অক্ষরবন্দী জীবন-৯
মননশীল পুরস্কার
কবিতার ঘর ও বাহির–এর পর থেকে-
ক্লাশ সিক্সে প্রথমবারের মত বই পুরষ্কার পাই, সেটা রাজাবাড়ি হাই স্কুলের বার্ষিক মিলাদের অনুষ্ঠানে নবীর জীবনীভিত্তিক রচনা প্রতিযোগিতার দ্বিতীয় পুরস্কার। বাবা আমাকে আট–দশ দিন ধরে ‘তোরা দেখে যা আমিনা মায়ের কোলে’ গজলটিও রেওয়াজ করিয়েছিলেন, কিন্তু আসলে হয়েছে কী- ছেলেবেলা থেকেই আমার গলা কর্কশ আর কন্ঠেও নাই সুর- তা অবশ্য কখনোই মনে রাখতাম না। বলাই বাহুল্য গজল গেয়ে দর্শক-শ্রোতাদের মন পাইনি, বিচারকদের তো নয়-ই। মাইকে যখন পুরস্কারের ঘোষণা হল আমি তখন নতুন একটা আমি হয়ে গিয়েছিলাম, নিজেকে নিজেই চিনতে পারছিলাম না যেন। পায়ের নিচে মাধ্যাকর্ষণ ছিল না মনে হয়। প্রথম হয়েছিলেন ক্লাশ নাইনের আজিজ। তাঁর সাথে অনেক বছর পর চাকুরীক্ষেত্রে দেখা। এই প্রসঙ্গ তুলতেই তিনি যুগপৎ অবাক এবং কুণ্ঠিত। পুরষ্কার হিসেবে পেয়েছিলাম হজরত উমর এর জীবনী। রূপালি মলাটের বইটা আমার পড়ার টেবিলে দর্শনীয়ভাবে সাজিয়ে রাখতাম, যে পড়ার টেবিলের গোপন দেরাজে ১৯৭৬ সাল থেকে নজরুল, জসীম উদ্দীন আর জয়নুলের পেপার কাটিং ছবির চারপাশে বকুল ফুলের মালা ছিল (সে বছরটাই ছিল তাঁদের জীবনের অন্তিম বছর)।
ক্যাডেট কলেজে অনেক সাহিত্য-সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা হতো, খেলাধুলা তো ছিলোই। সাধারণত সাহিত্য সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতায় বই আর ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় মেডেল আর ট্রফি পুরষ্কার দেয়া হত। সে সময় চিরায়ত বইয়ের পাশাপাশি সমকালীন সাহিত্যিকদের বইও পুরস্কার দেয়া হত, দেশি বই দেখতাম বেশি (মনে পড়ছে ধবল জোছনা, দুই হাতে দুই আদিম পাথর কিংবা দূরত্ব – এই বইগুলো কেউ কেউ পুরস্কার পেয়েছিল)। দু চারটে প্রতিযোগিতায় অংশ নিলেও না পেয়েছি ‘রূপালি’ বই না পেয়েছি সোনালি মেডেল। তবে বুঝিবা ক্ষুদে ওস্তাদ অপেক্ষা করছিল শেষ রাত্রির জন্য ! এস এস সি পরীক্ষায় ভাল ফলাফলের জন্য আমি বেশ কয়েকটা বই একসাথে পুরষ্কার পেয়ে গেলাম। অংকে কাঁচা ছিলাম বলে কখনই ভাল ফল করতে পারতাম না, কিন্তু ফাইনাল পরীক্ষার আগে পাওয়া সময় কাজে লাগিয়ে টেস্ট পেপার ঘেটে-ঘুটে অংকের জাহাজ হয়ে গেলাম, বাংলা-ইংরেজিতেও বেশ ভাল নম্বর পেলাম। সব মিলে অনেককেই পেছনে ফেলেছিলাম। পুরষ্কার হিসেবে পেয়েছিলাম ‘পূর্ব বাংলার সাংস্কৃতিক আন্দোলন’ (সৈয়দ আনোয়ার হোসেন), ‘বিশ্বজগতের পরিচয়’ (আবদুল হালিম), ‘স্ল্যান ‘ ( এ ই ভ্যান ভগট), নীহাররঞ্জন রায়ের ‘বাঙালীর ইতিহাস’ (সুভাষ মুখোপাধ্যায় কৃত সংক্ষেপিত সংস্করণ) আর ফাইনালি শামসুর রাহমানের ‘কবিতার সঙ্গে গেরস্থালী’।
