:
Days
:
Hours
:
Minutes
Seconds
লোকায়ত সুন্দরবন
প্রচ্ছদ: রাজিব রায়

লোকায়ত সুন্দরবন

তারকনাথ ঠাকুর নড়াইল থেকে নদীপথে বাদাবনে যেতেন কালী সাধনা করতে। একদিন ঘাটের কাছে থামতেই এক শাঁখা বিক্রেতার সাথে দেখা। দৌড়ে এসে বলল, বাবা এক জোড়া শাঁখার মূল্য পরিশোধ করুন। এই জঙ্গলে কে শাঁখা নিল তার নাম করে তারকনাথের আন্দাজে আসে না। বিক্রেতা দূরে নৌকায় বসে থাকা এক কিশোরীকে দেখিয়ে বললেন, শাঁখা নিয়ে বাবা দাম দেবে বলেছে। অথচ কিশোরী আর ফিরে তাকাল না, অচেনা নৌকায় চলে গেল অনির্দিষ্ট যাত্রাপথে। ভক্ত বুঝলেন, ভিন্নরূপে এসেছিলেন কালী। ভৈরব অতিক্রম করে তারকনাথ যেখানে নিত্যদিন পূজা করতে যেতেন, ওখানেই তৈরি হলো মানসা কালী বাড়ি। খুলনার রূপসা ঘাট থেকে ১০ টাকায় খেয়া পার হয়ে ভ্যানে নৈহাটি অতিক্রম করে ফকিরহাটে আছে সে মন্দির। নড়াইল জেলা থেকে খুলনা হয়ে বাগেরহাটে আসা এক ভক্তের সূত্রে মন্দির তৈরির ঘটনা সেই সময়ের সাক্ষী, যখন ভৌগোলিক দূরত্ব পরাজিত হতো ভক্তির কাছে। ভক্তের পথ কমাতে মন্দির নাকি এক রাতের মধ্যে উত্তরমুখী হয়েছিল। প্রকৃতিজয়ী মানুষের কাছে শক্তিরই ভিন্ন রূপ ভক্তি। এই বাদাবনের সমাজ জীবন গ্রামপ্রধান আর প্রাকৃতিক সম্পদই জীবনধারণের একমাত্র রসদ। তাই এখানকার মানুষ প্রকৃতির দান গ্রহণের সব প্রতিবন্ধকতা দূর করতে নির্ভর করে প্রাকৃতিক শক্তির কাছে। এখানে এমনও লৌকিক দেবতা আছেন, যিনি ধর্মের ব্যবধান দূর করে এ অঞ্চলের মানুষকে এক পরিচয়ে আবদ্ধ করেন। এই ভক্তি কৃষিজীবী, বনজীবী ও জলজীবী মানুষের প্রতিনিয়ত শ্বাপদ-সংকুল প্রতিকূল পরিস্থিতির সঙ্গে লড়াইয়ের অস্ত্র। তাই সুন্দরবনের মানুষের বিশ্বাসে কালী, বনবিবি, দক্ষিণ রায়, মনসা, শীতলা, মাকাল গাজি-কালু, পাঁচু বা জ্বরাসুরের মতো লৌকিক দেবতারা ধর্মীয় গ্রন্থের বাণী থেকে অধিক আশ্রয়ের, নির্ভরতার।

