‘বনলতা এবং অনেকে’ প্রসঙ্গ বিবরণ
বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের চিত্রশালায় চলছে শিল্পী সুশান্ত কুমার অধিকারীর প্রথম একক চিত্রকর্ম প্রদর্শনী ‘বনলতা’। গত ৯ জুলাই শুরু হওয়া এই প্রদর্শনী চলবে আগামীকাল ১৫ জুলাই রাত ৯টা পর্যন্ত। প্রদর্শনীতে স্থান পাওয়া ৩৭টি ছবির সকলেই নারী। রবীন্দ্রনাথের লাবণ্য, কেটি, নিরুপমা, ক্যামেলিয়া, হৈমন্তী; জীবনানন্দের বনলতা, সুচেতনা, সুরঞ্জনা, শ্যামলী, সুজাতা, শেফালিকা বোস কিংবা নজরুলের নার্গিস, সুনয়না সহ আমাদের কল্পজগতের সব চরিত্ররা আছেন এখানে।
এ লেখায় শিল্পীর হয়ে ওঠা সময়ের কথা আছে। চিত্রকর্মগুলোতে বৈষয়িক সব বৈচিত্র্যের পাশাপাশি গুরুত্ব পেয়েছে শিল্পের নানা কৌশল। আছে সেসব বিশ্লেষণ। মেঘচিলে ব্যবহৃত চিত্রকর্মগুলো প্রদর্শনী সূত্রে প্রাপ্ত। -সম্পাদক
বনলতা নামটি বাঙালির কল্পলোকে কাব্যিক সৌন্দর্যে পরিপূর্ণ এক নারীর নাম। কবি জীবনানন্দ দাশ এই নারী চরিত্রটি সৃষ্টি করেছেন। তাঁর ‘বনলতা সেন’ শিরোনামে কবিতার মধ্যে যার বসবাস। সে এখন শুধু কবিতার মধ্যেই বাস করে না, পাঠক মনে বনলতা প্রেমময় পরম সৌন্দর্যে গভীরভাবে অনুরণিত হয়। তার অস্তিত্ব নিয়ে পাঠক, অনুসন্ধিৎসু ও গবেষকদের মনে নানা ধরনের কৌতূহলের অন্ত নেই। বনলতা নাম্নী এই নারী কি বাস্তবের নাকি সম্পূর্ণ কল্পিত একটি কাব্যচরিত্র? কবি কি সত্যি নাটোর এসেছিলেন? কিন্তু রসিক, প্রেমিক, শিল্পী ওই প্রশ্ন বা কৌতূহল রাখেন না। কাব্য-সাহিত্যের সকল চরিত্রই তাই। বাস্তব এবং কাব্যিক কল্পলোকের চরিত্রগুলো ক্রমে সৌন্দর্য-শান্তির এক বিশেষ প্রতীকরূপে মিথ (Myth) হয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়।
এই ধরনের মিথিক (Mythic) চরিত্র প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্যের পুরাণ, কাব্য, সাহিত্যে লক্ষ করা যায়। যুগ যুগ ধরে সেসব চরিত্র প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে প্রতিফলিত হয় সৃজনকর্মীর স্বকীয় চিন্তায়। সংযোজন-বিয়োজনের মাধ্যমে কাব্যিক রূপ-বৈশিষ্ট্য নব নব অবয়বে গঠিত হয়। কিন্তু যা চিরন্তন, তা চিরকাল রয়ে যায় সমাজ-সংস্কৃতির গতিধারায়। প্রেম, সৌন্দর্য, ভালোবাসা সে রকমই অপরিবর্তনশীল একটি বিষয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, জীবনানন্দ দাশ প্রমুখ আধুনিক কবি নারীকে বিষয় করে গুণসমৃদ্ধ-সৌন্দর্য বর্ণনায় সাহিত্যাঙ্গনে