দেলোয়ার হোসেন মঞ্জু স্মরণ
আমি ও গেওর্গে আব্বাস ৪
আগে পড়ুন- আমি ও গেওর্গে আব্বাস ৩
মঞ্জুভাই আমার চেনা সব থেকে প্রচারবিমুখ আর পুরস্কারবিমুখ কবিদের একজন। তিনি আড়াল পছন্দ করতেন কাজ করার জন্যে। প্রথমে ছদ্মনামের আড়াল। তার বেশ কয়েকটা এমন নাম ছিলো। যথা মঞ্জু মিস্ত্রাল, গেওর্গে আব্বাস, রহিমা ট্রাকল, সকিনা আফ্রোদিতি, মেহেকা আন্দ্রিলা ইত্যাদি। এইসব নামে তিনি তার অন্যটাইপ কিংবা আন্ডাররেটেড লেখাগুলি লিখতেন। অভিজিৎ কুণ্ডু নামেও তিনি কবিতা লিখেছেন। তিনি প্রথম ছোটোকাগজ বের করেছিলেন ১৯৮৬/৮৭ সালের দিকে। খুব সম্ভবত নাইন-টেনে থাকতে তিনি ‘বসুন্ধরা’ নামে একটা ত্রৈমাসিক সাহিত্যের কাগজ করেছিলেন। তার সঙ্গে ছিলেন অগ্রজ বন্ধু কবি কিশওয়ার ইবনে দিলওয়ার। এটা সম্পর্কে তিনি বলেছিলেন মনে আছে, ‘প্রচ্ছদের জন্য কাঠের ব্লগ তৈরি করতে আমার বাড়ি থেকে পশ্চিমে পঁচিশ মাইল আর ছাপানোর জন্যে পূর্বদিকে আরো আঠারো মাইল যেতে হতো…।’ যাইহোক তার অনেক পরে তিনি বের করেছিলেন ‘ধীস্বর’ নামে একটা ছোটো কাগজ। সম্পাদকের নাম ছিলো মঞ্জু মিস্ত্রাল। পরের সংখ্যা ‘ধীস্বর’ তিনি দেলোয়ার হোসেন মঞ্জু নামেই করবেন ঠিক করেছিলেন। ‘ধীস্বর’ একটা সংখ্যা বের হয়েছিলো। সে এক অনন্য সম্পাদনা। এখনকার বাজারি বিজ্ঞাপনভর্তি দুইকেজি ওজনের লিটলম্যাগের মতো নয়।
তো তার ছদ্মনামগুলির মধ্যে ‘মঞ্জু মিস্ত্রাল’ নামটা সম্পর্কে আমাকে বলেছিলেন মনে আছে, ‘ধীস্বর’ আমি বের করি একপ্রকার কবি-লেখক বন্ধুদের প্ররোচনায়। আমি তো সম্পাদক হতে চাইনি কখনো। কিন্তু হতে হলো। আর প্রথাগত কারণে সম্পাদকের একটা নামের দরকার পড়ে। একদিন গভীর রাতে হঠাৎ করেই মনে পড়ে গেলো কবি গাব্রিয়েলা মিস্ত্রালের কথা। পৃথিবীতে কবিরূপে মিস্ত্রাল আছেন দুইজন। দুজনেই ফরাসি। একজন গাব্রিয়েলা মিস্ত্রাল, অন্যজন ফ্রেডেরিক মিস্ত্রাল। তো আমি কী করলাম, ম এর সঙ্গে ম-এর বন্ধন ঘটিয়ে তৃতীয় মিস্ত্রাল-এর জন্ম দিলাম। তারপর যেনো বুক থেকে পাথর নেমে গেলো। জন্ম হলো মঞ্জু মিস্ত্রালের।’
তিনি একবার আমাকে বলেছিলেন সম্ভবত এই রকম, ‘কিশওয়ার মারা যাবার পর ভাব ও ব্যবহারে আমি একজন কবির সন্ধানে ব্যাকুল হয়ে পড়ি। আমি যেনো সবার মধ্যে কিশওয়ারকেই খুঁজি। কোথাও তাকে পাই না, কোথাও তো কবি পাই না!’
