:
Days
:
Hours
:
Minutes
Seconds
Author Picture
প্রশান্ত মৃধা

কথাসাহিত্যিক

মোর প্রিয়া হবে, এস রানী
প্রচ্ছদ: রাজিব রায়

মোর প্রিয়া হবে, এস রানী

‘মোর প্রিয়া হবে, এস রানী, দেব খোঁপায় তারার ফুল।’ এই পুরো পঙক্তিটি প্রথম শুনেছিলাম বাবার মুখে, বাল্যে। বাবা প্রায় গান গাওয়ার মতন করে পঙক্তিটি আউড়েছিলেন আমার একমাত্র মাসির উদ্দেশে। আমি কাছেই দাঁড়ানো। কোন কথায়, কেন, কী জন্য বাবা একটু হেসে সদ্য ইশকুল পেরোনো তার একমাত্র শ্যালিকার উদ্দেশে এই গানের প্রথম পঙক্তিটি গেয়েছিলেন, মনে নেই। হতে পারে কথায় কথায় আমার ঘাড়ে হাত দিয়ে দাঁড়ানো মাসি তার ভগ্নিপতিকে কোনো কারণে গাইতে বলেছে। বাবাও পেয়ে গেলেন সুযোগ। মাসির নাম রানি। এই গানে সে কথা আছে, যে অর্থেই থাক, রানি কথাটা আছে। বাবা তৎক্ষণাৎ সেই সুযোগ নিলেন। আমি তখন চার-পাঁচ বছরের হব হয়তো। এ গান কার লেখা, কেন লেখা, কী নিয়ে লেখা, কিছুই জানি না। মাসির কাছে দাঁড়িয়ে আছি। ‘প্রিয়া’ শব্দটির ‘একটিমাত্র’ অর্থ একটু একটু বুঝি। বাবা প্রথম পঙক্তিটি গেয়ে থেমে গেলে মাসি বলল, ‘বাবুদা, তারপর?’ কিন্তু ‘কর্ণে দোলাব তৃতীয়া তিথির চৈতি চাঁদের দুল॥’-এই দ্বিতীয় পঙক্তিটি বাবা গাইবার চেষ্টা করেছিলেন কি না, মনে নেই। গাইলেও কিংবা গাইবার মতো করে উচ্চারণ করলেও কর্ণ, তৃতীয়া তিথি আর চৈতি চাঁদ–এসবের কোনো কিছুই আমি বুঝিনি; তাই, সেটুকু বাবা গাইলেও তাই হয়তো আমার স্মৃতিতে নেই।

তবে এ সময়ই প্রথম কাজী নজরুলকে চিনেছি। সেই চেনায়, এই গানের রচয়িতা তিনি, সে কথা কোনোভাবে জানা হয়নি। একদিন বিকেলের দিকে, কাজ থেকে ফিরে বাবা সেই প্রায় সন্ধ্যার মুখে আসা দৈনিকটা খুলে নিয়ে বসেছেন বাসার সামনে একখানা চেয়ার পেতে। আমি খেলা থেকে ফিরেছি। বাবার পাশে দাঁড়ানো। গোধূলি হতে তখনো কিছু বাকি। এ সময় তার সহকর্মী শাহজাহান কাকু এসে বাবাকে বললেন, ‘কাজী নজরুল ইসলাম মারা গেছেন!’ বাবা চোখ বড় করে মুখের দিকে তাকালেন। দুজনেরই মুখে বিষাদ। বাবা অস্ফুট জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কখন?’ তিনি জানালেন, ‘বিকেলবেলা।’ বলে, তার বাসার দিকে এগিয়ে গেলেন। আমি বাবার কাছে জানতে চাইলাম, ‘বাবা, কে মারা গেছে?’ বাবা বললেন, ‘বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম।’ বলেই একটু থামলেন, তার যেন মনে হলো কথাটা হয়তো আমি বুঝিনি, নামটা যেন আমার কাছে অপরিচিত, আরও যুক্ত করলেন, ‘তোমার ভোর হলো দোর খোলোর কবি।’ এতে কাজ হলো। ‘ভোর হলো দোর খোল খুকুমণি ওঠো রে’ পড়েছি। সেই কবি তখনো জীবিত কি মৃত, তা জানতাম না। কিন্তু এই মুহূর্তে জানলাম, তিনি মারা গেছেন। এখন সংবাদপত্র বাবার হাতে। নিশ্চয়ই সেখানে সে খবরটা আছে। তাই বাবার কাছে জানতে চাইলাম, আজকের এই সংবাদপত্রে আছে কি না সে খবর। বাবা জানালেন, কালকের কাগজে থাকবে। এই উত্তরে সেই দিনই প্রথম জানা হলো, আজ যা ঘটে, তা থাকে কালকের কাগজে।

