:
Days
:
Hours
:
Minutes
Seconds
Author Picture
নজরুল সৈয়দ

লেখক, সাহিত্য সমালোচক

মাংসের স্বাদ কিংবা বিস্বাদের আখ্যান
প্রচ্ছদ: 'আমিষ'-এর পোস্টার থেকে

আমিষ

মাংসের স্বাদ কিংবা বিস্বাদের আখ্যান

১.
আজ থেকে মাত্র ১৮ বছর আগে ‘সভ্য’ মানুষের পৃথিবীর অন্যতম কেন্দ্রস্থল জার্মানীতে যখন আরমিন মাইভেস নামের একজন কম্পিউটার টেকনিশিয়ান মানব-মাংস খাওয়ার আগ্রহ দেখালেন এবং সেজন্য রীতিমতো বিজ্ঞাপন দিয়ে ১৮-৩০ বছর বয়সী সুঠামদেহী স্বেচ্ছাসেবী চাইলেন, তখন মানুষ হাসাহাসি করেছিলো। কিন্তু পৃথিবীকে অবাক করে দিয়ে এক তরুণ যখন সত্যি সত্যি মাইভেসের এই এক্সপেরিমেন্টে দেহদান করতে রাজি হয়ে গেলেন স্বেচ্ছায় এবং সত্যি সত্যি এক রাতে মাইভেস সাহেব কেটে খেলেন স্বেচ্ছাসেবী সেই তরুণের যৌনাঙ্গ, তারপর ধীরে ধীরে শরীরের আরো আরো মাংস — এবং এভাবে স্বেচ্ছায় খুন হয়ে গেলেন সেই তরুণ— এবং পৃথিবী যখন জানলো সেই অবিশ্বাস্য ঘটনার কথা— বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গিয়েছিলো! এও সম্ভব?

সেই অসম্ভবের নাম পৃথিবী দিয়েছিলো ‘রটেনবার্গ ক্যানিবাল’। এ নিয়ে অনেক সিনেমা-গান-সাহিত্য হয়েছে, রামস্টেইন গেয়েছে অসাধারণ গান mein teil.

এই ঘটনার মাত্র কয়েক বছর পর বাংলাদেশে যখন শুরু হলো রাজনৈতিক অস্থিরতা, ছড়িয়ে পড়লো ভয় এবং তার প্রেক্ষিতে রানা মেহের লিখলেন অসাধারণ ছোটগল্প ‘পোকাদের দল পাতকুয়ায় ফেরে’, পড়ে চমকে গিয়েছিলাম। গল্পের শেষে “আমিও তর্ক শুরু করি বাবুর পক্ষে। তোমার লজ্জা করে না কুকুরের মতো কুকুরের মাংশ খেতে? আম্মা আমাদের দিকে ভীত চোখে তাকিয়ে থাকেন। আমরা লোভী চোখে চেয়ে থাকি আম্মার দিকে। কদিন পর হয়তো আমরা আম্মাকেও কেটেকুটে খেয়ে ফেলবো।” পড়ে দীর্ঘক্ষণ বিমূঢ় হয়ে বসে ছিলাম।

বা মনে পড়ে দুবছর আগে এক বইমেলার মাসে প্রথম আলোর শুক্রবারের সাহিত্য সাময়িকী অন্য আলোয় জি এইচ হাবীব-এর অনুবাদে হিস্পানি ভাষার লেখক ভার্জিলিও পিনেরার গল্প ‘মাংস’র কথা। “সেই আনন্দঘন পর্বের সবচেয়ে বর্ণিল ঘটনাটা ছিল নগরের ব্যালে নর্তকের গায়ের মাংসের শেষ টুকরোখানার ব্যবচ্ছেদ। নিজের শিল্পের প্রতি সমীহবশত তিনি তাঁর পায়ের আঙুলগুলো শেষের জন্য রেখে দিয়েছিলেন। তাঁর পড়শিরা খেয়াল করেছিল যে কয়েক দিন ধরে তিনি যারপরনাই অস্থির আচরণ করছেন। তো, এখন পায়ের একটা বড় আঙুলের মাংসল ডগাটা বাকি রয়েছে কেবল। এই সময় তিনি কর্তনটা দেখনোর জন্য তাঁর কয়েকজন বন্ধুবান্ধবকে আমন্ত্রণ জানালেন। রক্তাক্ত নীরবতার মধ্যে তিনি শেষ অংশটা কেটে নিলেন এবং সেটা এমনকি গরম না করেই সেই গহ্বরটার মধ্যে টুপ করে ফেলে দিলেন, যেটা এককালে তাঁর সুন্দর মুখ ছিল।” চমক ছিলো বৈকি!

