

সেলিম মোরশেদ: গল্পের তপস্যায় চন্দ্রবিন্দু
রাতকাটা ভোর। ভোর হবেই গল্প শেষ হবে না। একটা থেকে আরেকটা গল্প। যেতেই থাকি। বহু ঘুম, বহু রকম করে ফিরে যায়। পিংপং বলের মতো। কিন্তু গল্প থেকে যায়। গল্প পড়তে হয়। পড়তে থাকি।
গল্প পড়াটাও এক তপশ্চর্যার মতোই। এটা পাঠক হিসেবে আমার উপলব্ধি। স্বচ্ছন্দে বইয়ে বইয়ে, পাতায় পাতায়, মনে মনে হয় ছুটে চলা। আনন্দের চলা। বোধ ও শিক্ষার পূর্ণ ধারণায় নিজেকে পঞ্জীভূত করা। কী যে এক বন্ধুত্ব, মায়া—গল্প লেখক আর পাঠক মনের। যতযুগ ধরে তিনি লিখুন না কেন, ততযুগ তাকে আমি জানি। তিনি হয়তো আমায় চিনেন না। তার দরকারও নেই। তার সাথে আমার আত্মাযোগ হয়ে আছে। একটা অস্তিত্বের সাথে আমার পরিচয় হয়ে আছে। পাঠক হিসেবে আমার সৃষ্টিশীল মেজাজ কিন্তু থাকে, তা পাঠ অনুভূতির পাত্রে ঢালতে পারি। সেই লক্ষ্যে এ লেখা।
গল্পের আদি-অন্ত সবটুকু শিল্পকর্ম। এই ভূখণ্ডের চরিত্র-অনুচরিত্রগুলো কেবল পাঠকের একান্ত জগতের আদলে গড়া। এখানে বলে রাখা দরকার একজন মানুষ, গাছ, পশু-পাখি, কীট, কিংবা প্রাণহীন চেয়ার, টেবিল, আসবাব, বাড়ি, হয়তো তার বাইরে পাহাড়, নদী-প্রকৃতি কিছু চরিত্র-চিত্রনে উল্লেখ্য। এসবের সাথে পাঠকের অস্তিত্ব মিশে যায়। আমার মিলমিশও ঘটেছে, যখন আমি তার গল্প পড়েছি। একটা কথা সোজাসাপটা বলি, লেখকের সাথে বয়ানের চাপের উত্তেজনা সম্পৃক্ত। পাঠকের কথা সরলভাবে না ভেবে তিনি ন্যায়সংগত প্রণয়ন প্রণালীকে সামলে রেখে গল্প গড়ে তোলেন। এই সূক্ষ্মতর বিস্তার অভিজ্ঞতা-কৌশল দ্বারা ঘটে থাকে। হাঁ কৌশলী লেখক কিন্তু ভাষার মর্জি বুঝে একটা নিজস্ব গতিপথ তৈরি করেন। মাপ-মাপ রেখে প্রশ্রয়পুষ্ট এক ধারা তৈরি করতে পারেন।
আমার মনে হয়েছে সেলিম মোরশেদ তা পেরেছেন। প্রাসঙ্গিক পরিকল্পনা মাফিক আমার মনে ঢুকে পড়েছেন। কথা বলতে বলতে তিনি ঢঙ করেন। যে ঢঙটা সম্পূর্ণ তার একান্ত। বিশেষত্ব। দৃষ্টান্ত হচ্ছে, যখন পড়ছিলাম ‘কাটা সাপের মুণ্ডু’ তখন মনে হলো বলার ঢঙটা কেমন দুলে দুলে যাচ্ছে। দুটো চরিত্রকে সমানে উপস্থাপন করেছেন। হেমাঙ্গিনী ও কাটা সাপ।
গল্পের শেষ কাব্য রেশ হিসেবে থাকলো, ‘… সেই ঘুমের ভেতর হেমাঙ্গিনী জেনে গেলো, কাটা উরঙ্গের মুণ্ডুটা, হেমাঙ্গিনীর মাথা থেকে পা পর্যন্ত এক পাক ঘুরে, জাজ্বল্যমান খুপরি ছেড়ে বেরিয়ে গেলো নিঃশব্দে।’
আমার পাঠকর্ম থেকে সরল একটা প্রশ্ন উত্থাপন করি। তা হলো, আমি কি পেতে চাইলাম তার গল্পে? কী পেলাম?
