:
Days
:
Hours
:
Minutes
Seconds
Author Picture
শৈবাল সারোয়ার

চলচ্চিত্র সমালোচক

বেঙ্গলি বিউটি : সিনেমাটিক মোহ-বাস্তবতা অথবা মোহাবিষ্ট সিনেমাটিক বয়ান

বেঙ্গলি বিউটি : সিনেমাটিক মোহ-বাস্তবতা অথবা মোহাবিষ্ট সিনেমাটিক বয়ান

সমকালীন প্রেক্ষাপটে সিনেমা নির্মাণের ক্ষেত্রে একটা বাড়তি সুবিধা পাওয়া যায়, New Realism Film Movement-এর হাত ধরে স্টুডিওর বাইরে শুট করা যায় বলে। কিন্তু Periodical Films এর ক্ষেত্রে ব্যাপারটা এতোটা সহজ হয় না; কারণ এক্ষেত্রে পরিচালক ও শিল্পনির্দেশককে বিশ্বস্তভাবে কালটিকে ধরবার জন্য অনুষঙ্গের সাহায্য নিতে হয়- যেমনঃ আসবাব, জানলার গ্রিল, টেলিভিশনের মডেল, বই, টেলিফোন, পোশাক, রাস্তাঘাট, বারান্দা আরও কত কি! কিন্তু রাহশান ভাইকে প্রথমেই ধন্যবাদ দেবো, এত সুন্দর করে ১৯৭৪-১৯৭৫ কে আমাদের চোখের সামনে মূর্ত করে তুলবার জন্য। ব্রাভো!

পরিচালনায় ত্রুটি খুঁজে বেড়াইনি, কিন্তু নিজে একজন ফিল্মের ছাত্র হওয়াতে স্বাভাবিকভাবেই ভুলগুলো চোখে পড়ে বেশি। বলতে বাধ্য হচ্ছি, এই সিনেমাতে ভুল বা অসঙ্গতি নেই বললেই চলে, তবে অবশ্যই আমি একে সেরা ছবি বলছি না; তবে ঢাকাই সিনেমার ঘুরে দাঁড়াবার যে আন্দোলন গিয়াসউদ্দিন সেলিম পরিচালিত ‘মনপুরা’ দিয়ে শুরু হয়েছিল, এই সিনেমা নিঃসন্দেহে সেই তালিকাতে যুক্ত হবার দাবিদার।

আমার ব্যক্তিগত রেটিং ৮.৫। প্রথমেই বলি অভিনয়ের কথা। চলচ্চিত্র অনিভয়নির্ভর শিল্পমাধ্যম। অভিনয়ে আমরা পেয়েছি, মুমতাহিনা টয়া ও রাহশান নুরকে। তারিফের দাবিদার দুজনেই। পাশাপাশি ছোট-ছোট বেশ কিছু চরিত্র সুনিপুণভাবে ফুটে উঠেছে, অভিনেতাদের চেষ্টায় ও পরিচালনার মুনশিয়ানার ফলে।

আকরাম খান পরিচালিত ‘ঘাসফুল’ চলচ্চিত্রের Protagonist এর মা এবং নানুর চরিত্রে অভিনয়কারী অভিনয়শিল্পী নায়লা আজাদের অভিনয় নিজ গুণে দীপ্তিমান হয়ে উঠেছে।

সাবলীল ও প্রানবন্ত (হাস্যরসাত্মক) সংলাপ, এক কথায় মুগ্ধ করেছে। বারবার হাসির লহরী বয়ে যাচ্ছিলো পুরো হলজুড়ে। পরিবারের সাথে বসে দেখা যাবে না, এমন একটি সংলাপও এতে নেই। বরং পারিবারিক যে সনাতনী মূল্যবোধের চর্চা বন্ধ হয়ে যাওয়াতে আজ আমাদের পরিবার ভেঙ্গে অনু সৃষ্টি করছে, তাঁর মূলে আঘাত করে এই সিনেমাটি। দুর্দান্ত কিছু কাব্যিক সমাবেশ উঠতি বয়সি ছেলে-মেয়েদের হৃদয় ছুঁয়ে যাবে বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস।

এটি হয়ত আর্ট ফিল্ম নয়, নয় প্রচলিত অর্থের কমার্শিয়াল ফিল্ম, কিন্তু কি প্রয়োজন এই অহেতুক তর্কের? সিনেমা তো সিনেমাই, অন্য কিছু না, এর শরীরে গল্প, উপাখ্যান বাসা বাঁধে, আমরা সেইটাই দেখি, হোক না স্বল্প অথবা দীর্ঘ, আর্ট অথবা কমার্স, ডকু অথবা ফিকশন, এইসবই তো সিনেমা!

