:
Days
:
Hours
:
Minutes
Seconds
Author Picture
নির্ঝর নৈঃশব্দ্য

কবি, চিত্রশিল্পী

বীজ
ব্যবহৃত শিল্পকর্ম: নির্ঝর নৈঃশব্দ্য, মাধ্যম : অ্যাক্রিলিক অন ক্যানভাস

বীজ

মাকে স্বপ্নে দেখে ঘুম ভাঙলে সারাদিন কেমন করে যেন বুক কাঁপে। আজ ভোররাতে দেখলাম একটা মাঠের মাঝখানে একটা অনেক উঁচা আকাশঢাকা গাছের নিচে মা বসে আছে। গাছের ছায়া এমন দীর্ঘ বিস্তারিত হয়ে দিগন্তের দিকে চলে গেছে। আর কেমন সুন্দর বাতাস বইছে! গাছে নানা রঙের পাতা, নানা আকৃতি, নানা ধরনের ফল, রকমারি ফুল, গাছের ডালে অগুনতি পাখি, পাখিদেরও অনেক প্রকার। এই গাছ আমার কাছে অচেনা। গাছের নাম নাই। আমি বললাম, ‘মা, এইটা কী গাছ?’

মা গাছটির নাম বলল না। বলল, ‘এই নে, এইটা হলো এই গাছের বীজ, তুই লাগালেই হবে।’ বলে আমার হাতের তালুতে সেই গাছের একটা বীজ দিল, গমের দানার মতো পেটকাটা, লাল রঙের বীজ। তারপর মা তার দুহাতের চাপে আমার হাতটা মুঠো করে দিল।
কেঁপে কেঁপে আমার ঘুম ভেঙে গেল। বুঝলাম আমার দুই চোখ ভিজে গেছে। আর একটা হাত মুঠো-করা। মুঠো খুলে দেখি মুঠোর মধ্যে কিছু নাই।
মাকে ভাবলেই ভাবনা সব দৃশ্য হয়ে যায়। যেন সব চোখের সামনেই ঘটছে সেইসব দিনের মতো।

আমাদের ছিল ঘুমগাছের বন। সেই বনের ভিতর আমাদের কাঠের দোতলা বাড়ি, টিনের ছাউনি। ওখানে থাকত আমার রাত্রি মা, আমি, আমার ভাইবোনেরা, একটি ভয়ানক রূপবতী বৃদ্ধ দাদি, আর মধ্যে মধ্যে বাবা। বাবা তো দূর-বনে সরকারি চাকরি করত, তাই দূরের বনে বনে ঘুরে বেড়াত শাম্বা হরিণের মতো, কখনো মোষের মতো। মধ্যে মধ্যে বাড়ি আসত। বাবার কাঁধের চাপরাশে তখন লেগে থাকত শালবনের মাইল মাইল অন্ধকারের ঘ্রাণ। আমি বাবার কোলে চড়ে কাঁধে নাক রেখে সেই ঘ্রাণ নিতাম।

রাত্রি মা মানে আমার মা। আমার মায়ের নাম লায়লা, লায়লা বেগম আরজু। লায়লা মানে রাত্রি। আরজু মানে ইচ্ছা। আর ঘুমগাছ মানে রেইনট্রি। রেইনট্রির বাঙলা বর্ষাতরু, বৃষ্টিগাছ ইত্যাদি হতে পারে। মা বলত শিশু বটগাছ। পাড়াপ্রতিবেশী বলত ঘুমগাছ। কারণ সূর্য ডোবার সঙ্গে সঙ্গে এই গাছের পাতাবলি লজ্জাবতী পাতার মতো ভাঁজ হয়ে ঘুম যায়। তাই এর নাম ঘুমগাছ। ঘুমগাছের ফুল সূর্যের মতো অনেকটা, পাপড়িগুলি আঁকা সূর্যের আলোকরশ্মির মতো। সে যাইহোক, আমি ঘুমগাছ নামটাই নিলাম। ঘুমগাছের বন আসলে বন নয়, বাগান; আমার মায়ের হাতে লাগানো রেইন্ট্রি গাছের বাগান।