মন্দ বাতাসে মৃদু সত্য ঘুরপাক খায়। দাঁড়াতে পারে না। সত্য অনেক কঠিন। কঠিন ভাঙাও যায় না। তবে দৃঢ় হলে তাকে অটল করে তোলা যায়। গল্পে ঘটনা, আমি কোনো ঘটনা চাইনি। কাহিনি, টুপ টুপ করে বলে যাওয়া। আমি তা চাইনি। ঠিক ঘটনা কিংবা কাহিনি বলে যাওয়ার গল্প সেলিম মোরশেদ লেখেননি, এটাই স্বস্তি। এখানে অলংকার দিয়ে সমাজ থেকে কলুষ দূর করার প্রয়াস।
আমি চেয়েছি রুচির অলংকার গলে পরে আলোচ্য গল্পগুলো পাঠকের কাছে থাকুক। সেই পাঠকেরও কিছু গল্প পড়তে পড়তে রুচি তৈরি হয়। ধরুন এমন পাঠক আগে কোনো গল্প পড়েনি। সেলিম মোরশেদের গল্প পড়ে রুচি তৈরি হলো। এই রুচিকে বিচার করতে করতে যে ভবিষ্যৎ পাঠ নির্ধারণ করবে। আগ্রহ জন্মাবে। এই রুচির বিন্যাসটা সেলিম মোরশেদের গল্পে বিদ্যমান। যারা পড়তে পড়তে তার দ্বারে আসবেন, ঠকবেন না। সমাজ সন্নিবিষ্ট মানব উজানে গড়া তার গল্প চিন্তা।
সম্পর্কচর্চার বিশিষ্ট মাধ্যম হয়ে যায় গল্প। সেই সুতোয় হৃদয়বত্তায় প্রসার ঘটে। মনে মনে মিলন ঘটে পাঠক ও লেখকের। ব্যক্তি ও সমাজের, প্রকৃতির সংকট, পরিবর্তিত পরিস্থিতির কাছে বা সাথে লড়াইকে দাঁড় করানো এই গল্পের আবির্ভাব। সেলিম মোরশেদও এই বিংশ ও একবিংশ শতাব্দীর সংযোগ স্থলে এমন এক গল্পের পরিমণ্ডল হাজির করেছেন, তা আশ্চর্যের।
একটা মেয়ের কথা। সরাসরি সমাজের সাথে সভ্যতার পরিচয় বহন করে নারী। পঙ্ক্তি ভেঙে ভেঙে যে শব্দছবি এই গল্পে নেমে এলো, তা লেখকের দূরদর্শি ছন্দ। ‘নীল চুলের মেয়েটি যেভাবে তার চোখ দুটি বাঁচিয়েছিল’ গল্পে, ‘নীল চুলের একটি মেয়ে— এতো নীল তার চুল যে দূর থেকে কালো বলে মনে হয়— পরদিন সকালে এসে ছুটতে ছুটতে সবাইকে জানায়— যুবকটির লাশ কবর দিতে নিয়ে গিয়েছিলো ভোর বেলা, সেখানে গিয়ে সেই লাশটি কেউ দেখেনি— কেবল তাজা রক্তের একটি দীর্ঘ ধারা এগিয়ে গিয়েছে বহুদূর পর্যন্ত; তারা এর কোনো কারণ শনাক্ত করতে না পেরে ফিরে এসেছে।
সারা শহরে— এই সংবাদে— বিস্তর প্রতিক্রিয়া শুরু হয়। শহরের অধিবাসীরা তখন উপাসনাকেন্দ্রে গিয়ে দ্যাখে মেয়েটির কথা অবশ্যই সত্য। তারা সদলবলে রক্তের ধারা অনুসরণ করতে শুরু করে এবং দীর্ঘ কয়েক মাইল পাড়ি দিয়ে এক নির্জন প্রান্তে গিয়ে পৌঁছায়— যেখানে রক্তের ধারা থেমে গিয়েছিল।
প্রথমে তারা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে; এবং অবশেষে সবাই ঠিক করে, যে জায়গায় রক্ত বিন্দু স্থির হয়ে গিয়েছে— সেখানে সদলবলে অবিলম্বে একটি গর্ত খুঁড়বে।