সঙ্গীতের ব্যাপারে সতর্ক পরিচালক এতে কোন সন্দেহ নেই। এমন কিছু Ever Green Classics সিনেমাটিতে ব্যবহার করা হয়েছে কাহিনীর সাথে সামঞ্জস্য রেখে। সাথে D-Generation Pulse বুঝে কিছু ড্রামস বিটের ব্যবহারও ছিল শ্রুতিমধুর।

১৯৭৪-১৯৭৫ এর রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের ফলে সাধারণ মানুষের মনে যে অস্থিরতা সৃষ্টি হয়, তাও এই সিনেমাটিতে উঠে আসে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শের কথা বারবার শোনানো হয়। রাজনৈতিক বক্তব্য কি শুধুই আর্টঘরানার সিনেমার পৈতৃক সম্পত্তি? নাকি ‘তথাকথিত’ বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রেও তাঁর অবস্থান হতে পারে? এই সিনেমাটি এমন প্রশ্নের উত্তর দিয়ে গেলো সাবলীলভাবেই।

সিনেমাটি দেখতে দেখতে একসময় ভেবে দেখলাম, এই সিনেমাটি নিয়ে যে রাজনীতি করা হলো, দেশে একটি মাত্র সিনেমাহল ‘যমুনা ব্লকবাস্টার’ এ মুক্তি দিয়ে দেশের অধিকাংশ সাধারণ মানুষকে সিনেমাটির রসাস্বাদন থেকে বিরত করা হলো; কিন্তু আমেরিকা, চীন জয় করে আসবার পরেও যখন সিনেমাটি রিলিজ দেয়া হলো, কয়টি হলে সিনেমাটি মুক্তি পেলো?

বাংলাদেশের ছেলেরা/মেয়েরা এমন ছবি বানাবে, কিন্তু তা বাংলাদেশের মানুষকে দেখাতে পারবে না, তাহলে কেন বানাবে?

দৃশ্যায়নে নতুনত্ব বলতে আনকোরা নতুন কিছু ছিল, এমন দাবি করবো না। তবে লোকেশন রেকি ছাড়াও যে স্টুডিও ফ্রেমওয়ার্কের বাইরে গিয়ে এভাবে দেখানো যায়, সেটা আমাদের জন্য শিক্ষণীয়।

প্লটের ব্যপারে বলতে পারি, এভাবে গল্পের ছক কেটে গল্প বলা এবং ধীরে-ধীরে গল্পের মোড়ক উন্মোচনের ক্ষেত্রে পরিচালক মুনশিয়ানা দেখিয়েছেন, গল্পের ভিতরে কি করে দর্শককে টেনে নিয়ে যেতে হয় তা দেখিয়েছেন, দিনশেষে সিনেমাতে তো দর্শকরা গল্পটাই দেখতে চায়। তাই, পরিচালকের গল্প বলতে পারার ক্ষমতা, টেকনিক্যাল ক্ষমতার চাইতেও বেশি প্রয়োজনীয়। পরিচালক এ ব্যাপারে যথেষ্ট পারদর্শী।

সম্পাদনার রীতি গতানুগতিক হলেও সিনেমার আঙ্গিকের সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ মনে হয়নি।

বেঙ্গলি বিউটি । পরিচালক: রাহশান নুর 
ধরন: Drama, Music, Comedy। মুক্তিসাল: ২০১৮। ব্যাপ্তিকাল: ১০৩ মিনিট।

