সিনেমা, দর্শক ও পরিচালক (পর্ব-২)
চলচ্চিত্রিক মানসিকতা : সিনেমা, দর্শক ও পরিচালক (পর্ব-১) এর পর থেকে-
কিছুদিন আগের সুপারহিট একটি সিনেমা, যা গানে গানে মানুষকে মুগ্ধ করেছিল। কিন্তু স্বয়ং সিনেমাটা সেভাবে দর্শকদের মন ভরাতে পারেনি বলে অভিযোগ আছে, সেই সিনেমাটি নিয়ে একজন এক আড্ডায় বলেছিল, ‘আমি আসলে এই সিনেমাটায় টম হ্যাঙ্কসের “কাস্ট অ্যাওয়ে” সিনেমাটার মতো কিছু দেখতে পাবো বলে ভাবছিলাম। ওই সিনেমাটা দ্বীপে নায়ক একা থাকে, এই সিনেমাটাতেও নায়ক চরে একা থাকে। কিন্তু চরজীবনের কিছুই তো সিনেমাটাতে দেখাল না।’
আরেকটি সিনেমা, যা একাত্তরে আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধকে কেন্দ্র করে নির্মিত, অনেকেই আছেন, যারা সিনেমাটি দেখে রীতিমতো স্বর্গীয় সুখ লাভ করেছেন, তাদের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই আমি বলছি, যুদ্ধের সিনেমা বলতে আমি বুঝি গ্লাডিয়েটর, ব্রেভ হার্ট, বিহাইন্ড দ্য এনিমি লাইন, অল কোয়ায়েট অন দ্য ইস্টার্ন ফ্রন্ট ইত্যাদি। এই সিনেমাগুলোর যুদ্ধের দৃশ্যায়ন আমাকে দারুণভাবে আলোড়িত করে, শিহরিত করে। আমাদের দেশের যুদ্ধের সিনেমাগুলোতে কেন এভাবে দেখানো হয় না?
হয়তো বলবেন, সব যুদ্ধের সিনেমাতে যুদ্ধ দেখানো হয় না। হ্যাঁ, সত্যি কথা। যুদ্ধ ছাড়া যুদ্ধের অসাধারণ সিনেমার উদাহরণ তো আমাদের দেশেই রয়েছে। জহির রায়হানের ‘জীবন থেকে নেয়া’ আর খান আতাউর রহমানের ‘আবার তোরা মানুষ হ’ সিনেমা দুটি যারা দেখেছে, তাদের মধ্যে দেশের জন্যে যে আবেগ জন্মেছে, তা তো বর্তমানের এই সিনেমাটা জাগাতে পারছে না। তাহলে? ডক্টর জিভাগো, দ্য ইমিটেশন গেইম বা ওয়াটার ডিফাইনারের মতো হলিউডি যুদ্ধবিহীন যুদ্ধের সিনেমার কথা না হয় বাদই দিলাম।
আর যদি চলচ্চিত্র আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধকে জানার মাধ্যম হয়ে থাকে, তবে আমি জহির রায়হানের ‘স্টপ জেনোসাইড’ দেখব। তারেক মাসুদের ‘মুক্তির গান’ দেখব। যে সিনেমা অল কোয়ায়েট অন দ্য ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট বা গ্লাডিয়েটর হতে পারছে না, জীবন থেকে নেয়া বা আবার তোরা মানুষ হ হতে পারছে না, স্টপ জেনোসাইড বা মুক্তির গানও হতে পারছে না, শুধু ৭১-কে নিয়ে নির্মিত বলেই কি আমাকে সেই সিনেমা দেখে আহলাদে আটখানা হতে হবে? কেন ভাই? সিনেমা ব্যবসা করার বিষয়। কিন্তু ৭১ তো ব্যবসা করার বিষয় নয়।