মাকে নিয়ে দাদি অদ্ভুত এক গল্প বলত প্রায় সময়; বলত যে, ‘তোর মায়ের জন্ম তো গাছের পেটে…’। এই গল্প বলত যখন তার খুব অস্থির লাগত। তার তখন প্রায় মাথাখারাপ। একা একা কথা বলত। ঘর অন্ধকার করে সারাক্ষণ বিছানায় বসে থাকত। মাঝেমধ্যে খিলখিল করে হেসে উঠত। তেমন কেউ তার কাছে ঘেঁষতে পারত না। দাদির মাথাখারাপের ইতিহাস দাদার মৃত্যুর পর থেকে। সেই গল্প আরেকদিন করব।

দাদি আমাকে বলেছিল দাদা মরার পরই দাদির সঙ্গে একই সঙ্গে দুইজন জিনপুরুষের বিবাহ হয়েছিল। একটা ভালো জিন, আরেকটা খারাপ জিন। ভালো জিনটা দাদিকে ভালোবাসে, তখন তার মাথা ঠান্ডা থাকে; আর খারাপ জিন দাদির সঙ্গে শুধু ঝগড়া করে, তখন মাথার ঠিক থাকে না, সবাইকে গালিগালাজ করে। কিন্তু অজ্ঞাত কোনো কারণে দাদি আমাকে খুব পছন্দ করত। আমায় ডেকে আমার সঙ্গে গল্পগুজব করত নানা ধরনের। তার মধ্যে একটা গল্প মাকে নিয়ে; তাও পুরো গল্প না, অর্ধেক। এরপর অন্য প্রসঙ্গে চলে যেত। দাদি বলত, ‘তোর মায়ের জন্ম তো গাছের পেটে… তাই খালি গাছ-গাছ করে…’।
আমি প্রতিবারই বলতাম, ‘কী গাছের পেটে?’
দাদি বলত, ‘ডুমুর গাছের পেটে।’
এইটুকুই, তার অন্য গল্প কিংবা নিজে নিজে কথা বলা।

ডুমুর সেই এক আজব গাছ। ডুমুরের ফুল থাকে ফলের পেটের ভিতর। আমাদের বাড়ির সীমানাপ্রাচীরে শৈশবে অনেক ডুমুরগাছ ছিল, মা লাগিয়েছিল। কথায় আছে, কেউ ডুমুরের ফুল দেখলে সাত রাজার ধন পায়। আমরা নিয়ম করে ডুমুরের ফুল দেখার প্রতীক্ষায় থাকতাম। কিন্তু ডুমুরের ফুল আর দেখা যেত না।

আমাদের ছিল ঘুমগাছের বন। সেই বনের ভিতর আমাদের কাঠের দোতলা বাড়ি, টিনের ছাউনি। ওখানে থাকত আমার রাত্রি মা, আমি, আমার ভাইবোনেরা, একটি ভয়ানক রূপবতী বৃদ্ধ দাদি, আর মধ্যে মধ্যে বাবা। বাবা তো দূর-বনে সরকারি চাকরি করত, তাই দূরের বনে বনে ঘুরে বেড়াত শাম্বা হরিণের মতো, কখনো মোষের মতো। মধ্যে মধ্যে বাড়ি আসত। বাবার কাঁধের চাপরাশে তখন লেগে থাকত শালবনের মাইল মাইল অন্ধকারের ঘ্রাণ। আমি বাবার কোলে চড়ে কাঁধে নাক রেখে সেই ঘ্রাণ নিতাম।

ডুমুর নিয়ে কোরান শরিফে একটা সুরা আছে। সুরা তিন। আরবি তিন-এর অর্থ ডুমুরফল। সুরার শুরুতে ডুমুর আর জয়তুন, মানে জলপাই ফলের নামে শপথ আছে। এই ফলকে আল্লার বিশেষ অনুগ্রহরূপে ব্যক্ত করা হয়েছে। ওইসময় আরবের প্রধান খাদ্য ছিল। বাইবেলেও এই ফলের উল্লেখ আছে। সেখানে বলা হয়েছে, ক্ষুধার্ত যিশু একটি ডুমুরগাছ দেখলেন কিন্তু সেখানে কোনো ফল ছিল না, তাই তিনি গাছকে অভিশাপ দিলেন। বৌদ্ধধর্মেও এই গাছ পবিত্র। বুদ্ধ যে-গাছের তলে বসে ধ্যানমগ্ন হয়ে নির্বাণ লাভ করেন, সেই বোধিদ্রুম ছিল একটা ডুমুরজাতীয় গাছ। এর বাইরেও শুনেছি ডুমুরের অনেক ভেষজ গুণ আছে। ফলত বোঝাই যাচ্ছে এই ফলের কেমন মাহাত্ম্য।