বাগেরহাটের ফকিরহাটের মানসা কালী বাড়ির উত্তরমুখী হওয়া নিয়ে একই গল্প শোনা যায় যশোরের ঈশ্বরীপুরে যমুনার গতি পরিবর্তন প্রসঙ্গে। রাজা প্রতাপাদিত্যের সময়ের এ গল্প অবশ্য লেখিকা সরলা বসু শতবছর আগে সুন্দরবনের ভেতর বসে লোকমুখে নিজেই শুনেছিলেন। প্রতাপাদিত্য নির্মিত মন্দিরটি ছিল একেবারে বনের ভেতর। কালী তখন চলে যাওয়ার ছল খুঁজছেন। কিন্তু রাজা না বললে যেতে পারছেন না। একদিন রাজসভায় মেয়ের রূপ ধরে উপস্থিত হলেন দেবী। সভার ভেতর আকস্মিক নারীর উপস্থিতিতে প্রতাপাদিত্য রেগে বেরিয়ে যেতে বললেন। কালীও ছুঁতো পেয়ে রওনা হলেন আর মুহূর্তে যমুনা নদী উত্তর বাহিনী হয়ে গেল। প্রতাপাদিত্য কালীর অবস্থা দেখে মাথা ভাঙতে লাগলেন। নদীর সঙ্গে প্রাকৃতিক শক্তি, লৌকিক বিশ্বাসের এ গল্প যেমন পৌরাণিক ধারার মতো, তেমনি এ অঞ্চলের বৈচিত্র্যময় পরিবেশের অংশজাত। এ গল্প সরলা বসুর ‘জল বনের কাব্য’ উপন্যাস থেকে পাওয়া। এ অঞ্চলের লৌকিক বিশ্বাসের গল্প শত শত বছর নয়, হাজার বছরের পুরনো। সতীশচন্দ্র মিত্র যশোহর-খুলনার ইতিহাস বইয়ের প্রথম খণ্ডে ‘পৌরাণিক গ্রন্থে সুন্দরবন’ পরিচ্ছেদে উল্লেখ করেছেন, ‘রামায়ণেই সর্বপ্রথম গঙ্গাসাগর সঙ্গমের উৎপত্তির কথা বর্ণিত পাওয়া যায়। রামায়ণে রসাতল বলতে নিম্নবঙ্গের যে পরিচয় তা সুন্দরবন অঞ্চল। পদ্মপুরাণে উল্লেখিত গঙ্গাসাগর সঙ্গম সুন্দরবনই ছিল। ওই পুরাণ রচনাকালে অরণ্য ও জনপদ উভয়ই বর্তমান ছিল সুন্দরবনে।’ প্রকৃতি যে সংস্কৃতি তৈরি করে, একসময় তা-ই হয়ে ওঠে পৌরাণিক। বর্তমানের অভিজ্ঞান দিয়ে সে সত্য-মিথ্যা যাচাইয়ের পথ থাকে না। যে বিশ্বাসে আনন্দ ও নির্ভরতা থাকে, তাতেই প্রাণের সংযুক্তি। নদী-বননির্ভর সুন্দরবনে যতবার জনবসতি তৈরি হয়েছে, ততবারই এ অঞ্চলের মানুষ নিজস্ব বিশ্বাস ও আচারকে গুরুত্ব দিয়ে তৈরি করেছে বৈচিত্র্যময় লোকসংস্কৃতি। বিভিন্ন সময়ের ভক্ত ও দেবতার মানবিক যোগসূত্র, দেব-দেবীর মনোভাবের সঙ্গে নদীর গতিপথ পরিবর্তনের মর্জি এসবই সুন্দরবন অঞ্চলের বিশেষ সংস্কৃতি। নিত্যদিন জোয়ারের টানে উছলে ওঠা আর ভাটায় নেমে যাওয়া জলের আচরণ, নোনা ও মিঠা জল মিলমিশে বিচিত্র রসায়ন, একই ভূমিতে বন ও সমুদ্রের সহাবস্থানে রয়েছে এখানকার লোকায়ত সংস্কৃতির রসে।

প্রকৃতিজয়ী মানুষের কাছে শক্তিরই ভিন্ন রূপ ভক্তি। এই বাদাবনের সমাজ জীবন গ্রামপ্রধান আর প্রাকৃতিক সম্পদই জীবনধারণের একমাত্র রসদ। তাই এখানকার মানুষ প্রকৃতির দান গ্রহণের সব প্রতিবন্ধকতা দূর করতে নির্ভর করে প্রাকৃতিক শক্তির কাছে। এখানে এমনও লৌকিক দেবতা আছেন, যিনি ধর্মের ব্যবধান দূর করে এ অঞ্চলের মানুষকে এক পরিচয়ে আবদ্ধ করেন। এই ভক্তি কৃষিজীবী, বনজীবী ও জলজীবী মানুষের প্রতিনিয়ত শ্বাপদ-সংকুল প্রতিকূল পরিস্থিতির সঙ্গে লড়াইয়ের অস্ত্র।

সুন্দরবনকে উপজীব্য করে তৈরি আধুনিক সাহিত্যকর্মের মধ্যে সরলা বসুর ‘জল বনের কাব্য’ স্বতন্ত্র। বিভূতিভূষণকে উৎসর্গ করা বইটি ১৯৫৭ সালে তার পরিণত বয়সে লেখা হলেও অভিজ্ঞতা কৈশোরের। বিশ শতকের গোড়ার দিকে মাত্র ১১ বছর বয়সে কয়েক দিনের নদীপথে লেখিকা এসেছিলেন সুন্দরবনে। বন কর্মকর্তা স্বামীর সঙ্গে সঙ্গে থেকেছেন বাদাবনের সুপতি, চাঁদপাই, কপোতাক্ষী, বুড়ি গোয়ালিনী, নলগোড়া ফরেস্ট রেঞ্জে। উপন্যাসকে অবশ্য লেখিকা নিজেই সাহিত্যকর্ম বলতে রাজি নন। এ তার রঙের তুলিতে আঁকা কৈশোরের ছবি, স্মৃতির রেখায় সে ছবিরই দাগ জল বনের কাব্য। সপ্তাহখানেক ধরে সাত নদীর মোহনা হয়ে নদীপথে প্রথম পৌঁছেছিলেন বাগেরহাটের মোড়েলগঞ্জে। কয়েক দিনের যাত্রাপথে দেখা মাতন লাগা নদী, ন-বেকীর হাঁট, গাঘেঁষা বন, নোনা জলে জন্মানো সদ্য চেনা গাছের বাতাস, বন ও নদীনির্ভর মায়া বিবির মতো নানা গ্রামের হাটের নতুন খাবারের স্বাদ, বদলে যাওয়া টানে পরিবর্তিত ধারার আঞ্চলিক ভাষা সবই মনে রেখেছিলেন ছবির মতো। জীবনের এই উপকরণ গ্রহণ করতে করতে লেখিকার কাছে উপস্থিত হয়েছে সমাজের অচেনা একশ্রেণীর মানুষের জীবন। বাওয়াল, মৌয়াল, রাঁধুনি, ফকির, সন্ধিবুড়ি এমনকি তৎকালীন ইংরেজ বন কর্মকর্তার গল্প পেয়েছেন সরলা বসু। কৈশোরে চঞ্চলতা ও সরলতা নিয়ে প্রত্যক্ষ করেছেন চারপাশ আর লিখেছেন নিজের জন্য, তাই তার জল বনের কাব্য সরল হয়েও গভীর ও আন্তরিক।