যদি চলচ্চিত্র আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধকে জানার মাধ্যম হয়ে থাকে, তবে আমি জহির রায়হানের ‘স্টপ জেনোসাইড’ দেখব। তারেক মাসুদের ‘মুক্তির গান’ দেখব। যে সিনেমা অল কোয়ায়েট অন দ্য ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট বা গ্লাডিয়েটর হতে পারছে না, জীবন থেকে নেয়া বা আবার তোরা মানুষ হ হতে পারছে না, স্টপ জেনোসাইড বা মুক্তির গানও হতে পারছে না, শুধু ৭১-কে নিয়ে নির্মিত বলেই কি আমাকে সেই সিনেমা দেখে আহলাদে আটখানা হতে হবে? কেন ভাই? সিনেমা ব্যবসা করার বিষয়। কিন্তু ৭১ তো ব্যবসা করার বিষয় নয়।
চলচ্চিত্র বিশ্লেষকদের অভিযোগ, শিল্পসম্মত সিনেমা কখন ব্যবসা সফল হয় না। ডাহা মিথ্যা কথা। কেন, মুন্না ভাই এমবিবিএস বা লাগে রহো মুন্না ভাই কি ব্যবসাসফল হয়নি? মহাত্মা গান্ধী আর মুন্না ভাইকে নিয়ে যেভাবে কাহিনি সাজানো হয়েছে, সেটা তো ক্ল্যাসিক একটা বিষয়। জানি অনেকেই মুখ বাঁকিয়ে বলবেন, কমেডি সিনেমায় আবার শিল্প? ঠিক আছে, চার্লি চ্যাপলিনের মুখে ঝামা ঘষে দিয়ে মেনে নিলাম, কমেডি সিনেমাতে শিল্প হয় না। নিশ্চয় স্বীকার করবেন, লগান, রং দে বাসন্তি, থ্রি ইডিয়েট, এগুলো কোনো কমেডি সিনেমা নয় এবং এই সব সিনেমার শিল্পমান নিয়ে কোনো পাগলও প্রশ্ন তুলবে না। প্রায় ৫০০ কোটি রুপি ব্যবসা একেকটি সিমেনার। তাহলে? আমাদের দেশের সুভাষ দত্তের ‘সুতরাং’ও তো সে সময় রেকর্ড পরিমাণ ব্যবসা করেছিল। নিশ্চয় বলবেন না যে সুতরাং শিল্পহীন একটা সিনেমা।
আসলে আপনারা কি আদৌ স্পষ্ট করে জানেন, কেন, কী উদ্দেশ্যে আপনারা বারবার বলে থাকেন যে শিল্প আর ব্যবসা কখনো একসাথে হাতে হাত ধরে চলতে পারে না? সব দেশেই তো চলছে। স্বীকার করছি, অ্যাভেঞ্জার্স, এক্সম্যান বা দাবাং, চেন্নাই এক্সপ্রেসের মতো সিনেমাগুলো হয়তো শিল্পনির্ভর সিনেমাগুলোর চেয়ে বেশি ব্যবসা করছে। কিন্তু হলিউড, বলিউডসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশের শিল্পনির্ভর সব সিনেমা তো লসের খাতায় নেই।
সত্যি কথাটা হলো, আমাদের চোখ যে মানের সিনেমা দেখতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে, সেই মানের সিনেমা ছাড়া আমাদের আর অন্য কোনো ধরনের সিনেমাতে মন ভরবে না। তা সেই সিনেমায় আপনার যতই ধ্রুপদি শিল্প অথবা ৭১ বা ২১-এর ইমোশন থাক না কেন, কোনো লাভ নেই। ইমোশনের জায়গায় ইমোশন আছে এবং থাকবে। কিন্তু আমাদের দেশের সিনেমা বোধ হয় আর সিনেমার জায়গায় নেই। আফসোস, এই মাটিতে আর কোনো জহির রায়হান, সুভাষ দত্ত, খান আতাউর রহমান বা আলমগীর কবির জন্ম নিচ্ছেন না। তারা নিজেদের দেশাত্মবোধ বজায় রেখেই তাদের সমসাময়িক আন্তর্জাতিক সিনেমার গুণগত মানকে ছুঁতে পেরেছিলেন অজস্র প্রতিকূলতা থাকা সত্ত্বেও। বর্তমানের পরিচালকেরা কোনোভাবেই সেই মানকে ছুঁতে পারছে না। আর নিজেদের দোষ ঢাকতে নির্দ্বিধায় সমস্ত দোষ চাপাচ্ছে দর্শকদের ওপরে।