যখন আমরা তিনবেলা ছেড়ে দুবেলা খেতাম, তখন মধ্যে মধ্যে ডুমুরের ফল খেতাম। ডুমুরের ফল খেতে ভালো। কিন্তু বেশি খেতাম বলে খেতে খেতে বিস্বাদ লাগত। বিবমিষা তৈরি হতো।
আমরা ডুমুরের ফুল কখনোই দেখিনি। কিন্তু আমার নানি একবার দেখেছিল। সেই গল্পেরই খানিকটা দাদি বলত। কিন্তু দাদির সেই গল্প আমার পুরোপুরি বিশ্বাস হতো না। প্রতি ঈদে নানাবাড়ির ওদিক থেকে দাদির চেয়ে বয়স্ক এক থুত্থুড়ে বুড়ি ফিতরা নিতে আসত। একদিন ঈদের দিন ওই বুড়িকে একপাশে নিয়ে গেলাম ডেকে। জিজ্ঞেস করলাম দাদির বলা মায়ের গল্পের সত্যতা। সেই বুড়ি বলল ঘটনা সত্য। সেই গল্প নানাবাড়ির পুরো পাড়া জানে। বুড়ির কাছে শোনা সেই গল্পটাই বলছি।

নানির তখন বিয়ে হয়েছে মাত্র। নানা বলা যায় গরিব; গাজি কালু চম্পাবতী, সোনাভান, আমির ও মলকাবানু ইত্যাদি পুঁথি পড়ে আর টুকটাক কাঠমিস্ত্রির কাজ করে সংসার চলে। নানি জানত ডুমুরের ফুল দেখলে কী হয়। ফলত নানিও বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ি এসেই সীমানায় বেশ কয়েকটা ডুমুরগাছের চারা লাগিয়ে দিল। দেখতে দেখতে গাছগুলি তরতর করে বছর ঘোরার আগেই বড় হয়ে গেল, আর বেহায়ার মতো ফল দিতে শুরু করল। তখন প্রতিদিন ফজরের আযানের সময় উঠে কলসি-কোমরে নদী থেকে পানি আনতে যেতে-আসতে ডুমুরফুল ফুটল কিনা দেখত একবার আমার নানি। এর মধ্যে একটা গাছের মাঝামাঝি অংশটা ছিল পেটের মতো ফোলা।

নানি একদিন দুপুরবেলা দেখল ওই গাছটা মরে যাচ্ছে। ডালপালা সব মরে গেছে। গোড়ার দিকটাও প্রায় শুকিয়ে গেছে। কেবল ফোলা অংশটা এখনো সজীব সেটা বোঝা যাচ্ছিল। কিন্তু ওইটা তেমন খেয়াল করল না নানি। ভাবল নানাকে বলে একদিন গাছ কাটিয়ে ফেলবে। ওইখানে আরেকটা গাছ লাগাবে।

পরদিন ভোরবেলা নদী থেকে ফিরে ডুমুরগাছগুলিকে দেখতে গেল। দেখল একটা গাছে কয়েকটা ফল ফেটে গেছে, যেন-বা ফুল। কেমন এক খুশিতে নানির চোখ কেঁপে উঠল। আর তখনই কেমন চিনচিনে এক কান্নার শব্দ শুনল। যেন একটা বাচ্চা কাঁদছে। কিন্তু কোথাও কাউকে বা কোনো বাচ্চা দেখল না। নানি একটু ভয় পেল। একপ্রকার দৌড়ে ঘরে ঢুকে গেল। ততক্ষণে নানাভাই মসজিদ থেকে এসে কোরান শরিফ পড়তে বসে গেছেন। নানিকে ছুটে ঘরে ঢুকতে দেখে রেহেলে কোরান শরিফটা ভাঁজ করে রেখে নানির কাছে ঘটনা কী জানতে চাইলেন। নানি তাকে হাত ধরে টেনে জায়গায় নিয়ে গেলেন। নানাও কান্না শুনলেন। তবে নানা কান্নার উৎস বের করে ফেললেন। নানা বুঝলেন পেটফোলা ডুমুরগাছটার সেই ফোলা অংশের ভিতর থেকে কান্না আসছে। নানা ভয় পেলেও ভাবলেন আল্লার কুদরত, অনেককিছুই হতে পারে। তিনি মসজিদের ইমাম সাহেবকে ডেকে নিয়ে এলেন। সঙ্গে গ্রামের আরো কয়েকজন। সবার উপস্থিতিতে করাত এনে ধীরে ধীরে গাছের পেটের একটা অংশ কাটলেন। দেখলেন ভিতরে ফুটফুটে একটা বাচ্চা। ইমাম সাহেব সেই বাচ্চা দুহাতে বের করলেন, একটা মেয়ে বাচ্চা। মুখ দেখে তিনি বললেন, ‘আলহামদুলিল্লা’। তারপর নানাভাইয়ের কোলে সেই বাচ্চাটা তুলে দিয়ে বললেন, ‘সিদ্দিক, এই লও তোমার মাইয়া। এইটা আল্লায় দিছে। এরে খুবই যত্ম কইরা বড় করবা।’

