প্রথম ঈদসংখ্যা
প্রথম পর্বে পড়ুন- বইয়ের গন্ধ
কিছু কিছু রূপকথা আর মহাপুরুষদের দু-চারটা জীবনীতে ঘুরপাক খেতে খেতে একদিন ক্লাস সিক্সে পড়ার সময় দৈনিক বাংলায় চোখে পড়ল ‘বিচিত্রা ঈদসংখ্যা ১৯৭৮’-এর বিজ্ঞাপন, একেক দিন একেকজন লেখককে হাইলাইট করে বিজ্ঞাপন হতো। ছোট থেকেই বাসায় দৈনিক বাংলা পত্রিকা দেখে আসছি আর সপ্তাহান্তে বিচিত্রা, যখন দৈনিক বাংলার দাম ৪০ বা ৬০ পয়সা আর ‘ভারতে বিমান ডাকে ৮০ পয়সা’! বিজ্ঞাপন দেখে মায়ের মাধ্যমে বাবার কাছে আবদার করতে হকারের কাছ থেকে পেয়ে গেলাম জীবনের প্রথম ঈদসংখ্যা! স্বপ্নের সেই সূচি থেকে মনে আছে–মিরজা আবদুল হাইয়ের ‘ফিরে চলো’, সৈয়দ হকের ‘নিষিদ্ধ লোবান’, মাহমুদুল হকের ‘নিরাপদ তন্দ্রা’ ইত্যাদি–এসব উপন্যাসের কিছুটা হয়তো পড়েছিলাম, কিছুটা হয়তো অলংকরণ দেখে বুঝে নিয়েছিলাম, তবে নামগুলো তখন থেকেই মনে গেঁথে আছে; এমনকি রনবীর আঁকা প্রচ্ছদ ছিল ‘উডকাটের লে আউট’ (একটা পাখির ছবি ছিল সম্ভবত)–এই উডকাটের লে আউট বস্তুটা কী, তাও মনকে ভাবিয়েছে কম না। সেই ঈদসংখ্যা থেকে কাজী আনোয়ার হোসেনের উপন্যাসিকা (গিন্নী?) পড়েছিলাম, যার প্রথম লাইনটা এখনো মনে পড়ে–‘মনটা বিষিয়ে উঠল তরিকুল্লার’। এই তরিকুল্লা ধানমন্ডি লেকে মাছ ধরতে গিয়ে জলদেবতার অভিশাপে আর পানি পান করতে পারত না, তাঁর গায়ে বৃষ্টি লাগত না ইত্যাদি ইত্যাদি সমস্যার মধ্যে পড়ে গেছিল বেচারা! একই সময়ে কোথা থেকে হাতে এল সৌরজগতের প্রচ্ছদ আঁকা হুমায়ূন আহমেদের ‘তোমাদের জন্যে ভালবাসা’, বইয়ের পোস্তানির কাগজে জনৈক আফজাল লাল সাইনপেন দিয়ে লিখেছিল, ‘মা, তোমার কাছে আমি ঋণী’। কাজীদা আর হুমায়ূন আহমেদের এই দুটো লেখা আমাকে ভাবিয়েছে, সায়েন্স ফিকশন নামে যে আলাদা জাতের লেখা আছে, তা মহামতি ফিহার কাছ থেকে জানলাম।
সেই ঈদসংখ্যা থেকে কাজী আনোয়ার হোসেনের উপন্যাসিকা (গিন্নী?) পড়েছিলাম, যার প্রথম লাইনটা এখনো মনে পড়ে–‘মনটা বিষিয়ে উঠল তরিকুল্লার’। এই তরিকুল্লা ধানমন্ডি লেকে মাছ ধরতে গিয়ে জলদেবতার অভিশাপে আর পানি পান করতে পারত না, তাঁর গায়ে বৃষ্টি লাগত না ইত্যাদি ইত্যাদি সমস্যার মধ্যে পড়ে গেছিল বেচারা!
