:
Days
:
Hours
:
Minutes
Seconds
Author Picture
নাসরীন জাহান

কথাসাহিত্যিক

সেলিম মোরশেদ: স্মৃতিময়তার তুমুলে ভরপুর
শিল্পকর্ম: নির্ঝর নৈঃশব্দ্য

সেলিম মোরশেদ: স্মৃতিময়তার তুমুলে ভরপুর

আশির দশকে আমার শিল্প চর্চার কমিটমেন্টের, সততার ও নিরীক্ষাপ্রবণতার আন্তরিক সমর্থক ও আমার অনেক কাছের বন্ধু, আমার অনেক অনেক প্রিয় একজন মানুষ সেলিম মোরশেদ। তাকে ও তার লেখা নিয়ে ঐ সময়ের, এ সময়েরও অনেক সমৃদ্ধ লেখক তাঁদের সৃষ্টিশীল ও মেধাপূর্ণ প্রয়াসে তার সাহিত্যজগতের ঋদ্ধতাময় ডিটেইল নিয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খ আলোচনা, রিভিউ বা প্রবন্ধ লিখে তার যোগ্যতম প্রতিভাকে সম্মানে ভূষিত করেছেন।

সম্পাদক বিজন অরণ্যের অনুরোধ, আমিও যেন তাকে নিয়ে বা তার লেখা নিয়ে কিছু লিখি। আমি দুমাস ধরে আমার বুকে কষ্ট পুষে অপারগতার অক্ষমতার কথা যুক্তিপূর্ণ বাক্যে জানিয়ে গেছি। আমার নিশ্চিত প্রত্যাখ্যানে একেবারেই হাল না ছেড়ে, নিরন্তর তাগাদা দিয়ে গেছেন তিনি একটু যেন কিছু লিখি। এই জীবনে কেউ এমন অনুরোধ নিয়ে লেগে থাকা দুর্মর প্রত্যাশায় অটুট থাকতে পারে তা আমার জানা ছিল না। আমার কাছের বন্ধু এবং লেখক সেলিম সম্পর্কে আমার কী অনুভব তা জানে বলেই বিজন অরণ্য বারবার বলছিল, আপনার লেখা না থাকলে আয়োজনটি অসম্পূর্ণ থাকবে।

এতো কাছের মানুষ, প্রিয় লেখক, অনেক স্মৃতিময়তার তুমুলে ভরপুর বন্ধু সেলিমকে নিয়ে লিখতে কেন আমার এতো প্রত্যাখ্যান? আমি জীবন শুরু করেছি প্রথমে ছড়া, পরে ছোটগল্প, এরপর উপন্যাস লিখে; একে একে তিনটে সফল মঞ্চনাটক লেখার পরে এখন কবিতা লেখায় আনন্দ পাচ্ছি। কিন্তু জীবনে হাজার চেষ্টায়ও আমি কোন প্রবন্ধ, কলাম, বুক রিভিউ, অনেক প্রিয় লেখকের লেখা নিয়ে কিছুমাত্র লেখার যোগ্যতা অনুভব করিনি; এই মাধ্যমে আমার লেখক সত্তার দীনতাকে মাথা নত করে মেনে নিয়েছি।

সেলিমের গল্পে কাহিনি থাকে না বললেই চলে। আশির দশকের পুরোটা সময় সে একটার পর একটা তুলনাহীন গল্প লিখে আমাদের অনেককেই মুগ্ধতায় আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। নব্বইয়ের দশক বা শূন্য দশকেও অনেক গ্যাপ দিয়ে দিয়ে প্রকাশিত হলেও সেলিমের রচিত কোন লেখাকেই আমার অসমৃদ্ধ লেখা মনে হয়নি।

তো, এতো প্রত্যাখ্যান করে এখন কলম ধরলাম কেন?

আমি যখন এই বিষয়ে না লেখার সিদ্ধান্তে অনড় অটুট ভাবনাহীন, তখন আমাকে তাজ্জব করে কাবুলিওয়ালা বিজন অরণ্যের শেষ হালছাড়া ফোন। বলল, আমাদের কাজ শেষ। প্রচুর দুর্দান্ত লেখার দুর্মর আলোচনায় সংখ্যাটা অনেক বড় হয়ে গিয়েছে, আর পনেরো দিন পরই প্রকাশিত হবে। আপনি যদি এর মধ্যে কিছু লিখে দেন! তাই আমি তার একেকটা গল্পের কাটাছেঁড়া-অযোগ্য বিশ্লেষণের কাছে না গিয়ে লেখক ও বন্ধু সেলিম মোরশেদকে নিয়ে দু-চার কথা বলে তার যথাযোগ্য সম্মান দেয়ার চেষ্টা করবো।