সেই বাচ্চাটাই আমার মা। মায়ের বিয়ে হয়েছিল মায়ের যখন এগারো বছর বয়স। মা ঘরসংসার করার জন্যে শ্বশুরবাড়িতে যায় তার পনেরো বছর বয়সে। যাওয়ার সময় গরুর গাড়ি ভর্তি করে সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিল নানা গাছের চারা─যেন আমার গরিব নানার পক্ষে এর চেয়ে বেশি যৌতুক দেওয়ার সামর্থ্যছিল না। মা সেইসব গাছের চারা শ্বশুরবাড়ির ভিটায় লাগিয়ে একদিন বড় করে ফেলল।

তারপর আরো অনেক বছর পর, বাবা আমার জন্মের এক বছর আগে নদীর চরঘেঁষে, ব্রিজের দক্ষিণ-পশ্চিম কোনায় একটা জমি কিনল। জমির পরিমাণ আশি শতাংশ। সেই বেলে জমিতে ধু-ধু কাশবন ছাড়া আর কিছু ছিল না। সেই কাশবনের মাঝখানে বালি ও পাথরের ভিটায় আমাদের বাড়ি হলো। দোতলা বাড়িটির বাহিরে কাঠ আর ভিতরে বাঁশের বেড়া, উপরে ঢেউটিন আর সিমেন্ট-শিটের ছাউনি। বাবা তার ভাইদের নিজের ভাগের সবকিছু ছেড়েছুড়ে দিয়ে নদীর চরে এই বাড়ি বানিয়েছিলেন।

মা কাশবন রেখে দিল। শরৎকালে শাদা হয়ে থাকত আমাদের বাড়ির চারপাশ। মা চারপাশের বাউন্ডারি আর কাশবনের ফাঁকে ফাঁকে গুঁজে দিল শয়ে শয়ে ঘুমগাছের বীজ। বীজ থেকে মাটি ভেদ করে উদ্গত হতে থাকল ঘুমগাছের দল। ওরা আমার সঙ্গেই বড় হতে লাগল, যেন-বা আমার ভাই, আমার বোন।

আমার বয়স যখন সাত-আট তখন একদিন ছোটমামা আমাদের বাড়ির পূর্বপাশের দেয়ালে একটা আলগা হয়ে যাওয়া তক্তায় পেরেক ঠুকছিল হাতুড়ি দিয়ে। আর হাতুড়ির ঘায়ে ঘায়ে বলছিল: ‘বিশকরম, বিশকরম, বিশকরম…’।
তখনো বুঝতাম না এই বিশকরমের মানে কী। মামা শুধু বলেছিল, ‘বিশকরম বললে পেরেক সোজা হয়ে ঢোকে, বাঁকা হয়ে যায় না।’

সন্ধ্যা পার হয়ে সময় রাত্রিছুঁই-রাত্রিছুঁই হলে গাছভর্তি ট্রাকগুলি এক এক করে ছেড়ে চলে যায়। শেষ ট্রাকের শব্দ মিলিয়ে যেতেই আমি ঘর থেকে বের হই। গাছহীন মরুভূমির মতো আমাদের বাড়ির চারপাশে আকাশের চাঁদ গলে গলে পড়ছে যেন-বা। আমি দেখি গেটের কাছে কেউ দাঁড়িয়ে। কাছে গিয়ে দেখি মা, আমার রাত্রি মা। আমি মায়ের পাশে দাঁড়িয়ে থাকি নীরবে। আর চাঁদের আলোয় ঝলসে যাচ্ছিল আমার মায়ের চোখ থেকে গড়িয়ে পড়া জলস্রোত।