এর দুবছর পর ‘আশি দিনে বিশ্ব ভ্রমণ’ দিয়ে শুরু করে একের পর এক সেবা প্রকাশনী থেকে বের হওয়া জুলভার্নের অনুবাদগুলো (রহস্যের দ্বীপ, বেগমের রত্নভাণ্ডার, মরুশহর ) পড়ে ফেললাম গোগ্রাসে। আমার মনে হতো, প্রাপ্তবয়স্ক হবার আগে ‘মাসুদ রানা’ পড়ার অধিকার জন্মে না, সে আগ্রহও অবশ্য একটা সময় পর্যন্ত জাগেনি। চোখের সামনে মাসুদ রানা আর কুয়াশা বিনিময় হতো ক্লাসের ফাঁকে, দু-একটা ‘কুয়াশা’ পড়েছিলাম, মাসুদ রানা প্রথম পড়ি ক্লাস নাইনে নানাবাড়ি গিয়ে হাতের কাছে পেয়ে; পড়েছিলাম নিষিদ্ধ আনন্দে! ম্যাট্রিক পরীক্ষার পর পড়েছিলাম ‘নিরাপদ কারাগার’ আর ‘পাশের কামরা’–আমাকে খুব বেশি টানেনি (কিংবা টেনেছে কিন্তু ‘বাঁধনে জড়ায়নি’!) বাংলাদেশ কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সের এই ২৭ বছর বয়স্ক মহানায়ক! অন্যদিকে একই সাথে হুমায়ূন আহমেদের ‘নন্দিত নরকে’ আর ‘শঙ্খনীল কারাগার’ পড়ে ফেললাম এই অবকাশে। ’৮৪-র দিকে তিনি দেশে ফেরার পর একের পর এক বই প্রকাশ হচ্ছিল, আর বিচিত্রার গ্রন্থ আলোচনার সূত্র ধরে সোজা বাংলাবাজারে গিয়ে জোগাড় করে আনতাম ‘অন্যদিন’, ‘সৌরভ’, ‘একা একা’ কিংবা ‘শ্যামল ছায়া’। এ সময়ে আমি নসাসের আজীবন সদস্যও হয়ে যাই (সদস্য নম্বর ১৩)।
এই সময়ে গল্পগুচ্ছ আর গীতবিতান পড়তে শুরু করেছিলাম, যদিও আজও তা পড়া শেষ করতে পারিনি। আমার ছোট খালা মনে করলেন এই ছুটিতে পড়ার জন্য আমার জন্য বিমল মিত্রের ‘কড়ি দিয়ে কিনলাম’ই যথার্থ হবে। বইয়ের আকৃতি দেখে দমে গেলেও শেষ করেছিলাম; শেষ করে মনে হয়েছিল বইয়ের পাতা থেকে নায়ক বের হয়ে আমার ভেতরে ঢুকে যাচ্ছে, অন্যদিকে হুমায়ূন আহমেদ পড়ে মনে হয়েছিল আমিও একদিন লিখতে পারব! মোটা বইয়ের প্রতি একটা ভীতি এখনো আছে; অনেক সময় মোটা বই সংগ্রহ করে রাখলেও পড়া শুরু করতে দুই থেকে পাঁচ বছরও লেগে যাচ্ছে! এই সময়ে আবুল খায়ের মুসলেহউদ্দীনের ছোটগল্পের বই ‘শালবনের রাজা’, ‘নলখাগড়ার সাপ’–এসব বই পড়ে তাঁর ছোটগল্পের শেষের নাটকীয়তাটুকু গল্পের জন্য বেশি জরুরি নাকি হুমায়ূনের একধরনের শেষহীনতাই বেশি দরকারি–মাঝে মাঝে এই সবও ভাবতাম।
