

মৃত্যুর দিকে হাঁটো, দেখো জীবন কতোটা ভালোবাসে: সেলিম মোরশেদ
সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী: মাসুমুল আলম
[তিনি, সেলিম মোরশেদ, স্বাতন্ত্র্যচিহ্নিত একজন সাহিত্যিক। একজন লেখকের (সাহিত্যিক আর লেখক এক তো না, দেবী চৌধুরানী!) প্রকাশনার সংখ্যার দিক দিয়ে মূল্যায়ন করা একপ্রকার বালখিল্যতা। আর ওই এক কাটা সাপের মুণ্ডু-র লেখক সেলিম মোরশেদ—এই পরিচয়ে তাঁকে সীমাবদ্ধ করে ফেলা হয়েছে। গত ৪০ বছর ধরে নানাসময়ে বিশাল উদগার তোলা কিছু শিল্পভোক্তা শিল্পের অঙ্গনে এসে বারবার এই জিকির তুলে গেছে।
কথাসাহিত্যিক সেলিম মোরশেদের লিখনবিশ্ব, গত ২৬ বছর ধরে তাঁকে ব্যক্তিগতভাবে চেনা-জানা, তাঁর শিল্পালোচনা, তাঁর প্রতিষ্ঠানবিরোধী অবস্থান, চিন্তনকণা, রাজধানী বা যশোরে, ফুটপাতের বেঞ্চে, রেস্টুরেন্টে, টাউনহল মাঠ, দড়াটানা ভৈরব চত্বর, কালপত্র-এর আড্ডায় অহোরাত্র শিল্পসাহিত্য বিষয়ে তাঁর তীক্ষ্ণধার মন্তব্য ও বিশ্লেষণ— এ সবের সাথেই ছিল আমার বা আমাদের আগাগোড়া পরিচিতি।
এখন, ‘মেঘচিলে’র সৌজন্যে সেসব ফের, আরেকবার, এই ব্যাপদেশে ঝালাই করে নেয়ার অবকাশ তৈরি হল।
পাঠক, সমকালীন শিল্পসাহিত্যের সুলুকসন্ধান, প্রবণতা, মিডিয়া, নিউ মিডিয়া আর এর সাথে জড়িত ‘সাহিত্যের রাজনীতি’ বা রাজনীতি ও সাহিত্যের বিষয়-আশয় নিয়ে সেলিম মোরশেদের সাথে কথাসাহিত্যিক মাসুমুল আলমের সংলাপ বা আলাপচারিতায় আপনাকে স্বাগতম।]
মাসুমুল আলম: কোনো কোনো লেখক একটি গল্প দিয়ে পরিচিত হয়ে যান। আপনি আপনার প্রথম বইয়ের কাটা সাপের মুণ্ডু গল্প দিয়ে এভাবে প্রচিহ্নিত। কিন্তু এ গল্পটি দিয়ে চেনাজানার একটা দেয়াল তৈরি হয়ে গেছে। কেননা, পাঠক কেবল এই নামটিই বলে থাকে। আপনার বইয়ের চেনা-জানা, সুব্রত সেনগুপ্ত, বদ্ধ, বোধিদ্রুম তাদের কাছে অচেনা থেকে গেছে। আপনার কি তাই মনে হয়?
সেলিম মোরশেদ: কথাটা সত্য। সাহিত্যের বোধহয় নিয়তি থাকে। একবার কারো কিছু একটা নিলে, পরে তার চেয়ে অধিক হলেও অন্য লেখাগুলো পাঠকের কাছে প্রতিতুলনায় অতোটা গ্রহণযোগ্য হয় কিনা এটা প্রশ্নই থাকে। এটা সব লেখকের ক্ষেত্রে একই রকম।
মাসুমুল আলম: কারা আপনার পাঠক? ৪০ বছর আপনার নিজস্ব পাঠকগোষ্ঠীর বাইরে মেইনস্ট্রিম ফোর্সের কাছে আপনি যেতে পেরেছেন বলে মনে করেন?
সেলিম মোরশেদ: খুব একটা না। তবে বর্তমান পরিস্থিতি কিছুটা পাল্টিয়েছে বলেও মনে হয়।
মাসুমুল আলম: কাটা সাপের মুণ্ডু–তে লেখক হিসেবে আপনি স্বয়ং হাজির নাজির: ‘আর অদ্ভুত হেমাঙ্গিনীকে আমি সাহস জোগাই‘। একটি মোচড়ে এইখানে শিল্পের নতুন বীজতলা তৈরি হয়ে যায়। অথচ এটুকু বাদে এটা আবহমান গল্পধারায় একটি প্রচলিত গল্প হয়েই থাকত। অথচ আপনার অনেক এন্টি-ন্যারেটিভ টেক্সট রয়েছে। ভিন্ন ধারার গল্প। পাঠক যদি কেবল এই গল্পটি নিয়ে থাকে তাহলে বাংলা গল্পের এক্সপেরিমেন্টাল ধারার গল্পে আপনার আস্থাবোধ কতটা থাকে? একটা অনুসিদ্ধান্ত হিসেবে নিলে ভালো হয় যে, এই পাঠকেরা আবার একাদিক্রমে লেখকও, যারা নিজেরা এক্সপেরিমেন্টের ধারে-কাছেও নেই।
সেলিম মোরশেদ: আসলে বাংলাদেশের পাঠক প্রচলিত ধারার গল্পই তো ভালো করে পড়েননি। তাঁদের হাতের কাছেও আসেনি। তাঁরা নিজেরাও খোঁজেননি। ফলে, যাঁরা আলাদা দৃষ্টিভঙ্গির লেখা পড়েছেন; তাঁরা সংখ্যায় কম এবং খুব একটা অভ্যস্ত না। এখন আমার যেটা মনে হয়, নিরীক্ষা-পরীক্ষা লেখকের অন্তর্গত রসায়ন যখন যোগফল, সেই যোগফল যখন পাঠকের কাছে তখন সেই কাহিনি, আখ্যান, নিটোল গল্পের আদলটাই চাই। তাই বিষয়টা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। সময় এবং পরিস্থিতি যদিও পাল্টিয়েছে। ইনিয়ে-বিনিয়ে কথা বলা বাদ দিয়ে চিন্তাশীল গদ্যের প্রতি পাঠকের আগ্রহ দেখছি। স্রেফ বিনোদনমুখিনতা তাদের বাস্তবতার সঙ্গে এখন আর যায়ও না। এটা প্রবন্ধ লিখে বা সাক্ষাৎকার দিয়ে বোঝানোর বিষয় না। পাঠককে নিজে বুঝে নিতে হবে, সাহিত্যে আপনি কী চান । সত্য আর সৌন্দর্য! অন্তত যারা ন্যূনতম পড়াশোনায় আগ্রহী, অন্যান্য ধারাগুলো বাদই দিলাম; তাই যদি হয়, দেখেন, আপনার গোটা জীবনের বা অনুভব সমস্ত মন বা চেতনার কোনো দিক এই লেখাগুলো নেয় কি? সে নিজেও বোঝে। তার পরেও পড়ে কেন? রাজনীতির ছায়ায় কিংবা কোনো প্রভাবশালী প্রকাশনা, সংগঠন এগুলো প্রমোট করে। আমার ব্যক্তিগত বেদনা যেটা, কখনোই এই মানুষগুলোর কাছ থেকে মতামত বা যাচাই বিষয়টা নিতে পারলাম না, যে আমি তাদের লেখক কিনা।
মাসুমুল আলম: মধ্যবিত্ত শিল্পরুচিকে ঠাট্টা করে আপনি তো একসময়, চেনা-জানা গল্পে ‘আর্ট মানে আরাম’ অম্লানদের গল্প—এর শুরুটাই তো শিষ্ট পাঠকের কর্ণকুহরে বিষ ঢেলে দেয়: দাদন, মদন, চোদন, তিনজন। অতএব, এই শ্রেণি আপনার স্টোরিলাইন পাওয়া যায় এমন গল্প নিয়ে মাতবে এটাই স্বাভাবিক। আপনার কাছে প্রশ্ন, কোন ধরনের গল্পে আপনার পক্ষপাতিত্ব? শুধু নিজের না, অন্যের লেখা গল্পপাঠের ক্ষেত্রেও আপনি কি ধরনের নির্ণায়ককে গুরুত্ব দেবেন? যখন স্মার্ট গদ্য লেখাই আধুনিক সাহিত্য না।
সেলিম মোরশেদ: মধ্যবিত্তের শিল্পরুচিকে শুধু না, তাদের যে যাপন আর ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া, আমার ভেতর তাদের নিয়ে বেশিরভাগ সময় কৌতুকই তৈরি হয়। আবার পারফেক্ট মিডলক্লাস কারা এটা নিয়েও বিভ্রান্তিতে পড়ি, মধ্যবিত্তের কোনো ধরনের সংজ্ঞার সাথে এরা যায় না। কখনো ধনীদের মতো আচরণ, কখনো জ্ঞানীদের মতো কথা বলা— একটা প্রপঞ্চ-সুবিধা নেয়ার প্রক্রিয়াটা এতো নোংরা, শ্রেণি হিসেবে দুর্বৃত্ত-পুঁজির, বণিক-পুঁজির না। ফলে, এরা একেবারেই বিশ্বস্ত না।
আর আমি সবধরনের লেখাই নিতে পারি। তবে মূল্যায়নটা বোধ হয় এমন, লেখক যতো মায়া-মমতা নিয়েই লিখুক বা বলুক-না কেন, আসলে কোন শ্রেণির প্রতি সেই লেখকের পক্ষপাত, সেটাই লক্ষ করি। ভালো-লাগা মন্দ-লাগা বিষয়টার চেয়েও ওটাই আমার কাছে নির্ণায়ক।
মাসুমুল আলম: ছোটকাগজই একমাত্র এক্সপেরিমেন্টাল লেখা ধারণ করার সাহস দেখায়। সেটা আপনি বিলক্ষণ জানেন। এবং আপনি কি বিশ্বাস করেন পিউরিটান দৃষ্টিভঙ্গি, সৌন্দর্যচেতনার নামে ছোটকাগজ এবং বড়কাগজের মাঝে কিছু সাহিত্য পত্রিকা বা ওয়েবজিন নিরীক্ষার নামে একটা গ্রহণযোগ্য মাত্রার বোল্ডনেসের সাথে ড্রইংরুম সাহিত্যের ভাষ্যে মারিও ভার্গাস য়োসা বর্ণিত SWEETENED SHIT উপস্থাপন করে থাকে। পপুলার হতে চাওয়া কর্পোরেট গ্লামারাস লেখক ‘সিরিয়াস’ অভিধায় ট্রিট হয়। এদের সাথে কখনো একই পঙক্তিতে সূচিবদ্ধ হতে চাইবেন আপনি?
সেলিম মোরশেদ: অনেকগুলো বিষয় একসঙ্গে বলেছেন। শুধু এক্সপেরিমেন্টাল লেখা নয়, নিষ্ঠা এবং স্থৈর্যের জন্য ছোটকাগজের প্রয়োজন। হ্যাঁ, বিশ্বাস করি, ছোটকাগজের ভেতর অনেক ঝুঁকি নিতে হয়। তাদের লেখায় শুধু সাহিত্যের ছোঁয়াই নয়, নতুন গুড়ের গন্ধ। মনটা ভালো করে দেয়। আবার কারো কারো কবিতায় ছন্দ, পর্ব, মাত্রা প্রাতিষ্ঠানিক ভয়ে ভীতু হৃদয়, সবই পাবেন। শুধু ঠিক বিচার করে দেখবেন যখন, যে শিল্পতত্ত্ব বা যে শিল্পনন্দনের আমরা সমালোচনা করি, তাদের মূল্যবোধ সেইসব জীবনের অবলোকনে। এগুলো নানা কৌশলে আমাদের সামনে এসেছে। আমার পরবর্তী জেনারেশনের একজন আপনি মাসুমুল আলম। আজ বোধহয় পরবর্তী বলা সমীচীন না। মেঘে মেঘে বেলা হলো। আপনারও পঁচিশটা বছর হয়ে গেলো। কথাসাহিত্যে নয়টা বইও লিখেছেন। ‘নামপুরুষ ও অন্যান্য’ বইয়ে শহুরে মধ্যবিত্ত একটা মেয়েকে ঘিরে লেখক-শিল্পীদের যে আশ্রয়-আকাঙ্ক্ষা দেখিয়েছেন; নাম দিয়েছেন ‘স্বৈরিণীর জন্য প্রতীক্ষা’। আমি হলে হয়তো স্বৈরিণী শব্দটা দিতাম না। না, মধ্যবিত্তের ভয়ে না, এই জন্যে যে, ঘটনাটা আমার নিজেরও দেখা। যদিও গল্পটা আপনি লুম্পেন শ্রেণির আলোকেই লিখেছেন। এভাবে লেখা দেখার বিচার করতে চাই না। শিল্পীর লেখার বৈচিত্র্য, সেটা সীমাবদ্ধ হয়ে পড়তে পারে। আমি আপনার প্রশ্নের সূত্র ধরেই বলব, আমার অর্জন অইটুকুই, যে আমি সিরিয়ালে সূচিবদ্ধ হলেও আমার লেখা ওই স্বাদ দেবে না।
আমি মানবতাবাদী লেখক না। আমি ছাড়-দেয়া লেখক না। আমি তরুণদের বলবো, মৃত্যুর দিকে হাঁটো। দেখো, জীবন কতোটা ভালোবাসে।
মাসুমুল আলম: অনেকে ড্রয়িংরুম বা ক্যাফে সাহিত্য আড্ডায় বা ফেসবুক লাইভে, বইমেলার পার্বণে অথবা টিভিতে গিয়ে শুধু দল বেঁধে-চলা সিন্ডিকেটের কয়েকটি নাম উচ্চারণ করে চলে আসে। যতই সহচর হোক, ভুলেও তাঁরা সেলিম মোরশেদ, শোয়েব শাদাব, শান্তনু চৌধুরী, শামসুল কবির (ইচক দুয়েন্দে), রোকন রহমান বা আহমেদ নকীবের নাম অকুস্থলে গিয়ে উচ্চারণ করেন না। অথচ সন্ধেবেলায় একসাথে বসা বা আড্ডা হবে। এ বিষয়ে আপনার কিছু বলার আছে?
