শিষ্যের ঘ্রাণ
আমি আর মুজিব ইরম এই শহরে এসেছিলাম কবি হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে। আর আমাদের কেন জানি অদ্ভুত ধারণা ছিল এজন্য বাংলায় পড়াশোনা করতে হবে। সে জন্য এইচ এস সি পরীক্ষা দিয়েই সিলেট এম সি কলেজ থেকে অধ্যাপক সফিউদ্দিন আহমদ স্যারের সুপারিশপত্র নিয়ে এক বিকেলের ট্রেনে এই শহরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিয়েছিলাম। এই শহরে এসে যখন নামি তখন অনেক রাত। কিচ্ছু চিনি না। শুধু জানি ঢাকা কলেজের বাংলা বিভাগে গিয়ে অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যারের সাথে দেখা করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে তখনও ভর্তি পরীক্ষা শুরু হয়নি। হলেই ঘ ই্উনিটগুলোতে পরীক্ষা দেবো বাংলা বিভাগগুলোকে সামনে রেখে। কিন্তু বাংলায় পড়ার চান্স যাতে কোনো মতেই না হারাই তাই আগে ভাগে অন্তত কলেজের বাংলা বিভাগে হলেও একটা এডমিশন নিয়ে রাখা দরকার। সায়ীদ স্যার তখন ঢাকা কলেজের বাংলা বিভাগের প্রধান। আমাদের কলেজ জীবনের সক্রেটিস অধ্যাপক সফিউদ্দিন আহমদ স্যার উৎসাহ দিয়ে বলেছিলেন, তিনি সায়ীদ স্যারকে চেনেন এবং অনুরোধপত্র লিখে দিলে ভর্তি হয়ে থাকতে পারব। সেই চিঠি বুক পকেটে নিয়ে আমাদের ঢাকায় আসা। ঢাকায় এসে পরদিন সকালে আমাদের প্রথমেই মনে হল, এই শহরের উপযোগী পোশাক কেনা দরকার। আর সেটা হওয়া দরকার বেশ ভাবের। সস্তায় ভাব নেয়ার সব পাওয়া যায় গুলিস্তানে এটা আমাদের জানা ছিল। তাই গুলিস্তানে গিয়ে নিক্সন মার্কেট থেকে প্রথমেই কেনা হল কোট টাই। তারপর সেটা পরে পরদিন যাওয়া হল ঢাকা কলেজে। সায়ীদ স্যার বিভাগের সামনের বারান্দায় বসে পত্রিকা পড়ছিলেন বা এ রকম কিছু করছিলেন। আমরা গিয়ে সালাম দেয়ায় চোখ তুলে তাকালেন। তাকিয়ে মনে হল সামনে জলজ্যান্ত দুই উজবুক দেখছেন। পাঠক নিশ্চয়ই এ তথ্য জানেন, এক সময় উজবেকিস্তানের লোকেদের জোব্বা জাব্বার জন্যই মূলত তাঁদের উজবুক বলা হত। আমাদের নিশ্চয়ই সে রকম লাগছিল। আর গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হচ্ছে সে সময় সম্ভবত গরমকালও ছিল।
আমরা আমাদের আশা ভরসার উৎস চিঠিখানা স্যারকে দিলাম। স্যার খুবই অবজ্ঞা ভরে সেটা হাতে নিলেন। তারপর স্যারের সাথে আমাদের কথোপকথন—
: তোদের ঢাকা শহরে থাকার জায়গা আছে?
: না স্যার।
: গ্রামে জমিদারি আছে?
