চলচ্চিত্র : ভালোবাসা ও নিঃসঙ্গতা
সাধারণ দর্শক, যারা চলচ্চিত্র দেখতে ভালোবাসেন, তারা কতটা চলচ্চিত্র বিশ্লেষকের দৃষ্টিতে একটি সিনেমা দেখা শুরু করেন, তা বলা কঠিন। আমার ধারণা, যারা সিনেমা দেখতে ভালোবাসেন, তারা অন্তর্গত বোধ থেকেই সিনেমা দেখেন এবং একেকজন দর্শক বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা সিনেমাটি নিয়ে আলোচনা-পর্যালোচনার মাধ্যমে সিনেমাপ্রেমী হয়ে ওঠেন। সাধারণ দর্শকদের জন্য বোদ্ধা শব্দটি ব্যবহার হয়তো ঠিক নয়, তাই অন্য কোনো সমার্থক শব্দ না পাওয়াতে সিনেমাপ্রেমী বললাম।
আমি ব্যক্তিগতভাবে বিভিন্ন ধরনের সিনেমা দেখতে পছন্দ করি। সেসব সিনেমার সবগুলোই যে জ্ঞান লাভ বা মনে কোনো দাগ কাটে তা নয়, ভালো একটি সিনেমা দেখে আমার মনে বিভিন্ন ধরনের মানসিক অনুভূতির সৃষ্টি হয়। একটি ভালো সিনেমা শুধু বিনোদন দেয় না, বরং বিনোদনের পাশাপাশি একটি ভালো বই পড়ার মতো করে সমাজের ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র, বিশ্ব, মহাবিশ্বসহ তাবৎ বিষয়ে ভাবনার বীজ আমাদের মগজে গেঁথে দেয়। একটি সিনেমা দেখলাম, উঠে গেলাম, তারপর তার বিষয়বস্তু আমি বেমালুম ভুলে গেলাম; আমার মননে বা মগজে সে সিনেমা কোনো কম্পন বা কোনো রেখাপাত সৃষ্টি করল না, তেমন সিনেমাকে আমি সিনেমা বলব না। একটি সিনেমা দেখার পর সেটার বিষয়বস্তুর ভালো-মন্দ, প্রেম-ক্রোধ, বিদ্রোহ-উল্লাস মগজে ভাবনার অনুরণন তুলবে, বিষয়টি নিয়ে অনুভূতির ভেতর-বাইরে পক্ষে-বিপক্ষের ভাবনা তৈরি হবে; কিছু সময়ের জন্য হলেও আচ্ছন্নতা আমাদের গ্রাস করবে, তবেই না সেটি হয়ে উঠবে একটি সিনেমা। অনেক সিনেমা আমোদিত করে, অনেক সিনেমা অনুভূতিকে ঘোরের মধ্যে নিয়ে ফেলে, অনেক সিনেমা রোমান্টিসিজমে আক্রান্ত করে, অনেক সিনেমা দেখতে বসে আতঙ্কে হৃৎপিণ্ড ধড়াস ধড়াস করে লাফায় প্রবল টেনশনে; এই বিভিন্ন ধরণের প্রবল মানসিক অনুভূতি সৃষ্টি করতে পারা এবং ভাবতে বাধ্য করা একটি ভালো সিনেমার মান হতে পারে বলে আমার ধারণা। সাম্প্রতিক সময়ে দেখা কয়েকটি ভিন্ন ধরনের সিনেমার অনুভূতি নিয়ে আমার এই লেখা হলেও প্রতিটি সিনেমার একটি জায়গায় রয়েছে মিল, তা হলো চরিত্রদের অন্তঃস্থ ভালোবাসা ও নিঃসঙ্গতা।
এই সব সিনেমা দর্শককে ভীষণ রকম একাকিত্বের অনুভূতি দেয়। এসব সিনেমা মূলত বুঝতে দেয় মানুষ একা (!), একই সঙ্গে তার জীবন ভালোবাসায় আক্রান্ত এবং তার চলার পথ নিঃসঙ্গ। একা আর নিঃসঙ্গ মানুষের দু-একটি সিনেমা নিয়ে আমার এই পর্যালোচনা।
ব্লু জেসমিন
