

সেলিম মোরশেদের কান্নাঘর
কান্নাঘরকে সেলিম মোরশেদের গল্প বা ফিকশন হিসেবেই পড়ি আমরা। একশনধর্মী ফিকশন বলা যায়। একশনটা তৈরি হতে থাকে কর্তাভজা ভগবেনে সম্প্রদায় ও তার গুরু বিজয়মোহনকে ঘিরে। একটা একশন দৃশ্যের জন্য প্রয়োজনীয় রূপকল্প তৈরি হতে থাকে। একশন মানে একেবারে মারামারিই, তাও আবার আগ্নেয়াস্ত্র, রক্তারক্তি ব্যাপার আছে। বাস্তবে যেমন থাকে। কিন্তু ভগবেনেদের নিষেধ আছে। অমান্য করলে জরিমানা হয়।
গল্পের বর্ণনার শুরুতে আমরা একটা নতুন পরিবেশকে চিনতে শুরু করি এই একটা প্রামাণ্যচিত্রের মতো করে। বেগুন, আলুর স্তুপ, গামলায়, এরপরে আবার বেগুন আলুর স্তুপ, গুরুবাড়ির এই সেবা আয়োজনের ভেতরে আমরা ঢুকে পড়ি এই পুনরাবৃত্তির মধ্য দিয়ে। এরপরে আরো একবার ‘প্রথম প্রহরে চিড়ে, টক দই …।’ গুরু বিজয় মোহনের চোখের জলের মতই ঝরতে থাকে। এরপর সাংবাদিকরা, অতিথিরা চলে গেলে আমরাও বিজয় ঠাকুরের ঘরের ভেতরে প্রবেশ করতে পারি। তার দুই চোখের জলের হদিস পাই।
‘তরকারিতে যেমন গুরু মসলা নেই।’ তেমনি সহজ জীবন, সহজিয়া ধর্ম, সহজ প্রশ্ন নিয়েই মানুষের কারবার। বাইরের মানুষের কাছে সেগুলি হয়ত সহজ হয়ে ধরা দেয় না। তাই এক জায়গায় পাওয়া যায় ভিন্ন ভিন্ন চরিত্রের মানুষকে নিত্যানন্দ-সদানন্দ-বিজয়-যশোদা-আসমা-মাধুরী-মিল্লাত-দুই সাংবাদিক-ছটাকে মোশারফ-দেড় ব্যাটারি-শহীদ ড্রাইভার…। এই স্বল্প পরিসরেও প্রত্যেকটি চরিত্র স্ব স্ব ভূমিকা পালন করতে থাকে।
জলজ সন্তরণ, কান্নার জলে। সেই জলের তলে কী আছে? জলজ উদ্ভিদ, শেওলা, জলের মধ্যে মাছও আছে। সে মাছ সদা চঞ্চল। জীবনের কী সাধ্য তার দর্শন স্থির করে। এই জল থেকে উঁকি মেরে শ্বাস নেয়, আবার ডুব দেয় জীবনের জন্য। নাকি উল্টোটা। বাস্তবের সংঘাতে জলের ঘোর কিছুক্ষণের জন্যে কেটে যায়, সেখানেই গল্পের ক্লাইম্যাক্স। হয়ত এর পরে এখান থেকেই নতুন জলের আখ্যান, নতুন কান্নাঘরের উদ্বোধন হবে। আমরা সেই আশায় থাকি।
২.