সেলিম আর আমার আদর্শ ভিন্ন হলেও আমার লেখার শক্তির কারণে মূলত তখনকার ‘সংবেদ’, ‘পেঁচা’, ‘লিরিক’, ‘ড্যাফোডিল’, ‘রূপম’—অর্থাৎ যে সব সংকলনকে মাসপিপল লিটিল ম্যাগাজিন হিসেবে গুরুত্ব দিত সেসব ম্যাগাজিনে এবং বড়কাগজেরও দাপটময় সমান্তরালে ক্রমে ক্রমে জাদুবস্তবতার লেখক হিসেবে এ বাংলায়, ও বাংলারও লিটিলম্যাগে আমার লেখা ছাপা হতে থাকল। সেলিমের মতো অটুট বিশ্বাসে ওখানের সব লিটিলম্যাগে লেখা ছেপে ও বাংলার প্রতিষ্ঠান বিরোধী লেখক হিসেবে পরিচিত হতে থাকলাম। পরে সুনীল শঙ্খ বা আরও অনেক বিখ্যাত লেখক আমার লেখা পছন্দ করে আমার অন্তরঙ্গ বন্ধুর মতো হয়ে ওঠেন। কিন্তু তারপরও আমি কোনদিন দেশ, আনন্দবাজারে লেখা দিইনি। সেলিমের সাথে আগের নিবিড় বন্ধুত্বের দীর্ঘ প্রগাঢ়তা এমনি এমনি হয়নি। আমার এসব অনেক নির্লোভ প্রবণতা সেলিমের কাছেও আমাকে সম্মানীয় করে তুলেছিল। সেলিম মোরশেদরা মূলত ‘সংবেদ’, ‘অনিন্দ্য’, ‘গাণ্ডীবে’ই লিখতো।

আশির দশকে সেলিমের প্রতিটি গল্প কখনও আমি নিজে পড়ে, কখনও সেলিমের মুখে শুনে বিমুগ্ধতায় আচ্ছন্ন হয়ে তার প্রভাবে যথাসম্ভব নিরীক্ষামূলক, যথাসম্ভব ভিন্ন ট্র্যাকের আবহে নিজের লেখালেখিকে আরেকটু সমৃদ্ধ করার চেষ্টা করেছি।

আশির শুরুতেই আমাদের পাড়ায় থাকত কবি সাজ্জাদ শরিফ। আশির দশকের শুধু লিটিলম্যাগে লিখিয়ে নিরীক্ষাপ্রবণ তরুণ লেখকদের এক এক করে বন্ধু হিসেবে পেয়েছি তার মাধ্যমে।

প্রথম দেখায় সেলিমকে একজন গম্ভীর ও কম কথার মানুষ হিসেবে যেই নিজেকে দূরে রাখার কথা ভেবেছি তখন সেলিমের সরল অসাধারণ বিনয়ী হাসি, যার মধ্যে তার ভেতরের অসাধারণ সরলতা বেরিয়ে আসে, তেমনই হাসিতে আমাকে তাজ্জব করে জানাল, আমি ‘রূপমে’ আপনার লেখা পড়ে মুগ্ধ হয়েছি!

আমি সবে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেছি তখন, এ দেশের একমাত্র লেখক আমি যার নিরীক্ষার কাব্যভাষা গল্প। কবি আহসান হাবীবের সম্পদনার বড় কাগজ ‘দৈনিক বাংলা’য় আমার গল্প ছাপা হয়েছে—সে সময়ের অনেক তুখোড় লেখকের যা ছিল স্বপ্নের জায়গা।

এই উদাহরণ দিতে হল, একটা জরুরি কারণে, সেলিম মোরশেদ, পারভেজ হোসেন, কাজল শাহনেওয়াজ, সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ, শহিদুল আলম (যার গদ্যের সাথে আমার গদ্যের তুমুল মিল খুঁজে পেতাম) আরও অনেক তুখোড় লেখক বড় কাগজ সম্পূর্ণ এড়িয়ে শুধু লিটিলম্যাগেই লিখতেন।

এখন আমরা যেসব লিটিলম্যাগ দেখি; আকারে লিটল ম্যাগের মতো হলেও তাতে বড় কাগজের লেখকসহ অন্য অনেক আপসময় লেখকের লেখা ছেপে তাকে লিটিলম্যাগ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। সেলিম মোরশেদকে কেন জানি আমার সব সময় মনে হতো, সে লিটিলম্যাগের নেতৃত্বদান করা লেখক। বড় কাগজের লেখকদের সেখানে বিন্দুমাত্র আশ্রয় দেয়া হতো না।