সেলিম মোরশেদ: দাতা এবং গ্রহীতা বলে দুটো শব্দ আছে। ওরা আসে গ্রহণ করতে। আর কেউ ভাবলেও আমি কখনো তাদেরকে সঙ্গছাড়া মুহূর্তকালের জন্যেও বন্ধু ভাবি না কিংবা সতীর্থ। যূথবদ্ধটা তৈরি করতে এরা আসেনি। আপনি টেলিফোনে বলেছিলেন, হাংরি’র অমর মিত্র সরকারি টিভিতে শেষে সুবিমল মিশ্রের নাম বলে গেলো। এখানে কেন হয় না! এখানে এই জন্যে হয় না, শান্তিরঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় পর্যন্ত, সুবিমল বসাক, বাসুদেব দাশগুপ্ত থেকে সাধন চট্টোপাধ্যায় পর্যন্ত, অমর মিত্র, শৈবাল মিত্র, স্বপ্নময় চক্রবর্তী প্রমুখ একই চিন্তার লেখক আছেন। অমিয়ভূষণ মজুমদারের কথা এখানে থাক, আপনি আমার চেয়ে আরো জেনে গেছেন, এদের একটা কমন এগ্রিমেন্ট (কনসেপচুয়ালি) রয়েছে সাহিত্যের বিষয় নিয়ে। অর্থাৎ ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যই শুধু কাজ করেনি, সাহিত্যের টেক্সট, সময় এবং চিন্তার ঐক্য রয়েছে। ফলে, এরা অন্যের এ লেখাকে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যে ব্যক্তিসফলতা মনে করে না। এরা এটাকে সামষ্টিক সফলতা মনে করে।
কিন্তু বাংলাদেশে সত্যিকার অর্থে বাম রাজনীতি এবং যেকোনো বিকল্প চিন্তার ব্যর্থতা লেখক-মননেও যেভাবে প্রভাব বিস্তার করেছে, ফলে অনেকের দৃষ্টিতেই লিটল ম্যাগাজিনের সাথে ঐক্য করাটা লাভজনক মনে করেনি তাই।
আরো একটা বিষয়, আমাদের এখানে সর্ষের ভেতরে ভূত আছে। ঠিক সেইভাবে বিভক্তিকরণ হয়নি। ওখানে একটা মলয় রায়চৌধুরীর লেখার সাথে একটা সুবিমল মিশ্র এবং একজন বাসুদেব দাশগুপ্ত’র তুলনা হবে। একজন দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাথে একজন শান্তিরঞ্জনের তুলনা হবে। সুবিমল মিশ্রের সাথে কখনো রবিশংকর বলের তুলনা হবে না। মলয় রায়চৌধুরীর সাথে কখনো আবুল বাশারের তুলনা হবে না। এই ধারাটা প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু এখানে আপনার লেখার সাথে প্রথম আলো পুরস্কারপ্রাপ্ত একজন আপনার সমবয়সী লেখকের প্রতিতুলনা হয়। এই ধারাটাকে নষ্টও করেছে আমাদের ভেতরের সেইসব সতীর্থরা, আর দু’একটা পত্রিকা। যারা বলেছে, ভালো লেখাটাই আমরা দেখি। কেননা, সাধারণ গদ্যটাও ওদের হাতে আসেনি। একটা ছড়া লিখতে বলেন, পারবে না। ছড়া হলো লেখকের শিল্পযাত্রা করার শিল্পমনের প্রথম ধাপ।
মাসুমুল আলম: আপনি কি ধরেই নিচ্ছেন, যে ধরনের গল্পভুবন আপনি তৈরি করেছেন, তাতে সাধারণ পাঠকগোষ্ঠীর কাছে এই ৪০ বছরে আপনার লেখা পৌঁছেছে? কিংবা দেরি করে হলেও এখন পৌঁছোচ্ছে। এতটা দেরি হল কেন?। নাকি ট্রাডিশানাল গল্পধারার বাইরে যে আপনার গল্প/লেখালেখি তার জন্য এক শ্রেণির লেখকরাই আসল পাঠক? তাই যদি হয়, তারাও কি তবে ‘ঘটনাপ্রধান গল্প’ ধারার বাইরে কোনো নিরীক্ষাপ্রবণ পাঠকৃতি গ্রহণে সক্ষম বলে আপনি মনে করেন? যদি করেন তাহলে কাটা সাপের মুণ্ডু-র আপনার চেনা-জানা, দি পার্ভার্টেড ম্যান, কান্নাঘর নিয়ে কথাবার্তা কিন্তু হত। তাহলে কি এই লেখক-কাম-পাঠক গোষ্ঠী, এঁরাই আসলে ট্রাডিশনাল গল্পখোর? এমন পরিস্থিতিতে আপনি কি আশাবাদী?
সেলিম মোরশেদ: আমরা যতোই মিডিয়াকে দোষ দেই-না কেন, মিডিয়াকেও জনগণের কাছে পরীক্ষা দিতে হয়। আজকে মিডিয়া যদি বলে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চেয়ে এখানে একজন তরুণ লেখক অনেক বড়, কালকে হয়তো তার এক হাজার সার্কুলেশন কমে যাবে। তার মানে মিডিয়া-কেন্দ্রিকই যে সবসময়, তা না। মিডিয়া এখানকার সেই জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করে যে জনগোষ্ঠীর রুচিটা অনেক ধীরে ধীরে তৈরি হয়েছে। আর সেই ধীরে ধীরে তৈরি হওয়া রুচিটাকে শুধু মিডিয়াই লেখক তৈরি করে বানিয়েছে তা না। ট্রাডিশনাল-খোর লেখকরাও সেই জনরুচির উপরে দাঁড়িয়ে মিডিয়াকে ব্যবহার ক’রে তারা সম্মানিত হয়েছে বা সম্মানিত হচ্ছে; যেকথা আপনি বলছেন।
আমার লেখা যারা নিচ্ছে, তাদের প্রতি আমি কৃতজ্ঞ এই জন্যে, যে ওই সম্মানিত ওই মিডিয়া ওই ট্রাডিশনাল খোর লেখকগুলো এখন যথেষ্ট পরিমাণ উপেক্ষিত হচ্ছে। তাই তারা পুরস্কার এবং সম্মাননা, মর্যাদা, পোস্টার এগুলোর দিকে ছুটছে। সেক্ষেত্রে আমি আশাবাদী।
মাসুমুল আলম: আপনার গল্প বলার স্টাইল—ফর্মের প্রকরণ ও প্রয়োগ—অনেক অল্প বয়সেই আপনি একটি সাহিত্যভাষা পেয়ে গিয়েছিলেন বলে আমার মনে হয়। এ সময় আপনার লেখা বদ্ধ, নীল চুলের মেয়েটি যেভাবে তার চোখ দুটি বাঁচিয়েছিলো আপনার দু’টি অসাধারণ গল্প। যদিও এ-দুটোর গল্পের পাশাপাশি তরুণ প্রজন্ম আপনার সুব্রত সেনগুপ্ত, চেনা-জানা, দি পার্ভার্টেড ম্যান, অম্লানদের কথা—সমকালের অভিজ্ঞতাঋদ্ধ এ গল্প ৪টিকে তাদের টাইম এন্ড স্পেসের সাথে মিলিয়ে নেবে। পরিণত বয়সের লেখালেখিতে এসে আপনি আবহমান আখ্যানের ধারায় গল্প লেখার প্রয়োজনীয়তা কখনো অনুভব করেছেন?
সেলিম মোরশেদ: কখনো কখনো।
মাসুমুল আলম: আমরা এক অদ্ভুত নীরব সময় পার করছি। শুধু গ্রুপভিত্তিক হলেই হবে না, ক্ষমতাকেন্দ্রিক সিন্ডিকেটের অংশ না হলে, সে আপনি যতই ‘ইলিয়াড-অডেসি’ লেখেন (ভালো হলে ভালো লেখক নিজেই টের পায়) কোনো খবর হবে না। কেউ বুঝবে না। কেউ হয়তো পড়বেই না। কেননা, লেখার চেয়ে লেখক এবং কোথা থেকে বইটা বের হল সেটা তাদের কাছে ফ্যাক্টর। আর সর্বশেষ কেউ কেউ পড়লেও চুপ করে থাকবে। এরকম একটি বক্তব্য আপনি কি সমর্থন করেন?
সেলিম মোরশেদ: হ্যাঁ, সমর্থন করি এই কারণে; আপনাকে শুরু থেকে একটা ঘটনা ধরে বলি, বইমেলায় আখতারুজ্জামান ইলিয়াস একবার আমাকে বলেছিলেন, আশির দশকের মতো এতো প্রতিভাবান লেখক আর কখনো আসেনি। যদিও আমার প্রিয় আশির দশকের অনেক লেখকই। কিন্তু আমরা যখন লিখতে যাই, তখন আমি মামুন হুসাইন এবং তারেক শাহরিয়ারের লেখাকে ঈর্ষা করতাম। এই কারণে, যে আমার বিষয়বস্তুগুলো ঘুরেফিরে মনে হতো যেন ওরা লিখছে। এই এতোগুলো লেখক কোথায় গেলো? তাহলে নিশ্চয়ই এই নিরাশা তাদের পরবর্তীকালে জীবন-জীবিকার প্রয়োজনটাকে আরো ত্বরান্বিত করে সেদিকেই চলে গিয়েছে।
আমি মনে করি এই চুপ থাকার অর্থটাই হলো এই, তাদের হীনমন্যতা, অথবা তারা ইনসিকিউরিটিতে ভুগছে যে তাদের যে আইডেন্টিটি, সেটা বোধহয় পড়ে যেতে পারে সেই জন্যে।
আপনার পেশা যদি কথিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির কাছে সম্মানিত হয়, যদি রাষ্ট্রীয় কিছু পুরস্কার পান, লেখকের অর্থনৈতিক সাহায্য করার কিছু ক্ষমতা থাকে, ইলিয়াড-অডেসি অতদূর কেন, আপনি মাসুমুল আলম এ পর্যন্ত যা লিখেছেন, তার ভেতর থেকে কতকিছু আবিষ্কার হবে! তখন সবাই বুঝবে এই লেখাগুলো ইলিয়াড-অডেসিই হবে। আমার সারা জীবনের ধারণা ছিল, একজন লেখক অবিরত শ্রম দেবেন ভালো লেখার জন্য। লেখকের আর কিছু করার নেই। এখন দেখছি অনেক কিছু লাগে। এই ভোগবাদী সমাজে ভালো লেখক হওয়া একমাত্র শর্ত নয়, লেখকের উপরে ভর করা যায় এমন ক্ষমতাও লেখকের অর্জন করতে হবে।
মাসুমুল আলম: শিল্প-সাহিত্যে পরম্পরা আছে। তবু প্রচলের পথ ছেড়ে নিজের একটা ভাষা, নিরীক্ষাপ্রবণতা কোনো কোনো লেখকের অন্বিষ্ট হয়। সুবিমল বা আপনারও পূর্বসূরি বা উত্তরসূরি আছে। সুবিমলের আগে সুভাষ ঘোষ, দীপেন্দ্রনাথ…এমনভাবে সেই পূর্বসূরি হয়তো জগদীশ গুপ্ত। আমাদের তথাকথিত শিক্ষিত মধ্যবিত্ত পাঠকগোষ্ঠী এঁদেরকে গ্রহণ করতে পারে না। এই আত্মাভিমানী পাঠক-এঁদের অনেকে লেখক-এঁরা মাহমুদুল হককে সিরিয়াস অভিধায় উন্নীত করতে চান। একইসঙ্গে, সৈয়দ শামসুল হককে-ও। কিন্তু প্রকৃত প্রস্তাবে এ দু’জনের জনপ্রিয় লেখক হবার কথা ছিল। অথচ জনপ্রিয় হতে গিয়েও হতে পারেননি পিছিয়ে থাকা পাঠকগোষ্ঠীর ভুল মূল্যায়নের জন্য। আর মূলধারার ট্রাডিশনাল লেখক, তাঁদেরও তো পূর্বসূরি ও উত্তরসূরির ধারাবাহিকতা রয়েছে এবং প্রবলভাবেই রয়েছে। বর্তমানের কমিউনিকেটিভ গদ্যের কোমল বিহবল আখ্যানশিল্পীরাই ‘বাংলাদেশের সাহিত্যে‘ মাহমুদুল হক কে নিয়ে উচ্ছ্বসিত প্রসঙ্গ উত্থাপন করছেন। এ বিষয়ে আপনার অভিমত জানতে চাচ্ছি।
সেলিম মোরশেদ: আমাদের শিক্ষিত মধ্যবিত্ত পাঠক এঁদেরকে নিতে পারেন না। তার কারণ হলো, মুখে যতই তারা ভারী কথা বলুক, শিল্প-সাহিত্য বা সিনেমা বলতে তারা বিনোদনমুখিনতাই বোঝে। আপনি যে লেখকগুলোর নাম বললেন, আপনার জীবনের অফুরন্ত ভোগেচ্ছা তৈরি হবার মতোন কোনো ধরনের বিষয়বস্তু নিয়ে এঁদের কোনো লেখা নেই। এঁদের সব ক’জনের গদ্য এতো সাবলীল এবং বিবরণধর্মী, তবে নিচ্ছে না কেন?
রবীন্দ্রনাথ-পরবর্তী বাংলা গল্পে যে ক’জন শক্তিশালী কথাশিল্পী, জগদীশ গুপ্ত তাঁদের একজন। আর দীপেন্দ্রনাথের কথা বললেন? আমার মতো রূঢ় গদ্য লেখেন না। তাহলে? মধ্যবিত্তের বিষয় নিয়েও লিখেছেন, তবুও আমাদের দেশের পাঠক তাঁকে চেনে না। কেন? শুধু যাপনটা শুনুন, শারীরিকভাবে তিনি ছিলেন কিছুটা প্রতিবন্ধী। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পশ্চিমবাংলায় তাঁর ভূমিকা ছিল শ্রদ্ধা করার মতো। অন্যভাবে বলি, অবাক হবেন; ছাপ্পান্ন সাল থেকে সোভিয়েত ইউনিয়নে ক্রুশ্চেভের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের নীতিমালাকে কেন্দ্র করে সোভিয়েত ইউনিয়নে কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল-এ বিভক্তি ঘটলো মাও সেতুং আর চৌ এন লাইয়ের সঙ্গে। ভারতে নাম্বুবুদিরিপাদ গেলেন সিপিএমে। অজয় বাবুরা সিপিআইয়ে। বাংলাদেশে হক, তোয়াহা, সুখেন দস্তিদাররা গেলেন মাও সে তুং-চৌ এন লাইয়ের দিকে। অন্যদিকে মনি সিংহ, খোকা রায়েরা। ছাত্ররাজনীতির বিভক্তি হলো মেনন-মতিয়া। এইরকম একটা পরিস্থিতিতে দেবেশ রায় দীপেন্দ্রনাথ সম্পর্কে লিখছেন, এই সংবাদ শোনায় সারা ভারতবর্ষে আক্ষরিক অর্থে দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো মানসিকভাবে কেউ এতো অসুস্থ হয়ে পড়েনি। এই যাঁর মনন, তাঁর নাম বাংলাদেশের মতো এরকম একটা দেশে উচ্চারণ করা পাপ। বইটা যাঁরা বের করেছেন, ক্ষুব্ধ হয়ে ভূমিকায় সেই তরুণেরা লিখেছেন, তাঁর সমসাময়িক লেখকবন্ধুরা এতো দেরি করলেন কেন বইটা বের করতে?