শ্রীচৈতন্য দেবের বৈষ্ণব তত্ত্ব এক দিকে যেমন ভাবান্দোলনের সূচনা করেছিল, আরেকদিকে সামাজিক বিপ্লবেরও সূচনা করেছিল। এই গৌরচাঁদের বিদায়ের সাথে সাথেই তার উত্তরাধিকার প্রশ্নবিদ্ধ হয়। একদিকে উচ্চ বৃন্দাবনবাদীরা, অপরদিকে নিত্যানন্দের অনুসারী দল। চৈতন্যদেবের জীবদ্দশাতেই শুধু যে সমাজের সবচেয়ে অবহেলিত ও বেদবর্জিত শুদ্র শ্রেণি হরিনামের ছোঁয়া পাচ্ছিল তা নয়, সহজিয়ারা বা তান্ত্রিকপন্থাও এই সামাজিক বিপ্লবে ব্রাহ্মণ্যবাদকে ভাসিয়ে নিয়ে যাবার যোগাড় করছিল। সেটা কতটুকু কী পরিমাণে সে-বিবেচনা করা যাবে তুলাদণ্ডে, অন্য অবসরে। তবে চৈতন্য দেবের অন্তর্ধানের পর বৃন্দাবনবাদী অদ্বৈতাচার্যের প্রভাবে, রূপ-সনাতন প্রভৃতি গোস্বামীদের দ্বারা জরুরিভিত্তিতে প্রচুর শাস্ত্র লিখিত হয়। বেদবর্জিতরা হয়ে ওঠেন শাস্ত্রবর্জিত। অন্যদিকে নিত্যানন্দের পুত্র বীরচন্দ্র বা বীরভদ্র হয়ে ওঠেন সহজিয়া বৈষ্ণবদের অবতার।
‘বীরচন্দ্ররূপে পুনঃ গৌরঅবতার
যে না দেখেছে গৌর সে দেখুক আবার’
তাঁরই প্রশ্রয়ে-আশ্রয়ে সহজিয়া-তান্ত্রিকেরা বৈষ্ণববাদের ছায়াতলে আসে, থেকে যায়। এই সহজিয়াদেরই এক শাখা গল্পের ভগবেনে সম্প্রদায়। গল্পের মধ্যেই আমরা দেখি, বিজয় মোহন কালের হিসেব ফেঁদেছেন, ঠিক ক্লাইম্যাক্সের আগে দিয়ে, গোরাচাঁদ থেকে আউলচাঁদ। আউলচাঁদ থেকেই কর্তাভজারা। ভক্ত ও গুরু, গুরু ও ভক্ত, গুরুভক্ত মিলে কালের আবর্তনে গড়িয়ে চলে, গুরু ছাড়া ভক্ত হয় না, ভক্ত ছাড়া গুরু হয় না:
‘ভক্ত আমার মাতাপিতা
ভক্ত আমার গুরু
ভক্তরে রেখেছে নাম বাঞ্ছা কল্পতরু।’
বিজয়মোহন রোমন্থন করছেন, যুগান্তরের সেই প্রবাহকেই, সেই মহাবীর থেকে বুদ্ধ রামানন্দ হয়ে কবীর, তার থেকে চৈতন্য, চৈতন্য হতে আউলচাঁদ। বিজয়মোহন নিজেকে এই যুগাবতারদের ধারাতেই আবিষ্কার করছেন। কিন্তু আবিষ্কার করেই আঁতকে উঠছেন নিজেকে মূল্যায়ন করতে গিয়ে। এখানে দুর্বল বিজয়মোহনকে আবিষ্কার করি আমরা। যুগ-প্রশ্নের সমাধানে যে গুরু ব্যর্থ হতে যাচ্ছেন, এমন আলামত পাই।
কান্নাঘরের সংকটটিকে সেলিম মোরশেদ একটা আপাত সমাধানের দিকে নিয়ে যান বলে মনে হতে পারে। ক্লাইম্যাক্স দৃশ্যে খেয়াল করি, ভক্তরা তাকিয়ে আছেন, গুরুবদলের পালা শুরু হচ্ছে। পাঠকের জায়গা থেকে দেখলে আমরাও এই পরিণতিকামী সমাধানের দিকেই যেতে চাই। কিন্তু ভগবেনে সম্প্রদায়টির ভাগ্যে কি ঘটে আমরা আর জানতে পারি না।
কান্নাঘরের ক্লাইম্যাক্সও কিন্তু এই ধারাতেই পাওয়া যাচ্ছে। বিজয়মোহনের পরে কে? তার ডান আর বাম চোখে দুই ধারা, তার অনুজ সদানন্দ ও নিত্যানন্দ। যুগের প্রশ্ন সমাধানে বা জিজ্ঞাসায় কি বিজয়মোহন ব্যর্থ হচ্ছেন? তন্ত্র মন্ত্র এসে কি সহজ মানুষের চোখের জল ঘোলাটে করে দিয়ে যাচ্ছে? গুরু কে? গুরু ব্যর্থ হন কীভাবে? গুরুর তৈরি নিয়ম-নীতি জীবনপথ, এগুলির দ্বারা সংসার চলতে থাকলে চিরন্তনভাবে, চোখের জলের ধারার মতন, তাহলে আর বাঁধা কোথায়? বাঁধা আসবেই। বাঁধা আসে স্বাভাবিকভাবে, বাস্তবের বিবর্তনে, আর জলের বাঁধন তাতে টুটবেই, তাহলে ডানে নাকি বাঁয়ে, কোন দিকে যেতে হবে? জলজ কান্না নাকি শুষ্ক কান্না। সেলিম মোরশেদের এই গল্পটির ঢংটা প্রামাণ্য ধরনের। সমাধানটা ক্লাইম্যাক্সে স্পষ্ট করে গেছেন। যেন গোটা ভগবেনে সম্প্রদায় দাঁড়িয়ে আছে, ছিল এই যুগসন্ধিক্ষণে, এই সমাধানের অপেক্ষায়; আর লেখক আমাদেরকে নিয়ে দাঁড় করিয়েছেন বিজয়মোহনের উঠোনে, তার কান্নাঘরের সামনে।
৩.
