কমলা রকেট : নূর ইমরান মিঠুর ক্যানভাসে বাংলাদেশ
শাহাদুজ্জামান আমার প্রিয় লেখকদের একজন। তাঁর প্রায় সব লেখাই পড়া। থিয়েটার করার সুবাদে তাঁর গল্পগুলো নিয়ে আমরা মহড়ায় অনেক ইম্প্রভাইজেশন করেছি। ২০১৬ এর ডিসেম্বরে তাঁর কালজয়ী উপন্যাস ‘ক্রাচের কর্নেল’ নিয়ে মঞ্চ নাটকও নির্মাণ করেছি। তাঁর গল্প-উপন্যাস এর চিত্রায়ন সহজ নয়। ‘মৌলিক’ ও ‘সাইপ্রাস’ এই গল্প দুটোর চিত্রনাট্যের দৃশ্যায়ন করা প্রায় অসম্ভব কাজ, যেটি খুব সাবলিল ভাবে করেছে নূর ইমরান মিঠু।
কমলা রকেট লঞ্চটিকে কতভাবে দেশের মানুষের পয়েন্ট অফ ভিউ থেকে দেখলাম। আমরা দূর থেকে শুধু একটি লঞ্চই ছুটতে দেখি, এর ভিতরে কি হয় তা কিন্তু দেখিনা। আবার এসব লঞ্চে ভ্রমণ করলেও এর ভিতরে কি ঘটতে পারে তা ভাবি না। ‘কমলা রকেট’ এ নির্দেশক আমাদের কত কিছু দেখালেন। ছোট্ট লঞ্চে কত কাহিনি, আনন্দ বেদনা, ভালবাসা, জীবনকে চেনা, পরিবারের অচেনা মানুষকে নতুনভাবে জানা, অপরিণত সঙ্গম, ক্ষুধা কি করে সব ক্লাসের যাত্রীদের এক কাতারে নিয়ে আসে সেই গল্প, জাহাজের ভেতর বইয়ের ব্যবসার পাশাপাশি যৌনবাণিজ্য, সার্কাস দলের গল্প, কি নেই তাতে। আবার লাশবাহী মানুষের আহাজারির সাথে যিনি তাকে লাশ বানিয়েছেন তার পরিণতি সবই আমরা পাই।
গল্প বলতে চাইনা। শাহাদুজ্জামানের গল্প থেকেও নির্দেশক অনেক নতুন বাঁক সিনেমায় করেছেন, বাংলাদেশের রাজনীতির নিয়ামক কি করে সাধারণ মানুষ তারও ইঙ্গিত আছে সিনেমায়। ছোট ছোট শট দিয়ে কি বিশাল বাংলাদেশের ক্যানভাস এঁকেছেন নূর ইমরান মিঠু। বাহ সাধু!!! সিনেমা দেবার আগে খটকা ছিল, নির্দেশক কি বের হতে পারবেন তাঁর চেনা ভাই বেরাদারদের গণ্ডি মতন সংলাপ ও দৃশ্য নির্মাণে? তিনি পেরেছেন। আমরা নূর ইমরান মিঠুর ন্যারেটিভ পেয়েছি। যা স্বতন্ত্র, ভিন্ন ও নতুন।
প্রত্যেকটি চরিত্র নির্মাণ করেছেন নির্দেশক আপন ভঙ্গিমায়। সবাইকে অনেক বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়েছে। অভিনয় যেন করছেন না, এটাই তাঁর জীবন সেরকম মনে হয়েছে। তৌকির আহমেদ যেন একেবারেই তাজরিন গার্মেন্টসের মালিক যার কারখানায় পুড়ে মারা গিয়েছিলেন শতাধিক গার্মেন্টস শ্রমিক। কি তার অহমিকা! শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত দারুণ ধরে রেখেছেন চরিত্র। তাকে দেখলেই মনে হয়েছে হত্যাকারী, খুনী কিন্তু চেহারা মানুষের মতই, স্বাভাবিক, যেন কিছুই হয়নি। আন্ডারটোন অভিনয়ে তা খুব মানানসই হয়েছে।
মোশাররফ করিম অন্য সব ছবির মতো একি রকম অভিনয় করলেও, এই ছবিতে নির্দেশক তাঁর লাগামটা ধরেছিলেন ভাল করেই। তাঁর উপস্থিতি দর্শককে অনেক আনন্দ দিয়েছে। আগুনে পুড়ে যাওয়া মৃত শ্রমিকের স্বামী হিসেবে জয় রাজের অভিনয় আমাদের বেদানাহত করেছে। তাঁর জন্য পরাণ কেঁদেছে। গাড়ী ব্যবসায়ী ডমিনিক গোমেজ চরিত্রটি ধরেছেন দারুণ। তাঁর স্ত্রীর রুপদানকারী সেওতি অত্যন্ত সহজ ও চমৎকার ফুটিয়েছেন চরিত্রটি। তাঁর শ্যালিকা চরিত্রে সামিয়া সাঈদ একদম এ প্রজন্মের প্রতিনিধিত্ব করেছে। যারা কি ভাবে, কি করে কোন মিল নেই।
এমন লঞ্চের যাত্রায়ও যে প্রেম-যৌনতা খুব স্বাভাবিক একটি ঘটনা, যার প্রভাব কোথাও থাকেনা, এ রকম এলুফ প্রজন্মই তৈরি হচ্ছে দিনকে দিন। যাদের ফ্যান্টাসির কোন শেষ নাই, কনফিউশনেরও কোন কুল কিনারা নাই। গ্লামার ছাড়া কিভাবে গ্লামার ক্যারি করা যায় তা সামিয়া সাঈদের অভিনয়ে আমরা পেয়েছি। খুব অল্প সময়ে সুজাত শিমুল বাংলাদেশের বেকার যুবকদের হতাশা প্রকাশ করেছেন দারুণ।
সিনেমাটোগ্রাফার চিত্রনাট্য আয়ত্ত করেছেন শতভাগ, ক্যামেরার ভাষা চমৎকার, লেন্স ও ফোকাসের ব্যাবহার অসাধারণ, ছোট্ট লঞ্চে কত বাস্তব ব্যাকগ্রাউন্ড নির্মাণ করলেন শিল্প নির্দেশক, পোশাকের ঠিকঠাক আয়োজনে চরিত্রগুলো উজ্জ্বল হয়েছে। ফলি একদম ঠিকঠাক যদিও বিজিএম কোন আবেদন সৃষ্টি করতে পারেনি। এই ছবির একমাত্র দুর্বল জায়গা বিজিএম।এক কথায় সবাই মন প্রাণ ভালবাসা দিয়ে সিনেমাটি করেছেন। কুশীলবদের অভিনন্দন।
সিনেমাটি হলে গিয়ে দেখুন, এক ভিন্ন স্বাদ পাবেন। ভাল লাগবে। নস্টালজিয়ায় ভুগবেন। একটি লঞ্চে সারা বাংলাদেশ পাবেন। নূর ইমরান মিঠুর সিনেমা তাই বাংলাদেশের সিনেমা, আমাদের সিনেমা, আমাদের গৌরব। তাঁর হাত ধরে আরও অনেক সিনেমা নির্মাণ হোক, এই কামনা থাকলো।