লেখক সরল দেখার প্রশান্তি পেলে পাঠকও সে প্রসাদ পান। সুন্দরবনের গল্প হিসেবে জল বনের কাব্য অপরিমেয় আনন্দের উৎস। কিশোরী পেয়েছিলেন জলে নিমজ্জিত সভ্যতার নিদর্শন, ভদ্রা নদী, বুড়ো বাসুকী বা উ-ফাঁসের (কাদার ভেতর দিয়ে নৌকা টেনে নেয়া) মতো নতুন শব্দ। পরিচয় হয়েছে রাঁধুনি অক্ষয়ের মতো স্নেহপ্রবণ মানুষ, সরলা মিতিনের মতো সই, নছিমুদ্দিনের মতো এক হাতের দক্ষ বাঘ শিকারি আর নদীনির্ভর প্রকৃতির সঙ্গে। যাত্রাপথে বাবার বাড়ির নিজস্ব উঠোন ও আপনজনদের ঘ্রাণ যখন বুকের ভেতর হাহাকার তুলেছিল, তখনই খেয়াল করলেন, রসগোল্লা মিষ্টির রসটা নিংড়ে ছানাটুকু ছুড়ে দিলে মাছেরা লাফিয়ে আসে। ভাই ও স্বামীর জন্য মাটির হাঁড়িতে যত মিষ্টি ছিল সব তেমন করে দিয়ে মিতালী করলেন পশুর নদীর মাছদের সঙ্গে। ১১ বছরের কিশোরী বধূর কাছে তখনো স্বামী, ভ্রাতার খাবারের দায় থেকে মাছের উজ্জ্বল চোখ, উৎসুক আচরণ আবিষ্কারই অর্থপূর্ণ। তাই তিনি ঘরের চেয়ে নজরটা বেশি দিয়েছিলেন অরণ্যানী আর জলকেন্দ্রিক মানুষের যাপনের দিকে। একবার হেতাল বনের ভেতর দিয়ে যেতে যেতে পেয়েছিলেন ছোট্ট সুপেয় এক জলের পুকুর। চারপাশে লোনা জলের ভেতর সামান্য একটু স্বাদু জলের আধার ছিল বিস্ময়কর। সেখানে যতবার পাত্র দিলেন, স্বেচ্ছায় উঠে এল বিচিত্র বর্ণের মাছ। সরলা বসুর মনে হয়েছিল, এই মাছেরা তার সঙ্গে সখ্যতায় আগ্রহী। কিশোরী দেখেছিলেন, চৈত্রে শীর্ণা খরমা নদীর পাশের যে হেতাল বন, তা দূর থেকে সুপারিবন বলে ভুল হয়। কিশোরী চোখের বিস্ময়ে জগতের নিত্য সত্য পর্যন্ত বদলে যেতে পারে। বাঘের ডোরা কাটা শরীরে শেয়ালের মতো দেখতে বাগরোল নামক প্রাণীর দীর্ঘ দৃষ্টি দেখে তাকে প্রেম ভেবে শিহরিত হয়েছেন। একদিন বনে ঘুরতে ঘুরতে এমন অপরিচিত প্রাণীর সঙ্গে সরলা বসুর প্রথম দেখা। সে প্রাণীও ওই জঙ্গলে মানুষ দেখে বিস্মিত। দুজনই দুজনের দিকে তাকিয়ে রইল বহুক্ষণ। উভয়ই দু-এক পা করে পিছিয়ে আবার ফিরে আসে। অপলক দৃষ্টি বিনিময় চলল তাদের। সরলার বিশ্বাস, মানুষের প্রেমে পড়েছে বনের পশু। পরে অবশ্য শিউরে উঠেছেন, বুঝেছিলেন, এ প্রেম রক্তের আকর্ষণ। শত বছর আগের বাদাবন কেমন ছিল তা ধারণা করাই যায়। তখন নদীপথে এক রেঞ্জ থেকে আরেক রেঞ্জে গেলে বন কর্মকর্তারা সপ্তাহখানেকের আগে ফিরতেন না। বেচারি সরলা সারাদিন একা বসে সমুদ্রের জলে বৈঠার নালিশ শুনতে শুনতে ক্লান্ত হয়ে উঠেছিলেন। তাই সাহস করে ক্রমে বাওয়াল, মৌয়াল, জেলেদের আপন করে নিলেন। বন কর্মকর্তাদের স্ত্রীদের রক্ষণশীল আচরণ উপেক্ষা করে বাড়ির সামনে নদীর পাড় ধরে যাওয়া জেলে নৌকা থামিয়ে তাদের তুলে আনতেন বন অফিসের চৌহদ্দিতে। তাদের ডেকে নৌকা থেকে নামিয়ে ভাত খাওয়াতেন, বলতেন, বাপু এখানে বসেই পাশা খেলো একটু, আমি দেখি। সে আমলে বন কর্মকর্তাদের স্ত্রীদের সম্বোধন করা হতো মা ঠাকুরণ। এ কিশোরী এমনই কিশোরী যে তাকে কোলে নিয়ে এ ঘর থেকে ও ঘরে যাওয়া যায়। তাই তাকে সবাই নিজ কন্যা সমতুল্য ভাবলেন। সে সুযোগে লেখিকাও শুরু করলেন খবরদারি।