নীল চুলের মেয়েটি এই কাজে মুখ্য ভূমিকা রাখে।’
মেয়েটি রহস্যময় দিনের জন্য অপেক্ষায় ছিল। শহরময় এই চাঞ্চল্যকে নিয়েই মেয়েটি অন্ধ হয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু সে অন্ধ হতে চায় না। যেকোনোভাবে দেখতে চায়। পৃথিবীর তাবৎ শক্তির বিনিময়ে।
একটা অচীন আলোকরেখা ধরে হাঁটতে হয়েছে। পথে পথে নানা অচেনা স্টেশন, কিন্তু চরিত্রগুলো সব চেনা। চরিত্রে জীবনস্রোত মোহগ্রস্ত করে তোলে। মানুষের স্বভাবে কত বিচ্ছিন্ন, কত সংকীর্ণ, কত দুর্বল দিক থাকে, তা যদি গল্পে ধুয়ে নিতে হয়। তাও সম্ভব। সেলিম মোরশেদ পেরেছেন। গল্পে তার বাক্য ও শব্দ প্রয়োগ করা, কথা বলার ভঙ্গিতে রয়েছে কাব্যময় গতি। কনটেন্টকে ক্রমান্বয়ে মজবুত রাখে এই গদ্যঘোর। তিনি চিন্তাশীল সংগতিকে পাঠকের কাছে রেখেছেন। পাঠকও ভাবুক।
এভাবে পাঠক অজ্ঞাতসারে অন্যরকম অভিজ্ঞতায় প্রবেশ করেন। সেলিম মোরশেদের গল্প পড়ার অনুভূতি:
- সুখের সংহত, সংযম কিংবা অসীম স্পষ্ট হয়ে যায় বর্ণনা শৈলীতে। রোমাঞ্চকর অনুভূতিতে ভাবনার তাৎপর্যে গল্পরস চালনা করেছেন।
- দুঃখবোধ টানটান ছায়াপাঠের গভীর দৃশ্য, মনের মধ্যে গেঁথে যায়। হৃদয় নিংড়ানো ব্যাপক এই বোধ।
- বাদ-প্রতিবাদে তিনি সব সময় মুখর থেকেছেন, কোনো রকম অবহেলা বা বঞ্চনাকে ছাড় না দিয়ে নিজস্ব ভাবনায় তুলে রাখেন।
- তার বিদ্রুপের জায়গাগুলো তীক্ষ্ণ ও স্নিগ্ধ রসিকতায় পূর্ণ।
- ভয়কে স্থূল না করে চরম পর্যবেক্ষণে মাত্রা দিয়েছেন।
- আনন্দ কিংবা উল্লাসকে সৌজন্যমূলক পটে না ফেলে অভিশপ্ত জীবনকে যেন খোলস থেকে মুক্তি দিলেন।
- বৈচিত্র্য দিয়ে গল্প বলার কৌশল দেখিয়েছেন নিরীক্ষাপ্রবণ প্রায় সকল গল্পে।
- রাজনৈতিক সপ্রাণ বেশ মুখর থাকেন, সবসময় সরব, কলকণ্ঠের উচ্ছল যেন পাঠক মনে দোল দিয়ে যায়।
- মনস্তাত্ত্বিক গল্পগুলি মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্কের মূল্যহীন অনুভূতি। চমকে ওঠার মতো বোধ, অবিস্মরণীয়। মানবিক হয়ে যাওয়া মুহূর্তগুলো কতটা এগুলো। পৃথিবীর রূপকল্পনায় গল্প চিত্ত জয় করে নিল।
সম্পর্কচর্চার বিশিষ্ট মাধ্যম হয়ে যায় গল্প। সেই সুতোয় হৃদয়বত্তায় প্রসার ঘটে। মনে মনে মিলন ঘটে পাঠক ও লেখকের। ব্যক্তি ও সমাজের, প্রকৃতির সংকট, পরিবর্তিত পরিস্থিতির কাছে বা সাথে লড়াইকে দাঁড় করানো এই গল্পের আবির্ভাব। সেলিম মোরশেদও এই বিংশ ও একবিংশ শতাব্দীর সংযোগ স্থলে এমন এক গল্পের পরিমণ্ডল হাজির করেছেন, তা আশ্চর্যের।