অবদান রেখেছেন। প্রাচ্য-পাশ্চাত্য থেকে ভাব-উপাদান কম-বেশি গ্রহণ করে নিজস্ব পরিমণ্ডলে চরিত্রগুলো বিন্যস্ত করেছেন। সৌন্দর্যে, লাবণ্যে এবং বর্ণিত ঘটনায় সেসব চরিত্র পাঠকমনে রেখাপাত করে রয়েছে। সেসবের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ সৃষ্ট নারী চরিত্র লাবণ্য, কেটি, নিরুপমা, ক্যামেলিয়া, হৈমন্তী; নজরুল ইসলামের নার্গিস, সুনয়না; জীবনানন্দের সুচেতনা, সুরঞ্জনা, শ্যামলী, সুজাতা, শেফালিকা বোস ইত্যাদি চরিত্র উল্লেখযোগ্য।
আধুনিক সকল কবির সৃষ্ট নারী চরিত্রগুলোর মধ্যে জীবনানন্দের ‘বনলতা সেন’ কবিতার বনলতা বর্ণনায় সকলকে অতিক্রম করেছে। তাই কবিতাটি বিংশ শতাব্দীর সর্বাধিক পঠিত বাংলা কবিতার একটি। কথিত আছে, জীবনানন্দের উল্লিখিত কবিতাটিতে মার্কিন কবি এডগার অ্যালান পোর (Edgar Allan Poe, 18-1849) ‘টু হেলেন’ কবিতাটির সাদৃশ্য রয়েছে। সাদৃশ্য বা প্রভাব থাকাটা অস্বাভাবিক নয়। এটা সংস্কৃতির একটি চলমান ধারা। রবীন্দ্রনাথ, নজরুলসহ অন্য সকল সৃজনকর্মীর কাজেও ঐতিহ্যবাহী ও পরম্পরা কাব্য-সাহিতের ঘটনা চরিত্রের প্রভাব ও সাদৃশ্য বহু রয়েছে। কিন্তু অতীতকে ধারণ করে তাঁরা কে কতটা স্বতন্ত্র ভাবনায় প্রতিফলিত করেছেন, সেটাই বিবেচ্য বিষয়। ‘বনলতা সেন’ কবিতার ভাববস্তু পাশ্চাত্যের প্রভাবে সৃষ্ট কথিত নিন্দুকের কথায় কী এসে যায়, বনলতা যে বাঙালির একান্ত প্রিয় নারী চরিত্র, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। সে অতীতের সকল কাব্যের নারী চরিত্রের প্রতিনিধিস্বরূপ। তার সৌন্দর্যের মধ্যে ‘ভেনাস’, ‘মোনালিসা’, ‘সীতা’, ‘শকুন্তলা’ ‘কৃষ্ণকলি’, ‘লাবণ্য’, ‘নার্গিস’, প্রভৃতি নারী সৌন্দর্য বর্তমান। এটা আমার একান্ত উপলব্ধি। আমি বনলতা ও আরো কিছু চরিত্রের ভাবসম্পদকে গুরুত্ব দিয়ে বর্তমান ছবিগুলো এঁকেছি।
তাই চিত্রের ‘বনলতা’ কম্পিউটারে ইমেইল করতে অথবা গুগল সার্চ দিয়ে পাশ্চাত্যের বিখ্যাত শিল্পী পিকাসোর ছবিতে প্রাচ্যশৈলীর উপাদান খুঁজছে। এন্ড্রয়েড মোবাইলে ফেসবুকে অভিসারের সময় সম্পর্কে মেসেস দিচ্ছে অথবা ইউটিউবে আমির খানের Pk অথবা ফরিদা পারভীনের কণ্ঠে লালনের ‘মিলন হবে কত দিনে’ শুনছে; বাঙালির শোকের মাস আগস্টে পিতা, মাতা ও বোনকে নিয়ে বঙ্গবন্ধু মিউজিয়াম পরিদর্শনে অথবা শিশু দিবসে সন্তানসহ বঙ্গবন্ধুর একটি ম্যুরালের সামনে শ্রদ্ধা শেষে ছবি তোলার জন্য দাঁড়িয়েছে।