সেলিমের গল্পে কাহিনি থাকে না বললেই চলে। আশির দশকের পুরোটা সময় সে একটার পর একটা তুলনাহীন গল্প লিখে আমাদের অনেককেই মুগ্ধতায় আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। নব্বইয়ের দশক বা শূন্য দশকেও অনেক গ্যাপ দিয়ে দিয়ে প্রকাশিত হলেও সেলিমের রচিত কোন লেখাকেই আমার অসমৃদ্ধ লেখা মনে হয়নি।

প্রথমে পড়ে দেখলাম সেলিমের ‘কাটা সাপের মুণ্ডু’ অসাধারণ নীরিক্ষাপ্রবণ, ভাষা একটু জটিল—যা তার লেখনির শক্তির গুণে শিক্ষিত—পাঠকের কাছে যা অনেকটা অনায়াস সৌকর্যে গল্পে পরিণত করেছে। ওর আরেকটা দারুণ গুণ, সে যতই কম লিখুক, একটা লেখা থেকে আরেকটা লেখাকে একেবারে ভিন্ন করে ভালো লেখার দক্ষতা থাকা। প্রথম গল্পেই কুপোকাত আমি। পর্যায়ক্রমে সেলিমের কাছবর্তী বন্ধু হওয়ার কারণে আগেই বলেছি, প্রথমে পড়েছি, পরে ওর একান্ত পাঠে শুনেছি। কাহিনি থাকে না, ফলে প্রতিটি গল্পের অবয়ব সমৃদ্ধির প্রগাঢ় ছাপ আমার হৃদয়ে রেখেছে।

তখন পর্যয়াক্রমে তার এক এক অসাধারণ গল্প—‘কাটা সাপের মুণ্ডু’, ‘কান্নাঘর’, পরের সম্পূর্ণ ভিন্ন ট্র্যাকের গল্প—‘নীল চুলের মেয়েটি যেভাবে তার চোখ দুটি বাঁচিয়েছিল’, ‘সখিচান’, ‘বাঘের ঘরে ঘোগ’, ‘সুব্রত সেনগুপ্ত’—মোদ্দা কথা তার চারটে গল্পের বই, যার পর্যাক্রমের নাম ‘কাটা সাপের মুণ্ডু’, ‘রাতে অপরিচিতা গাছে ফুল’, ‘বাঘের ঘরে ঘোগ’, ‘কান্নাঘর’ চারটি অনবদ্য গল্পগ্রন্থের প্রতিটি গল্পই আমি পুঙ্খানুপুঙ্খ পড়েছি এবং সেলিমের পাঠে শুনেছি।

একটা কথা না বললেই নয়, ভূতের গলির ৫০১ নাম্বার বাড়িতে বিয়ে সূত্রে ঢাকায় আসা, আমার প্রিয় কবি আশরাফ আহমেদের সুখের সংসারে থাকছিলাম। সেলিম থাকতো ৫০০ নম্বর বাড়িতে। আমি গভীরভাবে বিমুগ্ধ হতাম, সেও আমার নিরীক্ষাপ্রবণ সুররিয়ালিস্টিক লেখার ভক্ত ছিলো।

এর পর একটু বিস্তার এড়িয়ে জানাচ্ছি, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের লাইব্রেরিয়ান, নিরীক্ষাপ্রবণ সুন্দর গল্পের লেখক, ছোট কাগজ ‘সংবেদ’-এর সম্পাদক পারভেজ হোসেনের সাথে আরও গভীর বন্ধুত্বে জড়িয়েছি। ওর পছন্দের দুর্লভ বই আমাকে পড়তে দিয়ে বিশ্বসাহিত্য সম্পর্কে জানার ঋণে এবং আমার লেখাকে ভিন্ন থেকে ভিন্নতর করার দুর্মর আকাঙ্ক্ষা উপহার দিয়েছিল। একদিন সে আমার গল্পের নীরিক্ষাপ্রবণ জাদুবাস্তবতায় মহামুগ্ধ হয়ে নিয়মের তোয়াক্কা না করে তার সম্পাদিত লিটিলম্যাগ ‘সংবেদে’ ছেপে দেয়। কিন্তু পারভেজ লেখা ছাপলে নীতির ক্ষেত্রে আপসহীন আমার লিটিলম্যাগের লেখক বন্ধুরা এর বিরুদ্ধে তুমুল প্রতিবাদে ফেটে পড়ল।