অমায়িক খচ্চরে বিশ বছর আগে আমার প্রিয় লেখকের তালিকায় তাঁর নাম সম্মানের সাথে স্মরণ করেছিলাম। কথাসাহিত্যিক কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীরের সঙ্গে এরকম এক আলাপচারিতায় সৈয়দ হক এবং মাহমুদুল হক সম্পর্কে আপনি যে কথাটা বললেন, আমি একই কথা বলেছিলাম। ‘কথার কথা’ বইটিতে আছে। যারা মাহমুদুল হককে নিয়ে আজ কথা বলে, তারা বলার জন্যে বলে। মাহমুদুল হকের গদ্যরেখার তলে যে দ্বিমাত্রিকতা রয়েছে, তা তাদের গদ্যে নেই। মাহমুদুল হক তো শেষের দিকে লেখা ছেড়ে দিল। আমি মুহম্মদ খসরু ভাইয়ের কাছ থেকে নিয়মিত তাঁর খবর শুনতাম। খসরু ভাই তাঁকে বটু ভাই বলে ডাকতেন। এরা প্রতিবছর বই বের করবে, এবং নিজেদের আত্মগত সংকটের সমাধান হিসেবে এই সমস্ত আবোল-তাবোল কথা বলবে।
মাসুমুল আলম: ২০০৯ সালে আপনার গল্প কাজলরেখা—ময়মনসিংহ গীতিকার আলেখ্য আপনি প্যারালাল টেক্সট হিসেবে ব্যবহার করেছেন। এই নগরের এই সময়ের এক নারী যে তার শিক্ষা, সৌন্দর্য, দর্শন নিয়ে আরেক নারী সীমা-র বিশ্লেষণী চোখে প্রতিবিম্বিত হচ্ছে। বাঘের ঘরে ঘোগ-এর অনেক দিন পর কাজলরেখা গল্পে আপনার অভিজ্ঞতার কোন জগৎ এইপ্রকার ভাষারীতির সাথে এই আধুনিক আখ্যান নির্মাণে আপনাকে প্ররোচিত করেছে?
সেলিম মোরশেদ: গল্পটা লিখতে গিয়ে বুঝতে পারছিলাম যে এটাকে একটু অন্যভাবে ডিল করতে হবে। দীর্ঘ লেখার দিকে হাত এগোচ্ছিল। না, ‘কাজলরেখা’ লিখতে কোনোকিছু প্ররোচিত করেনি। শুধু আমার কাছে মনে হয়েছিল, একটা বিষয় বার বার আমি চারপাশ ঘুরে দেখছিলাম, ঠিক নারীবাদ বলবো না, কাজলরেখায় যেভাবে কাজল তার সঙ্গীর প্রতি যে অনুগত বা যে নিবেদনটা ছিল, আজকে এসে দাঁড়িয়ে দেখলাম— একজন কাজল, সে অনেক স্বাধীন মনোবৃত্তির অনেক সাংগঠনিক, একটা মানুষ প্রজাতির দিকে যেন সে এগোচ্ছে। দুর্যোগ এবং নিয়তিনির্ভর জায়গাগুলো থেকে সে সরে আসছে। মনে হয়েছিল, এই কাজলকে তুলে ধরা জরুরি। তাই লিখেছিলাম। অন্যকিছু প্ররোচিত করেনি। এর ভাষার প্রশংসা অনেক শুনেছি, কিন্তু টেক্সটটা পছন্দ করলো না পরিচিতরা।
মাসুমুল আলম: ২০০৯-এর পর ২০১৪ সালে আবার একটি গল্প লিখলেন অনতিপাতার কুঁড়ি। পাঁচ বছর পরে এই গল্পের জন্য আপনার গল্পভাষা, নির্মাণশৈলী আধেয়’র বাস্তবতা ফুটিয়ে তুলতে প্রযুক্ত বাক্ রীতি গল্পটির চারপাশে দুর্ভেদ্য দেয়াল তৈরি করেছে। আপনার কি ধারণা, দীর্ঘ ব্যবধানের ফলে অভিজ্ঞতার সারাৎসার ব্যবহারের বিষয়ে নতুন গল্প লেখায় কোনো চাপ তৈরি হয়?
সেলিম মোরশেদ: আমার ক্ষেত্রে সেটি হয়নি। এখানে যেটা হয়েছিল, এমন একটা চরিত্র, যে শত বছরেও মধ্যবিত্ত চরিত্রের ভেতর থেকে বাবা-মাকে হত্যা করেছে, এমন ঘটনা ঘটেনি। সে তা করেছে। অপ্রকৃতিস্থ ছিল বলে কিছুটা হয়তো, একটা স্নেহবাৎসল্য কাজ করেছিল আমার। কিন্তু আমি কিছুতেই বুঝতে পারছিলাম না যে এ স্নেহটাকে কোন গন্তব্যে আমি নিয়ে যাই। বাবা-মাকে হত্যা করার এই ঘটনায় শুধু সমাজ পড়ে যাওয়ার চিন্তা আমার ছিল না। আমি বিস্মিত হয়েছিলাম। এবং একই সাথে ব্যথিতও হয়েছিলাম আমার পরবর্তী প্রজন্মকে এইভাবে দেখতে চাওয়ায়। ফলে, সে বাবা-মাকে হত্যা করলো, আবার সে ঠাণ্ডাভাবে বাথরুমে নিয়ে গিয়ে রাখলো। এবং সিএনজি নিয়ে ঘুরে বেড়ালো। গোটা ব্যাপারটাকে আমার কাছে অসম্ভব অস্বাভাবিক লাগায় আমি এটাকে নিয়ে খুঁটিনাটি বিশ্লেষণ করি। আমি ওর বাবার অফিসে গিয়েছিলাম, আমি ওদের বাড়িতে গিয়েছিলাম, আমি কোর্টে গিয়েছিলাম, যেখানেই যাই সেখানে গিয়েই আমি দেখেছি যে, ধিক্কার আর ধিক্কার। কোনো মানুষই ওর মৃত্যুকামনা ছাড়া আর কিছু চাইছে না। কিন্তু আমার মনে হচ্ছিল, হয়তো আমার হাত দিয়ে ওর সেই মনোজগতের সত্যটা চলে আসুক। এবং সেটা করতে গিয়ে, আমি দেখলাম ‘অনতিপাতার কুঁড়ি’-তে আমি ওর বেদনাটা কিছুতেই ধরতে পারছি না। আমি ওর ভেতরকার সেই অপ্রকৃতিস্থ সত্তাটাকে ধরতে পারছি না। পরবর্তী সময় আমি নতুন করে অপরাচিত্ত নামে এই গল্পের যন্ত্রণার দিকগুলো এবং সিএনজি নিয়ে ঘটনার পর ওর মুভমেন্টগুলোকে চিত্রিত করেছি, সেটা বোধহয় আপনি পড়েননি। তো, পরে ওর ফাঁসি হয়নি এটাই আমার ভালো লেগেছে। যে ও সংশোধনে গিয়েছে। ফলে, এটা এখন শিল্পের বাইরের একটি বিষয় বলেই আমি মনে করছি।
‘পরানকথা’ থেকে তাশরিক-ই-হাবিব ‘কান্নাঘর’টা যখন বের করলো, তখন অপরাচিত্ত নামে এ গল্পটা আমি লিখি। পরের বার লেখাটায় আউটলাইন এবং ইঙ্গিত দিয়ে দিয়ে আমার এগোতে হচ্ছিলো। ফলে এটা ছিল আমার জন্য একটা কঠিন ডিল। বাংলাদেশে প্রতিদিন যা হচ্ছে তা নিয়ে ফিচার লেখা যায়। সাহিত্য করা একটা অসম্ভব ব্যাপার।
মাসুমুল আলম: কাজলরেখা এবং অনতিপাতার কুঁড়ি এই দুইটি গল্প ছাড়া ২০০৯ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত এই ১১ বছরে আপনার আর কোনো নতুন গল্প নেই। এই দীর্ঘ বিরতির কারণ কী? মাঝে, ২০১১ সালে ‘মানুষ উত্তম’ নামে একটি নাটক লিখেছেন।
সেলিম মোরশেদ: হ্যাঁ, আমার লেখার ধারাবাহিকতায় এগারো বছর না, ছয় বছর ছোটখাটো কয়েকটা লেখা ছাড়া আমি তেমন কিছু লিখিনি। ইচ্ছা হয়নি। আর আরো একটা কারণ যে, আমি একটা দীর্ঘ লেখার পরিকল্পনা করছি। সে লেখাটি নিয়ে অনেক বেশি খাটাখাটনি গেছে আমার। সেটাও একটা অন্যতম কারণ। আর আপনারা তো জানেন যে আমি অনেক সময় ধরেই লিখি। সময়ে টিকে থাকবে ওই জন্যে না, সময়টাকে যেন সম্পূর্ণভাবে ধরতে পারি। লিখতে লিখতে এখন মনে হচ্ছে, বাংলাদেশের মতো একটা দেশে এতো ভাবি কেন? টাকা, নারী আর বিদেশ ছাড়া ওরা আর কিছু বোঝে?
মাসুমুল আলম: কমিউনিকেটিভ ল্যাঙ্গুয়েজের নামে ঝরঝরে তরল গদ্যে যেসব লেখা হচ্ছে, যাদের লেখা ও যাপনপ্রণালী পুরোটাই আলাদা, ফলে, তাদের রয়েছে বানোনো আখ্যানের একটা মায়া-জগত। তথাকথিত সৌন্দর্য-চেতনার কারবারি এদের লেখাপত্র আপনি কি পড়েন?
সেলিম মোরশেদ: আমি সবার লেখাই পড়ি কম-বেশি। অনেকক্ষণ ধরে আমি ঘুরিয়ে কথা বলেছি, এখন পরিষ্কার করে বলতে চাই। আসলে লিটল ম্যাগাজিন এখানে এই কথিত প্রতিষ্ঠান তৈরি করেছে। মেইনস্ট্রিম বলে যে ধারাটা সেটা লিটল ম্যাগাজিনই করেছে। লিটল ম্যাগাজিনের আদল ধার করে সেখান থেকে নিয়ে করেছে। আমাদের সতীর্থরাই সে ধারাটা বানিয়েছে। ফলে, লিটল ম্যাগাজিনের বা প্রতিষ্ঠানবিরোধী বলে যে ধরনের মনোভাবাপন্ন লেখা, সেই পলিটিকাল লেখা এখানে কম লেখা হয়েছে। আমি পড়ি বলেই আমি জানি। সৌন্দর্য-চেতনা কি শুধু জ্যোৎস্নার বর্ণনা, ট্রিটমেন্ট কই। মানবিক ভঙ্গিমাটা রপ্ত করেছে মাত্র।
মাসুমুল আলম: কিছু কিছু লেখা আছে, নিরীক্ষাপ্রবণতা ছাড়াই, ইন বিটউইন দ্য লাইনস কোনো ট্যুইস্ট ছাড়াই, নির্মাণপ্রচেষ্টা ব্যতিরেকে বিষয়বস্তুই এমন থাকে যে তা স্বয়ম্ভু এবং লেখকের কাছে কোনো এক সময় লেখাটি তার নিজের অস্তিত্ব জাহির করে। কান্নাঘর তেমনই একটা গল্প। পড়ার পরে এই গল্পের সামনে স্তব্ধ হয়ে বসে থাকতে হয়। বৃহত্তর সমাজজীবনের বাইরের নির্জন পথের সাধক কর্তাভজা সম্প্রদায়ের মানুষের বোধি ও ভূয়োদর্শী আলাপ ও জ্ঞানকাণ্ড আমাকে আভিভূত করে। ‘ইন্দ্রিয় পরিপাটি করে আনাই তো শূন্যতা, তখন দেখো, নৌকায় হীরা, আর হীরা সোনা রাখার জায়গা কই? যেমন সরল তেমনই গুহ্য একথা’। নিত্যানন্দের চোখে জল আসা পর্যন্ত ‘কান্নাঘর’ গল্পের পুরো টেক্সটের এই কাব্যপ্রাণ—কবিতার প্রাণপ্রবাহ সংবেদনশীল পাঠককে আলোড়িত করবে। গল্পটি লিখে ওঠার অভিজ্ঞতা বলেন।
সেলিম মোরশেদ: এটা যশোর থেকে মনিরামপুরে বাসে নেমে একটু এগিয়ে গেলেই একটা সম্প্রদায় আছে, কর্তাভজা। এ খবরটা আমাকে দিয়েছিল যশোর প্রেসক্লাবের প্রাক্তন সভাপতি আমার বন্ধু ফকির শওকত—যে এমন একটি সম্প্রদায় আছে, মার খাবে কিন্তু মার দেবে না, রক্তপাতে বিশ্বাসী না, অন্যের হাতে খাবার খাবে না, তারা ডাক্তারের কাছে যাবে না। তারা মনে করে এটা পূর্বজন্মের পাপ। আমি ওখানে ব্যক্তিগতভাবে যখন যাই, তখন আমি সেই ধরনের ব্যবহারই পেয়েছি। আমি ওখানে না খেয়ে থেকেছি দুইদিন। রাতে থাকার জন্যে ওরা আমাকে একধরনের নীরব এবং স্নিগ্ধভাবে উপেক্ষাই করেছিলো। তবুও আমি ছিলাম। এবং আমি পরে বিষয়টার সত্যতাও অনেকটা বুঝেছি, যে ওরা এমন। গল্পটা লেখার উদ্দেশ্য নিয়ে আপনি আমাকে প্রশ্ন করেননি। কিন্তু আপনার প্রশ্নের ভেতর দিয়ে আমি অনেককেই উত্তরটা দিচ্ছি, অনেকে হয়তো মনে করেন ‘কান্নাঘর’ বিষয়টা ক্লাসিক বা এই গল্পটা আমি কেন লিখলাম। আমি এই উত্তরটা এই প্রশ্নের ভেতর দিয়ে দিচ্ছি দুটি কারণে, একটি হলো, এই সমাজ বাস্তবতায় তারা বেঁচে থাকতে গেলে তাদের লড়াই-মনোবৃত্তিটা কিভাবে অন্তত আনা যায়, যদি ওদের সম্প্রদায়ের কেউ-একজন এই গল্পটি পড়ে, যদি কখনো ওদের ভেতরে কাজ করে, যদিও শিল্প দিয়ে বা লেখা দিয়ে একটা সম্প্রদায়ের দীর্ঘদিনের চিন্তাটা বন্ধ করা যায় না। এটা একটা আমার পরিকল্পনা ছিল, যে একটা লড়াই অন্তত ওরা করুক। দুই, পাপ নিয়ে ওরা প্রতি ক্ষণে ভাবছিলো, এই শুদ্ধতার প্রতি আমার একধরনের পক্ষপাত থাকলেও পারিপার্শ্বিক চিকিৎসা ব্যবস্থার উপর ওদের এতোটা অনীহা, সেটাকেও আমি তুলে ধরতে চেয়েছিলাম। যা মৃত্যুর দিকেও নিয়ে যাচ্ছিলো ওদের সম্প্রদায়ের ভিতরে। তরুণ প্রজন্মকে ক্ষতিগ্রস্ত করছিলো। সেই দুটি কারণেই আমি কান্নাঘর লিখি।
মাসুমুল আলম: চিতার অবশিষ্টাংশ গল্পের শ্মশানচারী যূথবদ্ধ নারী-পুরুষ, অন্যদিকে, বাংলা গদ্যে কমলকুমারের বৈজু চাঁড়াল, তা-ও সে একক, আর আফসার আমেদের একটি উপান্যাসে অজাচারজনিত কারণে শ্মশানবাসী সমাজচ্যুত এক পরিবারের কাহিনি ভিন্ন বাংলা গল্পধারায় আপনার চিতার অবশিষ্টাংশ গল্পটিতেই শ্মশানের গৃহস্থ জীবন, আর চরিত্র ধরে ধরে আখ্যানের চলমানতা তৈরি হয়েছে। চিত্রনাট্যের ফর্মে এই গল্প লিখতে গিয়ে সচেতনভাবে কি আপনাকে Inspire করেছিল?