‘ভোর হলো দোর খোলো’র কবির এটি ছাড়া আরেকটি ছড়া বা কবিতা তখন জানি। প্রথম পঙক্তি : ‘‘আমি হব সকালবেলার পাখি’। আর একটা ছবি ও ছড়ার বইতে তাঁর ছবির নিচে লেখা, ‘নজরুল নামে কবি, ঐ দেখো তারি ছবি’–সেটুকু মনে পড়ে। বাসার দেয়ালে টাঙানো একখানা ক্যালেন্ডারে ঝাঁকড়া চুলের বাবড়ি দোলানো ছবির নিচে লেখা : ‘ফুলের জলসায় নীরব কেন কবি!’ এর বাইরে কাজী নজরুল ইসলাম সম্পর্কে স্পষ্ট কি অস্পষ্ট কোনো ধারণাই নেই।
ফলে, ওই গানটি কাজী নজরুলের লেখা, সেই সময়ে কেউ বলে দেয়নি। সেই অকৃত্রিম পারিবারিক মুহূর্তে সে সুযোগও নেই। ওই একটি পঙক্তিটি বাবার মুখে শুনে মাসির নামের কারণেই তা মনে থাকে।

একদিন বিকেলের দিকে, কাজ থেকে ফিরে বাবা সেই প্রায় সন্ধ্যার মুখে আসা দৈনিকটা খুলে নিয়ে বসেছেন বাসার সামনে একখানা চেয়ার পেতে। আমি খেলা থেকে ফিরেছি। বাবার পাশে দাঁড়ানো। গোধূলি হতে তখনো কিছু বাকি। এ সময় তার সহকর্মী শাহজাহান কাকু এসে বাবাকে বললেন, ‘কাজী নজরুল ইসলাম মারা গেছেন!’ বাবা চোখ বড় করে মুখের দিকে তাকালেন। দুজনেরই মুখে বিষাদ। বাবা অস্ফুট জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কখন?’ তিনি জানালেন, ‘বিকেলবেলা।’ বলে, তার বাসার দিকে এগিয়ে গেলেন। আমি বাবার কাছে জানতে চাইলাম, ‘বাবা, কে মারা গেছে?’ বাবা বললেন, ‘বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম।’