পরে বড় হয়ে জেনেছি বিশকরম মানে বিশ্বকর্মা। বিশ্বকর্মা তো নিজহাতে পৃথিবী সৃষ্টি করেছিল, তাই এইজাতীয় ব্যবহারিক কাজে তার নাম নিলে কাজ ঠিকমতো হয়। যাইহোক, সেইদিন মামা পেরেক ঠুকতে ঠুকতে হঠাৎ করে একটা পেরেক বাঁকা হয়ে গেল। মামার আঙুলেও হাতুড়ির ঘা লাগল। মামা দেখি নতুন পেরেক আরেকটা নিয়ে বেশ রেগে রেগে ঠুকছিল, আর বিশকরমের জায়গায় বলছিল: ‘নুরুসেইন্না, নুরুসেইন্না, নুরুসেইন্না…’। আর হাতুড়ি আর পেরেকের ঘষায় ছুটছিল আগুনের ফুলকি। আমি মানে কিছু বুঝলাম না। পরে জেনেছি নুরুসেইন্না মানে নুর হোসেন। নুর হোসেন মানে নুর হোসেন চেয়ারম্যান। আমার মা-বাবার দূরসম্পর্কের মামা। মা-বাবার কেন? আমার মা আর বাবা বিবাহের আগে ছিল পরস্পরের খালাতো ভাইবোন।

আমাদের জমিটা বাবা কিনেছিল তার মামা নুর হোসেন চেয়ারম্যানের কাছ থেকে। সে টাকা নিয়েছিল, কিন্তু জমিটা বাবার নামে দলিলে রেজিস্ট্রি করে লিখে দেয়নি। আজ দেব কাল দেব করে বছর কেটে গেছে। বলত, ‘দরকার কী, আমি তো বেঁচে আছি, আমি থাকতে তোদের কেউ কিছু বলতে পারবে না…’ জাতীয় কথা।

তবু তার বাড়িতে আসা-যাওয়া করতে করতে আমার মা-বাবা যেন রাস্তা বানিয়ে ফেলল। তার সেই কথার ওপর মা-বাবা-মামা কারো ভরসা ছিল না। তখন একমাত্র ভরসার জায়গা ছিল ‘৭৮৬-এলাহি ভরসা’।
নুর হোসেন চেয়ারম্যান লোক ঠকাত, এমন কথা সবাই জানত। সে অনেককে ঠকিয়েছে, টাকা খেয়ে জমি কেড়ে নিয়েছে। এইসব প্রতারণার কারণে তাকে ‘চিটিং’ নামেও ডাকত। তাই সেইদিন মামা রেগে গিয়ে পেরেক ঠোকার সময় তার নাম বলছিল, যেন তার মাথাতেই পেরেক ঠুকছিল।

এইভাবে বাস্তু হারানোর ভয়ে মানসিক চাপ আর অনিশ্চয়তায় কেটে গেছে আমাদের আঠারো বছর। আমার বয়স তখন আঠারো, আমাদের ঘুমগাছেদের বয়সও আঠারো। তবে আমার থেকে ওরা কয়েক মাসের ছোট। ওরা তো আমার অনুজ সহোদরের মতোই। ঘুমগাছের শরীর আকাশগামী, ডালে-পালায় প্রতিদিন গাছভর্তি লাল লাল সূর্যফুল। শীতে হাজার হাজার টিয়াপাখি এসে ঘুমগাছের ডালে বসে পাতার ফাঁকে দিনভর ডাকে।

সেই সময় নুর হোসেনের কাছ থেকে চাপ আসতে লাগল। নতুন করে টাকা না দিলে সে জমির দখল নেবে। কিংবা স্থানীয় প্রভাবশালী গুন্ডাপান্ডাটাইপ কারো কাছে রেজিস্ট্রি করে দেবে, তারা যেন আমাদের ঘরছাড়া করে। আমাদের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। মাঝখানে বাবার চাকরি নাই সাত বছর। আমরা খেয়ে, না-খেয়ে, কচুঘেচু, শাক-লতা-পাতা খেয়ে দিন কাটাচ্ছি। বাবার পাগলের মতো অবস্থা। নুর হোসেনের হাতে ধরে আসে, পায়ে ধরে আসে, কিন্তু নুর হোসেন টলে না। আমার মা গিয়ে কান্নাকাটি করে, কোনো লাভ হয় না। একমাসের সময় বেঁধে দেয়।