প্রাতিষ্ঠানিক শিল্পশিক্ষা ও শিক্ষকতায় তিনটি দশক চিত্রচর্চায় সময়কাল অতিক্রম করছি। এর মধ্যে পর্যায়ক্রমে খুলনা আর্ট কলেজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাচ্যকলা বিভাগ ও বিশ্বভারতীর চিত্রকলা বিভাগে অধ্যয়ন এবং শিক্ষার্থী জীবন শেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাচ্যকলা বিভাগে খণ্ডকালীন শিক্ষকতা, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাচ্যকলা বিষয়ে অধ্যাপনা এবং বিশ্বভারতীতে পিএইচডি পর্যায়ে গবেষণার সময়কাল রয়েছে। এ ছাড়া চিত্রা নদীতে ভেলা ভাসিয়ে ডুবসাঁতারের কিশোর বয়সের প্রসঙ্গও গুরুত্ব কম নয়। যখন বাবার বন্ধু লাল মিয়া (এস এম সুলতান) দীর্ঘ কালো পাঞ্জাবি বেশে আমাদের খড়ের চৌচালা ঘরের বারান্দায় বাঁশি বাজাতেন, সঙ্গে বাবা (প্রয়াত সুরেন্দ্রনাথ অধিকারী) মৃদঙ্গ সংগত করতেন, বড়দা (বড় ভাই চিত্রশিল্পী বলদেব অধিকারী) আমাকে যে খাতায় আঁকা শেখাতেন, সেই খাতায় আঁকা ছবিগুলো বাবা নিয়ে সুলতানকে দেখাতেন, তিনি সংশোধন করে দিতেন, উৎসাহ দিতেন, যা থেকে শিল্পশিক্ষার বাসনা বহুদূর পর্যন্ত কল্পনায় বিস্তৃত হতে এবং স্বপ্ন দেখতে শিখিয়েছিল।
স্কুলের শিক্ষক নিরঞ্জন সরকার রবীন্দ্রনাথের ‘দুই বিঘা জমি’ আবৃত্তি ও রবীন্দ্র শৈলীতে ‘এই করেছো ভালো নিঠুর…’ বোর্ডে লিখে অর্থ ব্যাখ্যা করতেন, রবিশঙ্করের সেতার বাদন প্রসঙ্গ আলোচনা করতেন ইত্যাদি অপ্রচলিত এবং সিলেবাসবহির্ভূত বিষয়গুলো আমার কোমল হৃদয়ে ও মগজের কোষে যুক্ত হয়ে রয়েছে। বাবার ছোট আকৃতির হারমোনিয়ামে বড়দা-মেজদার গাওয়া ‘বাগিচায় বুলবুলি তুই… ’, ‘বউ কথা কও বউ কথা কও…’, ‘হারানো হিয়ার নিকুঞ্জ পথে…’ নজরুলের ইত্যাদি গানের কথা, সুর ও ভাববস্তু কল্পলোকে নিয়ে যেত; বড়দার আঁকা আমাদের কাঠের ঘরের বেড়ায় আঠা দিয়ে লাগানো ‘নয়ন ভরা জল গো তোমার…’ উল্লিখিত একটি নারী চরিত্রের ছবি, যার পরনে লালপেড়ে সাদা শাড়ি, আঁচলে রঙিন ফুল নয়নে জল ছবিটি এবং আর্ট পেপারে লেখা কাঠের বাতায় লাগানো মহাপুরুষদের বাণী ‘শিল্প স্বভাবের দর্পণ’ কথাটি আজও প্রতিনিয়ত উপলব্ধি করি। ‘বনলতা এবং অনেকে’ শীর্ষক এই প্রদর্শনীর বর্তমান চিত্র সম্ভার উপরোল্লেখিত সকল বিষয়েরই আধার বা ভিত্তি বলা যায়।