চিত্রনাট্য বোধ করি এই সিনেমাটির প্রাণভ্রমরা। এমন চিত্রনাট্য লেখা এবং তাতে কাজ করার সাহসের জন্য নুর ভাইকে আবারও ধন্যবাদ জানাই।
শব্দ ও রঙের ব্যবহার আশাতীতভাবে বাস্তবতায় ‘৭৪-‘৭৫ কে ধরতে ভীষণভাবে সাহায্য করেছে। Tone Selection এক কথায় অপূর্ব।

গান যে কয়টি আছে, সবগুলোই মন ছুঁয়ে যাবার। আর ‘৭০ এর সাজপোশাকের একটা Platonic effect বোধ করি কম-বেশি আমাদের সবারই আছে। এই সিনেমাতে সেই ভালোলাগাকে আরেকবার ছুঁয়ে দেখতে পারবেন। শেষ শামীম আখতারের ‘রীনা ব্রাউন’-এ এমনটা দেখেছিলাম।

উত্তাল ‘৭০ এর দশককে তুলে আনতে গিয়ে পরিচালককে যে ঝক্কি পোহাতে হয়েছে, তাতে করে সিনেমার রাজনীতির বাইরেও সিনেমাবাণিজ্য রাজনীতি প্রকটভাবে প্রকাশ পেয়েছে।

এবারে আসি, Magic Reality বিষয়ে। আমরা সবাই জানি, মার্কেজ আর আমাদের নিজস্ব সম্পত্তি শহীদুল জহিরের নাম। কিন্তু বাংলা সিনেমাতে অন্তত সমকালীন সিনেমাতে Magic Reality-র অনুপস্থিতি লক্ষণীয়। ‘বেঙ্গলি বিউটি’ কিছু কিছু ক্ষেত্রে সেই জাদুবাস্তবতায় দর্শককে মোহাবিষ্ট করতে পেরেছে বলেই আমার বিশ্বাস।

আমরা যদি সিনেমাটি দেখি, পরিচালকের পাশে দাঁড়াই, নিদেনপক্ষে অন্তত উনার দর্শনটা বুঝার চেষ্টা করি, তাহলে এঁরা আমাদের সিনেমা থেকে মুখ ঘুরিয়ে নেবেন না। দেশের সিনেমা নিয়ে হা-হুতাশ না করে, যারা সিনেমার সুদিন প্রত্যাশি, প্লিজ সিনেমাটি দেখুন। তারপর না হয় গালি দিয়েন, কিন্তু প্লিজ, দিনবদলের এই চলচ্চিত্রের সাথে আপনিও যুক্ত হন। দিনবদলের এই বিষয়টা আমাদের শুধু পরিচালকদের কাজ না, এই কাজটা সাধারণ দর্শকের, সবার।

এটি হয়ত আর্ট ফিল্ম নয়, নয় প্রচলিত অর্থের কমার্শিয়াল ফিল্ম, কিন্তু কি প্রয়োজন এই অহেতুক তর্কের? সিনেমা তো সিনেমাই, অন্য কিছু না, এর শরীরে গল্প, উপাখ্যান বাসা বাঁধে, আমরা সেইটাই দেখি, হোক না স্বল্প অথবা দীর্ঘ, আর্ট অথবা কমার্স, ডকু অথবা ফিকশন, এইসবই তো সিনেমা!

পরিশেষে বলবো, পরিবারের সাথে, একান্ত আপনজনের সাথে বসে দেখার সিনেমা এটি। আপনার/আপনাদের ঐকান্তিক উৎসাহই পারে, এমন সিনেমাকে তুলে ধরতে।

বি:দ্র: আমি মুখিয়ে থাকি এমন সিনেমার জন্য, আর আমার বিশ্বাসের জায়গা থেকে বলছি, আমাদের সিনেমার চেহারা পাল্টাতে এমন সিনেমাই প্রয়োজন; আঁতলামো করার সময় এখনো আমাদের আসে নি, নুর ভাই কি তাঁর সিনেমাতে কোন বক্তব্য রেখে যায়নি? অবশ্যই রেখেছে, কিন্তু সেইটাও humor এর মাধ্যমে। বোধ করি, জাতিগতভাবে আমরা ভীষণ হাসতে ভুলে গেছি!

Meghchil   is the leading literary portal in the Bengali readers. It uses cookies. Please refer to the Terms & Privacy Policy for details.