কিন্তু খুব অদ্ভুতভাবে এই চলচ্চিত্রের কোথাও গরু এবং শুকরের মাংস নিয়ে বিন্দুমাত্র আলাপ দেখা যায় না। ব্যাপারটা কি ইচ্ছাকৃত এড়িয়ে যাওয়া? নাকি এখানেই ভাস্কর হাজারিকা খুব অস্ফুটে কিছু বলতে চেয়েছেন তা ভাবায়। আর এই নরহত্যামূলক পৃথিবীতে মানুষের মাংস খাওয়ায় অভ্যস্ত হয়ে যাওয়া দেখে তীব্র ঝাঁকুনি খেয়ে আমরা অপেক্ষায় থাকি পরবর্তী দিনের সংবাদপত্রের আশায়। হয়তো সেখানে ছাপা হবে ট্রেনে কাটা পড়ে মরে যাওয়া শ্রমিকদের কথা।

দুদিন আগে যখন ভাস্কর হাজারিকার অসমিয়া চলচ্চিত্র ‘আমিষ’ (aamis) দেখলাম, আবারো একটু চমকালাম নতুন করে। সিনেমার পোস্টারে লেখা ‘কনজিউম্ড বাই লাভ’, গল্পটাও প্রেমের। কিন্তু নানাবিধ মাংস খাদ্য নিয়ে যে ভারতীয় চলচ্চিত্র, সেখানে কোথাও গরু কিংবা শুকরের মাংসের উল্লেখ নেই। আর মানব-মাংস খাবারের প্রতি তীব্র দুর্নিবার আকর্ষণ, যা শেষ পর্যন্ত খুন করতেও দ্বিধা যোগায় না — সে গল্পটা কি শুধুই প্রেমের? নাকি প্রেমের আড়ালে ভাস্কর হাজারিকা আমাদেরকে মুখ না ফুটে বলতে চান আরো অনেক কথা?

২.
বাংলাদেশ লাগোয়া আসামের প্রতি চিরকালের একটা আকর্ষণ আছে, কিন্তু যাওয়া হয়নি কখনো। ‘চল মিনি আসাম যাবো, দেশে বড় দুখ রে’ শুনলে মনে হয় আসামে বুঝি চিরসুখ। যদিও ছোটবেলা থেকে কামরূপ কামাক্ষ্যার দেশের নানাবিধ তান্ত্রিক গালগল্পের মধ্য দিয়ে আসাম কিছুটা ভীতিও জুগিয়েছিলো। কিন্তু প্রতিমা বরুয়া পান্ডে যখন গেয়ে ওঠেন গোয়ালপারিয়া গান… আর সেই মাটির গানে লেপ্টে থাকে অদ্ভুত এক দার্শনিক বাক্য ‘বান্ধিছেন ঘর মিছা, মিছা দ্বন্দ্বের বাজে গো সাঁইজী কোন রঙে’, যা পরবর্তীতে পাপন গেয়ে ওঠেন কোক স্টুডিওর রঙিন ক্যানভাসে — আসামকে তখন নতুন করে চিনতে হয়। আর কালিকা প্রসাদদা যখন গেয়ে ওঠেন ‘এই স্বপ্ন দুচোখ মেলে জেগে দেখা যায়, যদি নয়নতারায় বোসো তুমি’… আসামকে নিজের ভাবতে ইচ্ছে করে। অবশ্য এই সবকিছু ছাড়িয়ে বোধহয় ভুপেন হাজারিকার অসংখ্য গানই কানে বাজে বেশি…