ক্যাডেট কলেজে অনেক সাহিত্য-সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা হতো, খেলাধুলা তো ছিলোই। সাধারণত সাহিত্য সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতায় বই আর ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় মেডেল আর ট্রফি পুরষ্কার দেয়া হত। সে সময় চিরায়ত বইয়ের পাশাপাশি সমকালীন সাহিত্যিকদের বইও পুরস্কার দেয়া হত, দেশি বই দেখতাম বেশি (মনে পড়ছে ধবল জোছনা, দুই হাতে দুই আদিম পাথর কিংবা দূরত্ব – এই বইগুলো কেউ কেউ পুরস্কার পেয়েছিল)। দু চারটে প্রতিযোগিতায় অংশ নিলেও না পেয়েছি ‘রূপালি’ বই না পেয়েছি সোনালি মেডেল।
পূর্ব বাংলার সাংস্কৃতিক আন্দোলন বইটা আমি খুব আগ্রহ আর আনন্দ নিয়ে পড়েছিলাম; সহজভাবে ধারাবাহিক ইতিহাসকে তুলে আনা হয়েছে। শামসুর রাহমানের কবিতার বইটি (কবিতার সঙ্গে গেরস্থালী) আমাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। ‘নিজ বাসভূমে’ ছাড়া এই বইয়ের সাথে তুলনীয় শামসুর রাহমানের আর কোনও কবিতার বই আমি পাইনি। তবে ‘যে অন্ধ সুন্দরী কাঁদে’ আর ‘ইকারুসের আকাশ’ও আমার অন্যতম প্রিয় দুটি বই। বাঙালীর ইতিহাস বইটা ছাড়া ছাড়া ভাবে পড়েছি। কখনো কাজে লাগাইনি। আমার বড় মেয়ের টেবিলে একদিন মূল বইটি দেখে চমকে উঠেছিলাম। সময় এত দ্রুত বয়ে যাচ্ছে!
কলেজ জীবনেও বটতলায় গান শুনে ছবি আঁকা, নির্ধারিত বক্তৃতা,আর ক্লাশের ‘ভালো ছেলে’র পুরষ্কার হিসেবে বই-ই পেয়েছিলাম, কিন্তু একটা বইয়ের নামও আজ আর মনে নেই।
পুরষ্কার হিসেবে বই নির্বাচন করা খুবই দূরদর্শী সিদ্ধান্ত। মননশীল বই নির্বাচনের জন্যে যোগ্য মানুষও দরকার। শিশু-কিশোরদের কাছে এক একটা বই খুলে দিতে পারে এক একটা নতুন দিগন্ত। আমার ছোট মেয়েটাকে নিয়ে একবার বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের বই পড়া প্রতিযোগিতার পুরষ্কার বিতরণীতে গিয়েছিলাম রমনার বটমূলে। প্রায় চার হাজার ছাত্রছাত্রী বই পুরষ্কার পেয়েছিল। আমার মেয়ে পেয়েছিল ‘ফ্রান্সের রূপকথা’ । একটা বই পাবার জন্য মেয়ে ও তাঁর বান্ধবীদের ঘন্টার পর ঘন্টা অপেক্ষা, উতকন্ঠা আর বাবার ক্যামেরা নিয়ে উৎসব– একমাত্র বইই পারে আনন্দের এমন উপলক্ষ গড়ে দিতে।
কিন্তু পুরষ্কার দেয়ার ক্ষমতা যখন হাতে এল, আমি যখন একটি উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সাংস্কৃতিক সম্পাদক হিসেবে সপ্তাহব্যাপী সাহিত্য-সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতার আয়োজন করতাম, তখন অপ্রতুল বাজেটের দোহাই দিয়ে ক্রেস্ট, মেমেন্টো ইত্যাদি পুরষ্কার গছিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছিলাম। আজ অনুতাপ করি, প্রতিযোগিতায় বিজয়ীদেরকে কৃশকায় বই দিতে পারলেও আজ গর্ব করে লিখতে পারতাম যে, আমরা সে বছর চারশত কিংবা পাঁচশত বই পুরষ্কার দিয়েছিলাম।