সেলিম মোরশেদকে বলা যায় লিটিলম্যাগের লেখকদের মধ্যে সবচেয়ে আপসহীন, প্রতিবাদে তার ভূমিকা থাকার কথা সবচেয়ে বেশি, কিন্তু সে সবাইকে হতবাক করে বলে, আমরা কেন বড় কাগজে লিখি না? বড় কাগজ আমাদের নিরীক্ষামূলক আপসহীন প্রবণতার কারণে বাণিজ্যিক বড় কাগজ ছাপে না। কিন্তু নাসরীন একমাত্র ব্যতিক্রম, নিরীক্ষাপ্রবণ অসহজিয়া আপসহীন লেখক, যার লেখা বড় কাগজ ছেপে আমাকে বিভ্রান্তির মধ্যে ফেলে দেয়। ‘সংবেদে’র গল্পটা আমাদের অনেক লিটিলম্যাগ লেখকের লেখার তুলনায় একবিন্দু এক ইঞ্চি নিম্ন পর্যায়ের লেখা মনে হচ্ছে না!

যা হোক, ৫০০ নম্বর বাড়িতে থাকর সময় সবক্ষেত্রে আপসহীন লেখক প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার কারণে সকালে-সন্ধায় সে টিউশনি করে চলত। এরপর থেকে প্রতিদিন দুপুর একটা থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত সে আমাদের বাড়িতে আসত, ‘ম্যাডাম, পা দুটি টেবিলে রাখতে পারি?’ হা হা এমন বিনয়ে উচ্চারণ করত, প্রতিত্তরে আমাকে হাসতে দেখেই লম্বা দু-পা কাচঢাকা টেবিলে উঠিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে ওপরের যেসব গল্পের নাম নিলাম, তার লেখা সে সব গল্পের অনেকগুলো ছাপার আগেই আমাকে শোনাতো। আমিও আমারটা শোনাতাম। একটু পর পর চায়ের অর্ডারে প্রায়ই আমার গৃহকর্মী বিরক্ত হলেও তা বেশিক্ষণ স্থায়ী রাখতে পারত না।

আমি কোন একটা ভালোলাগার গল্প শুনে বা পড়ে, সাথে সাথে তার চুলচেরা বাক্য, শব্দ আন্ডারলাইন করে বিশ্লেষণ করতে পছন্দ করতাম। ও আসার আগেই আমার নিজের ঘরের কাজ দ্রুততার সাথে শেষ করে রাখতাম।

সেলিমের প্রথম উপন্যাস ‘সাপলুডু’ লেখার সময় আজিজ সুপার মার্কেট নির্মাণ চলছিল, সেখানকার কোন এক জায়গায়, হাইকোর্টের মাজারে, পার্কে ঢোকার মুখের মুদির দোকানে বসে চা পান সহ কত জায়গায় যে ঘুরেছি!

‘সাপলুডু’ উপন্যাসের কিছুটা অংশ আমাকে পড়ে শোনাতো, অসাধারণ ঋদ্ধতার এক্কেবারে ব্যতিক্রমী ভাষার উপন্যাস শুনতাম, আর সত্যি, ভেতরে ভেতরে ঈর্ষায় পুড়ে যেতাম।

একটা গোপন ফাঁস করি, সাপলুডুতে ভাষার কারিশমায় কিছু কিছু বুঝছিলাম, প্রচ্ছন্নে আমার চারিত্রিক প্রবণতা ঢুকে গেছে, পরে সে নিজেই বলল, একটা গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় তোমার সান্নিধ্যের কারণে প্রভাবিত হয়ে তোমাকে নিয়ে সৃষ্টি করেছি।

যাহোক, সেলিমের সাপলুডুতে আমার উপস্থিতির ব্যাপারে সেলিম বলেছিল, কথায় কথায় আমাকে মেধাবী পণ্ডিত বলো, কথায় কোনদিন কোন পাণ্ডিত্য টের পেয়েছ?

তুমি অন্য সবার চেয়ে আলাদা, অনেকের কাছে একটু পিকিউলিয়ার লাগতে পারে, যা আমার লাগে না, আড্ডায়ও তুখোড় মনস্তত্ত্ববোধ তোমাকে ছাপিয়ে ওঠে। পৃথিবীর কাউকে ভিলেন মনে করো না, ভিলেন হওয়ার যৌক্তিক কার্যকারণ বিশ্লেষণ করো।

আমি নিকট বন্ধুদের কাছে শুনেছি, যারা তোমারও নিকট বন্ধু, তারা তাদের পরকীয়া, হস্তমৈথুনের ব্যাপারও নির্বিকার তোমাকে শেয়ার করে।

তোমার বয়স, ২২ কী ২৩ এর মধ্য তুমুল টিউনিংএর জোরালো মিল না থাকলে কি আমাদের ঘণ্টাগুলো ব্যক্তিগত জীবন শেয়ারে, সাহিত্য বিশ্লেষণের তুমুল নৈকট্যে তরতর করে পার হয়ে যায়?