বিশ্বভারতীতে Elements from traditional mythic narratives in modern painting – continuity, re-interpretation and transformation : selected artists from West Bengal and Bangladesh শিরোনামে গবেষণায় চিত্র বিশ্লেষণকালে অবনীন্দ্রনাথ, নন্দলাল, সুব্রহ্মণ্যন, রশিদ চৌধুরী প্রমুখ শিল্পীকে দেখেছি কীভাবে কাব্যের মিথিক চরিত্রকে ভেঙেছেন আর গড়েছেন। অবনীন্দ্রনাথ ‘আরব্য উপন্যাস’ অবলম্বনে আঁকা একটি ছবির দর্জিবাড়ির অভ্যন্তরে চীন দেশের সিঙ্গার সেলাই মেশিন ও পেছনে `Kerr Tagore & Co’ লেখা একটি সাইনবোর্ড দিয়ে তাঁর কলকাতা শহরের দৃশ্যকে যুক্ত করেছেন; ‘Ganesh-Janani’ শীর্ষক চিত্রে মা বালক গণেশকে উঁচু করে ধরেছে আর সে তার শুঁড় লম্বা করে গাছের একটি ডাল ধরে রয়েছে, এ দৃশ্য এঁকে জনমানসে প্রচলিত স্বর্গবাসী দেব কল্পনার পরিবর্তে বালক গণেশ ও তার মাকে মানবজগতে সংযোজন করেছেন।
নন্দলাল ‘Sabari in the Youth’ চিত্রে রামায়ণের বৃদ্ধা চরিত্রকে যুবতী করে এঁকেছেন, রামায়ণে মূলত বৃদ্ধ সবরিকে বর্ণনা করা হয়েছে, শিল্পী রামায়ণের সবরিকে যুবতী নারী এঁকে তাকে দীর্ঘ সময় ধরে রাম দর্শনের অপেক্ষাকে তুলে ধরেছেন। সুব্রহ্মণ্যন `Shiva Parvati in Banaras’ শীর্ষক চিত্রে পুরাণের শিব পরিবারকে দৈনন্দিন মানবজীবনে উপস্থিত করেছেন, পুরাণের শিব রূপ-গুণসমৃদ্ধ সুদর্শন আদর্শ পুরুষ, সকলেই তার কৃপা-আশীর্বাদ প্রাপ্তির প্রত্যাশায় ভক্তিযোগে অর্ঘ্য দান করে, শিল্পীর এই চিত্রে তাকে বয়স্ক, বালক পুত্রদ্বয় কার্তিক ও গণেশকে সামলানোর দৃশ্যে দেখানো হয়েছে, অর্থাৎ ইহজাগতিক দৈনন্দিন মানবজীবন দৃশ্যায়িত করা হয়েছে।
রশিদ চৌধুরী ‘Radha-Krishna’-বিষয়ক চিত্রগুলোতে পদাবলির রাধাকৃষ্ণকে অবনীন্দ্রনাথের চেয়ে কয়েক ধাপ এগিয়ে একেবারে সমকালের বিমূর্তাঙ্গিকে চিত্রায়িত করেছেন, এতে রাধাকৃষ্ণের মিলনের আবহ-দৃশ্য খুঁজে পেতে দর্শকের বিভ্রান্ত হতে হয় না। পুরাণ-কাব্য-সাহিত্যের ভক্ত পাঠকের কাছে এ চিত্রগুলোর গুরুত্ব কম হলেও শিল্পকলার রসিক, আলোচক, সমালোচক, চিন্তাবিদ সকলের কাছে এর গুরুত্ব অপরিসীম। ‘বনলতা এবং অনেকে’ শীর্ষক এই চিত্রগুলোর বিষয় ও উপস্থাপনে উপরোল্লেখিত ভাব-দর্শন আমাকে প্রভাবিত করে। তাই বনলতা ও অন্য যেসব চরিত্র ছবিতে উপস্থাপন করেছি, তারা আমার ও আমাদের দৈনন্দিন জীবন ও পরিবেশে সম্পৃক্ত করেছি। বিষয়, কম্পোজিশন ও করণ-কৌশলের পরীক্ষা-নিরীক্ষালব্ধ অভিজ্ঞতায় চরিত্রগুলোকে বাঙালি ও বাংলার জীবনযাত্রার আলোকে উপস্থাপন করেছি।