সেলিম মোরশেদ: আসলে আপনি নিজে একজন লেখক। আপনি জানেন যে, অনেক সময় এমন এমন বিষয়গুলো এমন জায়গা থেকে আসে যেগুলো বেশ অবাকই লাগে, যে এখানে সেটা সাদৃশ্য হয়! কিন্তু খুব তুচ্ছ তুচ্ছ জায়গা থেকে হয়তো অনেক বিষয় আসে। যশোর থানায় P O L… পুলিশ বানানটায় আমি দেখলাম, পোলইট, লয়্যাল, অবিডিয়েন্স… আমি এটাকে একদিন মনে করে হাসতে হাসতে ভাবলাম। কিন্তু পরে যখন এটা আমি দেখি অরুন্ধতীর একটা লেখায় বা সম্ভবত কারো লেখায়, তখন আমি অবাক হয়েছিলাম যে, এটা তো আমি দেখেছি। কিন্তু এটা ব্যবহার করিনি। তো আসলে আমি এটা কোর্টের খাতায় দেখেছিলাম এই ফর্মটা। কোর্টের কোনো একটা কাজে বোধহয় আমি গিয়েছিলাম, ওয়ান্টেড ক্রিমিনালদের জন্যে অল্প একটু বড় করে করে তাদের নাম, বয়স, কোথায় চুল কাটা, চোখের নিচে কতোটা দাগ, এগুলো একটা বড় খাতার ভিতরে সম্ভবত দেখেছিলাম। পিপি বোধহয় আমার বন্ধু ছিলো। পাশাপাশি যখন আমি এটা দেখছিলাম, তখন আমার মনে হচ্ছিলো, যে এই ফর্মটাই যেন একটা মিথস্ক্রিয়া তৈরি করে আরেকটা ফর্মের সাথে। তো সেখান থেকে হয়তো আসতে পারে এটা।
মাসুমুল আলম: আপনি কি আপনার লেখালেখিকে রাজনীতির প্রকাশ বলে মনে করেন? বাঘের ঘরে ঘোগ এর গল্পগুলোতে Political intention রয়েছে। রাজনীতি সরাসরি সাহিত্যে আসাটা আপনি কিভাবে দ্যাখেন? বোর্হেসের মতো কেউ কেউ এটাকে ক্ষতিকর মনে করেন।
সেলিম মোরশেদ: বোর্হেস এটা মনে করতে পারেন কারণ, বোর্হেসের ফর্মটা এবং দৃষ্টিভঙ্গিটা এবং শিল্পের শৈলীটাও তাঁর আলাদা। কিন্তু আমার কাছে মনে হয় যে, এই একটি কথা বলে বহুদিন ধরেই রাজনীতির কোনো সুষ্ঠু বিশ্লেষণই শিল্পে আসেনি। সেজন্য আমি বোর্হেসের কথাটাকে ক্ষতিকর মনে করি। একজন লিটল ম্যাগাজিন এবং প্রতিষ্ঠানবিরোধী লেখকের কখনো কখনো একদম ব্যবহারিক রাজনীতি বা বিকল্প রাজনীতির যে বিপর্যয়গুলো, তা তুলে ধরা উচিত। সেই জন্যেই আমি ‘বাঘের ঘরে ঘোগ’ লিখেছিলাম। এবং ওখানে পাঁচটি গল্পই রাজনীতির গল্প ছিলো। ‘উলুখাগড়া’ আলোচনা লিখলো ‘রাজনৈতিক কথামালা’, আমার খারাপ লাগেনি। আমি অবলীলায় সেখানে লিখতে পেরেছি ক্রসফায়ার নিয়ে। আমি সেখানে লিখতে পেরেছি আজকের বামচিন্তার সেই বিপর্যস্ত কয়েকজন দলনেতার চরিত্র… আমি সেই বিষয়গুলোকে নিয়ে একটা ক্রিটিসিজমই করেছি।
এখন শিল্প ক্ষুণ্ণ কিংবা অক্ষুণ্ণ এটা নির্ভর করে, যারা এই প্র্যাক্টিসটার সাথেই নেই, এই প্র্যাক্টিসটা কতোটা ভুল, সেটাও যারা সঠিকভাবে জানে না, তাদের কাছে এটা ফ্যান্টাসি হতে পারে কিংবা তাদের কাছে এটা হীনমন্যতা তৈরি করে। তো লেখক তো শেষমেশ একজন সুবিধাভোগী শ্রেণির সামনে কী করে? একজন বিপরীত ধারার লেখক! বা বিপরীত ধারার শিল্পী, সে সুবিধাভোগী শ্রেণির বিপরীতে একটা গিল্টি-ফিলিংস তৈরি করা ছাড়া, একটা অপরাধবোধ তৈরি করা ছাড়া আর কী সে করে! এ বিপর্যয় থেকে যদি সে অপরাধবোধটুকুও তাদের তৈরি হয়, সে ভুলই হোক আর যা-ই হোক, তো এটা কোনো-না-কোনোভাবে সমাজের বৈষম্যহীনতার কারণেই ঘটনাগুলো তারা ঘটিয়েছে। বা এই ধরনের অমানবিক কাজ তারা করেছে। এর প্রক্রিয়ায় তারাও যে দায়ী, এটাও তুলে ধরা আমি মনে করি লেখকের কাজ। ফলে বোর্হেসের কথাটা এখানে সঠিক মনে হয়নি।
মাসুমুল আলম: ‘সব লেখকই কম বেশি আধ্যাত্মিক’—গার্সিয়া মার্কেজের এই কথাটির সাথে আপনি কি একমত? আপনার অনেক গল্পের চরিত্রের মনোবিশ্লেষণে আধ্যাত্মবোধ ও দার্শনিক উপলব্ধি পাওয়া যায়।
সেলিম মোরশেদ: আমি ভয়ঙ্করভাবে আধ্যাত্মবাদের তাড়না বোধ করি। কেন! মনে নেই? সরলা এরেন্দিরার ভেতর! যখন তাঁবুর ভেতর এরেন্দিরার কাছে তরুণটি যায় তার একরৈখিক প্রেম নিয়ে। সেখানে তরুণটার বাবাও যেতেন। এবং বাবা একদিন বুঝে ফেলেছিলেন যে তরুণটা এরেন্দিরার প্রতি গভীরভাবে অনুরক্ত। তখন কি তিনি এ কথাটা বলেননি, যে তুই যতদূর যাবি, আমার দীর্ঘ নিশ্বাস তোর পেছন পেছন যাবে। এ কথাটি কী আসলে! এ কথাটা আমাদের সমাজেও বলে। আমার নিশ্বাস ফেলা, আমার বুকে ব্যথা দেয়া, এইসমস্ত বিষয়গুলোর সাথে এমন একটা পরম সত্তার যুক্তি থাকে, যে তিনিই তখন ব্যথাটিকে নিয়ন্ত্রণ করেন, শাস্তি দেন। এটা শুধু প্রাকৃতিকও না। যা একটা শক্তিসম্পন্ন সক্ষমতা, আমি এটাকে আধ্যাত্মিকতা বলে মনে করি। এবং এই আধ্যাত্মিকতার বাইরে কখনো কোনো লেখক বা কবি যতই তর্ক-করুক না কেন, মানুষের হৃদয়ের কাছে যাওয়ার সক্ষমতা তাদের থাকবে না। আমরা যাদের প্রাতিষ্ঠানিক লেখক বলি বা বড় লেখক বলি, আমি তিনজন লেখককে বলছি, তাঁরা নিজেরাই পরমাত্মায় বিশ্বাসী ছিলেন। রবীন্দ্রনাথের স্রষ্টা একরকম ছিলেন, নজরুলের স্রষ্টা আরেক রকম ছিলেন, লালন তাঁর স্রষ্টাকে বিশ্বাস ক’রে তার পর বিপরীতে প্রশ্ন তুলেছেন।
তাহলে আমরা আমাদের সময়ের এই মানুষগুলোর শিল্প এবং জীবন দেখায় এবং এদের ক্রন্দনগুলো, নমিত হওয়ার কারণগুলো, বিনয়ী হওয়ার কারণগুলো এবং মানবিক হওয়ার কারণগুলো কোথা থেকে দেখেছি। আমরা যে সমর্পণটা বলি, সে সমর্পণ কিভাবে সম্ভব হয়। মানুষকে মানুষ সমর্পণ করা আজকের যুগে খুবই কঠিন। তার অন্তর্গত সমর্পণটা কী? এই অন্তর্গত সমর্পণই আমার কাছে মনে হয় আধ্যাত্মিকতা, এবং এর একটা বড় শক্তি আছে বলেও আমি বিশ্বাস করি। ‘কান্নাঘরে’ যশোদার যা ছিল, যে স্বাভাবিকভাবে কী সুতোটা দিয়ে দিলো। চিতার অবশিষ্টাংশে দীলিপের যা ছিল। পর্যুদস্ত, অক্ষম, শরীরী অসমর্থ, পঙ্গু, সেই অবস্থায় নারীর প্রেম লালন করছিলো। আমার বিবিধ লেখাতে যেমন রাজনৈতিক সচেতনতাও আসে, তেমন আধ্যাত্মিকতাও থাকে। এটা আপনি যথার্থ বলেছেন।
মাসুমুল আলম: অমিয়ভূষণ মজুমদারের ফ্রাইডে আইল্যান্ড অথবা নরমাংস ভক্ষণের গল্প এবং তাহার পর—প্রোলোগ এবং এপিলোগের অন্তঃস্থিত প্রচুর সাব-টাইটেল সহযোগে পুরো টেক্সটই সাধুভাষায় লিখিত। এই উপন্যাসটির ফর্ম এবং আখ্যান নিয়ে আপনার মূল্যায়ন জানতে চাইছি। এই উপন্যাস পড়ে আমি কিছু ধরতে পারিনি। তবু টেক্সটের একটা অমোঘ শ্লথ টান আছে। জন জোয়ায়িম ফ্রিডা জেফ… চরিত্রগুলোর এ-রকমই নাম। প্রামাণ্যচিত্রের ফর্ম, দ্বীপে নীল জলরাশির দিকে একটা ক্যামেরা স্ট্যাটিক ধরা আছে। ভূখণ্ড আলাদা, চরিত্রগুলোও বিদেশি।
একইসঙ্গে, অমিয়ভূষণ মজুমদারের বিশ্ব মিত্তিরের পৃথিবী, উপন্যাস নিয়ে, যেটা নাকি ইনসেস্ট রিলেশন নিয়ে লিখিত। এ উপন্যাসের সম্বন্ধে আপনার মতামত কী? সাহিত্যে যৌনতা থেকে উনি যেহেতু বরাবর একটু দূরে থেকেছেন।
সেলিম মোরশেদ: ‘ফ্রাইডে আইল্যান্ড’ আমার অনেক আগের পড়া। আলাপ করেছিলাম কোথায় যেন! হ্যাঁ, তবে দুইজনের নাম মনে পড়ছে। তাদের মনে আছে কি না কে জানে! কবি শান্তনু চৌধুরীর সাথে আলাপ করেছিলাম। বলেছিলেন যে, মনে হয়নি ভারতবর্ষে বসে লিখছেন, মনে হচ্ছে বাইরে বসে লিখছেন। আর সম্ভবত শাহবাগে লিটল ম্যাগাজিন কর্নারে একবার প্রসঙ্গটা উঠেছিল। হ্যাঁ, মনে পড়েছে। কথাসাহিত্যিক রাখাল রাহা ছিলেন। আলাপের একপর্যায়ে শুনে শেষে তিনি একটু বিরক্ত হয়েই বললেন, এই জটিলতার প্রয়োজন কী? যাইহোক, বরং আমার কথাই বলি। অ্যান্টি-ন্যারেটিভ লেখায় এতোটা আত্মমগ্ন অন্য কোনো লেখায় তিনি হননি। সমস্যাটা হয়েছিল, অ্যান্টি-ন্যারেটিভে যে ইনার কন্সিস্টেন্সি থাকে, সেটা তিনি খুব ব্যক্তিগত করে ফেললেন এখানে। আমিও নিতে পারছিলাম না। এইসব বই পড়ার নিয়ম হলো, প্রথমে টানা একবার পড়তে হয়। পরেরবার পড়ার সময় আগের আউটলাইনগুলোর সঙ্গে পরের কয়েকটা পর্বের ভেতর মিল খুঁজতে হয়। গদ্যরেখার আড়ালে জলছাপ কী বলে! একটা ব্যাখ্যাতীত গন্তব্য, শোনা যায়, দেখা যায় না। একটা অচেনা পথে নিতে চাচ্ছে। আপনি চরিত্রের কথা বলছেন? সেগুলো আবছায়া। তাদের পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়া কোনো ইঙ্গিত দেয় না। তবে অমিয়ভূষণ সমাপ্তিতে যেভাবে তিনি নিপুণ এবং সংহতি রাখেন, এটাতে সেটা বজায় রাখেননি। ভেবেছিলাম, শেষের অংশ নিয়ে একটা সমাধান পাব। সেটাও পেলাম না।
‘বাঘের বাচ্চা’ সুবিমল মিশ্র সংখ্যায় আমার একটা সাক্ষাৎকার নিয়েছিল। সেখানে সেক্স প্রসঙ্গে লেখকদের টেক্সট নিয়ে আলাপ করার সময় অমিয়ভূষণের ‘বিশ্ব মিত্তিরের পৃথিবী’ নিয়ে আমি কিছু মন্তব্য করেছিলাম। সেখান থেকে বরং কিছু অংশ তুলে দিই।
‘বাংলা ভাষায় তিরিশ-পরবর্তী শ্রেষ্ঠ দুজন লেখকের একজন অমিয়ভূষণ। এটা শুধু আমার একার সিদ্ধান্ত নাও হতে পারে। কেউ কেউ আমার মতোও ভাবেন। সেই অমিয়ভূষণের মতো লেখকও এই দুটি বিষয়ে তাঁর সক্ষমতার মান অনুসারে কোনো কোনো জায়গায় পারফেক্ট হ্যান্ডেল করতে পারেননি। ‘একটি বিপ্লবের মৃত্যু’ কেন তিনি লিখতে গেলেন? ঝর্ণার পাশে বলিউডের এক আবহে ইউ আর মাই ওয়াইফ, এইভাবে কোনো বিপ্লবী ভারতবর্ষের প্রেক্ষাপটে, বাংলার প্রেক্ষাপটে কোনো কমিউনিস্ট আন্দোলনের ইতিহাসে কোথাও দেখা যায় না। একটি বিদেশি গল্পের ছায়া দেখা যায়। যদিও তিনি তা করেননি। একজন লেখক বিশ্বায়নের লেখা লিখতেই পারেন। কিন্তু ‘একটি বিপ্লবের মৃত্যু’-তে অমিয়ভূষণ পারিপার্শ্বিক কোনো সূত্রকে সংযোগে রাখতে পারেননি। দ্বিতীয়ত, ‘বিশ্ব মিত্তিরের পৃথিবী’-তে এক নৈর্ব্যক্তিক চোখে তিনি আখ্যানভাগে যে গ্রাউন্ড তৈরি করেছেন তা নিঃসন্দেহে বিশ্বের সেরা লেখকদের সমতুল্য। তার পরেও লক্ষ করুন, এক জায়গায় মেয়ে বাবাকে বলছে (যে মেয়ের সাথে বাবার ইনসেস্টের সম্পর্ক), ‘বাবা আমি তোমাকে ভালোবাসি’—বিষয়টা নিষিদ্ধ আত্মীয়-সংস্পর্শের বিষয়। পুরো কাহিনিতে তিনি যে যে পরিস্থিতি দেখিয়েছেন, তাতে বাবা ও মেয়ের সম্পর্কটি এত স্বাভাবিকই ছিল যে মননের উপরে কোনোরূপ নৈতিক-ন্যায়-অন্যায় একবারও মনে হয়নি। কিন্তু ভুল হয়ে গেল ওই লাইনটি লিখে। লেখকের গ্লানিবোধ বেরিয়ে এল— অন্তত আমার কাছে।’
মাসুমুল আলম: অমিয়ভূষণ মজুমদার সম্পর্কে আপনার মুগ্ধতা, ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা আমরা জানি। যেমনটা জানি, সুবিমল মিশ্র এবং আখতারুজ্জামান ইলিয়াস সম্বন্ধেও। অমিয়ভূষণ মজুমদারের একটা নাটক আছে- গড অন মাউন্ট সিনাই। পয়গম্বর মুসাকে (মোজেস) নিয়ে। এই নাট্যখণ্ডের অনুপ্রেরণায় কি আপনার মনে ২০১১ সালে পয়গাম্বর ঈসার জীবন ও যুদ্ধ নিয়ে আরেক শিল্পসত্য—মানুষ উত্তম নাটক লেখার ইচ্ছা তৈরি হয়েছিল?
