স্মৃতিকাব্য
রফিক আজাদের রুটি
উন্মাদের রাজা না হলে কবিতা লেখা অসম্ভব। কথাটা ধানমণ্ডি হ্রদের পাড়ে শোনা। শনিবার ভোরে এক উম্মাদিনী বলেছিল। আমি যাচ্ছিলাম বত্রিশ থেকে তিন বাদ দিয়ে দুয়ের মাথায়। হ্রদের পরে হৃদয়ের রাস্তা। শুনেছি হ্রদের পাড়ে হাঁটলে সাপের পিঠে চড়ার আনন্দ মেলে। অথচ পথে কালো কালো পাথর বসানো। রাস্তার দক্ষিণে দ্বিতীয় গলিতে আমগাছতলা। শুনেছি সেদিকে রফিক আজাদ থাকেন। শুনেছি ভোর গড়ালে সূর্য মানুষের দিকে ধেয়ে আসে। তাই অরণ্যে হারানো ছায়া জমা রাখে মানুষ। রফিকও কি তাই করতেন!
লোহার গেট। তালা মারা। ভেতরে নিশ্চয়ই চাবি আছে। খোলা হলো অনন্ত দরোজা। সামনের লন রাজপথের চেয়ে বড়। চাইলে সবুজ ঘাসের পিঠে চড়া সম্ভব। হালকা কুয়াশা মাড়িয়ে একটু আগালে রফিক আজাদ। কিন্তু আমাকে দেখে তিনিই এগিয়ে এলেন। দূর থেকে শেফার্ডের মতো একটা কুকুর দৌড়ে আসল। বাদামী কালো ডোরা কাটা। ভাবলাম রফিককেই পদচুম্বন করবে। ঘটলো উলটো। মনে হলো সে পা শুঁকে শুঁকে সুগন্ধ নিলো। তবে কি কবির গায়ে শিউলি ফুলের ঘ্রাণ! বাতাস কুড়ালে ঝরা পাপড়ির মতো নত হয়!
গোলগাল চেহারা, তৃতীয়া চাঁদের মতো গোঁফ, নাক নিচু, ডেবডেবে চোখ, এলসাইজ চুলের রফিক আজাদ। বললেন, ভোরবেলা কোনো কবি কারো বাসায় আসে কিনা সন্দেহ আছে! বললাম, শুনেছি কবির অসুখ, তাই আসলাম! রফিকের থালার সামনে গোলকার পৃথিবী। বললাম, আপনি তো থালায় সুকান্তের চাঁদ নিয়ে বসেছেন। বললেন, দুটো গোলাকার পৃথিবী কবির সকালের নাস্তা। কয়েক টুকরো আলো আর একটু কুসুম। ভাবলাম, নক্ষত্র পতনের পর আমাদের ভোর হয়! অথচ কবি বললেন, ভাতের কবিতা আমার বড্ড ক্ষতি হয়ে গেছে! বললাম, ভাতই আপনাকে বাঁচিয়ে রাখবে! কবি মৃদু হাসলেন।
কবি বললেন, তুমিও চাইলে দুটো নক্ষত্র চিবিয়ে খেতে পারো! বললাম, নাহ লাগবে না। একটু রঙিন গরম জলই যথেষ্ট। রফিক বললেন, জীবন পানির মতো গড়ায়। যেখানেই তার গতি থামে, সেখানেই তার গতি একজলা কূপ। বড়জোর বলা যায়, হ্রদ! বললাম, জীবন বিপরীতমুখি! সমতলের লোকেরা পাহাড়ের চূড়ায় ওঠে। আর পাহাড়ে লোকেরা সমতল খোঁজে। অমন বৈপরিত্য মানুষের সহজ প্রবৃত্তি।
কবি বললেন, তুমিও চাইলে দুটো নক্ষত্র চিবিয়ে খেতে পারো! বললাম, নাহ লাগবে না। একটু রঙিন গরম জলই যথেষ্ট। রফিক বললেন, জীবন পানির মতো গড়ায়। যেখানেই তার গতি থামে, সেখানেই তার গতি একজলা কূপ। বড়জোর বলা যায়, হ্রদ! বললাম, জীবন বিপরীতমুখি! সমতলের লোকেরা পাহাড়ের চূড়ায় ওঠে। আর পাহাড়ে লোকেরা সমতল খোঁজে। অমন বৈপরিত্য মানুষের সহজ প্রবৃত্তি। বলা যায়, প্রকৃতির স্বভাব। দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন রফিক, বুঝলে বেটা আমি আত্মজীবনী লিখতে চাই। বললাম, লিখেন না কেন?