জল বনের কাব্য । ছবি: উইকিপিডিয়া

এ মুখে সে মুখে শুনেছিলেন বনবিবির গল্প। ডেকে গল্প করা বাওয়ালি, মৌয়ালরা জানিয়েছিল বনবিবিকে তুষ্ট করতে নানা লোকাচার পালনের কথা। অপদেবতারূপে বনে আছে দক্ষিণ রায় আর রক্ষাকর্ত্রী হিসেবে আছেন বনবিবি। সে অন্য দেব-দেবীর মতো উগ্র বা প্রতিহিংসাপরায়ণ নন। ভীষণ নন, বরং অরণ্যের দেবীরূপে পূজিতা বনবিবি লাবন্য ধারণ করে হয়ে উঠেছেন ভক্তবৎসলা। তার মাহাত্ম্যে মুগ্ধ বাদাবনের মানুষ। এক ভরদুপুরে স্বামী কাজে গেলে পূজার ফুল সংগ্রহের অজুহাতে কাউকে কিছু না জানিয়ে একাই চলে গেলেন বনের অনেকটা ভেতরে। কতদূর গিয়েছিলেন আন্দাজে ঠাহর হয় না। শান্ত স্থির গভীর অরণ্যানীর ভেতর একটা পুষ্প মণ্ডপের উঁচু ঢিবি আবিষ্কার করলেন সরলা বসু। সুগন্ধে তার মন উতলা হলো। প্রথম দেখাতেই মনে হয়, বহু বছর আগে ওখানে কোনো নিবেদনের আয়োজন হতো, এখন ঢাকা পড়েছে জঙ্গলে। সেখানে ফুলের ভারে নুইয়ে আছে লতানো গাছ। সাদা গোলাপি নীল ফুলের রঙে ঢাকা পড়েছে পাতার সবুজ। আনন্দে হাত বাড়ালেন। ছপাৎ করে লতাটি সরে গেল বহু দূরে। ঝুপঝাপ, দুপদাপ ছপাৎ শব্দে পুষ্পময় লতা গাছগুলো আন্দোলিত হতে লাগল। নৈঃশব্দের ভেতর হঠাৎ বাতাসে দুলে উঠল উঁচু স্থানটির সব পাতা। সাঁই সাঁই বাতাস শুরু হলো। আশ্চর্য, পুরো বনের আর কোথাও তখন বাতাস বইছে না। ভয় পেয়ে ফিরে এলেন, শয্যাশায়ী হলেন জ্বরে। ঘোরের ভেতর দেখলেন সেই ঢিবিতে মাথায় ফুলের মালা দিয়ে হাত ধরে নেচে চলেছে কয়েকজন তরুণী। এর পরই সে বাগরোল তাড়া করল তাদের। সবাই ঝাঁপিয়ে পড়লেন জলে, স্বপ্ন ভেঙে গেল। তিনি নিশ্চিত নন, আসলে বনে ওই পুষ্প মণ্ডপে কী ছিল সেদিন। তবে অনুভব করলেন, এসবই বনবিবির মায়া। বনবিবিকে দেখা যায় না, সে ধরা দেয় অনুভবে। সে অনুভবের কথা আরো একজন লেখক তুলে আনলেন জল বনের কাব্য রচনার প্রায় দুই যুগ বাদে। ১৯৭৮ সালে প্রকাশিত বরেন গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘বনবিবি উপাখ্যান’-এ একই রকম অভিজ্ঞতা হয়েছিল নায়েব দয়াল ঘোষের। দয়াল ঘোষ ছিলেন জমিদার সুরেন্দ্র নারায়ণের পরবর্তী প্রজন্মের জমিদারির নায়েব। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ দিকে ব্রিটিশ শাসনের সময় উড সাহেব নামে এক দোর্দণ্ডপ্রতাপশালী ইংরেজের হাত থেকে সুবেদার মলমল সিং অনেকটা জমি পেয়েছিলেন। ওটা নামেই জমি, আবাদ অসম্ভব। মলমল সিং দ্বীপ নিলামে তুললেন। সুরেন্দ্র নারায়ণ চৌধুরী জমি পেয়েছিলেন যৌতুক হিসেবে শ্বশুরের কাছ থেকে। রঙের ফানুসের মতো নাগালের বাইরেই ওই জমি অনাবাদি পড়ে রইল দীর্ঘকাল। অপরিমিত যাপনের খরচ জোগাতে বন্ধক রাখলেন সুরেন্দ্রনারায়ণ। তার নাতি নরেন্দ্র নারায়ণ (ছোট কর্তা) জমিটাকে জঙ্গলমুক্ত করতে উঠে পড়ে লাগলেন। দয়াল ঘোষকে প্রধান করে বাদাবনে ৩০ জন মুটে পাঠালেন সাফ করে আবাদের জন্য। শুয়োরের মুখ আকৃতির সে দ্বীপে একদিন ভিড়ল আশ্চর্য এক নৌকা। গৌরী নামে এক তরুণীর প্রতি দয়া করেছেন মা। মানে সে নারী বসন্ত রোগে আক্রান্ত হয়ে ভেসে এসেছে। এমন গল্পই আমাকে বলেছিলেন লোকগানের সংগ্রহক খুলনার বাসুদেব বিশ্বাস। দোলখোলার শীতলা দেবীর মন্দির চত্বরে দাঁড়িয়ে তিনি জানালেন, এককালে ভক্তশ্রেণী ছিল সুন্দরবনের জেলে, বাওয়ালি, মৌয়ালরা। বহু আগে নদীর প্রবাহ ছিল মন্দিরের কাছে। সেই সময় পর্তুগিজদের লবণ চাষের না প্রতাপাদিত্যের মন্দির নির্মাণের তা অবশ্য নিশ্চিত নন। কেউ অসুখে পড়লে তখন ডিঙিতে করে এ মন্দিরে রেখে যাওয়া হতো। মানত আর প্রার্থনার মধ্য দিয়ে দেবীর শরণাপন্ন হওয়াই ছিল গরিব সুন্দরবনবাসীর প্রধান চিকিৎসা। কোনো কোনো রোগীর অসহায় বা নিষ্ঠুর স্বজন জলেও ভাসিয়ে দিত তাদের। এখন দোলখোলার শীতলা দেবীর মন্দিরে আসা অধিকাংশই শহরের ধর্মপ্রাণ।