কিন্তু কিছুদিন বাদে নিজের কাছেই আবিষ্কৃত হয়, এই গানকে নজরুলগীতি বলে। মুক্তিযুদ্ধের পরপর, বাবা পিরোজপুর ছিলেন, তখন আমার শৈশব। সেই স্মৃতি নেই। তারপর খুলনায়। শৈশবের স্মৃতি যা কিছু খুলনাতে। কাজী নজরুলের মৃত্যুর কাছাকাছি সময়ে ইশকুলে যেতে শুরু করেছি। তখন একদিন হাতে আসে দুখানি গানের খাতা। হারমোনিয়াম ও মন্দিরার কাছাকাছি রাখা থাকত। সেই খাতায় কী আছে, কখনো কখনো উল্টেপাল্টে পড়ার চেষ্টা করেছি। অ-আ-ক-খ আর নিজের নাম লিখেছি এর কোনো কোনো ফাঁকা পৃষ্ঠায়, নিজের অক্ষরজ্ঞানের নমুনা জাহির করতে। তারপর যখন পড়তে পারি, তখন দেখি, সেখানে বেশ সুন্দর হাতের লেখায় প্রতিটি পৃষ্ঠায় একেকটি গান। প্রথম দিকের পৃষ্ঠার ওপরে লেখা : আধুনিক গান। সেইমতো কলকাতার পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের বিখ্যাত গায়ক-গায়িকাদের গাওয়া গান। তবে সংখ্যায় সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের গানই বেশি। এরপর রবীন্দ্রসংগীত। রবীন্দ্রনাথের জনপ্রিয় গানগুলো, অন্তত গোটা দশেক। সম্পূর্ণ ‘আমার সোনার বাংলা’ও ছিল। তারপর পৃষ্ঠার ওপরে লেখা নজরুলগীতি। একটু বড় অক্ষরে। নিচে আন্ডারলাইন। তারপর প্রতিটি পৃষ্ঠায় নজরুলের জনপ্রিয়, লেখা উচিত, খুব প্রচলিত গানগুলো। সে তালিকার ঠিকঠাক ধারাবাহিকতা আজ আর মনে করে ওঠা সম্ভব নয়। তবে, ‘আধো রাতে যদি ঘুম ভেঙে যায়’, ‘শাওন রাতে যদি স্মরণে আসে মোরে’, ‘নীল যমুনার জল’, ‘মনে পড়ে আজ সে কোন জনমে’, আর অবশ্যই ‘মোর প্রিয়া হবে, এস রানী, দেব খোঁপায় তারার ফুল।’ এই গানগুলোর পরে ছিল : ‘এ কী অপরূপ রূপে মা তোমায় হেরিনু পল্লি জননী।’ এটি দেশাত্মবোধক অংশে।

একদিন, কোনো একদিন হঠাৎ, একটু-আধটু পড়তে শিখে ওই খাতায় ওই গানখানি আবিষ্কারের পরে, দুই এক-লাইন পড়ে নিয়েও কিন্তু মনে হয়নি, বাবার গলায় এই গানখানি প্রথম শুনেছিলাম। কেন মনে হয়নি, জানি না। সম্পূর্ণ গানটি, কবিতার মতো করে হলেও কোনো দিন ওই বয়সে একবারও পড়িনি। কেন পড়িনি, তা জানি না। বরং প্রতিটি ক্লাসে শ্রেণিপাঠ্য কাজী নজরুল ইসলামের কবিতাই পড়ে গেছি। এমনকি তাকে নিয়ে লেখা আহসান হাবীবের ‘ছেলেটি ডানপিটে কাউকে সে মানে না, ভয়ের ভবানার নাম সে জানে না’-ও। শ্রেণিতে পাঠ্য হওয়ায় এই জানাশোনায় থাকেন কাজী নজরুল।

পাড়ায় কোনো অনুষ্ঠানে কিংবা বাগেরহাট শহরের কোনো অনুষ্ঠানে নজরুলের গান তো গাওয়াই হতো। প্রতিযোগিতা হতো। সেখানেও আসলে নির্দিষ্ট কিছু গানই গাওয়া হতো, হয়তো আজও তা-ই হয়। প্রতিযোগিতায় যেমন নজরুলগীতি গাওয়ার রেওয়াজ, সেখানে নিশ্চয়ই তাঁর সব গান গাইয়েদের জন্য অনুমোদিত ছিল না। হতে পারে, এমনিতেই ওই গানটি কেউ গাইত না। আকাশবাণী কলকাতা আর রেডিও বাংলাদেশের কোনো নজরুলগীতির আসরে নিশ্চয়ই প্রথম শুনেছিলাম, পুরো গানটি।