তাই চিত্রের ‘বনলতা’ কম্পিউটারে ইমেইল করতে অথবা গুগল সার্চ দিয়ে পাশ্চাত্যের বিখ্যাত শিল্পী পিকাসোর ছবিতে প্রাচ্যশৈলীর উপাদান খুঁজছে। এন্ড্রয়েড মোবাইলে ফেসবুকে অভিসারের সময় সম্পর্কে মেসেস দিচ্ছে অথবা ইউটিউবে আমির খানের Pk অথবা ফরিদা পারভীনের কণ্ঠে লালনের ‘মিলন হবে কত দিনে’ শুনছে; বাঙালির শোকের মাস আগস্টে পিতা, মাতা ও বোনকে নিয়ে বঙ্গবন্ধু মিউজিয়াম পরিদর্শনে অথবা শিশু দিবসে সন্তানসহ বঙ্গবন্ধুর একটি ম্যুরালের সামনে শ্রদ্ধা শেষে ছবি তোলার জন্য দাঁড়িয়েছে। কখনো জাপানে গিয়ে সন্তানসহ সে দেশের ঐতিহ্যবাহী চিত্র প্রদর্শনকক্ষে মগ্ন হয়ে ছবি দেখছে। সেই বনলতাই আবার ল্যুভর (Louver) মিউজিয়ামে লেওনার্দো দ্য ভিঞ্চির (Leonardo Da Vinci) মোনালিসার (The Mona Lisa) পাশে তার নীলাভ চোখে অর্ধপলকে উপস্থিত দর্শকের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। এখানে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সৌন্দর্যের সাদৃশ্য-বৈসাদৃশ্য ফুটে উঠেছে। কোথাও সে ড্রয়িং ক্লাসে নার্গিস, লাবণ্য, হৈমন্তী এবং অন্যান্য সকলের সাথে মাইকেলেঞ্জেলোর (Michelangelo) ডেভিড ভাস্কর্যটির (Statue of David) বড় আকৃতির ইজেলে রাখা একটি ফটোগ্রাফ চর্চা করছে। অর্থাৎ আমাদের সুন্দরী নারীরা পাশ্চাত্যের সুন্দরকে অনুশীলন করছে।
শুধুই কি অনুশীলন করছে? নাকি অনুশীলন করতে করতে কাম-কল্পনায় অথই সাগরে ডুবছে? বনলতার মতোই সৌন্দর্য নিয়ে কৃষ্ণকলি, নার্গিস নামে কেউ কেউ গ্রামের সাধারণ ঘরের কারও স্ত্রী হয়ে প্রসাধনীতে ব্যস্ত, অথবা গোবর মাটির ঘরের দেয়ালে ঘুঁটে দিচ্ছে। কখনো সেই বনলতা বা নার্গিস-হৈমন্তীরা ট্রেনে অথবা বাসের যাত্রীরূপে পুরোনো স্মৃতিতে অথবা স্মৃতিস্থলে ফিরছে। সে এত দিন কোথায় ছিল? কেনই বা ফিরছে? স্বামী-সংসারের জীবন-আনন্দ ফেলে প্রশান্তির খোঁজে বেরিয়েছে অথবা গ্রামের সেই কলেজ মাঠে রবীন্দ্র উৎসবে যে কণ্ঠে ক্যামেলিয়া কবিতা শুনে যার সাথে ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখেছিল? এ ফিরে যাওয়া বা আসা হয়তো চেতন-অচেতন অথবা অবচেতন মনের বিলাস? না হয় বাস্তবেই সে ফিরছে তার অতীতের প্রিয়জনের কাছে। কখনো সে মুক্তমঞ্চে রবীন্দ্রনাথের স্বদেশ পর্যায়ের গান পরিবেশন করে দেশপ্রেমে শ্রোতাদের উদ্বুদ্ধ করছে। কোথাও রবীন্দ্র-নজরুল-জীবনানন্দ উৎসব শেষে বনলতা ও কৃষ্ণকলি দুই সখী অনুষ্ঠানের ভালো-মন্দ আলোচনা-পর্যালোচনা করতে করতে ঘরে ফিরছে।
