

একথা সেকথা
ভাবনাকে মোর ধাওয়ায়
অধরাকে ধরবার জন্যই সমস্ত আয়োজন। দৃষ্টি পায় না যার দেখা, শ্রবণ শোনে না যা, স্বাদ-ঘ্রাণ-গতি-তাপ—কিছুই যায় না বোঝা যার, সেই নিখিল না-কে অস্তিত্বের সমগ্রতা দিয়ে অনুভব করাই শুধু নয়, এই প্রক্রিয়ার সাথে ভাষার দ্বন্দ্ব-মিলনে জন্ম নেয় কবিতা।
তবে কি যা আছে, যা দেখি-শুনি-ছুঁই, তা দিয়ে হয় না কবিতা?
হয়, হয়, হয়।
যা আছে, যা দেখি-শুনি-ছুঁই, তার নিতান্ত সামান্যই আছে নাগালে, বাকি সবটুকুই ঢেকে আছে বিপুল অজানার নিবিড় আঁচলে। সে আঁচল সামান্য নড়ে উঠলেই রহস্যময়তার যে কল্লোল নৈঃশব্দ্যের মন্ত্র জপ করে, তারই নাম কবিতা।
সে কবিতা লেখা হয়ে ওঠে না কখনো; কেবল তার প্রস্তুতি চলতে থাকে অনুক্ষণ।
২.
চারুকলা অনুষদে শারদোৎসব। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের প্রিয় হলুদ রঙের পোশাক পরা একদল তরুণ-তরুণী খোল-মন্দিরা বাজিয়ে নাচতে নাচতে গাইছে আর সমস্ত প্রাঙ্গণ প্রদক্ষিণ করছে:
মানুষ বানাইছে খোদা প্রেমের কারণে,
প্রেমের ডুরি বান্ধো রে মন মুরশিদের সনে।
এটাই ছিল অনুষ্ঠানের থিম। এই রকম আনুষ্ঠানিক ভাবময়তা আমাদের মধ্যশ্রেণির একটা বিলাস— এমনতর রূঢ় মন্তব্য করা বোধ হয় উচিত নয়। কারণ, এই ভাবধারার সাথে বিপুল মধ্যশ্রেণির জীবনযাপনের প্রত্যক্ষ সম্বন্ধ যদি না-ও থাকে, তবু তো এ অনুপ্রেরণা দেয় দৈনন্দিন জাগতিকতা ও সীমাবদ্ধতার বাইরে অপর এক প্রেমও প্রজ্ঞার জগতের অভিপ্রায়ের দিকে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আমার চর্যার ও আমার কবিতার কেন্দ্রীয় প্রণোদনা এই গুরুমুখী-প্রেমবাদী দর্শন।
৩.
সত্যের উপলব্ধি ব্যক্তিকেন্দ্রিক; কিন্তু সত্যের সত্যতা এখানেই যে তা ব্যক্তিকে অতিক্রম করে যায়। কবিতা কেবলই শব্দের খেলা নয়। সত্যের উপলব্ধি ছাড়া কবিতা মহৎ হয় না।
তা বলে কেবল ভারী ভারী কথা বলতে হবে কবিতায়—এমন নিশ্চয়ই নয়। যেকোনো আকস্মিক বা নৈমিত্তিক অনুভূতি-আবেগ-উপলব্ধির শিল্পময় প্রকাশ হতেই পারে। তবে কবির যদি কোনো বিশেষ দার্শনিক বীক্ষা থাকে, তবে কবিতায় তার বিশিষ্ট প্রকাশ ঘটেই থাকে।
৪.
বহির্বাস্তবতার তথ্যের সাথে কবিতায় ব্যবহৃত তথ্যের গরমিল থাকতেও পারে, কিন্তু কবিতার সত্যতা নির্ভর করে সেই তথ্যের প্রয়োগ-কুশলতায়, ব্যঞ্জনার নিবিড় দ্যোতনায়।
আমার কবিতা হয়তো একটু ভাবনাতাড়িত। কখনো কখনো একটু বেশি নিরাবরণ। শিল্পের মাপকাঠিতে সবই তুল্যমূল্য নয়, জানি—কিন্তু, বিশেষ একটি ভাবধারায় তথা সুফিবাদী বীক্ষায় আমি প্রাণিত, তাই আমার লেখায়—অনেক সময়ই—তার প্রকাশ থাকাটাই স্বাভাবিক।
৫.
