মায়াগ্রস্ততা
আলোর সুড়ঙ্গ দিয়ে গড়াতে গড়াতে প্রদোষের শ্রান্তির মধ্যে এসে পড়তেই চারদিককে এক বিপন্ন মায়াগ্রস্তের মতো মনে হয়। ঝুমঝুমির মতো গাছগুলো পাখিদের ফেরার শব্দে ঝুমঝুম করে চলে। তারপর নদীর গন্ধে বুকে একফালি চাঁদের জন্য টান পড়ে। কিন্তু তখনো কিছু বাকি থেকে যায়। একটি প্রতিমার মুখ হাত ফসকে পড়ে গেল বলে সেই শোক বুকে করে একটা শতক ক্ষয় করে চিতার আগুনে নিভে গেছে, যেই গান তার জন্য বুক পোড়ে, সেই গল্পের ডাল বেয়ে না-ফেরা এক মানুষের গামছার গন্ধ শুঁকে কাউকে কাউকে দেখি পাড়ি দেয় জোয়ারের নদী, তারপর কোনো এক ভাটিয়াল সুরে তার নৌকোর দিশা হারাবার শোকগাথা রেখে একদিন কাগজের নৌকো হয়ে তাকে চলে যেতে হয় জলের মধ্যে জল হতে।
জলের দুঃখ কি জানে কেউ, জানবার কথা ছিল যাদের? শব্দের মধ্যে শব্দ ঢেলে জল চলে যায় নদী হয়ে আর কবির বুকের মধ্যে এক কবিতার জন্মব্যথা বাসা বাঁধে জীবনের আশ্বাস পেতে। তখন হয়তো বাদুড়ের ডানার প্রবাহে অন্ধকার ঝুলে পড়ে ঝিঙুরের শব্দের ভাঁজে। আমি যে কোথায় যাব, কার কাছে পৌঁছাবার জন্য বেরিয়ে হারিয়ে ফেলেছি পথ, তার তল পাই না এখন। কেবল বুকে তার গন্ধমেদুর নিয়ে হেঁটে হেঁটে পাড়ি দিয়ে এইখানে এসে টের পাই, আঙুলে এখনো তার ঘামের গন্ধ আগরের মতো মোহময়, এখনো রক্তে তার নোনতা নোনতা কেঁপে ওঠা! হয়তো যুগল হয়ে হাঁটি, তবু মনে হয় হারিয়ে ফেলেছি তার হাত, তাকে আর পাব না পাঁজরে।
আমি যে কোথায় যাব, কার কাছে পৌঁছাবার জন্য বেরিয়ে হারিয়ে ফেলেছি পথ, তার তল পাই না এখন। কেবল বুকে তার গন্ধমেদুর নিয়ে হেঁটে হেঁটে পাড়ি দিয়ে এইখানে এসে টের পাই, আঙুলে এখনো তার ঘামের গন্ধ আগরের মতো মোহময়, এখনো রক্তে তার নোনতা নোনতা কেঁপে ওঠা!
বালিশে এখনো আছে চুলের গন্ধ মেখে তবু স্পর্শের স্বীকারোক্তি চাই। নিষ্ফল মনে হয়, তাই বুঝি বীজ বপনের কামনায় মাঠের পাঁজর ভিজে ওঠে, জিকিরে জিকিরে তার কিষানের আবাহন! একটা গুইসাপ কোত্থেকে লম্বা জিব বের করে হেঁটে চলে গেল আমাকে পাত্তা না দিয়েই। নিঝুমের মধ্যে কত গল্পের শেষ থামে, কত জীবনের জন্মের ক্রন্দন হয়; তাই মনে হয় যাকে খুঁজে এইখানে এসে দাঁড়ালাম, তার উঠোনের ধুলো আমার শরীরে মেখে আছে? নাকি সে আমাকে তার আঙিনার থেকে ঠেলে দিয়েছে মাঠের বুকে পথে পথে ভিখেরির মতো যমজ বেদনা সন্ধানে?
একদিন বেদনার সন্ধানে একদল ছায়া সমগ্র পৃথিবীর বুক তোলপাড় করে পরস্পরকে আবিষ্কার করেছিল বলে, বাতাসে কান্না শোনা গেল! কফিনের চারপাশ ঘিরে যারা বসে ছিল, তাদের হাড়ের ঘ্রাণে নীলমণি লতা জন্মাল, সেই ফুলে বিষাদের রং। যেইখানে আছি আজ, সেইখানে বড় বেশি মায়া, তাই ফিরে যেতে সাধ নেই, থেকে যেতে যেতে শেওলার গন্ধ হতে শখ হয়, নিজেকে ধুলোর মধ্যে ধুলো করে দিতে এক বাসনার সাড়া পাই, কী করে এড়াই তাকে? হাত ফসকানো প্রতিমার মুখ সন্ধানে একটা বয়স কেটে গেলে একদিন টের পাই, আমার দুহাত আজ প্রতিমার মুখ গড়ে দিতে পারে!
কিন্তু সে আদল মেলে না তবু; এই খেদ বুকে নিয়ে মাটি ছেনে ছেনে নির্মাতার পরাজয়ে পরাজিত হই! নিজের সঙ্গে যেই পরাজয়, তার কথা জানি শুধু আমি, তাই সুড়ঙ্গের মধ্য দিয়ে একদিন আলো নয়, অন্ধকার খুঁড়তে খুঁড়তে প্রদোষের গন্ধ পেয়ে থমকে দেখি কারোর কুটির জুড়ে দাউ দাউ দাবানল হয়ে বিষাদের উল্লাস, সেই অন্ধকারের মাঝে জোনাকির হাহাকার টের পেয়ে, আমাকে নাড়তে হলো কড়া। ভেতর থেকে কারোর দীর্ঘশ্বাস জানাল, এখানে আমার আর প্রয়োজন নেই। তাই ভালো লাগে বেঁচে থাকবার টান, যেন কেউ গুন টানে আর আমি নিজেকে সঙ্গে করে বয়ে নিয়ে যাই অনেক দূরের দিকে, যেইখানে সব অভিমান গলে জল হয়ে আমাকে ইশারা দেয়, আজ যার মুখ করতলে আশ্রয় চায়।
সেপ্টেম্বর ২০১৮
অলংকরণ : রাজীব রায়