

বিনোদন নাকি বক্তব্য (পর্ব-১)
কয়েক দিন আগে আমার এক পুরোনো ছাত্রের সঙ্গে দেখা। ছেলেটার ফিল্ম সেন্স বেশ ভালো, তার মাথায় অহরহ দারুণ দারুণ সব কনসেপ্ট ঘোরে। কিন্তু সে এখন পর্যন্ত একটাও শর্টফিল্ম বানায়নি। কারণটা জানতে চাওয়াতে সে উত্তর দিল, ‘আমি আসলে ঠিক বুঝতেছি না আমার ১০ জনের জন্যে সিনেমা বানানো উচিত, নাকি ১০০ জনের জন্যে।’ অর্থাৎ বোদ্ধা দর্শকদের জন্যে নাকি সাধারণ দর্শকদের জন্য? অন্য কথায় আর্ট ফিল্ম বা বক্তব্যধর্মী নাকি বাণিজ্যিক বা বিনোদনধর্মী?
সন্দেহ নেই, জটিল সংশয়। চলচ্চিত্র নির্মাতা হতে চায়, এমন অনেক তরুণের মাঝেই এমন সংশয় প্রকটভাবে রয়েছে। সংশয় মানুষের সামনে এগিয়ে যাওয়ার পথের সবচেয়ে বড় বাধা হতে পারে। সব ধরনের যোগ্যতা থাকার পরও অনেকেরই দেখা যায় শুধু এটা করা উচিত, নাকি ওটা করা উচিত, এই দ্বন্দ্বে শেষ পর্যন্ত আর কাজেই নামা হয় না। আমার নিজের জীবনেও এমনটা হয়েছিল। অভিজ্ঞতা থেকেই বলছি, কাজ শুরু করার জন্যে সংশয় দূর করা অত্যন্ত জরুরি।
এখানে বিষয় মোট চারটি- শিল্প, বক্তব্য, বিনোদন এবং ব্যবসা। আলোচনার সুবিধার জন্যে বিষয়গুলোকে একটু আলাদা আলাদা করে বিশ্লেষণ করা যাক।
চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে শিল্প বলতে অনেকেই বোঝেন এমন কিছু সিনেমা, যা কেউ কেউ বুঝবেন কিন্তু সবাই বুঝবেন না। শিল্পপ্রেমীরা গর্বের সাথে দাবি করে থাকেন, শিল্প মুষ্টিমেয় লোকের জন্যে, সবার জন্যে নয়। এই ধারণার পেছনে কিছু ইতিহাস রয়েছে। সুদূর অতীতে, যখন দাসপ্রথা শুরু হয়নি, তখন প্রত্যেকটা মানুষকে তার জীবিকার কাজে দিনভর ব্যস্ত থাকতে হতো। পরবর্তী সময়ে যখন দাসপ্রথা চালু হলো, তখন সম্পদশালী লোকদের হাতে কিছু অবসর সময়ের সৃষ্টি হলো। সেই অবসরকে উপভোগ করার জন্যেই শুরু হয় আয়োজন করে সাহিত্য, সংগীত, চিত্রকলা ইত্যাদির চর্চা। আর তাই স্বাভাবিকভাবেই শিল্পের সোল এজেন্সি চলে যায় মুষ্টিমেয় বিত্তবানের হাতে, যারা কিনা একটা বিষয় নিয়ে দিনের পর দিন ভাবতে পারবে, একটু একটু করে কাব্য বা সংগীতের অন্তরালের প্রকৃত কাব্য বা সংগীতটিকে খুঁজে বের করতে পারবে। শুধু তা-ই নয়, নিজেরদের সাথে সাধারণ মানুষের তফাত তৈরি করতে শিল্পকে ইচ্ছাকৃতভাবে দুর্বোধ্য করে তোলার প্রবণতাও তাদের মাঝে দেখা যায়।
তবে এ কথা অনস্বীকার্য যে একই সময়কালে স্রেফ অবসর কাটানো বা জাতে উঠবার উদ্দেশ্যে নয়, বরং শুধু প্রাণের তাগিদে গ্রামগঞ্জের সাধারণ মানুষ বা মুটে-মজুর আর নৌকার মাঝিদের দ্বারা সৃষ্টি হয়েছে জারি-সারি, ভাওয়াইয়া, ভাটিয়ালি আর নকশিকাঁথার মতো উন্নত মানের শিল্প, যা শোনামাত্রই বা দেখামাত্রই মানুষের অন্তরের গভীরে আসন গেড়ে বসে। দিনের পর দিন গবেষণা করে, একটু একটু করে মর্ম উদ্ধার করার প্রয়োজন পড়ে না।
চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে শিল্প বলতে অনেকেই বোঝেন এমন কিছু সিনেমা, যা কেউ কেউ বুঝবেন কিন্তু সবাই বুঝবেন না। শিল্পপ্রেমীরা গর্বের সাথে দাবি করে থাকেন, শিল্প মুষ্টিমেয় লোকের জন্যে, সবার জন্যে নয়। এই ধারণার পেছনে কিছু ইতিহাস রয়েছে। সুদূর অতীতে, যখন দাসপ্রথা শুরু হয়নি, তখন প্রত্যেকটা মানুষকে তার জীবিকার কাজে দিনভর ব্যস্ত থাকতে হতো। পরবর্তী সময়ে যখন দাসপ্রথা চালু হলো, তখন সম্পদশালী লোকদের হাতে কিছু অবসর সময়ের সৃষ্টি হলো। সেই অবসরকে উপভোগ করার জন্যেই শুরু হয় আয়োজন করে সাহিত্য, সংগীত, চিত্রকলা ইত্যাদির চর্চা।
শিল্পের ব্যাখ্যায় আরেকটা বিষয় রয়েছে, যা চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ, তা হলো, কোনো কিছুকে আপনি যতটা আকর্ষণীয় বা দৃষ্টিনন্দন করে তুলতে পারবেন, সেটা তত বড় শিল্প হয়ে উঠবে। মানে, ‘আমার খারাপ লোককেই ভালো লাগে’- এই বাক্যটা শিল্প নয়। কিন্তু ‘আমার চক্ষে কী হায় দোষ কইরাছে, রাতের বেলা দেখি আলো। সবাই যারে মন্দ বলে তারে লাগে ভালো’- এটা শিল্প। ‘হেমলেট, তোর তরোয়ালে ধার নাই। তুই কোন কামেরই না’- এটা শিল্প না। ‘হ্যামলেট ব্যর্থ তুই, তরবারি তো কান্নার শিশিরে শুধু ক্ষয়প্রাপ্ত, ধারহীন মরিচার গ্রাস’- এটা শিল্প। এই বিচারে, আপনি আপনার চলচ্চিত্রে যা-ই দেখান না কেন, সেটাকে যদি সাজিয়ে-গুছিয়ে দেখাতে পারেন, তো সেটাই শিল্প। হোক না সেটা অ্যাকশন ছবি বা রোমান্টিক ছবি অথবা পর্নোগ্রাফি।
প্রশ্ন জাগতে পারে, সুন্দর করে দেখালেই যদি সেটা শিল্প হয়, তাহলে তো সুন্দর করে বানানো পর্নোগ্রফি দেখাটাও হালাল কাজ। ঠিক এইখানে এসেই শিল্পের পাশাপাশি বক্তব্য বিষয়টি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। আপনি কি উদ্দেশ্যে শিল্প সৃষ্টি করছেন, সেটার ওপর অনেক কিছু নির্ভর করে। অনেক ক্রিমিনাল মাস্টারমাইন্ড হত্যাকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গেছে। তার অর্থ কিন্তু এই নয় যে খুন করা ভালো কাজ। শিল্প যেমন ইতিবাচক হতে পারে, তেমনি নেতিবাচকও হতে পারে। অবাক হচ্ছেন? একটা উদাহরণ দিই, যেহেতু আলোচনাটা চলচ্চিত্রনির্ভর, তাই চলচ্চিত্র থেকেই উদাহরণ টানছি। ঘটনাটি একটি অ্যানিমেশন সিরিজে দেখা- ইয়াং জাস্টিস, সিজন ১।
খাপে ভরা মন্ত্রপুত একটি তরবারি, যা কেউই খাপ থেকে বের করতে পারে না। প্রবাদ আছে, এই তরবারিটি শুধু সে-ই ব্যবহার করতে পারবে, যার রয়েছে পিওর হার্ট বা খাঁটি হৃদয়। অনেকেই চেষ্টা করে কিন্তু বিশেষ ক্ষমতাসম্পন্ন সেই তরবারিটি কেউই ব্যবহার করতে পারে না। অবশেষে বদমাশ টাইপের এক লোক এসে অনায়াসে সেই তরবারিটি খাপ থেকে খুলে নিল। সবাই অবাক। এই লোক তো অপরাধী, তার হার্ট তো কোনোভাবেই পিওর নয়, তবে সে কীভাবে এটা ব্যবহার করতে পারে? লোকটি দাঁত কেলিয়ে বলল, ‘বলা হয়েছে খাঁটি হৃদয় বা পিওর হার্ট, আমার হার্ট হচ্ছে পিওর ইভল, মানে খাঁটি শয়তান হৃদয়।’ অর্থাৎ এখানে বিষয়টা শুভ বা অশুভ নিয়ে নয়। বিষয়টা খাঁটিত্ব নিয়ে। সেটা খাঁটি ফেরেশতাও হতে পারে, আবার খাঁটি শয়তানও হতে পারে। শিল্প হচ্ছে কোনো বিষয়ের ‘মানের গভীরতা’ মাত্র। ‘বিষয়টা’ এখানে বিবেচ্য নয়। মানটাই বিবেচ্য।