তবে আকাশবাণী কলকাতার নজরুলগীতির কোনো অনুষ্ঠানে কি অনুরোধের আসরে হয়তো মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায় কিংবা ধীরেন বসুর গলায় প্রথম এই গানটি শুনে চমক ভাঙে। তখন বয়স কৈশোর ছাড়িয়েছে। কলেজে পড়ি। রেকর্ডে মুহম্মদ রফির নজরুল গীতিতে কিংবা অন্য কারও গলায় যে গানটি শুনিনি, তা মনে আছে। হোক মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায় অথবা ধীরেন বসু–গানটি গাওয়া হয়ে গেলে, গানটি শুনবার সময়ের মুগ্ধতা কানে বাজে, লেগে থাকে। কান থেকে করোটিতে। তখন তাদের গায়কি পৃথক করার মতো কান তৈরি হয়নি। মানবেন্দ্র একটু দ্রুত লয়ে কিন্তু শব্দগুলো বিস্তৃত করে উচ্চারণ করেন–সেখানে উচ্চাঙ্গসংগীতের আদল মাখামাখি দিয়ে যায়, তার তুলনায় ধীরেন বসুর গলা যেন একটু নিচু খাদে, গম্ভীর। তবে খুব আকুতিময়। দুজনেরটাই শুনতে ভালো লেগেছিল। আজও তা-ই লাগে।

কোথাও কোনো মতো নেই, মতো দিয়ে তুলনা নেই, তবু তুলনার কমতি নেই। উপমাও নেই। সবই উপমান-উপমেয়র খেলা। সবই ওই কল্পিত নারীর জন্য উপমেয়। কাজী নজরুল যাকে প্রিয়া হতে রানি সম্বোধন করে ডাকছেন, তার খোঁপায় তারার ফুল দিতে চান, কানে দিতে চান চৈত্র মাসের উজ্জ্বল শুক্লপক্ষের তৃতীয়া তিথির চাঁদের দুল। এই পঙক্তিটি পড়তে পড়তে ভাবি, তাঁর স্বাভাবিক কল্পনা শক্তি! যে কানের দুল তৃতীয়া তিথির চাঁদের মতন হয়, তা দেখতে কেমন? কিন্তু দেখতে যেমনি হোক, তিনি দেখিয়ে দেন।

বাবার মুখে গানেরই মতো করে শোনা, মায়ের সেই গানের খাতায় গানখানি দেখা আর কিছু বছর পর দুজন বিখ্যাত শিল্পীর গলায় এই গান শোনা–এই দিয়ে ওই গানটি গেঁথে থাকে। সেখানে আসলেই প্রকৃত গীতিকার অথবা স্বয়ং কাজী নজরুলের উপস্থিতি সামান্যই। গানটি তখন পড়ায় অন্তর্ভুক্ত হলে কিছুটা হয়তো থাকত। কিন্তু গানের খাতার অক্ষরগুলো আজও যেন চোখে দেখতে পাই, কিন্তু সেখানে ওই গানটি পড়িনি। বহুদিন বাদে একদিন আবার ধীরেন বসুর গলায় গানটি শোনার পর তাক থেকে নজরুলরচনাবলি নামাই। গানটি খুঁজি। পেয়ে যাই। পড়তে থাকি।

কোথাও কোনো মতো নেই, মতো দিয়ে তুলনা নেই, তবু তুলনার কমতি নেই। উপমাও নেই। সবই উপমান-উপমেয়র খেলা। সবই ওই কল্পিত নারীর জন্য উপমেয়। কাজী নজরুল যাকে প্রিয়া হতে রানি সম্বোধন করে ডাকছেন, তার খোঁপায় তারার ফুল দিতে চান, কানে দিতে চান চৈত্র মাসের উজ্জ্বল শুক্লপক্ষের তৃতীয়া তিথির চাঁদের দুল। এই পঙক্তিটি পড়তে পড়তে ভাবি, তাঁর স্বাভাবিক কল্পনা শক্তি! যে কানের দুল তৃতীয়া তিথির চাঁদের মতন হয়, তা দেখতে কেমন? কিন্তু দেখতে যেমনি হোক, তিনি দেখিয়ে দেন।

