স্বর্গীয় শৈশব
সাদা পাজামা আর নীল পাঞ্জাবির আকাশি হুজুর
আব্বার বুড়ো আঙুল ধরে হাঁটছি। ছোট ছোট পা-গুলো হেলেদুলে হাঁটছে। আমি আজও যেন দেখতে পাচ্ছি! কী অবাক কাণ্ড। সেই মাটির রাস্তা। বেলে মাটির। কালীবাড়ির মাঠ। মা আমাকে গুছিয়ে দিলেন। আমি আর আব্বা ফজলু চেয়ারম্যানের বাড়ির ছোট ছোট লেবুগাছের মধ্য দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি। লেবুর পাতায় এমন গন্ধ ক্যান, আব্বা? আমার চরম আগ্রহ তাদের নিশ্চয়ই আনন্দ দিয়েছিল সেদিন। একটা কালো শ্লেট। একটা সাদা চক। আর কী একটা ছিল আমার হাতে। আব্বা কখন যে আমার হাত থেকে ছোঁ মেরে সেটা নিলেন, জানিই না। মনে হয় এখনো আমার হাতে শ্লেট আছে। খড়িমাটি আছে। আমিও সেই ছোট্টটি রয়ে গেছি! কালীবাড়ির মাঠ পাড়ি দিচ্ছি আব্বা আর আমি। প্রথম স্কুল। বড় দিঘিটা পার হয়ে পাঁজিয়া বাজার। এই দিঘিতে বড় মাছ আছে কিনা? কলাপাতা কেন মাছে খায়? পানি কেন সবুজ হয়ে গেছে? বাজার এত বড় হয়? এত মানুষ? আমি কখনো এত মানুষ দেখিনি। অসংখ্য প্রশ্ন করে আব্বাকে যখন বিরক্তি ধরিয়ে দিয়েছি, তখনই বাজারে পৌঁছলাম বাপ-বেটা।
একটা বড় গরুর রক্তাক্ত শরীর থেকে চামড়া ছিলে ফেলছে কিছু লোক! আমি তো অবাক! আব্বাকে প্রশ্ন করতে যাব, এমন সময় খলচা হাজির। খলচা মানে আব্বার চাচা। আব্বা খলচা ডাকে। আমিও তা-ই ডাকি! ছোটবেলায় আব্বাকে ভাই মনে হতো! ভালো নাম খলিল। সে আমার সাদা পাজামার ভেতরে হাত ঢুকিয়ে দেয়। মানে আমার ছোট্ট নুনুটাকে সে খুঁজেই বের করে। আমি তো হাসি। লোকটাকে আমার খারাপ লাগে না। ভাবি হাসতে মন্দ কি। আমাকে নিয়ে সেই মিষ্টি তামাশা বেশ জমে যায়। এসব কথা মনে হলে আজ শরমে আমিও যেন টক দধির লাহান জমে যাই।
কেমন আছেন, সেই প্রশ্নটা তিনি আমাকে জীবনে যে কতবার করেছেন, আল্লাই মালুম। মা ছাত্র হিসেবে নাকি মেধাবী ছিলেন। লেখাপড়াটা হলো না। ছোটকালেই বিয়ে হয়ে গেল। কত আফসোস শুনেছি মায়ের স্যারদের মুখে। তারপর কেন জানি আমার মায়ের মতো হওয়ার সাধনা পেয়ে বসে। মানে মায়ের মতো সবাই যেন আমার নামও নেয়। এই খ্যাতিই কি আমাকে পেয়ে বসেছে পরবর্তী জীবনে? এই মোহ কিসের মোহ? ঠিক জানি না আমি।
আব্বা আমাকে নিয়ে একটা একচালা ঘরে ঢোকায়। একটা লাল খাতায় নাম ওঠানো হয়। সেখানে আমার একটা হুজুরের সাথে পরিচয় ঘটে। আজ বুঝতে পারি, স্কুলের মোড়কে আমাকে মাদ্রাসায় ভর্তি করা হয়েছিল। ভালোই হয়েছিল। প্রতিটি আঙিনার আলাদা ছায়া। ভিন্ন রকমের রোদ থাকে। আমি যে হুজুরের সাথে পরিচিত হলাম, উনি নুরুল ইসলাম। আমার মায়েরও হুজুর। ফলে আমার কদর বেড়ে গেল। তিনি আমার কালচে এবড়োখেবড়ো মুখটা উঁচু করে ধরে বললেন, তোমার মায়ের নাম কী? আমি খানিকটা পরাস্ত হয়ে বলি, আব্বার নাম মোস্তফা। আর মায়ের নাম ছাবিয়া বেগম। হুজুর আমার মুখের ওপর থেকে মুখ সরিয়ে আব্বার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেন। তাকিয়ে তিনি সেদিন কী বলতে চেয়েছিলেন? সে প্রশ্নের উত্তর আমি আজ জানি।
হুজুরের সাথে গত বছর দেখা হলো। ছেলের মোটরসাইকেলে চড়ে কোথায় যাচ্ছেন। আমি সালাম দিলাম। গাড়ি থামিয়ে আমার ভালোমন্দ জানলেন। যেমনটা সেই প্রথম দিন আমি দেখেছিলাম। এখনো তিনি সে রকম আছেন। বিস্মিত হই। ওনার বয়স এখন ৬৫ বছর। মা কেমন আছেন, সেই প্রশ্নটা তিনি আমাকে জীবনে যে কতবার করেছেন, আল্লাই মালুম। মা ছাত্র হিসেবে নাকি মেধাবী ছিলেন। লেখাপড়াটা হলো না। ছোটকালেই বিয়ে হয়ে গেল। কত আফসোস শুনেছি মায়ের স্যারদের মুখে। তারপর কেন জানি আমার মায়ের মতো হওয়ার সাধনা পেয়ে বসে। মানে মায়ের মতো সবাই যেন আমার নামও নেয়। এই খ্যাতিই কি আমাকে পেয়ে বসেছে পরবর্তী জীবনে? এই মোহ কিসের মোহ? ঠিক জানি না আমি।
প্রথম দিনের সেই আকাশি হুজুর আজও স্কুল বা মাদ্রাসা থেকে যেন ফিরতে পারিনি। ফেরার কোনো স্মৃতি আমার মনে নেই। তার মানে আমি এখনো সেই মাদ্রাসা থেকে, সেই স্কুল থেকে, সেই বিদ্যালয় থেকে ফিরতে পারিনি। বিদ্যা থেকে আর কখনো যেন ফেরা না হয় আমার!