তখন আমি ক্লাস ফোর কি ফাইভে পড়ি। পরীক্ষা দিয়ে বাসায় ফিরেছি। আব্বা জানতে চাইল, ‘পরীক্ষা কেমন হয়েছে?’ আমি হাত পা ঝাঁকিয়ে বললাম, ‘দারুণ।’ আব্বা মৃদু হেসে আবার প্রশ্ন করল, ‘দারুণ ভালো, নাকি দারুণ খারাপ?’ সেই প্রথমবারের মতো মাথায় ঢুকল দারুণ শব্দটা ‘খুব ভালো’ অর্থে ব্যবহার করা হলেও প্রকৃতপক্ষে দারুণ মানে শুধুই ‘খুব’ বা ‘অনেক’। এটা ভালো বা খারাপের সামনে যুক্ত হয়ে তাদের মানের তীব্রতা বাড়ায় মাত্র।
বাচ্চা ছেলেদের কার্টুন ছবির উদাহরণ দিলাম বলে অনেকেই হয়তো বলবেন, কিসের মধ্যে কী, পান্তা ভাতে ঘি। ঠিক আছে, এবার তাহলে বাস্তব জীবন থেকে একটা উদাহরণ দিই। আচ্ছা, বলেন তো, প্রকৃতিগতভাবে নারী-পুরুষের সবচেয়ে আরাধ্য বা কাঙ্ক্ষিত বিষয়টি কী? যা জীবনকে পূর্ণাঙ্গ করতে পারে বা সুখে ভাসিয়ে দিতে পারে। আবার প্রকৃতিগতভাবেই নারী-পুরুষসংক্রান্ত সবচেয়ে জঘন্য অপরাধটি কী? যা মানুষকে অমানুষ বানিয়ে দেয় বা জীবনটাকে জর্জরিত করে দেয়। দুটো প্রশ্নেরই উত্তর একটাই- সেক্স। উভয়ের তৎপরতায় যা ভালোবাসা, শুধু একজনের তৎপরতায় তা ধর্ষণ। বউয়ের সাথে যৌনতায় কোনো পাপ নেই। কিন্তু পতিতার সাথে যৌনতা মহাপাপ। অর্থাৎ স্বয়ং ‘যৌনতা’ আসলে ভালো বা মন্দ নয়। এটা স্রেফ মানব-মানবীর দেহের আদিমতম একটা প্রক্রিয়ামাত্র, যার ভালো-মন্দ নির্ধারণ করে ঘটনার প্রেক্ষাপট। একইভাবে শিল্পও কোনো কিছুকে প্রকাশ করার একটা উন্নততর প্রক্রিয়া মাত্র, যা সহজেই মানুষের মনের অনেক গভীরে প্রবেশ করতে পারে, যা প্রবেশ করল তা ভালোও হতে পারে, আবার খারাপও হতে পারে। এখানে শিল্পের কোনো দায় নেই। দায়টুকু চলচ্চিত্র নির্মাতার।
এতক্ষণে নিশ্চয় বুঝতে পেরেছেন চলচ্চিত্রে খারাপ কিছুকে সাদামাটাভাবে উপস্থাপন করলে যতটা ক্ষতিকর হতে পারে, শিল্পসম্মতভাবে উপস্থাপন করলে তার চেয়ে কয়েক গুণ বেশি ক্ষতিকর হতে পারে। কারণ, শৈল্পিক বিষয় সাদামাটা বিষয়ের চেয়ে অনেক জোরালোভাবে মানুষের মনে আসন গেড়ে বসতে পারে। একটু ভাবেন, রাইফেলের বুলেট একটি ক্ষতিকর বস্তু। আবার অনেক সাধনা করে বানানো পারমাণবিক বোমাও ক্ষতিকর। কিন্তু দুটোর ক্ষতির মাত্রা স্পষ্টই দুই রকম। যে জিনিসটাকে যতটা সাধনা বা মমতা দিয়ে বানানো হয়, তার প্রভাবনী ক্ষমতা তত বেশি হয়। সেটা ভালো হলে ভালো আর খারাপ হলে খারাপ।
এখানে আমার স্কুলজীবনের একটা ছোট্ট ঘটনা বলবার লোভ সামলাতে পারছি না। তখন আমি ক্লাস ফোর কি ফাইভে পড়ি। পরীক্ষা দিয়ে বাসায় ফিরেছি। আব্বা জানতে চাইল, ‘পরীক্ষা কেমন হয়েছে?’ আমি হাত পা ঝাঁকিয়ে বললাম, ‘দারুণ।’ আব্বা মৃদু হেসে আবার প্রশ্ন করল, ‘দারুণ ভালো, নাকি দারুণ খারাপ?’ সেই প্রথমবারের মতো মাথায় ঢুকল দারুণ শব্দটা ‘খুব ভালো’ অর্থে ব্যবহার করা হলেও প্রকৃতপক্ষে দারুণ মানে শুধুই ‘খুব’ বা ‘অনেক’। এটা ভালো বা খারাপের সামনে যুক্ত হয়ে তাদের মানের তীব্রতা বাড়ায় মাত্র।
চলবে…