কোনো উপায় মেলে না। আমাদের আর-কোনো জমিজমা ছিল না। আমার রাত্রি মা, গভীর রাতে বাবাকে বলে, ‘গাছ বিক্রি করে দেন।’
শুনে বাবা বেকুবের মতো হয়ে যায়। কিন্তু কোনো উপায় নাই। শুধু ক্ষীণস্বরে বলেন, ‘আচ্ছা।’
তারপরদিনই গুনে গুনে একান্নটা ঘুমগাছ বিক্রি হয়ে যায়। আঠারো বছরের তরুণ একান্নটা ঘুমগাছ আমার স্বপ্নের সমান। আমরা কিছু জানতে পারি না। আমাদের ভিটেবাড়ি নতুন করে রেজিস্ট্রি হয়। আঠারো বছর পর অনিশ্চয়তা নেমে যায় ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ার মতো।

একদিন ভোরবেলা কাঁধে ভারী ভারী করাত নিয়ে করাতিদল আমাদের বাড়ির সামনে এসে নামে লাইন ধরে। তখন বুঝতে পারি গাছবন বিক্রি হয়ে গেছে।
তিনদিনে সব গাছ কাটা হয়ে গেল। গাছকাটার দিনগুলিতে আমি কলেজে যাই না। আমার জানলাবিহীন অন্ধকার ঘরে দরজা বন্ধ করে শুয়ে থাকি। আমার মাথার বালিশ ভিজে যায়। আমার কান্নার কথা জেনে যায় কেবল বালিশের পাশে রাখা প্রিয় গীতবিতান।
তিনদিন পর দুপুরবেলা বাড়ির সামনের রাস্তায় লাইন ধরে ট্রাক দাঁড়ায় অনেকগুলি। সন্ধ্যা পার হয়ে সময় রাত্রিছুঁই-রাত্রিছুঁই হলে গাছভর্তি ট্রাকগুলি এক এক করে ছেড়ে চলে যায়। শেষ ট্রাকের শব্দ মিলিয়ে যেতেই আমি ঘর থেকে বের হই। গাছহীন মরুভূমির মতো আমাদের বাড়ির চারপাশে আকাশের চাঁদ গলে গলে পড়ছে যেন-বা। আমি দেখি গেটের কাছে কেউ দাঁড়িয়ে। কাছে গিয়ে দেখি মা, আমার রাত্রি মা। আমি মায়ের পাশে দাঁড়িয়ে থাকি নীরবে। আর চাঁদের আলোয় ঝলসে যাচ্ছিল আমার মায়ের চোখ থেকে গড়িয়ে পড়া জলস্রোত।

তারপর মা একদিন অসুস্থ হয়ে পড়ল। মা পরপর দুইবার স্ট্রোক করল। যে-মাকে কখনো ঘুম ছাড়া বসে থাকতে দেখিনি, কোনো-না-কোনো কাজ করত, গভীর জ্বরের মধ্যেও কোনো-না-কোনো হাতের কাজ করত, সোয়েটার বুনত বা কাপড়ে ফুল তুলত─সেই মা বিছানায় পড়ে রইল পাঁচ বছর, কথা বলতে পারে না, নড়তে পারে না। আমরা বছর বছর আমাদের বাগানে রেইন্ট্রি গাছের বীজ পুঁতে দিই; চারা লাগাই, হয় না, মরে যায় বন্যায় কিংবা দেখাশোনার অভাবে।

তারপর মা একদিন মরে গেল। মাকে কবর দিলাম বাড়ির পূর্বদিকে একটা শিমুলগাছের তলায়। আমি আর ভাই মিলে কবরে নামালাম। মাটি দিলাম। কবরের উপর হুজুর মাষকলাইয়ের দানা ছিটিয়ে দিল। তারপর ছিটিয়ে দিল পানি। তারপর একটা খেজুরের ডাল পুঁতে দিল।
একসপ্তাহ পর দূর থেকে দেখি মায়ের কবর-সহ আশপাশ অনেকদূর সবুজ হয়ে আছে। কাছে গিয়ে দেখি মাষকলাইয়ের চারা নয়─সব ঘুমগাছের চারা। অবাক হলাম না। কারণ আমি জানতাম আমার মা তো আসলে ঘুমগাছের বীজ।

Meghchil   is the leading literary portal in the Bengali readers. It uses cookies. Please refer to the Terms & Privacy Policy for details.