আমি যখন ব্লু জেসমিন ছবিটি দেখি, তখন সিনেমাটি কয়েক ক্যাটাগরিতে অস্কার জিতে হইচই ফেলে দিয়েছে। অবশ্য সব সিনেমাপ্রেমী আশা করেন দক্ষ পরিচালক উডি এলানের কাছ থেকে একটি কমেডি ধাঁচের সিনেমা। দর্শক চাহিদা অনুযায়ী তিনি কমেডি ঘরানার সিনেমা দিয়ে বাজিমাত করেন যেমন, ঠিক তেমনি তিনি সিরিয়াস ধাঁচের একটি বিষয়বস্তুর মধ্যে জীবনের কিছু কমেডি দর্শকদের জন্য রেখে দেন, এখানেই তাঁর ছবি পরিচালনার কারিশমা! ব্লু জেসমিন তেমনি একটি ছবি। উডি এলেন বরাবর সেসব ছবি তৈরি করেন, যা সব সময়ই দর্শকের মনে দাগ রেখে যায় এবং তাঁর চরিত্র সৃষ্টির কৌশল অসাধারণ। অবশ্য তাঁর সৃষ্ট সেসব চরিত্র ফুটিয়ে তোলার দায়িত্ব যাদের ওপর তিনি ন্যস্ত করেন, সেসব অভিনেতা-অভিনেত্রীর নির্বাচনও নিঃসন্দেহে পারফেক্ট হয় বলে উডি এলেনের সিনেমার মান প্রশ্নাতীত। উডি এলেনের ব্লু জেসমিন ছবির কাহিনি বা পরিচালনা এককথায় নিখুঁত এবং উপভোগ্য। উডি এলেনের এই সিনেমার বিষয়বস্তু জেসমিন নামের এমন এক নারীকে নিয়ে, যে সদ্য তার ধনকুবের স্বামী হ্যালকে ছেড়ে এসেছে। বিবাহিত জীবনে জেসমিন তার স্বামীর সঙ্গে নিউইয়র্কের অভিজাত এলাকায় বাস করত এবং তাদের ছিল খুবই জাঁকজমকপূর্ণ আর বিলাসী জীবনযাপন। প্রতিনিয়ত পার্টি বা ভ্রমণ বা অভিজাত সব খেলাধুলায় সময় কাটানো জেসমিনের জীবনের রুটিন ছিল। জেসমিন যখন জানতে পারল ওর স্বামী আরেক নারীর সঙ্গে গোপনে ডেট করছে, তখন সে তা মেনে নিতে পারে না এবং অপমানিত ও ক্ষুব্ধ জেসমিন তাকে প্রতারিত করবার অপরাধে স্বামীকে পুলিশে ধরিয়ে দিয়ে কপর্দকশূন্য অবস্থায় নিম্নবিত্ত ছোট বোন জিনজারের কাছে এসে থাকতে শুরু করে। শুরু হয় জেসমিনের নতুন জীবন। এই জীবনে জেসমিনের ক্রাইসিস, স্ট্রাগল, মানসিক নিঃসঙ্গতা আর অস্থিরতা এবং আবার নতুন করে শুরু করতে যাওয়া জীবন ব্লু জেসমিন সিনেমার বিষয়বস্তু।
জেসমিন যখন জানতে পারল ওর স্বামী আরেক নারীর সঙ্গে গোপনে ডেট করছে, তখন সে তা মেনে নিতে পারে না এবং অপমানিত ও ক্ষুব্ধ জেসমিন তাকে প্রতারিত করবার অপরাধে স্বামীকে পুলিশে ধরিয়ে দিয়ে কপর্দকশূন্য অবস্থায় নিম্নবিত্ত ছোট বোন জিনজারের কাছে এসে থাকতে শুরু করে। শুরু হয় জেসমিনের নতুন জীবন। এই জীবনে জেসমিনের ক্রাইসিস, স্ট্রাগল, মানসিক নিঃসঙ্গতা আর অস্থিরতা এবং আবার নতুন করে শুরু করতে যাওয়া জীবন ব্লু জেসমিন সিনেমার বিষয়বস্তু।