আসামের ভাষা আন্দোলন, গান যতটুকু আকর্ষণ তৈরি করে, চলচ্চিত্র ততটুকু খোঁজে থাকে না। তবু আমাদের জানা থাকে প্রথম কৃত্রিম লাইট, ফ্ল্যাশব্যাক মন্তাজ, টেলিপ্যাথি শট আর সাবজেক্টিভ ক্যামেরা ব্যবহার করে ভারতীয় চলচ্চিত্রের চেহারাই পাল্টে দিয়েছিলেন এক অসমীয়া পরিচালক— দেবদাসখ্যাত প্রমথেশ বরুয়া। আর কোনোরকম প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা, তারকা অভিনেতা, চিত্রগ্রাহক ছাড়াই, এমনকি প্রায় বিনা বাজেটে বানানো অসমিয়া চলচ্চিত্র ‘ভিলেজ রকস্টার্স’ যখন মিলিয়ন মিলিয়ন বাজেটের তারকাখচিত মুম্বাই, তামিল ইত্যাদি চলচ্চিত্রকে হতবাকের বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে একমাত্র সিনেমা হিসেবে ভারতের প্রতিনিধিত্ব করে অস্কারের বাজারে — আর অর্জন করে নেয় ভারতীয় জাতীয় পুরষ্কার — তখন বিস্ময়ের সীমা থাকে না। আমরা তখন সেই বিস্ময়-জাগানিয়া নির্মাতা রীমা দাসের চলচ্চিত্র দেখার জন্য অন্তর্জাল তোলপাড় করি, দেখার সুযোগ মেলে না। কিন্তু রীমা দাস আবার নতুন করে আগ্রহ জাগিয়ে তোলেন অসমিয়া চলচ্চিত্রের প্রতি। সেই আগ্রহ না মিটতেই নির্ভরযোগ্য একজন চলচ্চিত্র দর্শকের কাছে যখন ‘আমিষ’ এর উচ্চ প্রশংসা শুনি, দেখার জন্য ব্যাকুল হই। কিন্তু যথারীতি কোথাও না পেয়ে শেষ পর্যন্ত ‘গোপন সূত্রে’ সংগ্রহ করে দেখে ফেলি। এবং বিস্মিত হই।

আমিষ (aamis). Writer & Director: Bhaskar Hazarika
Stars: Lima Das, Arghadeep Baruah, Neetali Das.
Assamese. 1h 47min
(ছবি: আমিষ (aamis) ছবির দৃশ্যে লিমা দাস ও অর্ঘ্যদ্বীপ বরুয়া)

৩.
শিশুরোগ চিকিৎসক নির্মালির স্বামীকে পেশাগত প্রয়োজনে বেশিরভাগ সময় শহরের এমনকি ফোন নেটওয়ার্কের বাইরে থাকতে হয়। শিশুসন্তান নিয়ে নির্মালি একাই শহরে থাকেন। কিন্তু বন্ধু ঝুমির মতো পরকীয়াতেও তার আগ্রহ নেই। এর মধ্যেই পরিচয় হয় সুমনের সঙ্গে, যে মূলত উত্তর-পূর্ব ভারতের খাদ্যাভ্যাস নিয়ে গবেষণা করছে পিএইচডির জন্য। বিভিন্ন প্রাণীর মাংস বিষয়ে তার আগ্রহ আছে। সাপ, জোঁক, ব্যাঙ, বাদুর, খরগোশ… সব খায়। সুমন ও তার খাদ্য-নিরীক্ষা নির্মালির নিঃসঙ্গ নিস্তরঙ্গ জীবনে নতুন দ্যোতনা তৈরি করে। তাদের প্রেম তৈরি হয় কিন্তু তা করার সাহস নেই। পরষ্পরের প্রতি শারিরীক আকর্ষণ তৈরি হয় কিন্তু তা ঘটিয়ে ফেলার সাহস নেই। যদিও সুমন চায় নির্মালির আরো গভীরে প্রবেশ করতে! কী করবে সে?