সুন্দরবনকে উপজীব্য করে তৈরি আধুনিক সাহিত্যকর্মের মধ্যে সরলা বসুর ‘জল বনের কাব্য’ স্বতন্ত্র। বিভূতিভূষণকে উৎসর্গ করা বইটি ১৯৫৭ সালে তার পরিণত বয়সে লেখা হলেও অভিজ্ঞতা কৈশোরের। বিশ শতকের গোড়ার দিকে মাত্র ১১ বছর বয়সে কয়েক দিনের নদীপথে লেখিকা এসেছিলেন সুন্দরবনে। বন কর্মকর্তা স্বামীর সঙ্গে সঙ্গে থেকেছেন বাদাবনের সুপতি, চাঁদপাই, কপোতাক্ষী, বুড়ি গোয়ালিনী, নলগোড়া ফরেস্ট রেঞ্জে। উপন্যাসকে অবশ্য লেখিকা নিজেই সাহিত্যকর্ম বলতে রাজি নন। এ তার রঙের তুলিতে আঁকা কৈশোরের ছবি, স্মৃতির রেখায় সে ছবিরই দাগ জল বনের কাব্য

বনবিবি উপাখ্যানে গৌরীকে নৌকায় ভাসিয়ে পালিয়েছিল প্রেমিক। নৌকা ভেসে ভেসে ঠেকল চৌধুরীদের আবাদে। সংক্রামক এই ব্যাধি নিয়ে আসা মরণাপন্ন নারীকে আশ্রয় দেয়া হবে কিনা তা নিয়ে শুরু হলো কলহ। নায়েব দয়াল ঘোষ যেকোনোভাবে হোক প্রাণ রক্ষার দায় নিতে চাইলেও মজুরদের কথা ভেবে বিরোধিতা করল দলের দ্বিতীয় প্রধান রজনী। সে ছড়িয়ে দিল, নৌকার নারী অপদেবী। আশ্রয় দিলে সবারই প্রাণ সংশয়ের আশঙ্কা। গল্প এগিয়েছে মানবতার সংকট ও লৌকিক বিশ্বাসকে কেন্দ্র করে সুন্দরবনে বর্তমান আবাদ পর্ব শুরুর গল্পে। তখন খ্রিস্টান পাদ্রিরা বাদাবনে মানবতা ও যিশুর মাহাত্ম্য প্রচার করছেন। নিজের অভিজ্ঞতায় এই দৃশ্য সরলা বসুও লিখেছেন বিশেষভাবে। বনবিবি উপাখ্যানে গৌরী আবার ভাসতে ভাসতে এসে আশ্রয় পেয়েছিল চৌধুরীদের পাশের ঘোষবনে। সেখানে পাদ্রিপাড়ায় গৌরীর আশ্রয় হয়েছিল। তবে হিন্দু থেকে খ্রিস্টান হয়েছিল সে। গৌরীকে তাড়িয়ে দেয়ার দিন দয়াল ঘোষ বিচিত্র অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হলেন। আশ্রয় দিতে না পারায় নতজানু হয়েছিলেন নিজের কাছে সেদিন। মানবতার পরাজয়ে বিমুখ হয়েছিলেন বৈষয়িক দায়ের প্রতি। সে সন্ধ্যায় কাছারি ঘরের কাছে মুটেরা দিন শেষে আমোদে মেতেছে। দীননাথের কণ্ঠে বেসুরো তালেই শোনা যাচ্ছে, কী দিয়ে পূজিব রাঙা চরণ তোমার, গগনেতে জ্বলিতেছে দীপ উপাচার। বাদাবনের বাতাসে তখন নদী থেকে উঠে আসা বিচিত্র শব্দ, দয়াল ঘোষ সামনে বনের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন। ভেড়ির গায়ে দাউ দাউ করে জ্বলছে আগুন। দয়াল ঘোষ আগুনের ভেতর দেখলেন লকলকে জিহ্বা। সে রূপ সম্মোহন করেছিল তাকে। সারেঙ্গির শব্দ তার সমস্ত অস্তিত্বের মধ্যে গলে গলে পড়ছে। প্রাণকেষ্ট ঢাকে কাঠি দিচ্ছে। দয়াল ঘোষ ঝাপসা চোখে তাকালেন আবার বনের দিকে। আশ্চর্য তখন জ্যোত্স্না থাকার কথা নয়, তবুও বনের ভেতর শুধু একটি জায়গা জ্যোত্স্নায় ভেসে যাচ্ছে। সমস্ত ইন্দ্রিয়কে সে তীক্ষ জ্যোতির দিকে নিবদ্ধ করলেন। মনে হতে লাগল দূরে কোথাও আরতির কাঁসারঘণ্টা। ধূপে ধুনোয় ষোড়শ উপাচারে এক পবিত্র গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে চারপাশে। এরই মধ্যে দেখলেন বনের সেই আলোয় শুভ্রবসনা জ্যোতির্ময়ী দেবী মূর্তি। মুহূর্তে মিলিয়ে গেল সে নারী। এরপর প্রকৃতির বিরূপতায় একদিন দয়াল ঘোষসহ সবাইকে কাজ শেষ না করেই প্রাণ নিয়ে পালাতে হয়েছে কলকাতায়। এ উপন্যাসে কল্পনার বনবিবি আর রক্ত-মাংসের গৌরী একসঙ্গে মিলেমিশে যাত্রা করেছে। উভয়ই তারা প্রকৃতির অংশ।