আমার কোন লেখাতে এর প্রভাব পড়া খুব কী অযৌক্তিক?

তুমি লেখায় বিশ্বাসে স্বাধীনতাবিরোধী ছাড়া অন্য অন্য অনেককে কেন ভিলেন হল, এই শেকড়ে গিয়ে তাকে সম্পূর্ণ ঘৃণা করতে পারো না।

মনস্তাত্ত্বিক বিষয় তো যুক্ত আছেই, শৈশবে তুমি রূপকথার আচ্ছন্নতায় নিজের লেখার মধ্যে সেই বয়স থেকেই রূপকের প্রাধান্যকে গুরুত্বপূর্ণ করা অনুভব করেছ। কিন্তু তোমার লেখা বিশ্বাসে কোন মূল চরিত্র পুরুষ কখনও হিরো বা রাজপুত্র হয় না, মূল নারী চরিত্র রাজকন্যা হয় না, অটল নিরপেক্ষতায় তারাও দোষে গুণে মিশ্রিত রক্তমাংসের মানুষ হয়।

নিজের প্রশংসা শোনানোর জন্য এসব বাক্য আমি লিখিনি। আমার মনে হচ্ছিল, সেলিম আমাকে, আমার লেখা নিয়ে এসব বলছে না, তার নিজের লেখায় এসবের হুবহু প্রবণতা থাকে, নিজের স্বভাবেরও।

এজন্য আমাদের স্বতঃস্ফুর্ত ঘণ্টাগুলো ব্যক্তিগত সাহিত্য বিশ্বাসের প্রচুর সহমতে কীভাবে কেটে যেত।

আমাদের সব লেখকের চেয়ে সেলিমের একসময় চূড়ান্ত কষ্টের জীবনের সাথে গভীর বন্ধুত্ব শুরু হয়।

সেলিম মোরশেদকে বলা যায় লিটিলম্যাগের লেখকদের মধ্যে সবচেয়ে আপসহীন, প্রতিবাদে তার ভূমিকা থাকার কথা সবচেয়ে বেশি, কিন্তু সে সবাইকে হতবাক করে বলে, আমরা কেন বড় কাগজে লিখি না? বড় কাগজ আমাদের নিরীক্ষামূলক আপসহীন প্রবণতার কারণে বাণিজ্যিক বড় কাগজ ছাপে না। কিন্তু নাসরীন একমাত্র ব্যতিক্রম, নিরীক্ষাপ্রবণ অসহজিয়া আপসহীন লেখক, যার লেখা বড় কাগজ ছেপে আমাকে বিভ্রান্তির মধ্যে ফেলে দেয়।

এই সবই আমার প্রথম পাঁচটি গ্রন্থ, বের হতে থাকা উপন্যাস ‘উড়ুক্কু’লেখার কিছুদিন আগের ঘটনা। ‘উড়ুক্কু’ বেরোনোর সময়ই সবাই যে যার কর্মজগতে ব্যস্ত হয়ে পড়ায় আরও বেশ ক বছর সেলিমের সাথে যোগাযোগহীন কেটেছে।

চারটা উপন্যাস লিখে আরও ক-টা রচিত ছোটগল্পের বাছাই করা গল্প নিয়ে আমার ‘নির্বাচিত গল্প’ নামের একটা মাঝারি মোটা বই বের হয়। সেই বইটা আমি উৎসর্গ করি জাগতিক দূরত্বের সেলিম মোরশেদকে। নিচে লিখি, ‘যে দর্শনে ভিন্ন কিন্ত সাহিত্য সৃষ্টির ক্ষেত্রে অভিন্ন আমার প্রিয় লেখক।’

দুটো ঘটনা উল্লেখ করি, যদিও প্রথম যেটার কথা বলব, তা আদৌ কতটা তার দুর্বলতা সে ব্যাপারে আমি সন্দিহান, কিন্তু যদি আজ না পারি তার দ্বিতীয় আপসের কথা আমি আগামীকাল উল্লেখ করব।