সাদামাটা একটা পরকীয়া প্রেমের গল্পের গতিপথ ভাস্কর হাজারিকা ঠিক এখান থেকেই পাল্টে দেন। পাল্টে দেন এমন এক প্রক্রিয়ায়, যা দেখে দর্শক থমকে যাবে, চমকে যাবে। যা মানুষের স্বাভাবিক চিন্তা আর অভিজ্ঞতার বাইরে। সুমনের শরীরের এখান থেকে ওখান থেকে একটু একটু করে মাংস রান্না করা খাবার হয়ে ঢুকে যেতে থাকে নির্মালির অভ্যন্তরে। এই নতুন ভিন্ন স্বাদে নির্মালি ক্রমশ অভ্যস্ত হয়ে ওঠে, ঠিক যেভাবে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে মানুষখেকো বাঘ!

কিন্তু খুব অদ্ভুতভাবে এই চলচ্চিত্রের কোথাও গরু এবং শুকরের মাংস নিয়ে বিন্দুমাত্র আলাপ দেখা যায় না। ব্যাপারটা কি ইচ্ছাকৃত এড়িয়ে যাওয়া? নাকি এখানেই ভাস্কর হাজারিকা খুব অস্ফুটে কিছু বলতে চেয়েছেন তা ভাবায়। আর এই নরহত্যামূলক পৃথিবীতে মানুষের মাংস খাওয়ায় অভ্যস্ত হয়ে যাওয়া দেখে তীব্র ঝাঁকুনি খেয়ে আমরা অপেক্ষায় থাকি পরবর্তী দিনের সংবাদপত্রের আশায়। হয়তো সেখানে ছাপা হবে ট্রেনে কাটা পড়ে মরে যাওয়া শ্রমিকদের কথা। তাদের থেতলে যাওয়া মাংস আমরা আড়াল করবো সভ্যতার চোখ থেকে, ছেপে দেওয়া হবে শুকনো রুটির ছবি। মানুষগুলো ভোগে যাবে অন্যকিছু মানুষের। যেভাবে গিয়েছে অতীতে, যেভাবে যাবে ভবিষ্যতেও…

৪.
খুব সংবেদনশীল মানুষের জন্য সংবিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ সাইনবোর্ড — শিশুদের জন্যও। অন্যরা দেখুন, ভাবুন… ঋত্বিক ঘটকও যদিও বলেছিলেন ভাবনাটা প্র্যাকটিস করতে, আমরা তা করিনি। ভাস্কর হাজারিকা মনে করিয়ে দিলেন। তাঁর ব্যাপারে আগ্রহ জাগলো। সুযোগ পেলে তাঁর কথানদীটাও দেখার ইচ্ছে থাকলো। এটুকু আগ্রহ তিনি জাগাতে পেরেছেন। লিমা দাস আর অর্ঘ্যদ্বীপ বরুয়ার অভিনয় ভালো লেগেছে, অনেকটাই সাবলীল। রিজু দাসের চিত্রগ্রহণও ভালো লেগেছে।

সংযুক্তি

  1. ট্রেলর : আমিষ
  2. রানা মেহের’র গল্প : পোকাদের দল পাতকুয়ায় ফেরে
  3. জি এইচ হাবীবের অনুবাদে ভার্জিলিও পিনেরা’র গল্প : মাংস
  4. রামস্টেইনের গান : mein teil
  5. আরমিন মাইভেস এর উইকিপিডিয়া ভুক্তি
  6. আমি তোমারই নাম গাই
  7. দিনে দিনে খসিয়া পড়িবে (প্রতিমা বরুয়া পাণ্ডে)

Meghchil   is the leading literary portal in the Bengali readers. It uses cookies. Please refer to the Terms & Privacy Policy for details.