রফিক আঙুল দেখিয়ে বলল, দেখ বেটা গরম বেরুচ্ছে কেমন! সত্যিই তো কবির আর্থারাইটিস! ফোলা গিরাগুলো মনে হলো তাকিয়ে আছে কবিতার দিকে। শব্দের খোঁজে। দর্শন বোঝে, কাব্যতত্ত্ব জানে, ইতিহাসের বাঁক ধরতে পারে তোর মতো একজন হলে ভালো হতো। জীবন আঁকা যেত! কিন্তু তুই না! আমি ভাবলাম, কেন? বড় লেখকের মর্যাদা সমাজ দেয় না। আমি দেই! কুণ্ঠিত মনে রফিকের হৃদয় ধরতে চাইলাম! দেখলাম, গহীন অরণ্যের সবুজ পাতার মতো হৃদয় কাঁপছে! রফিক বললেন, এখানকার সাহিত্যিকরা ভালো লিখতে লিখতে শহীদ হয়ে যান!
বাতাস ভারী। ছলছলে চোখ! তবুও বললাম, ইমানুয়েল কান্ট নিয়ে নাড়াচাড়া করে এক ছেলে আছে। নাম মাহমুদ হাসান। আপনার কথা সে আঁকতে পারবে। রফিক বললেন, ঠিক আছে, তবে অর্থ বেশি দিতে পারবো না, ভালোবাসার কমতি থাকবে না। আমি হাসানকে ফোন দিলাম। হাসান বলল, আমি পাহাড়ের চূড়ায়, সমতলে এসে দেখা করছি। হাসান কি নিউ এইজে কাজ করতো! মনে পড়ে না খুব! ঠিকই হাসান এলো সমতলে। দেখা হলো না! শুনেছি, সেও ট্রেনের নিচে জীবন সাবাড় করেছে! আহা জীবন কতো ঠুনকো। মৃত্যুও পলকের মতো হালকা!
বাড়ি দোতলা হলেই ভালো হতো। সিঁড়ি দিয়ে ছাদে উঠে আকাশ ছোঁয়া যেত। রাতের নক্ষত্রগুলো হাতে ছোঁয়া যেত! অন্ধকার অনায়সে গিলে খাওয়া যেত। কিন্তু ছোট্ট ছাদে কবিকে মানায় না। আকাশ কবির বড্ড দরকার। আকাশে স্বাধীনতা অবারিত থাকে। প্রসন্ন হৃদয় থাকে। বিন্দু বিন্দু আলো দূর মাস্তুলের মতো জোনাকির মতো ভাসে। কিছুদিন পর রফিক আজাদের ফোন, আমার জীবনী লেখার কি সুরাহা হলো? বললাম, আমি আপনাকে এক নিহত নক্ষত্রের কথা বলেছিলাম। দুঃখিত রফিক ভাই! রফিক আজাদ বললেন, জীবন এমনি এক ট্রাম, যেন জীবনানন্দ দাশ!
৭/৪/২০১৯
ঢাকা
- সুকান্ত ভট্টাচার্য, কবি
- জীবনানন্দ দাশ, কবি
- মাহমুদ হাসান, অকাল প্রয়াত কবি
- ইমানুয়েল কান্ট, জার্মান দার্শনিক