অথবা তারা কিছুই করছে না, শুধু সুদূরপানে চেয়ে অনাগতের স্বপ্ন বাস্তবায়নের চিন্তায় বিভোর রয়েছে। এই চিত্রগুলোতে মূলত নায়ক অনুপস্থিত। শুধু নায়িকা কেন? আমি আসলে আমাদের মনোগভীরে যে সুন্দর সৌন্দর্য নারীর মধ্যে প্রতিনিয়ত দৃশ্যমান হয়, তাকেই সর্বজনের সম্মুখে উপস্থাপন করেছি। কলেজে, শ্রেণিকক্ষে, মেলায়, বন্ধুর বাড়ি, অফিসে, বাসে, ট্রেনে কত নারীই না দেখি। কে না দেখে? সবাই দেখে। প্রবীণও দেখেন, নবীনও দেখেন; কিন্তু সবার দৃষ্টিভঙ্গি এক রকম থাকে না, এটা মানতে হবে; তবে আমি সেই নারীকে এঁকেছি, যারা নবীন-প্রবীণ সকল রসিকমনে বনলতা, কমলা, কৃষ্ণকলি, লাবণ্য, সাঁওতালি মেয়ে অথবা নার্গিস-সদৃশ কল্পনায় আবির্ভূতা হয়। মনে মনে ‘বনলতা’ কবিতা আওড়ায়, ‘কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি’ গানটি গুনগুন করে মুহূর্তে কল্পজগতে ভ্রমণ করে। এই নারী চরিত্রগুলো বাস্তবের ভোগ-বিলাসজাত প্রয়োজনের জন্য নয়, শুধুই মনোজগতের নিঃস্বার্থ আনন্দ উপভোগের।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাচ্যকলা বিভাগের বিএফএ অধ্যয়ন (১৯৯১-৯৫) নাসরীন ম্যাডামের (প্রফেসর শিল্পী নাসরীন বেগম) কাছে অবনীন্দ্রনাথ প্রবর্তিত জলরঙের ধৌত পদ্ধতি ও ঐতিহ্যবাহী প্রাচ্যশৈলীর ছন্দায়িত ড্রয়িং; শওকত স্যারের (প্রয়াত শিল্পী শওকাতুজ্জামান) কাছে ওপেক পদ্ধতিতে টেম্পারা ও সিল্ক পেইন্টিং; সাত্তার স্যারের (প্রফেসর আব্দুস সাত্তার) কাছ থেকে প্রাচ্যশিল্পের ইতিহাস তত্ত্ব, নন্দনতত্ত্ব এবং তাঁর ছাপচিত্রের মনোক্রোম (Monochrome) রঙের প্রয়োগ এবং হাশেম খান স্যারের (প্রফেসর শিল্পী আবুল হাশেম খান) কাছে তেলরং পদ্ধতি, পেন-স্কেচ ধরন-কৌশল ইত্যাদি বিষয়াদি শিখেছি। তত্ত্বীয় শিক্ষক বুলবন স্যারের (প্রফেসর বুলবন ওসমান) সমাজতত্ত্বের দর্শন পাঠে পারিপার্শ্বিক সামাজিক পরিবেশ ও সংস্কৃতির নানা দিক জেনেছি এবং নাজমা ম্যাডামের (প্রফেসর নাজমা খান মজলিশ) মোগল মিনিয়েচারের পাঠদানে চিত্রে ব্যবহৃত সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম তুলির আঁচড়ের গভীরতা অনুভব করেছি।
এই সময়ের আগে ও পরে আরও কিছু কথা থেকে যায়; খুলনা আর্ট কলেজে (১৯৮৭-৯১) প্রি-বিএফএ অধ্যয়নকালে জলরঙে দক্ষিণবঙ্গের ঘন সবুজ-সমতলীয় ভূদৃশ্য, কালি-কলমে শুধুই সৌন্দর্য চর্চা করছে? শুধুই সৌন্দর্য চর্চা করছে? রেলওয়ে স্টেশনের যাত্রী ও ভিখারি, রূপসা নদীর ঘাট ইত্যাদি স্থানের পরিবেশ ও বিমানেশ স্যার (শিল্পী বিমানেশ বিশ্বাস), নিখিল স্যার (শিল্পী নিখিল মিত্র), বেবী ম্যাডাম (শিল্পী বেবী সুলতানা), চৈতন্য স্যার (শিল্পী চৈতন্য মল্লিক) প্রমুখ শিক্ষকের উৎসাহ আমাকে সৃষ্টিচিন্তাকে ত্বরান্বিত করেছে।