আর ফিল্ম ক্যারিয়ারে বিরতির পর পুনরায় অভিনয়ে ফিরে এসে কেট ব্ল্যানচেট অসাধারণ নিপুণতায় জেসমিন চরিত্রটি ফুটিয়ে তুলেছেন। অভিনয় করার সময় আদপেই বিষণ্ণ জেসমিন হয়ে উঠেছিলেন কেট ব্ল্যানচেট। কেট ব্ল্যানচেট জেসমিন চরিত্রে অভিনয় করবার সময় কোনো রকম তাড়াহুড়া বা কাটছাঁট বা অতিরঞ্জিত অভিনয় না করে তার পরিমিত অভিনয় দিয়ে দর্শকদের এমন একটি ভাবনায় নিয়ে ফেলেছেন, যেন দর্শক কারও জানালায় উঁকি দিয়ে তার ব্যক্তিগত জীবন দেখে নিচ্ছে। কেটের অভিনয় দেখে সহজেই বোঝা যায় উডি এলেন চরিত্রের চাহিদার দাবিকে প্রাধান্য দিয়ে অভিনেতা-অভিনেত্রী নির্বাচনে কতটুকু পটু।
ব্লু জেসমিন ছবির কাহিনি উপভোগ্য এবং ঠাসা বুননের পাণ্ডুলিপি। তদুপরি ব্লু জেসমিন দেখতে বসে বারবার মনে হয়েছে, এ যেন আমার পাশের গলির কোনো নারীর গল্প, আমার দেশের নারীর গল্প; কিংবা আমারই গল্প; শুধু ভাষা আর সামাজিকতা বা লৌকিকতা ছাড়া। হয়তো সারা বিশ্বে, সে পূর্ব কি পশ্চিম হোক; উত্তর কি দক্ষিণ হোক, নারীর একই রূপ; একই অবস্থান। নারী স্বাধীনতার যুগে আমেরিকার মতো ব্যক্তিস্বাধীন দেশে জেসমিনের প্রতি স্বামীর প্রতারণা বা বিত্তবান স্বামীর বিলাস-বৈভব ছেড়ে এসে অর্থাভাবে পড়া বা একটি কাজ জোটানো এবং কর্মস্থানে নারীর অনিরাপত্তা বা পুনরায় নতুন সম্পর্কের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে না পারা, এসব যেন আমাদের দেশের চিত্র। জিনজার যেমন সহজে জীবনের সঙ্গে মানিয়ে নিয়ে সুখী হয়ে উঠতে পারে, জেসমিন তা পারে না, বিলাসী জীবনে অভ্যস্ত জেসমিন সাধারণ জীবনের রূঢ় অনেক বাস্তবতার সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারে না। শেষ পর্যন্ত তাই আমরা দেখতে পাই জেসমিন নিঃসঙ্গ, কথা বলার কেউ নেই পাশে; সে নিঃসঙ্গ বেঞ্চে বসে নিজের সঙ্গে নিজেই কথা বলে চলেছে।
ব্লু জেসমিন একা নারীর গল্প, একাকিত্বের গল্প। সর্বোপরি ভালোবাসার গল্প।
ধোবী ঘাট
ধোবী ঘাট ছবিতে চারজন একাকী মানুষকে আমরা দেখতে পাই। চারজন চার আঙ্গিকের মানুষ, আপাতদৃষ্টিতে তাদের কারও সঙ্গে কারোরই মিল নেই, তারপরও তারা যেন সকলেই কোথাও একটি সূত্রে গাঁথা। এই রকম অবাণিজ্যিক ছবি তৈরি করা তখনই সম্ভব হয়, যখন একটি কাহিনিকে পর্দায় ফুটিয়ে তুলবার জন্য একজন পরিচালকের ছবির প্রতি প্রচণ্ড রকম ভালোবাসা কাজ করে। ধোবী ঘাটের পরিচালক কিরণ রাওয়ের ছবির প্রতি তেমন ভালোবাসা ছিল বলে দর্শক এ রকম একটি মনস্তাত্ত্বিক ছবি দেখতে পায়। ধোবী ঘাট ছবিটি যেমন চারজন মানুষের দুঃখ-বেদনা-হতাশা-অপ্রাপ্তি-অপূর্ণতার কথা বলে যায় দর্শকদের কানে কানে, তেমনি আরেকটি চরিত্রও দর্শকের চোখের সামনে ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠতে থাকে, তা হলো মুম্বাই শহর। মূলত এই ছবির কাহিনিতে শহরটি প্রধান চরিত্র। এই শহরের মধ্যে প্রবল ভালোবাসায় প্রতিদিন বিপুল মানুষ বাস করে, তেমনি অনেক মানুষ এই শহরে নিঃসঙ্গ জীবন টেনে চলে। সমাজের বিভিন্ন ক্লাসের মানুষের সমস্যা, ক্রাইম, শিল্পকলা, ফটোগ্রাফি এবং একই সঙ্গে শহরের রহস্যময়তার পরও ভালোবাসা আর নিঃসঙ্গতা এই ছবির গায়ে লেপ্টে থাকে।