ছদ্মনামের পরেও মঞ্জুভাই নিজের প্রিয়তম মানুষদের সামনে রেখে নিজেকে আড়াল করে মূল কাজ তিনি করতে পছন্দ করতেন। তিনি একবার আমাকে বলেছিলেন সম্ভবত এই রকম, ‘কিশওয়ার মারা যাবার পর ভাব ও ব্যবহারে আমি একজন কবির সন্ধানে ব্যাকুল হয়ে পড়ি। আমি যেনো সবার মধ্যে কিশওয়ারকেই খুঁজি। কোথাও তাকে পাই না, কোথাও তো কবি পাই না!’ এই যে বাঙলা অ্যাকাডেমি ইউকে, আর এর মুখপত্র ‘রক্তকরবী’, কবি দিলওয়ার স্মারক ‘দিলওয়ার মঙ্গল’ সবই প্রকৃত অর্থে মঞ্জুভাই করেছেন। এই বিষয় আমি জানি কারণ ‘রক্তকরবী’ দুইটা সংখ্যা এবং দিলওয়ার মঙ্গল ৯০ ভাগ কাজ (৩০ ভাগ লেখা সংগ্রহ, এডিটিং, প্রুফরিডিং, সেটআপ, প্রচ্ছদ-সহ প্রেসে নিয়ে ছাপিয়ে কাঁধে করে নিয়ে কার্ডিফে সম্পাদকের ঠিকানায় কুরিয়ার করা) আমি করেছি। ‘রক্তকরবী’ তৃতীয় সংখ্যার অধিকাংশ লেখাপত্র এখনো আমার কাছে। যেটা বের হওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু মঞ্জুভাই অসুস্থ হওয়ায় করা হয়নি। শুধু প্রিন্টিং-এডিটিং-এর বিষয় নয়, ওইসবকে ঘিরে লন্ডনে যতো প্রোগ্রাম তার ক্রেস্ট, টিকিট, সনদ, পদক-সহ সবকিছুর ডিজাইন নিয়মিত আমি করে দিয়েছি।
আপনারা কী ভাবছেন, আমি টাকার জন্যে বা তৃতীয় বাঙলার সাহিত্য উদ্ধারের জন্যে বা সম্পাদকের অনুরোধে এইসব কাজ করেছি? না, সেটা আমি কখনোই করিনি বা করতে পারি না। আমি করেছি মঞ্জুভাইয়ের জন্যে। যেইসব কাজ আমি নিজে করেছি মানে মঞ্জুভাইয়ের নিজের বই এবং বাঙলা অ্যাকাডেমি ইউকে এর কাজ যথা বইয়ের প্রচ্ছদ প্রুফ রিডিং, এডিটিং, সেটআপ-মেকআপ, ইলাস্ট্রেশন, ডিজাইন এইসব কাজের জন্যে কখনোই মঞ্জুভাইয়ের কাছ থেকে কোনো টাকা পয়সা দাবি করিনি। তিনিও দেননি। কেবল ‘রক্তকরবী’ ও ‘দিলওয়ার মঙ্গল’-এর ছাপার খরচটা সম্পাদক আমার ব্যাংকে পাঠিয়েছিলেন। সেটা একেবারেই প্রিন্টের খরচ, ওটার মধ্যে অন্য কোনো প্রকার খরচ ছিলো না। অথচ মঞ্জুভাইয়ের প্রাণের বন্ধুদের একজন তার তিনচার ফর্মার কবিতার বই ছাপিয়ে ছাপার খরচের তিনগুণ টাকা নিয়েছিলো কোনোদিন এমন কথাও তিনি একদিন আমাকে বলেছিলেন।
অবশ্য মঞ্জুভাই আমাকে একবার আমাকে বলেছিলেন, ‘নির্ঝর, এই যে আপনি আমাদের কাজ করে দেন, এর জন্যে আমরা ঠিক করেছি বাঙলা অ্যাকাডেমি ইউকের পক্ষ থেকে প্রতিবছর আপনাকে কিছু সম্মানী দেবো।’ আমি বললাম, ‘কী যে বলেন মঞ্জুভাই, আমি তো কতো কাজই লোকজনকে এমনিতেই করে দিই। অনেকে টাকা পয়সা দিবে বলেও দেয় না। আর আপনার কাজ তো আমি করি ভালোবেসে, আনন্দ নিয়ে করি। আমাকে কিছু দেয়া লাগবে না। অবশ্য আপনি মরে গেলে আপনার অ্যাকাডেমির কোনো কাজ আর আমি করবো কিনা বলতে পারছি না…।’ যাই হোক এরপর আর তিনি কথা বাড়াননি।
দুঃখ এই যে মঞ্জুভাইয়ের মৃত্যুর পরও তার প্রতি অন্যায় হলো। তার মৃত্যুপরবর্তী স্বজন ও অনুরাগীদের যে শোক, বেদনা আর কান্না সেটাও বিভাগ হয়ে গেলো। পৃথিবী আসলেই একটা তামাশার জায়গা।
(ক্রমশ)
আরও পড়ুন-
● আমি ও গেওর্গে আব্বাস ১
● আমি ও গেওর্গে আব্বাস ২
● ক্যান্সার আক্রান্ত অকবিতা