সত্যি কথাটা হলো, আমাদের চোখ যে মানের সিনেমা দেখতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে, সেই মানের সিনেমা ছাড়া আমাদের আর অন্য কোনো ধরনের সিনেমাতে মন ভরবে না। তা সেই সিনেমায় আপনার যতই ধ্রুপদি শিল্প অথবা ৭১ বা ২১-এর ইমোশন থাক না কেন, কোনো লাভ নেই। ইমোশনের জায়গায় ইমোশন আছে এবং থাকবে। কিন্তু আমাদের দেশের সিনেমা বোধ হয় আর সিনেমার জায়গায় নেই।
এখানে আরেকটা বিষয় না বললেই নয়। আমেরিকা, ভারত, কোরিয়া বা ইরানের পরিচালকেরা তাদের দেশের বিষয়কে নিয়ে তাদের ঐতিহ্য অনুযায়ী সিনেমা বানায়। সুতরাং আমাদের দেশের পরিচালকেরাও যে আমাদের দেশের বিষয় ও ঐতিহ্য নিয়ে সিনেমা বানাবে, এটাই দর্শকদের প্রত্যাশা। অন্য দেশের ভালো কোনো সিনেমাকে নকল করে বাজার মাত করার কোনো সুযোগ কিন্তু এখানে নেই। আরও বলে রাখা ভালো, নিজের দেশের ঐতিহ্যের নামে আপনি যদি শুধু অভাব, দারিদ্র্য আর ধর্মীয় কুসংস্কার দেখান, তবে বিদেশ থেকে হাতি-ঘোড়া বিভিন্ন পুরস্কার পেলেও দেশের দর্শকদের মন কিন্তু ভরাতে পারবেন না।
মানুষ নিজের দেশকে যথাসম্ভব ভালো চেহারায় দেখতে চায়। হলিউডি বা বলিউডি সিনেমায় শত সমস্যা দেখানোর পরও নিজ দেশ বা জাতির উন্নত দিকগুলোকে দেখাতে কখনো ভুলে যায় না। এই দেশের কিছু পরিচালক আছেন, যারা হয়তো এই দেশের মাঝে উন্নত কিছু খুঁজেই পান না। আমরা ব্যক্তিজীবনে যে যন্ত্রণা ভোগ করছি, সিনেমার পর্দায়ও সেই যন্ত্রণা দেখাটা আসলেই বিরক্তিকর। তাও যদি সেই সিনেমাগুলোতে শেষ পর্যন্ত কোনো সমাধান বা আশার বাণী শোনা যেত। আমি আমাদের দেশের বা জাতির দোষগুলোকে অস্বীকার করার কথা বলছি না। করলে সেটা হবে মিথ্যাচার। আমি দোষের পাশাপাশি গুণগুলোকেও দেখানোর কথা বলছি।
সত্যজিৎ রায় বলেছিলেন, ‘আমরা যদি ভালো সিনেমা বানাই, তবেই দর্শকদের মাঝে ভালো সিনেমা দেখার অভ্যাস তৈরি হবে।’ অর্থাৎ বিষয়টা এমন নয় যে দর্শকদের অভ্যাস বা রুচির উন্নয়ন ঘটার পরেই পরিচালকেরা ভালো সিনেমা বানানো শুরু করবেন। আমাদের দেশে অবশ্য বিষয়টা একটু উল্টো হয়ে গেছে। ইন্টারনেটের কল্যাণে বাইরের দেশের উন্নত মানের সিনেমা দেখে দেখে আমাদের দর্শকদের রুচি আকাশছোঁয়া হয়ে গেছে। যদি আমাদের পরিচালকেরা নিজেদের দেশাত্মবোধকে বজায় রেখে সেই রুচিকে ধরতে পারেন, তাদের চাহিদা অনুযায়ী গুণগত মান দিতে পারেন, তবেই আমাদের দেশের হলগুলো অতীতের মতো দর্শকে পরিপূর্ণ হবে, তার আগে নয়। তা সে আপনি যতই তথাকথিত শিল্পসম্মত সিনেমা বা আর্টফিল্ম বানান না কেন, দর্শকের তাতে কিছুই যায় আসে না।
সমাপ্ত
অলংকরণ : রাজিব রায়