মাঝে মাঝে ভাবি, আমার বই পড়ার রুচিটা চিরকালই অদ্ভুত। ‘ফটিকচাঁদ’ কিংবা ‘বাড়ি থেকে পালিয়ে’ না ধরে আমি ধরতাম ‘শাহরিয়ারের অ্যাডভেঞ্চার’! তবে ক্লাস টেনে সত্যজিৎ রায়ের ‘যখন ছোট ছিলাম’ আর ‘রয়েল বেঙ্গল রহস্য’ পড়তে পড়তে আরেক দিগন্তের খোঁজ পেয়েছিলাম।
এই ম্যাট্রিক পরীক্ষার ছুটিতে আমার ‘পর্যটকের চোখে মান্ধাতা গগলস’ নামক কবিতার পাণ্ডুলিপি তৈরি হতে থাকলেও পদাবলি গোষ্ঠীর একটা কবিতাসংকলন ছাড়া আধুনিক কবিদের কবিতার কোনো বই তখন পর্যন্ত পড়িনি বা সংগ্রহে ছিল না (ব্যতিক্রম–শামসুর রাহমানের ‘কবিতার সঙ্গে গেরস্থালি’, প্রাইজ পাওয়া বই)। সেই সংকলনটি হারিয়ে গেলেও মুদ্রিত পৃষ্ঠাগুলো স্মৃতিতে আছে । শামসুর রাহমানের ‘দুঃসময়ের মুখোমুখি’, ‘টেলেমেকাস’, সিকদার আমিনুল হকের ‘সুলতা জানে’, রফিক আজাদের ‘ভালবাসার সংজ্ঞা’ আর ‘চুনিয়া আমার আর্কেডিয়া’, মুহম্মদ নূরুল হুদার ‘আমরা তামাটে জাতি’, আসাদ চৌধুরীর ‘পেঁয়াজ আমার ননদী’, হাবিবুল্লাহ সিরাজীর ‘ হর্ষবর্ধনের হাতি’, এ ছাড়া মনে পড়ছে সাইয়ীদ আতিকুল্লাহ আর হায়াত সাইফের কবিতাও ছিল। সেই বইয়ের কিছু কিছু কবিতার কিছু কিছু লাইন আমাকে টানতে থাকে। শামসুর রাহমানের ‘বাচ্চু’টা কে, তা তখন নিশ্চিত করে জানতাম না, কিন্তু ‘স্মৃতির শহর’-এর সুবাদে ‘ছেচল্লিশ মাহুতটুলীর খোলা ছাদ’ কী, সেটা চিনতাম। আর বাচ্চুকে একবার ‘তুই’ একবার ‘তুমি’ সম্বোধন করে কবি তাকে চলে যেতে বলছেন সেই মাহুতটুলীতেই, সেটা একধরনের রহস্য সৃষ্টি করেছিল।
সেই ছুটিতে ট্রেনে করে দাদার বাড়ি যাচ্ছিলাম, পথে ‘দেবদাস’ পড়া হয়ে যায়, তখন দেবদাস পড়ার প্রেরণা ছিল বুলবুল অভিনীত সদ্য মুক্তি পাওয়া বাংলা সিনেমা। ট্রেনভ্রমণে পড়ছিলাম বলেই মনে হয় দেবদাসের বেদনার সমকক্ষতা অনুভব করতে পেরছিলাম । এই যে ‘সমকক্ষতা অনুভব করা’র কথা বললাম, এটা অনেক বছর আগে সৈয়দ হকের বই থেকে পাওয়া শব্দবন্ধ, যা আমার নিজের ভান্ডারেই ঢুকে গেছে কবে!
মাঝে মাঝে ভাবি, আমার বই পড়ার রুচিটা চিরকালই অদ্ভুত। ‘ফটিকচাঁদ’ কিংবা ‘বাড়ি থেকে পালিয়ে’ না ধরে আমি ধরতাম ‘শাহরিয়ারের অ্যাডভেঞ্চার’! তবে ক্লাস টেনে সত্যজিৎ রায়ের ‘যখন ছোট ছিলাম’ আর ‘রয়েল বেঙ্গল রহস্য’ পড়তে পড়তে আরেক দিগন্তের খোঁজ পেয়েছিলাম।