সেলিম মোরশেদ: ওটা ছিল পাঁচ-সাত পাতার একটি নাটক। নাটকটা উনি বেশি সাহিত্যের মতো করে ফেলেছিলেন। এবং অনেক বেশি বিমূর্ত ছিল। আমি এটা (মানুষ উত্তম) কেন লিখি, এটা বোধহয় আপনার সবচেয়ে ভালো জানার কথা। তার পরেও আমি জানাচ্ছি। ‘প্রতিশিল্প’ যখন দ্বিতীয় সংখ্যা বের হয়, এক বড়োদিনে যশোরের তাবিথা পান্না ‘প্রতিশিল্পে’র দ্বিতীয় সংখ্যায় যুক্ত হয়েছিলেন। তখন আপনার আগ্রহে আমি যিশুর জীবন নিয়ে একটা নৃত্যনাটক লিখি। যেটা ওর নামে ছাপি, কারণ তখন ওর বিয়ে হচ্ছে। আমার মনে হয়েছিল, উপহার হিসাবে মন্দ না। পরে কোনো ধর্মান্তরি চেতনা থেকে যে ঈসাকে নিয়ে লিখেছি, তা না। বইয়ের ভূমিকায় সেটা আমি বলেছি।
আসলে আমি জানি, আপনি আরো পেছনে জানতে চাইছেন। সাদ্দামের ফাঁসি, তুর্কিদের মনোভাব, আমেরিকার ভণ্ডামি, সর্বোপরি বনি ইসরাইল ও বনি ইসমাইল; একই বাবার দুই রক্তের ধারা যতোটা-না ধর্মের তারচেয়ে আভিজাত্যের বৈষম্যের লড়াই ছিল। ঈসাকে কোথাও লেখক নবী হিসেবে দেখেননি। আপনি নিজে লেখাটার উপর ‘শিরদাঁড়া’য় লিখেছেন। এখানে কেন্দ্রীয় চরিত্র নিপীড়িত মানুষের প্রতিনিধিত্ব করেছে। এবং আপনি সে আলোচনায় আবিষ্কার করেছিলেন, বর্তমান প্যালেস্টাইনের রাজনৈতিক কার্যক্রমের সাথে ঈসার সেই সময়কার কার্যক্রমের সাদৃশ্য। আমি আপনাকে আগেও বলেছি, যে আমি বোর্হেসের কথায় একমত না। আমার প্রতিটা লেখাই কম-বেশি রাজনৈতিক।
মাসুমুল আলম: আপনার ‘সুব্রত সেনগুপ্ত’ গল্পটি তারেক মাসুদ চিত্রনাট্যে রূপান্তর করেছিলেন। তপন বড়ুয়া সম্পাদিত গাণ্ডীবে সেটা ছাপাও হয়েছিল। ২০১৯ সালে এটা একটা সিনেমা হয়েছে। আপনার বন্ধুজন অনেকেই ফিল্মমেকার। তাঁরা কেন এটা করেননি বলে আপনার মনে হয়? এমনকি, তাঁরা সমসাময়িক নিরীক্ষাপ্রবণ গল্পের দিকেও যেন হাত বাড়ান না। সাহিত্য ও চলচ্চিত্রের নিরীক্ষাপ্রবণতা তাহলে হাতধরাধরি করে চলে না?
সেলিম মোরশেদ: আমাদের দেশে এখনও সেই বাস্তবতাটা আসেনি। বিষয়টা আপনি যেভাবে বলছেন, সেটা ঠিক না। এখানকার প্যারালাল সিনেমার মুভমেন্ট অনেক আগেই বিলুপ্ত। মোদ্দাকথা, জাতীয়তাবাদের এই বিকৃত রাজনীতির বাইরে বা ভেতরে যা-ই বলুন না কেন, কোনো ধরনের বিকল্প কিছু করার অবকাশ নেই। এই জাতীয়তাবাদী রাজনীতি যতক্ষণ-না সুগঠিত হবে, ততক্ষণ কোনো কিছু শুধু অসম্ভব না; সামাজিক অর্থেও অনর্থকতা। এদেশে যাঁরা প্যারালাল সিনেমার মুভমেন্ট করেছেন, আপনি নিশ্চয়ই জানেন, তাঁরা আমার শুধু বন্ধু না, অনেকে আমার লেখকজীবনের সঙ্গী। আমার অনেক লেখার সাথীও তাঁরা। কিন্তু প্রশ্নটা হলো, শুধু ছবি করার ঝুঁকি নেয় বললে তো হবে না, যার ছবি করছে তার সামাজিক অবস্থান, পেশাগত ব্যক্তিত্ব, রাষ্ট্রীয় ও পশ্চিমবঙ্গের স্বীকৃতি, পুরস্কার, সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর সাপোর্ট, এতোগুলো বিষয় না হলে অনুদান পাবেন না। চলচ্চিত্র আন্দোলনের বন্ধুদের সাথে আমার ভালো সম্পর্ক। যাঁরা মারা গেছেন তাঁদের সাথেও ছিল। এই ধারাবাহিকতার কিছু ব্যতিক্রম যদিও আছে। তবুও আমি বলব যে, এই ব্যক্তিগত অর্থের ঝুঁকি নিয়ে কেন তারা করবে। আর তার পরেও প্রতিটা চলচ্চিত্রশিল্পীকে মেইনস্ট্রিমের কারো-না-কারো সঙ্গে প্রতিযোগিতাও তো করতে হয়। (বাণিজ্যসফল অর্থে না, ডিগনিফাইড অর্থে।) কার গল্প নিয়েছে, দর্শককে লেখক সম্পর্কেও অবহিত থাকতে হবে।
তবে ‘সুব্রত সেনগুপ্ত’ নিয়ে আবীর ফেরদৌস মুখর যেটা করছেন সে ব্যাপারে ছবিটা হওয়ার আগেই বলা ভালো, ছবিটা কখন হবে, কেমন হবে, এ বিষয় নিয়ে আমার খুব বড় কিছু মূল্যায়ন নেই বা প্রত্যাশাও নেই। শুধু আমি বলব, আজ থেকে পঁয়ত্রিশ বছর আগে আমার যে বয়স ছিল, সেই বয়সে আমার একটা দেখা ছিল। দীর্ঘদিন পরে আবীর ফেরদৌস মুখর তার দেখাটা দেখবে। এবার আবীর ফেরদৌস মুখরের ‘সুব্রত সেনগুপ্ত’কে আবার দেখবে তার পরের প্রজন্ম। এই যে দেখাটা, এই দেখার যে কতোটা তারতম্য আছে, আমি যদি এখন ‘সূর্যদীঘল বাড়ি’ কিংবা প্যারালাল সিনেমার কোনো মডেলকে মাথায় রেখে সুব্রত সেনগুপ্ত বা সুস্থ ছবি করেছেন এমন ছবির সাথে প্রতিতুলনায় কখনোই যাব না। আমি মনে করি, যে প্যারালাল সিনেমা, আবীর ফেরদৌস মুখর যেভাবে তার মায়ের কাছ থেকে অর্থ নিয়ে বা যেভাবে সে বানিয়ে যাচ্ছে, এটুকুই যথেষ্ট।
মাসুমুল আলম: কিছুদিন আগে জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান প্রয়াত হলেন। উনি আনন্দ পুরস্কার পেয়েছিলেন। পেয়েছিলেন আখতারুজ্জামান ইলিয়াসও। আপনি প্রায়শ বলেন, মাথার ওপরে শ্রদ্ধা করার মতো বটগাছ থাকতে হয়। তো, কোলকাতায় শঙ্খ ঘোষ তেমনই শ্রদ্ধাভাজন। তাঁর ‘জার্নাল’ বইটিতে তিনি সুবিমল মিশ্র ও শৈলেশ্বর ঘোষের লেখালেখি নিয়ে বেশ কথাবার্তা বলেছেন। দূরদর্শনে সাহিত্য আলোচনায় যোগ দিতে গিয়ে অমর মিত্র সুবিমলের কথা বলে আসতে পারেন। এটা তাঁদের সাহিত্যিক সততা। আমাদের এখানে মুরব্বি সাহিত্যিকসহ প্রৌঢ় বা পাওয়ারসেন্ট্রিক তরুণেরা ড্রইংরুম সাহিত্য আসর বা মিডিয়ায় গেলেও মুখে কুলুপ এঁটে বসে থাকেন। এটা তুলনামূলক আচরণের পার্থক্য। এ বিষয়ে আপনার অভিমত কী?
আপনি নিজে ফ্ল্যাপ ভিন্ন আপনার সমসাময়িক বা পূর্বসূরি অথবা পরের প্রজন্ম কারো ওপর কোনো লেখা কি লিখেছেন? আমার মনে আছে, ২০১৩ সালে তারেক শাহরিয়ারের গল্প-সংকলনে তাঁর গল্পবিশ্ব নিয়ে আপনি একটি লেখা লিখেছিলেন।
সেলিম মোরশেদ: শেষমেশ এটাও সত্য যে, মানুষের অচেতন মন সত্যের দিকে যায়। যতটুকু শিল্পের জন্য কেউ পরিশ্রম দিবে, কেউ-না-কেউ কথা বলবে। তবে আপনি ব্যাপকহারে যে কথা বা উচ্চারণ চাচ্ছেন, আমি তা আগেও বলেছি, এই রেওয়াজটা আমাদের দেশে নেই। এই কালচারটাই আমাদের দেশে নেই। এরা খুবই হীনমন্য।
আর আমি নিজের কথা যদি বলি তাহলে বলব, আমি কারো ব্যাককভার বা ফ্ল্যাপ হিসেবে যেগুলো বলছেন, সেগুলোকে আমি মনে করি না। কারণ সেগুলো সেই লেখক সম্পর্কিত মূল্যায়নই। যে মূল্যায়নটা অনেক দীর্ঘ আলাপের চেয়েও এই পনেরো-ষোল লাইন অনেক গুরুত্বপূর্ণ। এবং লক্ষ করলে দেখা যাবে অন্যদের ব্যাককভারের সাথে, আমারটা একরকম না। আর এটা যেহেতু আমার মূল্যায়ন এবং একটা বই সম্পর্কিত আমার মূল্যায়ন মনে করি। এটা যদি আমি না-মনে করতাম, তাহলে আমার অমায়িক খচ্চর গ্রন্থে আমি এই একুশটা ছাপতাম না। কারণ ব্যাককভার দিয়ে কেউ বইয়ের পাতা ভরে না। আমি এগুলোকে নিজের মূল্যায়ন মনে করি। এছাড়া, তারেক শাহরিয়ারের কথাবিশ্বে, লেখকদের সম্পর্কে, বিশেষ করে তারেক শাহরিয়ার সম্পর্কে এবং তারেক শাহরিয়ারকে সঙ্গে নিয়ে, গোটা আশির দশক নিয়ে আমার লেখা রয়েছে আর সাত-আটটা ছোটখাটো নিবন্ধ রয়েছে। হাবিব ওয়াহিদের তথ্যচিত্রের উপর, ফরিদা হাফিজের গ্রন্থের উপর, আরো হয়তো কিছু কিছু আছে। আমি লেখার চেষ্টা করি।
আর পশ্চিমবঙ্গের কালচারাল ডেভলপমেন্টটা যে জায়গায় গেছে, সেই জায়গার তুলনায় এখানে যাদের কাছ থেকে আপনি বার বারই মুখ খোলার কথা বলছেন, আমার তো তাদের খুব অসহায় মনে হয়। এবং লেখার তলাগুলোও আমি খুব ভালো বুঝতে পারি, যে কার কোন লেখার কেমন ফাউন্ডেশন। নিশ্চয়ই আমারটাও আপনারা যেমন বোঝেন। তবে স্বীকার করতে বিব্রত হবো না, ছোটকাগজের রোকন রহমান এবং আপনার উপর লেখা আমার হয়ে ওঠেনি। একটা বড় অপরাধবোধ সে জন্যে কাজ করে।
মাসুমুল আলম: দেশে বাণিজ্যিক পত্রপত্রিকার লেখক হওয়া সত্ত্বেও অনেকেই পশ্চিমবঙ্গে ছোটকাগজের সূচিবদ্ধ হয়ে থাকেন। আবার, হাংরি লেখক মলয় রায়চৌধুরী, ছোটকাগজের শুভংকর দাশ, এঁরাও সীমানা পেরিয়ে বাংলাদেশে বাণিজ্যিক সাহিত্য পত্রিকার লেখক হন। বা, এ-ধরনের প্রকাশনা থেকে বই বের করেন। আবার বাংলাদেশেরও কিছু লেখক মিডিম্যাগের সাহিত্যিক কোলকাতায় দিব্যি বাঘের বাচ্চা ব’নে যান এবং সেখানকার অল্টারনেটিভ প্রকাশনা থেকে বই বের করেন। সীমানা পেরিয়ে গেলেই এই ছোটকাগজ-বড়কাগজ ভেদরেখাটি যে ঘুচে যায়, এটা লেখকদের সরল অজ্ঞতাপ্রসূত বলে আপনি মনে করেন?