: না স্যার।
এবার স্যার হঠাৎ করেই হুঙ্কার দিয়ে উঠলেন— তাহলে বাংলায় পড়তে এসেছিস কেন? বাংলায় পড়বে জমিদারের ছেলেরা। পায়ের উপর পা তুলে তামুক খাবে আর লম্বা লম্বা কথা বলবে। রাজার উজির মারবে। তোরা পড়বি পাসকোর্স। দুই বৎসরে পাস করে কেরাণীগিরি করবে! যা পাসকোর্সে ভর্তি হ।
আমরা হাল ছাড়লাম না। দাঁড়িয়ে রইলাম। অনেকক্ষণ পর স্যার আসল কথাটি বললেন।
: কলেজের বাংলা বিভাগে কেউ পড়তে আসে না। সিট খালিই থাকে। বিভাগের পিয়নের সাথে কথা বলে ঠিকানা দিয়ে যা। সময় হলে ও জানাবে। তখন এসে ভর্তি হোস।
আমরা তাই করলাম। কয়েকদিন পর চিঠি পেয়ে পিয়নের মাধ্যমেই ভর্তি হয়ে গেলাম।
স্যার হঠাৎ করেই হুঙ্কার দিয়ে উঠলেন— তাহলে বাংলায় পড়তে এসেছিস কেন? বাংলায় পড়বে জমিদারের ছেলেরা। পায়ের উপর পা তুলে তামুক খাবে আর লম্বা লম্বা কথা বলবে। রাজার উজির মারবে। তোরা পড়বি পাসকোর্স। দুই বৎসরে পাস করে কেরাণীগিরি করবে! যা পাসকোর্সে ভর্তি হ।
ক্লাশ শুরু হল। সাথে আরও কয়েকজন বন্ধু পেলাম। লেখালেখি করে। এদের অনেকে অখনে বিখ্যাত হয়েছে। বন্ধুসঙ্গ ভালোই লাগল। কিন্তু সমস্যা শুরু হল ক্লাশ আরম্ভ হওয়ার পর। প্রত্যেক শিক্ষকই এসে অপমানসূচক কথাবার্তা বলেন। যেন খুব খারাপ ছাত্র আমরা। কোথাও চান্স পাব না বলে বাংলায় ভর্তি হয়েছি। অথচ আমরা বিজ্ঞান বিভাগ থেকে ভাল রেজাল্ট করা ছাত্র। সবচেয়ে মর্মান্তিক অপমানগুলো করতে লাগলেন সায়ীদ স্যার নিজে। মুজিব তখন আরও নাদুসনুদুস ছিল। আক্রমণটা তার উপরই বেশি হত। একেক দিন একেক কায়দায়। একদিন জিজ্ঞাসা করলেন, তোরা ক্লাশের পর কী করিস। আমরা বললাম, মেসে পড়াশনা করি। স্যার বললেন, না। আমি জানি কী করিস।
: কী করি স্যার?
: তোরা বিকেলে নিউমার্কেট গিয়ে ইডেন কলেজের মেয়েদের দেখার আশায় দাঁড়িয়ে থাকিস। আর দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়িস। আমাদের কপাল ভাল যে তোদের দীর্ঘ শ্বাসের ভার নেই। না হলে তোদের দীর্ঘশ্বাসের ভারে নিউমার্কেট এলাকা কয়েক হাজার ফিট মাটির নিচে চলে যেত।
প্রায় প্রতিদিনই এ রকম মর্মান্তিক অপমান করেন। কাহাতক আর সহ্য করা যায়।
এক সময় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তি পরীক্ষা শুরু হল। প্রথমে বিজ্ঞাপন হল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। আমরা ঢাকা থেকে স্বল্পতম সময়ে, সস্তায় কী করে চট্টগ্রাম যাওয়া যায় জানতাম না। ফলত এক দুপুরে সায়েদাবাদ গিয়ে চড়ে বসলাম এক বাসে। বাসটি প্রকৃতপক্ষে ছিল লোকাল। সে বাসটি থামতে থামতে যাচ্ছিল। এক সময় স্থায়ীভাবে থেমে গেল মধ্যপথে। নষ্ট হয়ে গিয়েছে। সেটা সারিয়ে আবার থামতে থামতে চট্টগ্রাম পৌঁছাল অনেক রাতে। নানা ঝক্কি পেরিয়ে পর দিন পৌঁছালাম চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সুন্দর ক্যাম্পাসে। চিনতাম না সেখানকার তেমন কাউকেই। শুধু জানতাম এক বাম ছাত্রনেতার নাম। হলে গেলাম তাঁর খোঁজে। কিছু ষণ্ডামার্কা ছেলে ঘিরে ধরল আমাদের। কাকে চাই? নাম বলাতে তারা তেলেবেগুনে জ্বলে উঠল। তারপর সাফ জানিয়ে দিল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে হলে শুধুমাত্র তাদের মৌলবাদী সংগঠনটি করা যাবে। আমি আর মুজিব পরস্পরের মুখের দিকে তাকালাম। আর সে রাগ অভিমানে তখনই আবার রওয়ানা দিলাম ঢাকার উদ্দেশ্যে। তারপর সে রাগ আর কখনই যায়নি। কিন্তু মনে মনে আজও সে সবুজ ক্যাম্পাসটিকে মিস করি।