পাগলাটে স্বভাবের মানুষ সম্পদক-লেখক আন্ওয়ার আহমদ সবচেয়ে দীর্ঘদিন ধরে প্রকাশ হওয়া লিটিলম্যাগ ‘রূপমে’ আমার অনেক লেখা ছেপেছেন মুগ্ধতা নিয়ে। বড় কাগজের লেখকদের লেখা ছাপলে সেটাকে তখন লিটিলম্যাগ হিসেবে গৃহীত হতো না, কিন্তু তাঁর বিশ্বাসে তা লিটিলম্যাগই ছিলো। একবার আন্ওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন আশির দশকের বিশেষ করে লিটিলম্যাগের লেখকদের নিয়ে একটা সংকলন বের করবেন। কিন্তু তাঁর কড়া শর্ত ছিলো, আমি লিটিলম্যাগ না বড় কাগজের লেখক, এর ধার না ধেরে তাঁর বিশ্বাসে ঋদ্ধ হিসেবে আমার লেখাও ছাপবেন।

তখন ন’দশটি লিটলম্যাগের তুখোড় লেখক আমার যুক্ততার ব্যাপারে একদিকে ছিল বিরোধ, অন্যদিকে সংকলনটা যাতে অবশ্যই বের হয় তা চওয়া ছিল প্রগাঢ়ভাবে। এই ঘটনা আমাকে স্বপ্নভঙ্গের কষ্টের মুখোমুখি করেছিল।

একদিন অনেক কাছের মানুষ প্রিয় লেখক বন্ধু পারভেজ হোসেন জানালো, মহা উদার মনের মানুষ ও লেখক যাদের গুণবান হিরো মনে করতাম তারা আমার লেখা যুক্ত থাকবে কি থাকবে না এ নিয়ে ভোটাভুটির আয়োজন করেছে। তারা সব লিটলম্যাগের লেখক।

সত্যি বলছি, তখন এক মুহূর্তের জন্য হলেও লিটলম্যাগের লেখকদের লিটল হার্টের লেখক মনে হয়েছিল।

পারভেজ জানত, সে আর সম্ভবত সেলিম আমার পক্ষে ভোট দিতে পারে, তখন পারভেজকে কড়া নির্দেশ দিলাম, প্লিজ আমাকে ভোট দিয়ে আমার অপমানের ভার বাড়িও না।

যথারীতি ভোটাভুটি শুরু হলো। শুনলাম, এ ব্যাপারে নির্বিকার সেলিম মোরশেদ সহ বাকি সব লিটিলম্যাগ লিখিয়েদের ভোটে আমি শূন্য নাম্বার পেয়েছি।

ওরা সব লেখা এক করে আন্ওয়ার ভাইয়ের হাতে দিলে উত্তেজিত হলেন সম্পাদক, কেন তাঁর মতে গুরুত্বপূর্ণ লেখক আমার লেখা নেই!

এই প্রশ্নের উত্তরে তারা ভোটাভুটি করেছেন শুনে পাগলাটে স্বভাবের নিরন্তর উত্তেজিত আন্ওয়ার ভাই বলেছিলেন, তোমাদের ভোটাভুটির গুষ্টি কিলাই। আমি এ সংকলন বের করব না। মুহূর্তে সব আয়োজন নস্যাৎ হয়ে গেলো, সংখ্যাটি বেরোলো না।

এরপর ‘উড়ুক্কু’র অনেক আগে আমার প্রথম গ্রন্থ বেরোনোর পরই আমার বহুদিনের প্রিয় সম্মানীয় বিখ্যাত কথাশিল্পী সেলিনা হোসেন পত্রিকায় আমার লেখা পড়ে মুগ্ধতায় সীমাহীন ভালোলাগায় আমার খোঁজ করতে থাকেন। এরপর থেকে আমার ব্যক্তিগত ও লেখক জীবনের খ্যাতির পেছনে উনার ব্যাপক ভূমিকার নিরন্তর ঋণের কথা বলতে গেলে মহাকাব্য হয়ে যাবে।

একসময় বাংলা একাডেমির পরিচালক সেলিনা আপা একাডেমি থেকে বেরোনো আশির দশকের ভালো লেখকদের গল্প নিয়ে ‘আশির দশকের গল্প’ সম্পাদনার দায়িত্ব দিলেন। এসবই ‘উড়ুক্কু’র অনেক আগের ঘটনা, আমি লিটিলম্যাগের প্রায় সব ভালো লিখিয়েদের সাথে বড় কাগজের অনেক লেখককে সমান গুরুত্ব দিয়ে গল্প বাছাই করলাম।