সেলিম মোরশেদ: বিষয়টার সাথে আরেকটু যোগ করলে বোধহয় এমন দাঁড়াবে, যে এঁরা সকলেই প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতা বলতে দেশ, আনন্দবাজার, আজকাল, এগুলোকেই মনে করেন। এগুলোর প্রতিতুলনায় এখানকার সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান সেরকম না। এটাও সত্য। বিশ্বস্ত সূত্রে জানা, এখানে একজন সম্পাদক তাঁর কাগজের গোল্লাছুট আর সাহিত্য সাময়িকী পাতাটাকে সাবসিডি বলে মনে করেন। তাহলে তিনি কী চান? তাঁর বইয়ের যে প্রকাশনা, তাঁর পত্রিকার যে প্রকাশনা, সেখানে দেখা গেছে, সাহিত্যের কোনো ধারাবাহিক বই তিনি ছাপেন না বা সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান করার ইচ্ছা তাঁর আদৌ নেই। তাঁরা বা তিনি বাংলাদেশের তিন নম্বর রাজনৈতিক দলের একজন হতে চান। আরো বড় প্রতিষ্ঠানের। ফলে, সাহিত্য প্রতিষ্ঠান হিসাবে তাঁর আগ্রহটা নেই। ফলে, আমাদের পশ্চিমবাংলার বন্ধুরা, হয়তো শুভংকর দাশ আমাদের কারণে দু চারটা পত্রিকায় লিখছে না। আমার মনে হয় এটা। কিন্তু তিনি বাদে আর সব বন্ধুরাই মনে করেন যে এখানে ওই প্রতিতুলনার তেমন কোনো প্রতিষ্ঠান নেই। ফলে তাঁরা এ বিষয়টাকে মনে করেন যে, খানিকটা পশ্চিমবাংলার অনুকরণে বোধহয় এই চিৎকার-চেঁচামেচিটা হচ্ছে। যদিও এখানকার সবচেয়ে বড় প্রতিষ্ঠান বলে যদি কিছু থাকে, সেটা হলো একটা বিকৃত জাতীয়তাবাদী চিন্তার ধারক-বাহকের প্রতিষ্ঠান আছে, যেগুলোকে সুষ্ঠু প্রতিষ্ঠান করাই লক্ষ্য। বিরোধিতা নয়। বিরোধিতা হলো ওখানেই, যে বিকৃতিটাকে সুকৃতিতে আনা। যদি কিন্তু প্রতিষ্ঠানবিরোধী মানে, এখন প্রতিষ্ঠানকে ভেঙে ফেলা না। এই বিকৃত সিস্টেম, এই বিকৃত প্রতিষ্ঠানকে সুকৃতিতে আনা। এবং এটাই আমাদের কাজ; যদি রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব মানি, তাহলে রাষ্ট্রের বিরোধিতা না, বরং আমরা রাষ্ট্রের সিস্টেম— যে সরকার চালায়, যে সরকার আসে, সে সরকার বিরোধের সাথে আমাদের যুক্ততা থাকতে পারে। আজকে প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতা হলো বৈষম্যের বিরোধিতা। এবং এটা অবশ্যই আমি মনে করি এটি রাজনৈতিক বিরোধিতা। এবং সেটি কী রাজনীতি হবে সেটা নিয়ে আমাদের চিন্তা করা জরুরি। এটা কোনো ব্যক্তির মনোজগতের উপর নির্ভরশীল না। সেটা তাহলে হবে একটা র্যাডিকাল চিন্তা। দ্বিতীয়ত, প্রতিষ্ঠানকে সুষ্ঠুভাবে তৈরির পদ্ধতিটা কেমন হবে, সেটা কোন আন্দোলনের ভিত্তিতে হবে, সেই রাজনীতিই বলে দেবে। কারণ পৃথিবীর কোনো সংস্কৃতিবানরা কখনো প্রতিষ্ঠান গড়েওনি, প্রতিষ্ঠান ভাঙ্গেওনি। তারা যেটা করেছে সেটা হলো, তাদের বেঁচে থাকার উপযোগী, তাদের দৃষ্টিভঙ্গি-উপযোগী একটা প্রতিষ্ঠানকে তারা সনাক্ত করেছে। কিংবা বর্জন করেছেন। সেটা রাষ্ট্রচিন্তার বাইরে। কিন্তু আমাদের এখানে রাষ্ট্রের চিন্তার বাইরে কিছু বর্জন করার উপায় নাই। ফলে আমাদের এখানে প্রতিষ্ঠান গড়ারই এখন সময়। যেহেতু এতো বিকৃত সব প্রতিষ্ঠান যে কোনো কাজই করা যাচ্ছে না।
মাসুমুল আলম: আপনার ব্যক্তিগত ইশতেহার, ছোটকাগজ বিষয়ক লেখাপত্র এবং সাক্ষাৎকারগুলোয় আপনার যে অবস্থান, সেই অবস্থান কি এখনো অটুট রয়েছে?
সেলিম মোরশেদ: কোনো দার্শনিক বিষয়কে অটুট না ভেবে মজবুত ভাবা ভালো। সেখানেই তো আছে।
মাসুমুল আলম: সুবিমল মিশ্র আপনাকে ‘প্রতিষ্ঠান বিরোধী লেখক’ হিসেবে সম্মানিত করেছেন। গত ৪০ বছর ধরে আপনি প্রতিষ্ঠানবিরোধী লেখক এবং এক্টিভিস্ট, ‘প্রতিষ্ঠানবিরোধী’ হতে গিয়ে আপনি কি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। হলে, কীভাবে?
সেলিম মোরশেদ: বহু দিক থেকে। ব্যক্তিজীবনের প্রশ্নে যদি আসেন তাহলে বলব, স্বচ্ছল না, স্বাভাবিক না, সম্মানজনক না। তছনছ হয়েছে আমার ব্যক্তিজীবন। ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় না-হয় কোনোদিন বলব। খারাপ লাগে যেটা, উনিশ-বিশের একটা ভ্যারি করলে একটা স্টান্ডার্ড নিজের রাখা যায়। কিন্তু চারিপাশে এতো স্লো ডেভলপমেন্টের ভেতর নিজের নিয়ত নির্মাণ, অধ্যবসায় এগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আমি ব্যক্তিজীবনের কথা বলছি না। লেখালেখি বা বোধের আপেক্ষিক সমতা নিয়ে কথাটা বলেছি। প্র্যাকটিসটা এমন হয়েছে, নিজের বিষয়ে কিছু ভাবতেও পারি না একা। চারপাশের অবস্থা এমন, নিজেকে সঠিকভাবে প্রতিস্থাপিত করাও মুশকিল হয়ে দাঁড়ায়।
মাসুমুল আলম: ‘মেঘচিল’ আপনাকে নিয়ে ক্রোড়পত্র করার ঘোষণাপত্রে বলেছে, আপনি একমাত্র ব্যক্তি যিনি এই চার দশকে অন্তত ২০০ তরুণের বই প্রকাশে ব্যক্তিগত আপনি অবদান রেখেছেন। ২০০ একটি দানবীয় সংখ্যা। এটা করতে গিয়েই কি আপনি ক্ষতিগ্রস্ত বা রোগাক্রান্ত হয়েছেন? এঁদের মধ্যে (২০০ জন) উল্লেখযোগ্য কারা?
অমিয়ভূষণ মজুমদার এবং সুবিমল মিশ্রকে একইসাথে একজন প্রতিষ্ঠানবিরোধী লেখক কীভাবে মিলাতে পারেন? উল্লেখ্য, লেখার পাশাপাশি সুবিমল মিশ্রও তো সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সাথে বাহাস করেছেন সামনাসামনি।
সেলিম মোরশেদ: এতোগুলো প্রশ্ন এক প্যারায় বেশ ঘনবদ্ধ লাগে। দু’শ মানে প্রায় ওরকমই। দানবীয় হবে, তবে আমি ব্যক্তিগতভাবে করেছি তা তো না, আমি বয়োজ্যেষ্ঠ বলে উদ্যোগ নিয়েছি। হয়তো আমার নামটা আসছে। আপনারাও আছেন। কবি আহমেদ নকীব, মারুফুল আলম, সুহৃদ শহীদুল্লাহ, নাভিল মানদার, সর্বোপরি ‘উলুখড়’। এবং অন্যান্য সব মিলিয়ে প্রত্যক্ষ এক-দেড় শ বই তো আমরা সবাই মিলেই করলাম। অধিকাংশ বইগুলোর সাথে আমি ফিজিক্যালি থেকেছি। পাণ্ডুলিপি দেখেছি। এছাড়া আরো বাইরেও বিচ্ছিন্ন অনেক আছে। পরোক্ষভাবে সাম্প্রতিককালে ‘উড়কি’র বইগুলোর কথাও বলা যায়। এখানেও থাকলাম। এই করোনা-র ভেতরেও হাতে তিনটা বই আছে। মারুফুল আলমকে নিয়ে মহসিন রেজা এবং দুর্বাশা দুর্বার, অভিজিৎ বসুকে নিয়ে নাভিল মানদারের সাথেও তো তিনটা বইয়ের কথা ভেবেছিলাম, হবে কিনা জানি না। কেন আপনার মনে নেই, ওইভাবে লিটল ম্যাগাজিনের সঙ্গে তিনি না, তবুও যশোরের পাবলিক লাইব্রেরির সামনে তাঁর একটি ঢাউস বই যখন ‘প্রতিশিল্পে’র সবাইকে নিয়ে উদ্যোগ নিচ্ছিলাম, আপনি বিরক্তি প্রকাশ করেছিলেন! এরকম টুকিটাকি করি। এক্টিভিস্টের কাজ হিসেবেও মনে করি।
আর ক্ষতি? সব ক্ষেত্রেই। এই যে আপনি প্রশ্নগুলি করছেন, যখন আপনার মেয়ে অসুস্থ, হাসপাতালে, তার পাশে বসে। কেন? আমি জানি নিশ্চিত আপনার কোনো বৈষয়িক লাভ নেই। নিজে শিল্প করেন, তার তাড়না থেকে করছেন। আসলে আমরা সবাই আটকে গেছি, মাসুমুল আলম! এর একটিই কারণ, আমরা সম্মিলিত প্রতিবাদে অংশ নিচ্ছি না। আমরা ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে রাজনীতির উগ্র বিষয়টাকে মানতে পারছি না। কিন্তু সমস্যাগুলো উগ্র হয়ে আমাকে-আপনাকে জড়িয়ে রেখেছে। সবার প্রশ্নের ভেতরেই আমি লক্ষ করছি, গোষ্ঠীর অপারগতা, নিরাশা দেখছি। কিন্তু সম্মিলিত প্রতিবাদের আহ্বান শুনছি না। আপনারা কেউ কি প্ল্যাটফর্ম চান? না চান-না এটাও ঠিক বুঝতে পারছি না, প্লিজ! একটা স্ট্যান্ডপয়েন্টে লেখা এবং যাপন যখন তৈরি হয়, তখন সবার সঙ্গে চলা যায়। সুবিমল এবং সুনীল এক জায়গায় বসতে পারেন। কারণ সুবিমল মিশ্রের ব্যক্তিত্বটাই আলাদা। লেখকের সঙ্গে সুবিধাভোগী শ্রেণির একজন লেখকের চালচলন, জীবন যাপন, শিল্পের দৃষ্টিভঙ্গি, যখন সবই মিলছে না, তখন সে বাহাস ছাড়া করবে কী! আপনার কোনো প্রজ্ঞাবান সতীর্থও তো সেটা মেনে নেবে না, যদি আপনি ভিন্নরকম যাপনের লোক না হন। পথ তো দুটো, ক্রুশচেভের শান্তিপূর্ণ অবস্থা এইসব আহাজারি নিয়ে, অথবা সত্যিকারের বিকল্পধারার প্ল্যাটফর্ম করা। একবার করেন, দেখেন কীভাবে পেরিফেরিতে কতো মানুষ পাওয়া যায়। শুধু লেখকদের নিয়েই চিন্তা করছেন কেন?
আমি গাঙচিল বা মেঘচিল যে চিলেই লিখি-না কেন, আমি কিছুটা আমি না-হলে আপনি আমাকে এই প্রশ্ন করতেন না। কিংবা আমি কিছুটা আপনাদের না হলে আপনি মেঘচিলে আমায় প্রশ্ন করতেন না। আর এই প্রশ্নগুলো কখনো কখনো পাঁচটা ব্লকের বাইপাসের রোগী এবং সাম্প্রতিক নিউরোস্ট্রোক হওয়া মানুষের কাছে যথার্থ আন্তরিকতায় অমানবিকও লাগতে পারে।
মাসুমুল আলম: মিডিয়া তার চরিত্র বদলায়। এটা আপনি জানেন। মিডিয়া আনিসুল হকের পাশে শহীদুল জহিরকে পরিবেশন করে। অতীত, বর্তমান নিয়ে দৃষ্টান্ত দিলে দেওয়াই যায়। এই পরিস্থিতিতে, যখন নিউ মিডিয়া উপস্থিত, ওয়েবজিন চলে এসেছে, তখন ছোটকাগজ-বড়কাগজের প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে আপনার এখনকার অভিমত জানতে চাই।
সেলিম মোরশেদ: মানুষের অবচেতন মন সত্যের দিকে যায়, আমি বার বার কথাটা বলছি। জ্ঞানহীন মানুষও গুণ ধরতে পারে। হয়তো প্রকাশ করতে পারে না। এই জগাখিচুড়ি নিয়ে এতো ক্রিটিক্যালি না-ভাবাই ভালো। আনিসুল হক তা-ও তো সমাজ নিয়ে লেখে। কল্পকাহিনি লেখে না। বুদ্ধিজীবীগিরি করে না। এনজিও’র কনসালটেনসি করে না। এর আগেরগুলোও-বা কী ছিলো?