এই সময়ের আগে ও পরে আরও কিছু কথা থেকে যায়; খুলনা আর্ট কলেজে (১৯৮৭-৯১) প্রি-বিএফএ অধ্যয়নকালে জলরঙে দক্ষিণবঙ্গের ঘন সবুজ-সমতলীয় ভূদৃশ্য, কালি-কলমে শুধুই সৌন্দর্য চর্চা করছে? শুধুই সৌন্দর্য চর্চা করছে? রেলওয়ে স্টেশনের যাত্রী ও ভিখারি, রূপসা নদীর ঘাট ইত্যাদি স্থানের পরিবেশ ও বিমানেশ স্যার (শিল্পী বিমানেশ বিশ্বাস), নিখিল স্যার (শিল্পী নিখিল মিত্র), বেবী ম্যাডাম (শিল্পী বেবী সুলতানা), চৈতন্য স্যার (শিল্পী চৈতন্য মল্লিক) প্রমুখ শিক্ষকের উৎসাহ আমাকে সৃষ্টিচিন্তাকে ত্বরান্বিত করেছে। সর্বশেষে বিশ্বভারতীতে (১৯৯৫-৯৮) এমএফএ করতে গিয়ে নেপালি পেপার ছবি আঁকার উপযোগী করা এবং প্রাকৃতিক রং দিয়ে টেম্পারা পদ্ধতিতে ছবি আঁকা ও ঐতিহ্যবাহী জয়পুরি ফ্রেস্কোর করণ-কৌশল আয়ত্ত করেছিলাম নন্দদার (প্রফেসর নন্দদুলাল মুখোপাধ্যায়) কাছে এবং মানিদাকে (শিল্পী গণপতি সুব্রহ্মণ্যন) সরাসরি ছবি আঁকতে দেখা ও ছবির বিষয় নির্বাচনের দিকগুলো আকৃষ্ট করে।
তত্ত্বীয় শিক্ষক জয়ন্ত চক্রবর্তীর কাছ থেকে ‘ভারতীয় নন্দনতত্ত্ব’ বিষয়ে প্রাচ্যশিল্পের শাস্ত্রীয় তথ্যাদি সম্পর্কে নানাবিধ জ্ঞান অর্জন করি। গবেষণাকালে সঞ্জয়দার (ড. সঞ্জয় কুমার মল্লিক) কাছে মিথিক চরিত্র বিশ্লেষণের কৌশল সৃষ্টিচিন্তায় সহায়ক হয়েছে। সে সময়ে শিথিক চরিত্র ও ঘটনা এবং ইতিহাসের চরিত্র রূপায়ণে ভাবনার গভীরে প্রবেশ করি, তাই গৌতম বুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ এবং নানা রকম চরিত্র আঁকতে আজও উৎসাহিত হই। সম্প্রতি ঢাকার ‘কলাকেন্দ্র’ আয়োজিত ওয়ার্কশপের মাধ্যমে মরমি চিত্রশিল্পী শহিদ কবীরের কাছে ঐতিহ্যবাহী এগ টেম্পারা এবং পশ্চিমবঙ্গে একটি ওয়ার্কশপে শান্তিনিকেতনের শিল্পী ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়ের সান্নিধ্যে রিভার্স বা গ্লাস পেইন্টিং শিখেছি।