তারপর ভর্তি পরীক্ষা দিলাম জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে। চান্স পেয়ে গেলাম প্রার্থিত বাংলা বিভাগে। ততদিনে সায়ীদ স্যার ঢাকা কলেজ থেকে চলে গিয়েছেন। নতুন চেয়ারম্যান হয়ে এসেছেন আখতারুজ্জামান ইলিয়াস। তিনি আগে থেকে লেখালেখিসূত্রে চিনতেন। যখন সে বিভাগ থেকে বিদায় নিতে এলাম ইলিয়াস স্যারের আকূতি শোনা গেল। তিনি তাঁর স্বভাবজাতভাবে তোতলাতে তোতলাতে বললেন, তুমি ঢাকা ছেড়ে যাইও না শোয়েব। এইখানে বড় লেখক হবে। জাহাঙ্গীরনগরকে তখন ঢাকা থেকে বিচ্ছিন্ন ভাবা হত। এখনও বোধহয় ভাবা হয়। ইলিয়াস স্যারের অনুরোধে আমার অভিমান আরও জেগে উঠল। বললাম, এ বিভাগে আর নয় স্যার। যা অপমান করা হয়েছে কখনও ভুলবো না।
তারপর জাহাঙ্গীরনগর পর্ব শেষ করে পিএইচ ডি করে বিদেশ টিদেশ ঘুরে পেশাগত জীবনে বেশ জাঁকিয়ে প্রবেশ করেছি। এরমধ্যে একসন্ধ্যায় আজিজে সায়ীদ স্যারের লোক স্যারকে সাহায্য করার আবেদনটি নিয়ে হাজির হলেন। স্যার তখন একটি মস্ত প্রকল্প নিয়ে বিপদে পড়েছেন। প্রকল্পের মাঝপথে শিক্ষাতত্ত্ব বিষয়ের বিশেষজ্ঞ ব্যক্তি বিদেশে কাট মেরেছেন। ফলত কাজটি মাঝপথে ঝুলে গেছে। স্যার কোথাও থেকে জেনেছেন আমি এ বিষয়ে কাজ করি। ফলত তিনি আমার চেনা লোক ধরেছেন।
সে মানুষটি আমাকে যখন সে অনুরোধ জানালো আমার অপমানিত হওয়ার পুরোনো জ্বালা মুহূর্তেই দপ করে জ্বলে উঠল। আমি সাফ না বলে দিলাম। কিন্তু লোকটি ছাড়বার পাত্র নয়। শেষে বেচারা বলল, ঠিকাছে। কাজ করার দরকার নেই। স্যার আপনার সাথে জাস্ট কথা বলতে চেয়েছেন।
আমি রাগ ভুলে স্যারের প্রতি কৃতজ্ঞতা বোধ করতে শুরু করলাম। কিন্তু হঠাৎ করে তুমি বলার সন্দেহ রয়েই গেল। একদিন কথাটি পাড়লাম। স্যার হাসতে হাসতে বললেন, আমি তোকে তখনই চিনতে পেরেছিলাম রে। কিন্তু তোর রাগটি মেটানোর সুযোগ দিয়ে যাচ্ছিলাম। শিক্ষকরা তাঁদের একদিনের ছাত্রটিরও গায়ের গন্ধ টের পায়। চিনতে ভুল করে না।
আমি অভিমান হত মন নিয়া এক শীতের সন্ধ্যায় এবার সত্যিকারে সাহেবি কেতায় কেন্দ্রে উপস্থিত হলাম। কেন্দ্র তখনও বহুতলা হয়নি। পুরোনো বাড়িতে আছে। গিয়ে দেখি স্যার আগে থেকেই বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি খুব সম্মানের সাথে ভেতরে নিয়ে গেলেন। কথা হলো। অনুরোধ করলেন। আমি যে তাঁর এক সময়ের ছাত্র ছিলাম তা ঘুর্ণাক্ষরেও জানতে দিলাম না। তারপর এক সাথে কয়েক বৎসর কাজ করলাম। আমরা পরস্পরের সাথে সহকর্মী হিসেবে সহবতের সাথে আপনি আপনি করে দাপ্তরিক সম্পর্ক চালিয়ে গেলাম। এক সময় কাজ শেষ হল। রাগ অভিমানে কখনও বলা হল না আমি আপনার ছাত্র ছিলাম।
অনেক দিন পর এক রাতে স্যার আমাকে ফোন করলেন। বললেন, শিক্ষা নিয়ে আন্তর্জাতিক একটি সংস্থা কাজ করবে। পরামর্শক খুঁজছে। তারপর বললেন, আমি ‘তোমার’ নাম বলে দিয়েছি।
স্যার এই প্রথম আমাকে তুমি বললেন। আমি বুঝলাম কোথাও একটা গড়বড় হয়েছে। না হলে আমাকে হঠাৎ আজ তুমি বলার কথা নয়। খানিক ভয়ও পেলাম।
ইতোসময়ে সে কাজটি পেয়ে আমার যথেষ্ট পেশাগত ও আর্থিক সমৃদ্ধি ঘটল। আমি রাগ ভুলে স্যারের প্রতি কৃতজ্ঞতা বোধ করতে শুরু করলাম। কিন্তু হঠাৎ করে তুমি বলার সন্দেহ রয়েই গেল। একদিন কথাটি পাড়লাম। স্যার হাসতে হাসতে বললেন, আমি তোকে তখনই চিনতে পেরেছিলাম রে। কিন্তু তোর রাগটি মেটানোর সুযোগ দিয়ে যাচ্ছিলাম। শিক্ষকরা তাঁদের একদিনের ছাত্রটিরও গায়ের গন্ধ টের পায়। চিনতে ভুল করে না।
আমি অভিভূত হয়ে গেলাম।
আমাদের সে মান অভিমান উজিয়ে ছাত্র শিক্ষকের সম্পর্কটি অখনেও টিকে আছে, স্নেহে ভালবাসায় সমুজ্জল।