মাসুমুল আলম: বাংলাদেশ ছোটকাগজ প্রকাশনা এখন নেই। ‘উলুখড়’ প্রকাশনা একদা ছিল। কোলকাতায় ছিল গ্রাফিত্তি, এখন সেখানে আছে আন্ডারগ্রাউন্ড বিভিন্ন পাবলিকেশন: কোয়ার্ক, পার্চমেন্ট এসব। ছোটোকাগজের লেখক যাঁরা গাঁটের পয়সা খরচ করে বই করতে পারবেন না, তাঁদের জন্য এখন ছোটকাগজের প্রকাশনা থাকার বাস্তবতাটা কতটুকু? উল্লেখ্য, দেবেশ রায়ের উদ্যোগে ‘প্রতিক্ষণ’ থেকে বাণিজ্যিক – অবাণিজ্যিক পত্রিকায় লেখালেখি করেন, কিন্তু ভালো লেখেন এমন তরুণ লেখকদের নিয়ে ‘প্রতিক্ষণ’ প্রকাশনা দাঁড়িয়েছিলো। বাংলাদেশেও বিগ হাউজের দৈনিক পত্রিকা, একাধিক ওয়েবজিন এবং সাহিত্য পত্রিকায় (ছোটকাগজ নয়) অথবা স্বাধীন প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান ‘হাম সব এক হ্যায়; আমরা সবাই ভাই ভাই’— এই প্রবণতা শুরু হয়েছে। প্রগতিশীলতার মুখোশে তাহলে এখন ‘ভালো লেখাই বিচার্য’ একাসনে বসে শুধু সাহিত্য জারি রাখা বিষয়ে আপনার মতামত জানতে চাইছি।
সেলিম মোরশেদ: ভালো লেখাই বিচার্য এই কথাটা কে বলছে! বা কারা বলছে! আপনি বার বার যখন বলছেন কথাটা। তিনি নিজে কতোটা ভালো লিখেছেন? কবে থেকে? তাঁর সময়ে তাঁর ক’টা লেখা আছে? কতোটা পথ ধরে এগিয়েছেন? কতোটা শিল্প-সাহিত্যের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বক্তব্য রেখেছেন? আর আমি মনে করি, উলুখড় প্রকাশনী বন্ধ হয়নি। উলুখড় প্রকাশনীতে যাঁরা বই লিখবেন, বা আসবেন, আমি বাদে তাঁদের সকলেই তো চাকরি করেন। সকলে মিলেই আর আমি হোলটাইমার খাটনি দিব। সকলে মিলে আবার আমরা ‘উলুখড়’কে বাঁচিয়ে আনতে পারি। একথা ঠিক, ছোটকাগজের সেই লেখকটির বই উলুখড় থাকাতে নির্বিঘ্নে বের হয়েছে। কখনো এই ভালো লেখার বিচার্যের পণ্ডিতি করতে আসেনি। সরাসরি যারা পণ্ডিতি করতে আসবে, তাদেরকে বলুন, আপনি কে? সরাসরি বলুন। ভালো লেখা বিচার করার আপনি কে? তখন কী সত্যটা সে বলে, দেখুন। ‘উলুখড়’ নিশ্চয়ই আবার হবে। কারণ সাগর নীল খান যখনই পারবে তখনই এই চেষ্টাটা করবে। এই ধরনের মুভমেন্টকে, যেখানে নিরাশা আর হতাশা আছে, প্রকাশকের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য থাকতে হয়। সাগর নীল খানের তা আছে। উচ্চাকাঙ্ক্ষা থাকলে তার হবে না। লেখক হওয়া সত্ত্বেও, চিন্তার গভীরতা সত্ত্বেও দীপের ভেতর যা নেই। দ্বিতীয়ত, একটু পিছিয়ে পড়েছে, এমন কোনো লেখককে সে সম্মান দিতে কার্পণ্য করেনি। তৃতীয়ত, তার ভালোলাগাটার সাথে লিটল ম্যাগাজিনের সবার ভালোলাগার একটা কমন রুচি, কমন বোধটা তৈরি হয়েছিল। সাহিত্যের জন্যে সময় অপচয়ে পারদর্শী— যেটা আমার সবচেয়ে পছন্দ, সেটা দীপের ছিলো। আমি কখনোই মনে করি না যে ‘উলুখড়’ বন্ধ হবে। এমনকি ‘উড়কি’র প্রকাশক মোশারফ খোকনও বহুবার ‘উলুখড়’কে কো-অপারেট করতে চেয়েছে। সাগর নীল খান তা নিতে চায়নি। সেই অর্থে ‘উলুখড়’ আবার পুনরুজ্জীবিত হবে, আমরাই ‘উলুখড়’ করেছি, আমরাই আবার সময়মতো ‘উলুখড়’কে জাগিয়ে দেব। গাটের পয়সা খরচ করে প্রতিশিল্প, দ্রষ্টব্য এবং করাতকল বেশ কিছু বই-ই তো করেছে। তারা কি কারো ধার ধেরেছে? না কি সেগুলো বই না।
মাসুমুল আলম: আপনার সাপলুডু খেলা আমার অত্যন্ত প্রিয়। বইটির প্রথম প্রকাশনাকাল থেকে ২০১৬ সালে ‘শ্রেষ্ঠ গল্প’-এর প্রকাশকাল পর্যন্ত (বইয়ের শেষে গ্রন্থতালিকা) সব জায়গায় আপনি এটিকে নভেলেট বা উপন্যাসিকা হিসেবেই চিহ্নিত করেছেন। আপনার সর্বমোট ২৮ টি গল্পের বাইরে, সাপলুডু খেলা-কে এখন আপনি উপন্যাস হিসেবে দেখতে চাইছেন কেন? যদিও উপন্যাস হিসেবে আপনি এটিকে প্রতিষ্ঠা করতে চাইলে কোনো সমস্যাই নেই। কেননা, মার্গারিত দ্যুরাস, প্যাট্রিক মোদিয়ানো, আরো আগের আলব্যের ক্যামু, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, সন্দীপন, দীপেন্দ্রনাথ, বাসুদেব………… এঁরা তো সুইয়ের ভেতর দিয়ে উট চালান করে দিতে পেরেছিলেন। বৃহৎ কলেবর গতরজব্দ ঔপন্যাসিকদের ‘শ্রমের মর্যাদা’ দিয়ে যেতে হবে এটা মাথায় রেখেই আপনার ‘উপন্যাস ভাবনা’ বিষয়ে জানতে চাচ্ছি।
সেলিম মোরশেদ: আসলে ‘সাপলুডু খেলা’ যখন লিখি তখনকার পরিস্থিতি এমন; আমার ছেলে সঞ্চয় প্রথম জীবন-মৃত্যুর মাঝামাঝি। হলি ফ্যামেলিতে বসে রুমে লেখা। যশোরে ফিরে মাঠের ভেতরে ‘প্রতিশিল্পে’র লেখক-শিল্পী সবাইকে দেখাই। আপনার বয়স তখন আঠারো। আধঘণ্টার ভেতর ব্যাককভারটা আমার সামনে লিখলেন। উনিশ বছর পরে ‘উড়কি’ আবার যখন পুনঃপ্রকাশ করলো আমি ওটাই রেখে দিয়েছি। ওটা নভেলা কি নভেলেট কি নভেল, আমি নিজেও ঠিক করতে পারছিলাম না। হঠাৎ দেখলাম ২০১৫-তে কলাভবন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্পাদক ভীষ্মদেব চৌধুরী এবং তাঁর সম্পাদনা পরিষদ একটা ক্রোড়পত্র করলেন ‘বাংলাদেশের উপন্যাস’ শিরোনামে। ওখানে মৌমিতা রায় কেন এটা উপন্যাস না, বলে এমন সব যুক্তি দিলেন যেন-বা উলটো, গালে কচু ধরলো। একাডেমি সাধারণত এটা উপন্যাস নয়, ওটা উপন্যাস নয়, ওইটা অপন্যাস— এইসব বলে। যেহেতু আমাদের সাহিত্য অধ্যাপক দ্বারা শাসিত, ফলে ভয়ে উপন্যাস বললাম। হ্যাঁ, উপন্যাসের সংজ্ঞা আমি এপর্যন্ত যতগুলো পড়েছি; খুব একটা ইমপ্রেসড হইনি। যে কটা লেখা পড়েছি, ভালো লেগেছে দুটো। একটা দেবেশ রায়ের উপন্যাসের নতুন ধরনের খোঁজে আরেকটা লরেন্সের হোয়াই দ্য নভেল ম্যাটারস। এখন মনে হচ্ছে লিখতে লিখতে উপন্যাসের নতুন একটা সংজ্ঞা তৈরি করতে হবে।
মাসুমুল আলম: হালফিল কার উপন্যাস আপনি পড়লেন? প্রতিষ্ঠানবিরোধী এক্টিভিস্ট এবং পাঠক হিসেবে ছোটকাগজ-কেন্দ্রিক আর বড়কাগজের উৎসব সংখ্যা, ওয়েবজিন বা মিডিম্যাগ সাহিত্য পত্রিকায় মুদ্রিত গল্প-উপন্যাসের সাথে আপনার তুলনামূলক মূল্যায়ন ও বিশ্লেষণ জানতে চাই।
সেলিম মোরশেদ: যে যার মতো স্বাধীনভাবে লিখছে। একটা বিষয় তারা কেনো বোঝেন না, লেখক হবার একটা অন্যতম শর্ত কী লিখবে আর কী লিখবে না। পরিচিতির আকাঙ্ক্ষা লোভের পর্যায়ে গেলে ফ্রাস্টেশনে চলে যাবে।
মাসুমুল আলম: আপনার এন্টি-এস্ট্যাবলিশমেন্ট মানসিকতা বুঝবার জন্য ‘পাল্টা কথার সূত্রমুখ অথবা বুনো শুয়োরের গোঁ’ নামে একটা বই আছে। এর মধ্যে আছে ইশতেহার ও সাক্ষাৎকার। এটার আলোকেই বৃহত্তর পাঠকসমাজ আপনার শিল্প ও শিল্পযাপন দেখবে কি না?
সেলিম মোরশেদ: কখনো কখনো।
মাসুমুল আলম: ব্যক্তিগতভাবে যারা আপনাকে জানে, আপনি বাক্য নির্মাণে যথেষ্ট যত্নশীল এবং খুঁতখুঁতে। যে লেখা একবার প্রকাশ হয়ে যায়, সেই লেখা আপনি আবার পড়েন?
সেলিম মোরশেদ: হ্যাঁ, এটা সত্যি।
মাসুমুল আলম: বিশ্বসাহিত্যের সর্বশেষ স্টোরিটেলার নোবেলজয়ী গার্সিয়া মার্কেস। যিনি আবার বোর্হেসেরও পাঁড় ভক্ত, তিনি বলেছেন, ‘হুলিও কোর্তাসারের উদাহরণ টেনে বলা যায় যে, আমি বিশ্বাস করি লেখালেখির জন্য এখনো অনুদান বা অর্থানুকূল্য গ্রহণ করলে লেখকের মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হয় আর সব অর্থানুকূল্যই এক ধরনের আপোষকামিতারই নামান্তর।’ যদিও এখানে সরাসরি পুরস্কারের কথাটি নেই, তবে পুরস্কারের সঙ্গে অর্থের বিষয়টি থাকেই। স্বীকৃতি বা পুরস্কার গ্রহণে লেখকের সাহিত্যিক রাজনীতিও থাকতে পারে। আর মাঝেমধ্যে পুরস্কার জিনিসটা হাত ফসকে সৃজনশীল মানুষের কাছেও চলে যায়। যেমনটি আপনার ক্ষেত্রে হয়েছে বলে মনে করি। হ্যাঁ, আপনি ২০২০ সালে ‘লোক সাহিত্য’ পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছেন। এ বিষয়ে আপনার প্রতিক্রিয়া কী? পুরস্কারের বিষয়টি যদি আপনার গুরুত্বপূর্ণ বা গুরুত্বহীনও হয়, তবে পুরস্কার জিনিসটা আপনার কাছে কীরকম?
সেলিম মোরশেদ: এখন আমি যে পর্যায়ে ভাবনা-চিন্তা করি, পুরস্কারটা আমার কাছে কোনো গুরুত্বপূর্ণ না। সেটা একেবারেই না। বরং একটা কথা আমি খুবই গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করি, সেটা হলো, মানুষের যোগ্যতার তুলনায় অধিক সফলতা এলে সেটাকে আমি ভয় পাই। মার্কেসের এই কথাটা আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ, সুবিমল মিশ্রের এই কথাটাও আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু বাংলাদেশের এই পুরস্কার কি পুরস্কার না, এইসব বিষয় আমার কাছে এখন গুরুত্বপূর্ণ না। সেটা ‘লোক’ থেকে রাষ্ট্রীয় পুরস্কার পর্যন্ত কোনোকিছু পাওয়ার জন্য যেমন আমি উদগ্রীবও না, তেমন আমি কোনোকিছু প্রত্যাখ্যান করার জন্যে কারণবিহীন পোস্ট দিয়ে সততা প্রমাণ দেয়া এখন প্রয়োজন মনে করি না। যে লেখাটা লিখতে চাই, সেটা হচ্ছে কি না এটাই একমাত্র চিন্তা।
আজকে অনিকেত শামীমের ‘লোক সাহিত্য পুরস্কার’ নিয়ে কথা শুনছি যথেষ্ট। ‘লোক’ যদি প্রতিষ্ঠান হয় এবং যারা বলছে, তারা কোন দপ্তরে কাজ করে? আমি এখানে দেখেছি, জীবনের প্রত্যেকটা ক্ষেত্রেই তারা সমস্ত বড় বড় প্রতিষ্ঠানে যুক্ত হয়ে কাজ করে। বসের ধাতানি খায়। কি নিয়মনিষ্ঠ কাজ করে; শুধু পাঁচজন যখন একত্র হয়, তখন এসে বন্ধুদের সামনে এই বিরোধী মনোভাব হওয়ার কথা শুনি। আমাকে অনিকেত শামীম পুরো দশটি বছর ধরে একইভাবে চাইছে। কী বিক্রি করবে সে আমাকে নিয়ে? আমার সকালটা কেমন যায় নকীব জানে, মারুফ জানে। আমার প্রতিদিন কেমন যায়, যারা এসব বলে আমি তাদের গুরুত্ব দেই না। আমি তো তাদের মতো বেনসন খাই না। আমি গোল্ডলিফ-ডার্বি খাই। আমি তাদের মতো বড়ো চাকরি করে ফ্যাশন করে লিটল ম্যাগাজিন করি না।
অনিকেত শামীম যদি প্রতিষ্ঠান হয়, আর সে যদি কোনো ধরনের লিটল ম্যাগাজিনের ক্ষতির কারণ হয়, তাহলে বাংলাদেশের এতোগুলো লিটল ম্যাগাজিন এবং উলুখড় প্রকাশনী অনিকেত শামীমের কাছ থেকে এ সম্মানটা নিত না। বরং আমরা তাকে এটা বোঝাতে সক্ষম হয়েছি, যে প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতার যে জোট সেটা তার ব্যক্তির চেয়ে অনেক শক্তিশালী। এবং দ্বিতীয়ত, সে ভালোবেসেই এখানে থাকতে চেয়েছে। সঙ্গে নিতে চেয়েছে। আর ‘লোক’ তো এখন বন্ধ হয়ে গেল। আমি তার ভালোবাসারই মর্যাদা দিয়েছি। আমি আবারও বলছি, কাজ বাদ দিয়ে ‘লোক’ থেকে রাষ্ট্রীয় পুরস্কার পর্যন্ত, যারা আদর্শের কথা বলে, কমপ্লিটলি ভণ্ড। ছোটকালে স্কুলে বিতর্ক প্রতিযোগিতা ও খেলাধুলায় সবসময় পুরস্কার পেয়েছি। এমনকি লেখালেখিতেও। এখন এটা আমার ইচ্ছা সাপেক্ষে। কোনো বিষয়-নীতি সাপেক্ষে না। নীতি আসবে প্রীতি থেকে, কোনোপ্রকার সংশয় বা ভীতি থেকে না। অনেক জরুরি বিষয় এখনও ইচ্ছা করলে প্রত্যাখ্যান করতে পারি।
মাসুমুল আলম: শহীদুল জহির তো তাঁর বইতে ম্যাড়ম্যাড়ে সাদা-কালো পাসপোর্ট ছবির নিচে পেশা হিসেবে কেবল ‘সরকারি চাকরিজীবী’ লিখতেন। এতে কর্মকর্তা বা কর্মচারী বোঝারও উপায় ছিল না। অথচ কত পদস্থ কিন্তু তৃতীয় শ্রেণির কবি-লেখক এখানে রয়েছে। এদেরকে পড়াও যায় না। ল্যাতিন সাহিত্যিকদের বাস্তবতা তো এখানে নেই। পাবলো নেরুদা, অক্টভিও পাজ, কার্লোস ফুয়েন্তেস, মিগুয়েল অ্যানহেল আস্তুরিয়াস…. এঁরা মন্ত্রী বা রাষ্ট্রদূত কিন্তু তাঁরা সমধিক পরিচিত সাহিত্যে নোবেল জয়ী হিসেবেই।
মোদ্দা কথা, প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়া, অধীত বিষয়, উল্লেখ করার মতো পেশা, পারিবারিক ঐতিহ্য… এসব তো শিল্প-সাহিত্যের বাইরে গৌণ একটি বিষয় কিন্তু মধ্যবিত্ত শ্রেণি এগুলোকে গুরুত্ব দেয় বলেই কি লেখক-পরিচিতিকে একটু ভারি বা সবিস্তার করার ট্রেন্ড চালু হয়েছে এদেশে? তথাকথিত শিক্ষার আলোকপ্রাপ্ত অশিক্ষিত সমাজে এটা কি সামাজিক মর্যাদার প্রশ্ন? যেমনটা পুরস্কারখচিত হওয়া?