সুন্দরবনের বাউল সম্প্রদায় বনবিবির নামে মন্ত্র পাঠ করে গুরুর কাছে দীক্ষা গ্রহণ করে। শিবশঙ্কর মিত্র তার ‘সুন্দরবন সমগ্র’তে উল্লেখ করেছেন, বনবিবির আসল মন্ত্র নিতে হয় বাদায় দাঁড়িয়ে। গুরুরা আবাদে দেন সহযোগী মন্ত্র। বাউলের শিষ্যত্ব গ্রহণের অন্তত পাঁচ বছর পর আসল মন্ত্র গ্রহণের অধিকার। এ সাধনায় ১০ বছর ঘর সংসার বিয়ে বারণ। শিবশঙ্করের ভবঘুরে কলিম বাঘের কাছ থেকে প্রাণে বেঁচেছিল। কলিমের সন্দেহ ছিল না, শুধু বনবিবির দয়াতেই সম্ভব হয়েছিল প্রাণ রক্ষা। কলিম মেজাজি রাগি আকরাম বাউলের কাছে দীক্ষা গ্রহণের সময় নতুন কাপড়, সুন্দরবনে দুষ্প্রাপ্য আখের গুড়ের সঙ্গে বেতের নতুন ধামা নিয়েছিল, ফল না পেয়ে কচি লাউ নিয়েছিল গুরুদক্ষিণা হিসেবে।

বাসুদেব বিশ্বাস গান সংগ্রহ করতে মাঝে মাঝেই সুন্দরবনের অনেক ভেতরে চলে যান। দোলখোলার শীতলা দেবী মন্দির দেখাতে দেখাতে তিনি বিচিত্র এক গল্প করেছিলেন। মাঘ মাসের শুরুতে যে বনবিবির মেলা হয়, সেখানে জহুরনামা পাঠ করেন এক বয়স্ক নারী। জীর্ণ শীর্ণ অরণ্যবাসী ওই নারী এমন একটি জায়গায় থাকেন, যেখানে এখনো মিষ্টির ধারণা হচ্ছে কলা থেকে নিংড়ে নেয়া নির্যাস। সে নারীকে একবার খুলনা শহরে পুঁথি পাঠের জন্য বহুভাবে অনুনয় করা হলে প্রত্যাখ্যান করে জানিয়েছেন বন থেকে বাইরে এলেই আত্মিক গুণ নষ্টের আশঙ্কার কথা।

জল-বনের কাব্য by সরলা বসু। প্রথম প্রকাশ ১৯৫৭। প্রচ্ছদ খালেদ চৌধুরী।
The Hungry Tide by Amitav Ghosh
সরলা বসু ও অমিতাভ ঘোষের ছবি: উইকিপিডিয়া। মেঘচিল কোলাজ।