প্রথম ওই গানের পঙক্তি শোনার দিনগুলোতে কোনো কোনো দিন গোধূলির সময় খুলনা শহরে রূপসার কূলে দাঁড়াতাম। খেলা শেষ অথবা খেলা নেই। অথবা হয়তো সেদিন রূপসার কূলে নতুন হওয়া বাঁধের ওপরই খেলা। তখন সারাটা দিন এই পশ্চিমের শহরের দিক থেকে নদীর ওপর ফিরে যাচ্ছে হাঁসের সারি। অথবা নদীর ওপর পুবদিকে ধানখেতে সারা দিন কাটিয়ে এই হাঁসের সারি পশ্চিম দিকে শহরের বড় গাছগুলো আশ্রয় নিতে ফিরে আসছে। অথবা যাবে আরও পশ্চিমে। অনেক ওপরে সে সারি। মাথা অনেকখানি উঁচু করে দেখতে হয়। সেখানে একটি বক কি সারস কি বেলেহাঁস একেবারে সামনে। তার পেছনে দুই দিকে বাকিগুলো। একেবারে মালার মতো তাদের আকার।

ফলে, ‘কণ্ঠে তোমার পরাব বালিকা/ হংস সারির দুলানো মালিকা’–এটি ভেবে নিতে পারি। এই চিত্রকল্প আমার জানা। সেটিকে কাজী নজরুলের কল্পনার অংশ করে তুলতে পারি কি না পারি–কোনো নারীর গলায় এমন একটি মালার আকৃতিও কল্পনায় ভাসে। আর বিজলিতে চুলের ফিতে ভাববারও অবকাশ থাকে ‘বিজলি-জরিন ফিতায় বাঁধিব মেঘ রং এলোচুল॥’
তবে এই গীতিকবিতার সবচেয়ে বিস্ময়কর ও সাহসী অংশ এই দুটো পঙক্তিটি। এইখানে কবি কল্পনার নিজস্ব পরিধিকে ছাড়িয়ে গেছেন। পড়তে পড়তে নিজেও সে পরিধির চৌহদ্দিকে কোনোভাবে নিজের ভাবনার সীমানায় নিয়ে দাঁড় করানো যায় না।
জ্যোৎস্নার সাথে চন্দন দিয়ে মাখাব তোমার গায়,
রামধনু হতে লাল রং ছানি’ আলতা পরাব পায়।

জ্যোৎস্নার সাথে চন্দন? কেমন সেই বর্ণ? বিস্ময়কর! কবি কল্পনার সীমা জানি অথবা জানি না। কিন্তু উপমাকে এভাবে বাস্তব করে তোলা? চন্দন তো গায়ে মাখানোই যায় কিন্তু তার সঙ্গে যদি জ্যোৎস্নার রং যুক্ত হয়, তাহলে? কেমন সেই বর্ণ! সেই বর্ণ একজন নারীর গায়ে মাখাতে চাইছেন কাজী নজরুল। আর রংধনু থেকে লালরং নিয়ে আলতার যে বর্ণ হবে!

চলচ্চিত্রের গানে কখনো কখনো প্রচুর প্রায় আজগুবি উপমার ব্যবহার তো থাকেই, নায়ক-নায়িকার জন্য রচিত হয়। তার জন্য প্রয়োজনীয় দৃশ্যে তারা অভিনয়ও করেন। সেই দিক থেকে ভাবতে গেলে, কাজী নজরুলের মতো অন্যতম শ্রেষ্ঠ গীতিকারও তা-ই করেছেন। কিন্তু এই গীতিকবিতায় একটি উপমাকেও তো কোনোক্রমে আজগুবি লাগে না। কোনোক্রমে মনেই হয় না, খোঁপায় কী করে তারার ফুল পরানো যায়, তৃতীয়া তিথির চৈতি চাঁদের দুল কীভাবে কানে দোলে কিংবা হংসসারির মতো মালা বানিয়ে কীভাবে গলায় পরে কোনো নারী? আর আশ্চর্যতম জ্যোৎস্নার সাথে চন্দন দিয়ে গায়ে মাখানোর এই প্রয়াস, রংধনু থেকে লালরং নিয়ে আলতা!