আমার অনুজপ্রতিম কবিবন্ধু নভেরা হোসেন মাঝেমধ্যে বলে, ‘আপনার কবিতার ভেতর একরকম প্রশান্তি আছে।’ আবার কখনো-বা এর সাথে যোগ করে, ‘তবে ওটা আপনার ভানও হতে পারে।’
এই ‘ভান’ শব্দটি আমাকে আরও দু-একবার শুনতে হয়েছে (হয়তো আরও হবে—এর বিশেষণ-রূপসহ) আমার অপরাপর কোনো কোনো কবি‘বন্ধু’র কাছ থেকে। আমার প্রকাশ ও যাপন সম্পর্কে তাদের এ বঙ্কিম উক্তি। আমরা অশান্তি আর অসত্যের সাথে এমনই জড়িয়ে আছি নিত্য যে অন্য রকম কিছু দেখলে সংশয় জাগে, সেটাকেই অসত্য বলে মনে হয়। সেই মহান ‘অসত্য’কে, সেই খাঁটি ‘ভান’কে ধারণ করাই আমার চর্যার ও আমার কবিতার অভিমুখ—সবিনয়ে এটুকু বলা যায়।
৬.
একজন অগ্রজ কবি আক্ষেপ করেছেন যে আমাদের কবিতা হতে গান হারিয়ে যাচ্ছে। সেই নিরিখে আমার কবিতা হয়তো একটু বেশি গীতল—অনুজ এক কবিতানুরাগীর মন্তব্যে সেরকমই মত শুনতে পেলাম। কবিতায় ধ্বনিপ্রতিমার কল্লোল আমার ভালো লাগে।
৭.
মাত্রাবৃত্ত ছন্দ আমার খুব প্রিয়। এটি ‘বিপ্লবী’ কি না, তা নিশ্চিতভাবে বলতে পারব না। তবে এই ছন্দের আঁটসাঁট নিয়মিত চলন আছে, যা স্বরবৃত্তের (অনেক সময়েই অক্ষরবৃত্তেরও) আলুথালু ভাব থেকে মুক্ত। ফলে এতে একটা মুক্ত আবহ পাওয়া যায়। তদুপরি এ ছন্দ খুবই গতিশীল। ছয় মাত্রা ছাড়াও, পাঁচ, সাত কিংবা চার মাত্রায় নানা রকম বৈচিত্র্য আসে (আমার কবিতায় এই বৈচিত্র্য অবশ্য কমই—স্বীকার করে নিচ্ছি)। তা ছাড়া পঙ্ক্তি-দৈর্ঘ্যের বৈবিধ্য, উপপর্ব, মুক্তকতা এবং অনুপ্রাস প্রয়োগে এতে আরও নানা রকম বৈশিষ্ট্য আনা যায় (আমার কবিতায় সেসব হয়তো তেমন বেশি নয়)। উপরন্তু, শব্দের কুশলী প্রয়োগের অবকাশ তো রয়েছেই। এ ছন্দে উচ্চারণের একপ্রকার ঋজুতা ও স্পষ্টতা আছে। এ ছন্দের সাবলীল ধ্বনিময় নৃত্যপরায়ণতা আমার ভালো লাগে।
৮.
কোনো শব্দই অচ্ছুৎ নয়। কেবল কবিতার ভাব আর অন্যান্য শব্দের অনুষঙ্গে সুমিতিবোধই জরুরি। তৎসম শব্দের পাশাপাশি আরবি-ফারসি শব্দ, দেশি শব্দের সাথে কখনো কখনো ইংরেজি বা অন্য যেকোনো ভাষার শব্দ আবহের, ভাবধারার ও শৈলীর প্রয়োজনে ব্যবহারযোগ্য। মাঝেমধ্যে চলতি ভাষার বাগ্বিধির ব্যবহার কবিতাকে বোধ হয় একটু সরস করে তোলে।
৯.
আমার কবিতা হয়তো একটু ভাবনাতাড়িত। কখনো কখনো একটু বেশি নিরাবরণ। শিল্পের মাপকাঠিতে সবই তুল্যমূল্য নয়, জানি—কিন্তু, বিশেষ একটি ভাবধারায় তথা সুফিবাদী বীক্ষায় আমি প্রাণিত, তাই আমার লেখায়—অনেক সময়ই—তার প্রকাশ থাকাটাই স্বাভাবিক। আর কখনো কখনো, সেই ভাবধারার সাথে আপাত-অসংগত ভাবনাও আমার রচনায় হয়তো দুষ্প্রাপ্য নয়।
১০.
আমার দীক্ষাপূর্বকালের কবিতাবলিকে আমি অস্বীকার করি না।