সুন্দরবনের লোকজ সংস্কৃতি রহস্যময়। বনবিবিকে তুষ্ট না করে বননির্ভর মানুষ কাজে যান না। বাড়ি ফেরার আগ পর্যন্ত দিনের পর দিন মৌয়াল, বাওয়াল বা জেলেদের স্ত্রীরা স্বেচ্ছায় বিধবার বেশ গ্রহণ করেন। স্বামী ফিরে আসার আগে সিঁথিতে সিঁদুর ছোঁয়ান না। সূর্যের আলোয় আগুন জ্বালেন না মাটির ওপর। সূর্যাস্তের পর থেকে সূর্যোদয়ের আগ পর্যন্ত তাদের রান্না খাওয়ার সময়। কষ্টকে শরীরে ধারণ আসলে স্বামীর নিরাপত্তায় নিজেকে নিবেদন। এই বাদাবন শুধু প্রাণবৈচিত্র্যে নয়, সংস্কৃতিগত দিক থেকেও বিপুলভাবে সমৃদ্ধ। হাজার বছর ধরে এখানে সভ্যতার পত্তন ঘটেছে, জলে নিমজ্জিত হয়েছে। মিলেমিশে গিয়েছে বহু প্রজন্মের, নানা ধর্মের সংস্কৃতির মানুষের বিশ্বাস-অবিশ্বাস। দক্ষিণাঞ্চলের লৌকিক দেবতাদের মধ্যে বনবিবি অন্যতম, যাকে স্মরণের সময় হিন্দু-মুসলমান কোনো জাতের ভেদ থাকে না। বাদাবন নিয়ে ইতিহাস, সমাজ কাঠামো তৈরি, বিষয় নির্বাচন, বনকেন্দ্রিক রাজনীতি, চরিত্র নির্মাণের বিবেচনায় সাম্প্রতিক আধুনিক উপন্যাসটির নাম অমিতাভ ঘোষের হাংরি টাইড। ২০০৪ সালে প্রকাশিত এ উপন্যাসে বাদাবনকে কেন্দ্র করে অমিতাভ ঘোষ তুলে এনেছেন পরিবেশ সংকটের কথা। সেখানে বাঘ সংরক্ষণ এলাকা থেকে সমুদ্রের শুশুকের অস্তিত্ব সংকট, হ্যামিলটন কুঠিকে কেন্দ্র করে নীলিমার নারী সেবা সংঘ, হাসপাতাল নির্মাণ থেকে সাইক্লোন শেল্টার, মরিচঝাঁপি গণহত্যা থেকে দণ্ডকারণ্যের উদ্বাস্তুদের ভোটের সংখ্যা হয়ে যাওয়ার গল্প ঠাঁই পেয়েছে। তবে এসব গল্পই বলা হয়েছে বাদাবনবাসীর জীবিকাকে কেন্দ্র করে। অমিতাভ ঘোষ স্বল্প পরিসরে নৃতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে মুন্সিয়ানার সঙ্গে উপস্থাপন করেছেন বাদাবনের ভিন্ন ভিন্ন ধর্মের মানুষের বিশ্বাসের ঐক্যটা এক, যা প্রাকৃতিক শক্তিরই উৎসজাত। সমন্বয় করেছেন বিস্তর ব্যবধানের দুই স্তরের মানুষের মধ্যে। এক সংযোগ কেন্দ্রের জন্য যা প্রয়োজন তা প্রকৃতিনির্ভরতা। যুক্তরাষ্ট্র থেকে শুশুকের ওপর সার্ভে করতে আসা পিয়া আর সুন্দরবনের কাঁকড়া ধরা জেলে ফকির মণ্ডল। হাংরি টাইডের গর্জনতলায় পরিচ্ছেদে, নদী দিয়ে চলতে চলতে বাদাবনে ছেলে টুটুলকে সঙ্গে করে নেমেছিল স্বল্পভাষী ফকির। হাঁটু পর্যন্ত কাদার ভেতর হিমশিম খেয়ে তাদের অনুসরণ করল পিয়া রয়। পিয়া তখনো জানে না ফকির হিন্দু না মুসলমান। ফাঁকা এক জায়গায় মন্দিরের মতো একটা ছোট্ট ঘরের সামনে থামল ফকির। পাতা দিয়ে তৈরি সে মন্দিরের ভেতর যে মূর্তি রয়েছে, তাদের সঙ্গের পিয়ার মায়ের দেব-দেবীদের চেহারার মিল নেই। সবচেয়ে বড় স্ত্রী মূর্তির টানা টানা চোখ, পাশে আকারে ছোট একটি পুরুষ মূর্তি, দুজনের মাঝে বসে আছে মাটির বাঘ। পিয়া দেখল, ফকির আর টুটুল প্রথমে কিছু ফুল-পাতা এনে মূর্তিগুলোর সামনে রাখল, তারপর মাথা হেঁট করে জোড়হাতে মন্ত্রের মতো পাঠ করে পূজা করল। ভাবগতি দেখে পিয়ার মনে হলো ফকির হিন্দু। পর মুহূর্তেই মন্ত্রের ভেতর ‘আল্লাহ’ শব্দ শুনে ধারণা হলো ফকির মুসলমান। ফকির বনবিবির তুষ্টির জন্য যে পূজা করছিল, তা আসলে সুন্দরবনের নিজস্ব লৌকিক ধর্ম। পিয়া রয়কে সেদিন যা আশ্চর্য করেছিল তা-ই অরণ্যবাসীর বহু শতাব্দীর চর্চা। এ বিশ্বাস তাদের হিন্দু-মুসলমান-খ্রিস্টান নয়, অরণ্যনির্ভর মানুষ হিসেবে পরিচিতি দেয়। আবার এই দেব-দেবীরও রয়েছে বিবর্তনের রূপ।