সেলিম মোরশেদ: আদৌ কি গৌণ? বিনয় বা সিমপ্লিসিটি— এটা বুর্জোয়া কালচার। আপনি যেটা বললেন, সেটা আগের। বর্তমান প্রেক্ষিত-পরিপ্রেক্ষিতের না। বর্তমান ট্রেন্ডও না, এ ভূখণ্ডের ট্রেন্ড হারিয়ে গেছে। মানুষ উন্নত পেশার লোককে খুবই গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করে। রবীন্দ্রনাথ যখন জার্মানে গিয়েছিলেন, টমাস মান অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। অথচ রবীন্দ্রনাথের বিনয়ের তখন সীমা ছিলো না। তো কে ম্যাড়মেড়ে পোশাকে ছবি দিল সেগুলো খুবই বিচ্ছিন্ন বিষয়, কিন্তু এদেশের লেখককে মানুষ মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো দেখতে চায়। এদেশে লেখককে মানুষ বিভূতিভূষণের মতো দেখতে চায়। এদেশের মানুষ লেখককে মন্ত্রী, আমলা বা এইসমস্ত উচ্চ পদের চাকরিতে দেখতে চায় না। এর ভেতরে ব্যক্তিগতভাবে যদি কেউ সৎ থাকে, তার লেখনীর মূল্যায়নটাও যেমন হবে, হ্যাঁ, পাশাপাশি তিনি না লিখলেও তিনি যে একজন উচ্চপদস্থ, এবং উচ্চপদস্থ বলেও ওই সমমানের অন্য কেউ কম গুরুত্বপূর্ণ এ সত্যটাও সকলে জানে। এটা বলছেন না কেন? বর্তমানে এর ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছে। বাংলাদেশে লেখকদের প্রতিযোগিতায় ফেলে দেয়া হয়েছে স্ট্যান্ডার্ড লাইভ লিডিংয়ে।
লেখার সাথে তো লেখকের ব্যক্তিজীবন খোঁজ নেয়। তার পেশার খোঁজ নেয়। আপনি কল্পনা করুন তো, যে একজন বড় মাপের লেখক আজ মুদি দোকানদার। কল্পনা করুন তিনি সিএনজি চালান! আজকে বাংলাদেশে সেটা সম্ভব? কিন্তু বাংলাদেশ, পশ্চিমবাংলাসহ সারা পৃথিবীর লেখকরাই এই ধরনের পেশা, এই ধরনের বিষয়গুলোকে গ্রহণ করেছে। অসামাজিক হওয়ার এটাও একটা অন্যতম কারণ। কারণ এই সুবিধাভোগী শ্রেণিদের কাছে তারা যেতে চায়নি বলেও খানিকটা অসামাজিক হয়েছে। কারণ সুবিধাভোগী শ্রেণিদের কাছে গেলেই এই ধরনের মর্যাদাবোধ, এই ধরনের বিষয়-আশয় নিয়ে তাদেরকে তৃপ্তিতে রাখে। ফলে, অবশ্যই এটা ট্রেন্ড না। অবশ্যই, আমি তো মনে করি বাংলাদেশে এটা এখন এমন পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে, যে এই পেশার কারণেও বহু লোক ওভাররেটেড। আহমদ ছফাদের মতো পেশাহীন মানুষদের যুগ শেষ।
মাসুমুল আলম: ঐতিহাসিক উপন্যাস বলে কিছু বিশ্বাস করেন আপনি? আর তা বৃহৎ কলেবরযুক্ত হবেই? যেহেতু, ঐতিহাসিক কবিতা তো হয় না! সংজ্ঞাভিত্তিক উপন্যাসের প্রকরণ পাল্টে গেছে কি-না?
সেলিম মোরশেদ: একসময় উপন্যাসের কিছু ক্রাইটেরিয়া ছিল। যেমন ঐতিহাসিক উপন্যাস, সামাজিক উপন্যাস, প্রেমের উপন্যাস, চরিত্র-প্রধান না ঘটনা-প্রধান, পত্রোপন্যাস। এখন বর্তমান সময়ে সবকিছুর মিশ্রণ নিয়েই লেখা হয়। ফলে এইভাবে ভাগ করার কোনো অবকাশ নেই। তারপরেও কোনো কোনো উপন্যাস হয়তো-বা বিশেষ একটা উপন্যাসের টার্মে পড়ে যেতে পারে।
আর সংজ্ঞাভিত্তিক উপন্যাসের যে প্রকরণ বলছেন, জেমস জয়েস পালটিয়ে দিয়েছেন। শুধু জেমস জয়েস না, বহু লেখকই পাল্টে দিয়েছেন। বাংলা ভাষায় কমলকুমার মজুমদার নিজেও তো পাল্টে দিয়েছেন।
মাসুমুল আলম: নগুগি ওয়া থিয়োংগা কেনিয়ান না আফ্রিকান, বোর্হেস বা হুলিও কোর্তাসার আর্হেন্তাইন না ল্যাতিন? এই ধারাবাহিকতায় আমাদের এখানে বাংলাসাহিত্য না বাংলাদেশী সাহিত্য? এরকম একটা কথাবার্তা যেহেতু শোনা যায় মাঝেমধ্যে।
সেলিম মোরশেদ: বাঙালি এবং বাংলাদেশি এই শব্দ দুটোই ভুয়া। তার পরেও যদি আমি এটা মেনে নেই, যেহেতু বায়ান্ন এবং একাত্তরে একটা আন্দোলন এবং যুদ্ধ হয়েছে; কিন্তু বাংলাদেশী সাহিত্য আর বাঙালি-সাহিত্য এই প্রশ্ন অবান্তর। নিজের পায়ে কুড়াল মারা ছাড়া আর কি। বিএনপির রাজনীতিতে হয়তো কাজে লাগতে পারে।
মাসুমুল আলম: আপনার লেখালেখি, সাহিত্যচর্চায় কাদের কাদের সাহিত্যপাঠ আপনাকে সাহিত্যিক হিসেবে তৈরি করেছে? পাঠক হিসেবে আপনার প্রিয় বিষয় কী?
সেলিম মোরশেদ: অনেক লেখকই আমার সাহিত্য পাঠের বিষয়ে, লেখার বিষয়ে ভূমিকা রেখেছেন। আর পাঠক হিসেবে আমার প্রিয় বিষয় সমাজবাস্তবতা।
মাসুমুল আলম: নিজেকে কখনো ‘সামন্ত মানসিকতার’ বলে মনে হয় আপনার?
কোভিড-১৯ গোটা বিশ্বকে আক্রান্ত করেছে— সাম্প্রতিক এই ঘটনা আপনার ভবিষ্যত লেখালেখিতে কি প্রভাব তৈরি করবে?
সেলিম মোরশেদ: হ্যাঁ, মনে হয়।
আমার মনে হয়, করোনা থেকে বা মানুষের যে মৃত্যু হচ্ছে তার থেকে বেশি প্রভাব ফেলবে, ওই যে বললাম; রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের মাধ্যমে। সেটা হয়তো আমার লেখায় নতুন একটা ধারা এনে দিতে পারে। আবার অন্যভাবে অর্থনৈতিক মন্দা একটা সশস্ত্র আন্দোলনেও নিয়ে যেতে পারে।
মাসুমুল আলম: হুয়ান রুলফো সম্বন্ধে শোনা যেত, তিনি ‘শৈলশিরা’ নামে একটি উপন্যাস লিখছেন, তাঁর একমাত্র উপন্যাস ‘পেদ্রোঁ পারামো’-র পরে এমনটাই প্রচারণা ছিল। অনেক বছর ধরে শোনা যাচ্ছে, আপনি একটি উপন্যাস লিখছেন ‘গাজী কালু–চম্পাবতী’ মিথ নিয়ে। কতদূর এগোলো এটা? প্রাথমিক ভাবনা নিয়ে কিছু বলতে চান?
সেলিম মোরশেদ: শুধু হুয়ান রুলফো কেন, দস্তয়েভস্কি কতো বছর লেখা বন্ধ করেছিলেন এটা নিশ্চয়ই আপনার জানা আছে। কখনো জোর করে বা বই বের করার জন্যে বা পাঠক উত্যক্ত করলে আমার লেখা আসে না। আমি মাত্র ছ বছর লেখালেখির ভেতরে সক্রিয় কোনো বই উৎপাদন করিনি। এছাড়া আমি তো লেখার ভেতর সবসময় থাকি। এ মুহূর্তেও আছি।
হ্যাঁ, ওই দীর্ঘ লেখাটির দিকেই আমার মনোনিবেশ।
মাসুমুল আলম: সাম্প্রতিক ৫টি বাংলা উপন্যাস এবং ৫টি বিদেশি উপন্যাসের নাম জানতে চাই।
সেলিম মোরশেদ: কাল রাতে অবশ্য একটা পড়ছিলাম। নুট হ্যামসুনের ‘প্যান’। বরং ওইটা বাদ দেই। ওইভাবে গুনে গুনে না বলে বরং দশবার একটি বাংলা উপন্যাসের নাম বলি। সেটা বোধহয় ভালো হবে। আমি ফেসবুক অপারেট করতে পারি না। সাহিত্য পাতা পড়ি না। মানে চোখের কারণে পড়া হয়না। নিউরোস্ট্রোক আর ফ্রোজেন সোল্ডারের চাপে থাকি। তবে একটা উপন্যাসের কথা বলি, পড়ছি, হাসান আজিজুল হকের উপন্যাস। নভেলা বলব না। মাত্র অল্প কয়েকটি পাতার। নাম ‘বিধবাদের কথা’। অনেকটা সুস্থ বোধ করছি। আমি বিস্মিত এবং স্তম্ভিত হয়েছি। লেখাটা আগে পড়িনি বলে আফসোস করছি। যে সময়ে আমার উপর অভিযোগ যে মুক্তিযুদ্ধের উপরে আমি গুরুত্বপূর্ণ কাজটা কেন করছি না! তখন বইটা আমার নিজের বই মনে হয়েছে।
দুটো বোন, তারা সাদা এবং কালো। দু বছরের বড় ছোট। জমজ নয় কিন্তু দেখতে এক রকম। নিম্ন-মধ্যবিত্ত ঘরের। তাদের বিয়ের বয়স হলো। বিয়ে ঠিক হলো দু ভাইয়ের সাথে। দুই ভাই আর দুই বোনের দুটো বাচ্চা হলো, দুটোই ছেলে। ছেলেরা বড় হলো। চাচা-ভাতিজা, খালা-বোনপো।
এর ভেতরে কখন যে ঢুকে গেলো অস্ত্র! ভারত, বাংলাদেশ, শেখ মুজিব, মুক্তিপন্থী, স্বাধীনতা, স্বাধীনতার বিপক্ষের শক্তি। বাইরের থেকে কেউ আসেনি, ধর্ষণ করেনি, গুলি চালায়নি, ঘর পোড়ায়নি। বাপ ছেলে, চাচাতো ভাই কিংবা খালাতো ভাই তারা নিজেরা হত্যাকারী হয়ে একে অন্যের সামনে দাঁড়ালো। স্ব স্ব মত নিয়ে তারা পরস্পরের শত্রু হয়ে উঠলো। ঘরের ভেতরে চলছে, পরে বাইরে কিছুটা ছড়ালো। এবং তারা পরস্পরকে হত্যা করতে উদ্যত হচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধের উপরে এতো ভালো লেখা আমি পড়িনি। হাসান আজিজুল হকের এ বিষয়ে আরো লেখা আছে। আখতারুজ্জামান ইলিয়াসেরও আছে। অনেকের আছে। ক’দিন আগে পড়ছিলাম আবদুল গাফফার চৌধুরী সম্পাদিত ‘বাংলাদেশ কথা কও’। অনেক অপরিচিত লেখাও অবাক করলো। ওখানে নির্মলেন্দু গুণেরও একটি গল্প আছে। তার পরেও এই ‘বিধবাদের কথা’ বাঙালিদের ঘরে ঘরে থাকা উচিত। মুক্তিযুদ্ধের এতো ইতিহাস যতোটা-না মানুষকে উজ্জীবিত করবে, এই একটা বই এতো টোটালিটি নিয়ে সাহিত্যমান নিয়ে লেখা কল্পনা করাও যায় না। আট বছর থেকে আশি বছর পর্যন্ত যেকোনো সত্তা এই বইটিকে শ্রদ্ধায় বরণ করবে।
এই সাক্ষাৎকার যাঁরা পড়েছেন, ব্যক্তিগত অনুরোধ রইলো, তাঁদের মতামত জানানোর। হ্যাঁ মাসুম, এই বইটাতেই এখন ঘুরপাক খাচ্ছি। বরং এই বইটার কথাই আমরা দশজন বাঙালিকে বলি।
[এই সাক্ষাৎকারের গ্রন্থস্বত্ব (Copy right) সাক্ষাৎকার-গ্রহণকারীর। সাক্ষাৎকার গ্রহণকারীর অনুমতি ব্যতীত সাক্ষাৎকারটি পুনরায় পূর্ণ বা আংশিকভাবে অন্য কোথাও প্রকাশ বা মুদ্রণ করা যাবে না।]

আরো পড়তে পারেন