অল্প বাক্যে বিশাল অফসোসের কথা না বললেই নয়, শৈশব কৈশোরের প্রাণবন্ধু তখনই নিরীক্ষা প্রবণতার সমৃদ্ধ গল্প লিখে লেখক হিসেবে আমাকে প্রেরণায় উদ্ধুদ্ধ করে গেছে। সে হঠাৎ ঢাকা ভার্সিটির স্বপ্ন ত্যাগ করে ময়মনসিংহেই এমএ করে মনে হচ্ছিল, সাহিত্য থেকে দূরে গিয়ে এনজিওর চাকরিতে ঢুকে গেল, আমার একার সিদ্ধান্তে এই প্রথম ওর লেখা সম্পর্কে অজানা সেলিনা আপা এড়িয়ে যেতে বললেন। পরে সে দুর্মর গতিতে, এখন অদ্ভুত ঋদ্ধময় গদ্যের পর গদ্য লিখে পাঠককে সমৃদ্ধ করে যাচ্ছে।

কিন্তু তখন তাকে ত্যাগ করে আমি বাছাই শেষ করলে সেলিম বলল, বড় কাগজের লেখক কেন? শুধু লিটিলম্যাগের লিখিয়েদের লেখা নিয়ে সংকলন করা যায় না?

তার এই বোকা প্রশ্নের উত্তরে বললাম, কী বলছ? একাডেমি থেকে বেরোনো সংকলনে সম্পূর্ণ একাডেমিক নিয়মে ছোট বড় সব ভালো লিখিয়েদের লেখাকে সমান গুরুত্ব দিতে হবে।

শুধু সম্পাদক হিসেবে আমি থাকায় বিশাল তালিকায় এতোগুলা লিটিলম্যাগের লেখকদের মানে তোমাদের রেখেছি। অন্য কোন বড় কাগজ লিখিয়ে সাহিত্যিক যদি এটা সম্পাদনা করত, ধারে কাছে তোমাদের রাখত কীনা সন্দেহ।

সেলিম মোরশেদসহ লিটলম্যাগের লেখকেরা সম্পূর্ণ একাডেমির বাইরের আন্ওয়ার ভাইয়ের সম্পাদনার ক্ষেত্রে ভোটাভুটির মতো লজ্জাকর অনুভূতির সামনে আমাকে দাঁড় করিয়েছিল, অন্যদিকে প্রধান অ্যাকাডেমিক প্রতিষ্ঠান বাংলা একাডেমিও তার রুচির বিশ্বাসে অনড় ছিল। একসময় সে সহ বাকি সব লিটিলম্যাগ লিখিয়েরা একশোভাগ একাডেমি থেকে প্রকাশিত সংকলনে খুশি খুশি যুক্ত হল।

সেলিমের একমাত্র বড় আপস বাংলা একাডেমি থেকে আমার সম্পাদিত একাডেমিক, প্রাতিষ্ঠানিক জায়গায় তার লেখা প্রকাশের অনুমতি দেয়া। সেলিমের এই আপসে আমি অনেক বিস্মিত হলেও, তার লেখা প্রাপ্তিতে আমার ভালোই লাগছিল।

সেই সংকলনের ভূমিকায় সব লেখক সম্পর্কে এক বাক্যে তাদের গুরুত্ব বোঝাতে চেয়েছি, সেখানে সেলিম সম্পর্কে একাধিক মুগ্ধময় বাক্যে তাকে মূল্যায়ন করার চেষ্টা করেছি।

যুগে যুগে কোন নতুনই তার কালে গ্রহণযোগ্য হয়নি। সে বিচারে এই দশকের স্বল্প লিখিয়ে, নির্মোহ গদ্যের ধারকদের সম্পর্কে এখন কোনো রকম মন্তব্য না করাই উচিত। এরপরও কয়েকজন গল্পকারের গল্পের প্রবণতার অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত উল্লেখ না করলে চলছে না। সেলিম মোরশেদ এই দশকের একজন নিরীক্ষাপ্রবণ অন্যতম নির্মোহ গদ্যকার। কর্কশ, রূঢ় বাস্তবতা তাঁর কলমে ভিন্ন কণ্ঠস্বরের মধ্য দিয়ে মূর্ত হয়ে ওঠে।

এইবার শেষ নাগাল টানি, একসময় আমি লক্ষ্য করলাম, ধারাবাহিকভাবে প্রায় সব লিটিলম্যাগ লিখিয়েরা বড় কাগজের আশ্রয়ে চলে গেছে।