বনবিবির শত্রু রাজা দক্ষিণ রায়ের ইতিহাসই তো তেমন চমকপ্রদ। সে বনের একাংশ মানুষের কাছে এখন অসুর অথচ তামস যুগের যে সামান্য ইতিহাস পাওয়া যায়, সেখানেও দক্ষিণ রায় ত্রাণকর্তা হিসেবে উপস্থিত। তারও বহু আগে থেকে দক্ষিণ রায়কে এ অঞ্চলে স্মরণ করা হয় কৃষি বা বাঘের দেবতা হিসেবে, কখনো বিশ্বাস করা হয় ঐতিহাসিক চরিত্র হিসেবে। মানুষের ঈশ্বর চিন্তা মানুষকে দেখেই, মানুষেরই কাছ থেকেই পাওয়া। গোপেন্দ্র কৃষ্ণ বসুর বর্ণনায় পাওয়া যায়, বাংলার লৌকিক দেবতারা ধর্মের চেয়ে বেশি লোকাচারসম্ভূত। ধরা যাক হুগলি জেলার রাজবল্লভীর কথা। দেবী দুর্গাই এ অঞ্চলে রাজবল্লভী হিসেবে পূজা পান। আবার রাজবল্লভী কালী মন্দির এখানকার ঐতিহাসিক মন্দির। মাছের সঙ্গে দুই দেবীর সরাসরি সম্পর্ক না থাকলেও পূজায় লাগে কুচো চিংড়ি। সুন্দরবন অঞ্চলের লুপ্ত দেবতা আটেশ্বরকে মেদিনীপুরের মানুষ ভাবে অপদেবতা। গোপেন্দ্র কৃষ্ণ বসুর ‘লৌকিক দেবতা’ গ্রন্থটি এ অঞ্চলের অনেক দেব-দেবীর বিবর্তনের পরিচয় দিয়েছে। এই দেবতারা শাস্ত্রের নয়, প্রাকৃত মনের। স্থান-কাল ভেদে মানুষের পোশাক, খাদ্যাভ্যাস বদলের মতো ধর্মীয় আচার-আচরণও বদলায়। আর জীবন তো শুধু শাস্ত্র বিধান দিয়ে যাপন করা চলে না, সেভাবে নিয়ন্ত্রণও অসম্ভব। ধর্মের সঙ্গে সংস্কৃতি অঙ্গীভূত হয় আবার পরিবর্তিত আচার প্রবেশ করে ধর্মেরই অংশ হয়েছে।

সতীশচন্দ্র মিত্রের তথ্য অনুযায়ী ১৫০০ সালের কাছাকাছি সময়ে, সুন্দরবন এলাকায় দক্ষিণ রায়, বণিক ধোনাই ও মোনাই এবং গাজির অস্তিত্ব পাওয়া যায়। দক্ষিণ রায় যশোরের ব্রাহ্মণনগরের রাজা মুকুট রায়ের অধীন ভাটির দেশের রাজা ছিলেন। তার সঙ্গে বনবিবির একাধিক যুদ্ধ হয়। দক্ষিণ রায় পরাজিত হয়ে সন্ধি করেন। পাঁচশ বছর আগের মানুষের কাছে শস্য ও বাঘের দেবতা হিসেবে দক্ষিণ রায়ের উপস্থিতি রয়েছে। ধারণা করা হয়, নারায়ণী পুত্র দক্ষিণ রায় দক্ষিণাঞ্চলের এক ঐতিহাসিক চরিত্র। কোথাও ধড়বিহীন, কোথাও বারো হাতের মূর্তিতে পূজা হয় দক্ষিণ রায়ের। এই পরিবর্তনের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে যায় গোষ্ঠী ও গোত্রের ভেতরকার দ্বন্দ্বের ইতিহাস। ক্ষমতার লড়াই, বনভূমির দখলের গল্প। ইতিহাস বহু বছরে গল্প হয়, তা থেকে জন্মায় অরণ্যজয়ী মানুষের বিশ্বাস। পরবর্তী সময়ে তাই হয় লৌকিক দেব-দেবী অর্চনার সংস্কৃতি। নির্ভরতার এসব গল্প জীবন জয়ের উপাখ্যান। সে উপাখ্যান লেখা হয় সময় ও বিবর্তনের মধ্য দিয়ে। একে অন্যের পাশে না দাঁড়ালে বাদাবনে যেমন হিংস্র পশুর মুখোমুখি হওয়া যায় না, তেমনি লোনা জলের প্রবল প্লাবনের বিরুদ্ধে যোজনব্যাপী দীর্ঘ ভেড়ি গাঁথা ও রক্ষার দায়ও সম্ভব নয়। জীবনের জীবিকার জন্য আত্মীয়তার বোধই এখানকার সমাজের ভিত। আর সে ভিত থেকে তৈরি লৌকিক দেব-দেবী, বিশ্বাস, পালা-পার্বণের সংস্কৃতি লালন করে বাংলার ঐতিহ্যকে। গোপেন্দ্র কৃষ্ণ বসুর মতো লোকগবেষকরা তাই বলেন, সব জাতিই বহন করে তার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার। বনভূমি ও জলের ব্যঞ্জনার সঙ্গে এসব লোকায়ত ঐতিহ্যকে ধারণ করেই সুন্দরবন হয়ে ওঠে আরো গভীর।

(লেখাটি ২০১৯ সালে ‘সিল্করুট’-এর প্রকাশিত। লেখকের অনুমতিক্রমে পুনঃপ্রকাশ করা হল।) 

Meghchil   is the leading literary portal in the Bengali readers. It uses cookies. Please refer to the Terms & Privacy Policy for details.