এর পরের অংশটুকু কবির গানের সুর দিয়ে সেই নারীর জন্য বাসর রচনার প্রয়াস, তাকে ঘিরে তাঁর কবিতার বুলবুল গাহিবে গান।
কিন্তু বাবার মুখে এক ব্যক্তিগত শোনা, বিখ্যাত গায়কের গলায় শোনা আর সেই গীতিকবিতাটা পড়া–এর ভেতরে তফাতগুলো ধীরে ধীরে ফুটে ওঠে। এ শুধু কোনো প্রেমেরই প্রকাশ তো নয়, একই সঙ্গে প্রেমিকের সেই সর্বময় আকুতি, যাতে নিকট ও দূর প্রকৃতি থেকে সবই তুলনা করে প্রেমিকাকে সাজাতে চায়। কিন্তু সেখানে কোনো প্রকার কষ্টকল্পনাও তো ভর করে নেই। যেন খুব স্বাভাবিকভাবেই তিনি ভেবে নিতে পারছেন।

ফলে, সেই কল্পনা ওই গান প্রথম শোনার দিনগুলো পেরিয়ে যখন বইয়ের পৃষ্ঠায় গানটি পড়ি, তখন যেন এর ভেতরে একাত্মতা আরও তীব্র। নিজের তো সেই পড়ায় কিছু কল্পনা করে নেওয়ার সুযোগ ঘটে। চলচ্চিত্রের গানে কখনো কখনো প্রচুর প্রায় আজগুবি উপমার ব্যবহার তো থাকেই, নায়ক-নায়িকার জন্য রচিত হয়। তার জন্য প্রয়োজনীয় দৃশ্যে তারা অভিনয়ও করেন। সেই দিক থেকে ভাবতে গেলে, কাজী নজরুলের মতো অন্যতম শ্রেষ্ঠ গীতিকারও তা-ই করেছেন। কিন্তু এই গীতিকবিতায় একটি উপমাকেও তো কোনোক্রমে আজগুবি লাগে না। কোনোক্রমে মনেই হয় না, খোঁপায় কী করে তারার ফুল পরানো যায়, তৃতীয়া তিথির চৈতি চাঁদের দুল কীভাবে কানে দোলে কিংবা হংসসারির মতো মালা বানিয়ে কীভাবে গলায় পরে কোনো নারী? আর আশ্চর্যতম জ্যোৎস্নার সাথে চন্দন দিয়ে গায়ে মাখানোর এই প্রয়াস, রংধনু থেকে লালরং নিয়ে আলতা!

আমাদের তো জানা আছে, জানা থাকে, যেকোনো কবিতা কিংবা গীতি কবিতায় কবি তাঁর কল্পনাকে সংক্রামিত করেন। এখনেও তাই। প্রায় তিন যুগ ধরে নিজের কাছে সেই সংক্রমণ। ফলে, এখন প্রতিবার শোনায় কিংবা কখনো কখনো পাঠে তাই কাজী নজরুলের এই প্রয়াস নতুন লাগে।
আর বাবার সেই গায়কিটুকু সঙ্গে থাকে, সেই প্রথম পঙক্তিটিতে। গীতিকবিতাটা বোঝার অথবা না বোঝার একপ্রকার ইঙ্গিত সেখানে ছড়ানোই যেন ছিল। মাসির উদ্দেশে তার গাওয়ার প্রয়াসের সেই দুর্লভ মুহূর্ত তাই কোনোভাবে ভোলার নয়!

৩০ অক্টোবর ২০১৩, সিলেট

Meghchil   is the leading literary portal in the Bengali readers. It uses cookies. Please refer to the Terms & Privacy Policy for details.