একমাত্র সেলিম মোরশেদ হারাধনের একটি সন্তান হিসেবে একটা বিচ্যুতি ছাড়া আজীবন অপ্রাতিষ্ঠানিক, লিটিলম্যাগ লিখিয়ের ভূমিকা থেকে এককণা সরে যায়নি।

এ জন্য সেলিমকে স্যালুট।

‘গাণ্ডীব’, ‘সংবেদে’র লেখক সেলিম জাগতিক কারণে যশোরে দীর্ঘসময়ের বাসিন্দা হয়েছিল, সেখানেও সে থেমে থাকেনি।

যশোর থেকে প্রকাশিত একশোভাগ লিটিলম্যাগ ‘প্রতিশিল্পে’ সে একের পর এক সমৃদ্ধ লেখা উপহার দিয়ে যাচ্ছিল। যেভাবেই হোক, আমি সেই প্রতিশিল্প সংগ্রহ করি (তথ্যগত ভুল হলে পাঠক আমার স্মৃতিভ্রষ্টতাকে প্লিজ ক্ষমার চোখে দেখবেন)। সম্ভবত ‘প্রতিশল্পে’ই তার প্রতিভার বহুমুখী অনবদ্য গদ্য সম্পর্কে জানার সুযোগ ঘটেছিল।

তার কবিতাগ্রন্থ ‘দাঁড়িয়ে অতৃপ্ত রোদ’, গদ্য ‘পাল্টা কথার সূত্রমুখ অথবা বুনো শোয়োরে গোঁ’, ট্রাভেলগ/ প্রবন্ধ ‘অমায়িক খচ্চর’। জীবনের হাজার বিপর্যয়ের মধ্যেও একটু গ্যাপ দিয়ে দিয়ে এখনও তার দর্শন বিশ্বাসে অনড় থেকে নিজেকে ঋদ্ধতাপুর্ণ চালু লেখক হিসেবে চুজি পাঠকদের কাছে অনেক সম্মানীয় মর্যাদার স্থান করে নিয়েছে, নিচ্ছে। এরপরও এখনও হয়তো তার সৃষ্টিকর্মের সীমাহীন দক্ষতার সাথে অনেক ঋদ্ধ পাঠকের পরিচয় ঘটেনি। মেধাপূর্ণ সেলিমের গল্প-উপন্যাস এবং অন্যান্য রচনা নিয়ে প্রত্যেকে বিশ্লেষণময় শব্দে বাক্যে সঠিক মূল্যায়ন করেছেন। সেসব লেখার পাশাপাশি  আমার সহজিয়া বাক্যে স্মৃতিচারণের মধ্য দিয়ে দুর্দান্ত ভিন্নট্র্যাকের এই লেখকের চূড়ান্ত আপসহীন সত্তাকে আমার সাধ্যে যদ্দুর কুলিয়েছে আমি আমূল সম্মান জানানোর চেষ্টা করেছি।

চৌকস নীরিক্ষাপূর্ণ কবিতার কবি আমার জীবনসঙ্গী আশরাফ আহমদ প্রথম দু-তিন বছর আমার মতোই তার লেখায় আমূল ডুবে থাকত। এরপর ক্যারিয়ারকে প্রাধান্য দিয়ে দিনরাত চাকরিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ায় দীর্ঘ সময়ের বিরতি পড়ে তার। কিন্তু সেই সময়ও দীর্ঘরাত জেগে আমার লেখার সুযোগ ঘটিয়ে যায়। নিজের লেখায় বিরতি দিয়ে দিয়ে পরে আরও তিনটে বই যুক্ত করে  নির্বাচিত কবিতার বই বের করে। ছেলেমেয়ের আড্ডার ব্যাপারে আশরাফ আর আমি দুজনই দুজনের ক্ষেত্রে উদার আজীবন। কবিতাচর্চায় লিপ্ত থাকার প্রথমদিকে এক সময়ের সম্পাদক হিসেবে ‘স্বকাল’ নামের লিটিলম্যাগ বের করা কবি আশরাফ আহমদও সেলিমের লেখা, দর্শন-আদর্শকে এবং ব্যক্তি মানুষ হিসেবে সেলিম মোরশেদকে অনেক পছন্দ করত, সম্মান করতো।

পরিশেষে কথাসাহিত্যিক সেলিম মোরশেদকে নিয়ে এরকম একটি মোটা সংকলন বের করার জন্য সম্পাদক বিজন অরণ্যকে অনেক অনেক অনেক সাধুবাদ।

Meghchil   is the leading literary portal in the Bengali readers. It uses cookies. Please refer to the Terms & Privacy Policy for details.

error: Content is protected !!