আমার বোধই আমাকে লেখায়। আমি গল্পকে তার নিজস্বতা থেকে সরিয়ে নেওয়া মানে বোধকে অস্বীকার অথবা বোধকে বিক্রি করে দেওয়া।
দীর্ঘ ৪ বছর ধরে ছুটোছুটির পর অবশেষে আমিও ভিক্ষাবৃত্তির পথ বেছে নিলাম। ভিক্ষাবৃত্তি শব্দটায় অনেকেই আহত হতে পারেন। কিন্তু এর চেয়ে নির্মম বাস্তবতা আর কী হতে পারে! আমরা কতটুকু সফল হব, জানি না, তবে আমাদের স্বপ্ন আমাদের পথ চলতে শিখিয়েছে। থামব না আমরা। হয়তো নিঃশেষ হয়ে যাব রাসেলের মতো। একদিন হয়তো আমাদের এই ভিক্ষাবৃত্তিকে, আমাদের আত্মাহুতিকে সম্মান দেওয়া হবে। এই ভিক্ষাবৃত্তিই একদিন হয়তো ইতিতাস হবে। আমরা এ দেশের চলচ্চিত্রের ইতিহাসের হারানো গৌরবকে পুনরুদ্ধার করবই, আর পাশাপাশি আমাদের স্বপ্নগুলোর ওজন যারা আজ বুঝতে পারছে না, তাদের বুঝিয়ে ছাড়বই। আমরা বিশ্বাস করি, স্বপ্নের চেয়ে শক্তিশালী ও দৃঢ় কোনো কিছুই হতে পারে না। আমাদের চলচ্চিত্র একদিন পথ দেখাবে। আলোর পথ। মুক্তির পথ। জয় হোক বাংলা চলচ্চিত্রের। জয় হোক স্বপ্নের।