গল্পের বর্ণনা প্রামাণ্যধর্মী। পথ দেখিয়ে সাংবাদিক ও অন্যান্য অতিথিকে নিয়ে যাওয়া হয় উঠোনের সামিয়ানার নিচে। ভক্তরাও আছেন, কিন্তু নেপথ্যে, সচল-সজীব বাঞ্ছা-কল্পতরু হয়ে। এক ও অনেকের মধ্যে থেকে লেখক বের করে আনেন সামিয়ানার তল থেকে, নিয়ে যান স্কুলের পাশের চায়ের দোকানে। ছটাকে মোশাররফ আর দেড় ব্যাটারিকে হাজির করেন, এন্টি ম্যাটার। আবার ফিরিয়ে নিয়ে যান উঠোনে। আমরা পাঠকেরা অপেক্ষা করতে থাকি, উঠোনে কখন এন্টি ম্যাটার এসে হাজির হয় তার ক্লাইম্যাক্স নিয়ে।
বিজয়মোহনের কান্নাঘর, ভক্তদের নিয়ে তার সংসার, সে-ই সংসারের আইন। সহজ প্রশ্নে, সহজ মানুষের সহজিয়া তরিকা। আসলেই কি সহজ! এই কান্নার মধ্যেই অতীত, আর ভবিতব্যের ধারা বহমান। সদানন্দের কান্না যেখানে মিলে যায়। সদানন্দ সেই কান্নার আর্দ্রধারা। বিজয়মোহন যাকে উত্তরসূরী হিসেবে মনে মনে নির্বাচন করে রেখেছেন। সেলিম মোরশেদ কিন্তু সদানন্দের স্বরূপের সন্ধান দিয়েছেন। জলজ উদ্ভিদ, সন্তরণশীল মাছের মুখগহ্বরে আসা-যাওয়া করে প্রতিক্ষণ, কান্নার জল যতক্ষণ তাকে ধারণ করে, এর বাইরেও, বাস্তবেও। প্রশ্ন জাগে এই মীন সন্তরণে কাদা হয় না? জল ঘোলা হয়ে যায় না তখন?
আর শুষ্ক ধারাটির নাম নিত্যানন্দ। সেও কান্নার অংশ। কিন্তু বাস্তবতা তাকে প্রকাশ্যে কাঁদতে দেয় না। আড়াল খুঁজতে সে শহরে যায়, হোটেলে গিয়ে ওঠে, কিন্তু তবুও কাঁদার অবকাশ পায় না। ফিরে আসে বাস্তব থেকে প্রত্যাখ্যাত হয়ে। ভগবেনে প্রান্তিক সম্প্রদায়। তাদের বিশ্বাস সহজিয়া দর্শনের মতন সহজিয়া জীবন ধারণ প্রক্রিয়ার ফলে তাদের রোগবালাই হয় না। এমনই অনেক আইন রয়ে গেছে কর্তাভজাদের সংসারে। আছে বিধিনিষেধ, চুরি, এঁটো, ছেনালি, মদ, মাংস, মিথ্যা ও রক্তারক্তি। বৈদ্য ডাক্তারের কাছে যাওয়া যাবে না, রেস্টুরেন্টে খাওয়া যাবে না। বাস্তব ধর্মগুলির আইন যেমন হয় আর কি! সে আইন অমান্য করলে আছে জরিমানা, পাপ-পুণ্য এবং তার অধিক হিসাবের ধারাপাত। প্রত্যাখ্যাত নিত্যানন্দ সেখানেও সহজ প্রশ্নের উত্তর খোঁজ করে। এ জন্যেই বোধহয় অশ্রুহীন কাঁদতে হয় তাকে। কিন্তু প্রশ্নের উত্তর না মিলিয়ে সে কাঁদতে পারে না। সেও প্রতি মুহুর্তে কম্পমান সেই জলজ শৈবালের মতই। কান্নাঘরের সেও এক অনিবার্য অশ্রু।
৪.
কান্নাঘরের সংকটটিকে সেলিম মোরশেদ একটা আপাত সমাধানের দিকে নিয়ে যান বলে মনে হতে পারে। ক্লাইম্যাক্স দৃশ্যে খেয়াল করি, ভক্তরা তাকিয়ে আছেন, গুরুবদলের পালা শুরু হচ্ছে। পাঠকের জায়গা থেকে দেখলে আমরাও এই পরিণতিকামী সমাধানের দিকেই যেতে চাই। কিন্তু ভগবেনে সম্প্রদায়টির ভাগ্যে কি ঘটে আমরা আর জানতে পারি না। প্রান্তিক ভক্তগুরু সম্প্রদায়ের ফিকশন ফেলে আমরা আমাদের নন-ফিকশন জীবনের বাস্তবতায় ফিরি, কান্নাঘর গল্পটির অবসানে। কিন্তু কান্না চলতে থাকে।