উল্লিখিত শিক্ষকমণ্ডলী ও শিল্পীদের কাছ থেকে প্রাপ্ত জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা এবং শুভানুধ্যায়ী শিল্প-সমালোচক জাহিদ মোস্তফা, অনুজ শিল্পী মলয় বালা, সহকর্মী শিল্পী সিদ্ধার্থ তালুকদার, ভাইপো কান্তি (শিল্পী কান্তিদেব অধিকারী) প্রমুখ জনের উৎসাহ প্রতিফলিত হয়েছে বর্তমান প্রদর্শিত ছবিগুলোর মধ্যে। কিন্তু তা প্রচলিত একাডেমিক শিক্ষার গতানুগতিক ধারায় নয়। আমি তাঁদের সবকিছু গ্রহণ করেছি, ছবি সৃষ্টিতে অভিজ্ঞতার প্রতিফলন ঘটিয়েছি নিজের মতো করে। জলরঙের বহুমাত্রিক রং ও রঙের ঔজ্জ্বল্য আবহ বিয়োগ করে, কম্পোজিশনে প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের সংমিশ্রণে, কল্পনা ও বাস্তবতার সমন্বয়ে প্রাচ্য ঐতিহ্যকে অক্ষুণ্ন রেখে চিত্রপট রাঙিয়েছি। আমার সকল শিক্ষা ও গবেষণালব্ধ অভিজ্ঞতার ফসল এই চিত্রমালা। তাই আমার এই সিরিজের চিত্রজমিন প্রস্তুত করতে প্রচলিত ধারায় জলরং ব্যবহারকে পরিহার করে পানিতে দীর্ঘ সময় ভিজিয়ে কেমিক্যালজাতীয় দ্রব্যের ক্রিয়া কমিয়ে ওপেক করে ব্যবহার করেছি। চিত্রতল হিসেবে মাউন্ডবোর্ড, বুক বাইন্ডিং বোর্ড, লোকাল হ্যান্ডমেড ইত্যাদি দেশি কাগজকে গুরুত্ব দিয়েছি। সকল পদ্ধতি-ধারা সমন্বিত করে মোগল মিনিয়েচারের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম গুণকে গুরুত্ব দিয়ে চিত্রতলের সম্পূর্ণ জায়গা তুলির আঁচড়ে মৃদু আলোছায়ায় নারীর কোমল চরিত্র এঁকেছি।
আমার এই আলোচনায় বর্তমান চিত্রগুলো নিয়ে বিস্তারিত বলা হলো না। ছবিগুলো সৃষ্টির অন্তরালের বা নেপথ্যে শিক্ষা ও অভিজ্ঞতার বিবরণই বেশি উল্লেখ করা হলো। আমি প্রদর্শনীতে আসা রসিক, শিল্প-সমালোচক, বিজ্ঞ-বোদ্ধাজনের উদ্দেশ্যে আলোচনা-সমালোচনার জন্য অনুল্লেখিত বিষয়টি উন্মুক্ত রাখলাম।
শিল্পাচার্য অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিল্পাদর্শ ও প্রবর্তিত চিত্রধারাকে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন গুরুত্বের সাথে গ্রহণ করেছিলেন এবং তাঁর শিল্পশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ওই ধারা চর্চার জন্য যে প্রাচ্যকলা বিভাগ খোলেন, সেই বিভাগের আমি একজন প্রাক্তন শিক্ষার্থী, বর্তমানে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উক্ত প্রাচ্যকলা বিষয়ের শিক্ষক এবং প্রাচ্যচিত্র ধারায় উজ্জীবিত একজন পথিক-শিল্পী। জয়নুল নামাঙ্কিত প্রদর্শনকক্ষে আমার বর্তমান প্রদর্শনীর চিত্রকর্ম দর্শক-রসিকজনের মনকে যদি বিন্দুমাত্র অনুরণিত করে, তাহলে উল্লিখিত আচার্যগণের পরম্পরা-ঐতিহ্য ও স্বদেশচিন্তা এবং আমার গভীর নিরীক্ষণে সৃষ্ট চিত্রগুলো সার্থকতায় পূর্ণতা পাবে।
আরো পড়তে পারেন
Content not found!
Please add specific content.