ছবির প্রারম্ভে আমরা শহরকে নিয়ে ভিডিওতে ইয়াসমিনের বর্ণনা আর ট্যাক্সিওয়ালার সঙ্গে কিছু কথোপকথন শুনি। একপর্যায়ে ইয়াসমিনের ভিডিও ডায়েরি আশ্রয় নেয় ক্রমাগত বদলাতে থাকা শহরের একটি কাঠের দেরাজে। খ্যাতিমান, নির্বিকার কিন্তু জীবন থেকে পলায়নপর শিল্পী অরুণ সে ভিডিও খুঁজে পেলে শহরে নবাগতা তরুণী বধূ ইয়াসমিনের শহুরে একাকী জীবন তার সামনে ভাঁজ খুলতে থাকে, প্রতি ভাঁজে ‘পেহেলি চিঠ্ঠি, দুসরি চিঠ্ঠি, তেসরি চিঠ্ঠি’ নামে ভাইয়ের জন্য তৈরি করা ভিডিও ডায়েরিতে সে ইয়ামিনের জীবনের কৌতূহল, হাসি, চমক বা প্রতীক্ষা ইত্যাদি আবিষ্কার করে অচেনা-অজানা ইয়াসমিনের জন্য অন্য রকম ভালোবাসা বোধ করে। তাই তো দেরাজে খুঁজে পাওয়া ইয়াসমিনের রুপোর চেইন ঘষে পরিষ্কার করে হঠাৎ করেই নিজের গলায় পরে নেয় অরুণ।
মূলত এই ছবির কাহিনিতে শহরটি প্রধান চরিত্র। এই শহরের মধ্যে প্রবল ভালোবাসায় প্রতিদিন বিপুল মানুষ বাস করে, তেমনি অনেক মানুষ এই শহরে নিঃসঙ্গ জীবন টেনে চলে। সমাজের বিভিন্ন ক্লাসের মানুষের সমস্যা, ক্রাইম, শিল্পকলা, ফটোগ্রাফি এবং একই সঙ্গে শহরের রহস্যময়তার পরও ভালোবাসা আর নিঃসঙ্গতা এই ছবির গায়ে লেপ্টে থাকে।
আবার আমেরিকার ব্যাংকের চাকরি ছেড়ে আসা অ্যামেচার ফটোগ্রাফার শাইর সঙ্গে এক রাত্রি যাপন করেও অরুণের কাছে তা জীবনের একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া আর কিছুই নয়। যদিও শাই অরুণের সঙ্গে সম্পর্ককে একটি গন্তব্য দিতে চেয়েছিল। অন্যদিকে তরুণ ধোবী মুন্না, যার কাজ বাড়ি বাড়ি গিয়ে কাপড় সংগ্রহ করা, স্বপ্ন ফিল্মস্টার হওয়ার; তার সঙ্গে শাইর যে বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে ওঠে, তাতে শাইর পক্ষ থেকে মুন্নার জন্য কোনো প্রত্যাশা বা দায়িত্ববোধ ছিল না। কিন্তু মুন্নার মনে ফিল্মস্টার হওয়ার স্বপ্নের মতো, রূপকথার মতো আরেকটি স্বপ্ন দানা বাঁধে শাইকে নিয়ে। তাই তো সে অরুণের ঘরে শাইকে দেখে ঈর্ষান্বিত হয়ে পড়ে। আবার রাতের অন্ধকারে ইঁদুর মেরে বিক্রির জন্য দৌড়াতে থাকা মুন্নাকে শাই দেখে ফেলেছিল বলে বিব্রত মুন্না শাইর কাছ থেকে পালাতে থাকে কিংবা নিজের কাছ থেকে পালায়।
অরুণ ভিডিও ডায়েরির মাধ্যমে জানতে পারে ইয়াসমিনের মানসিক যন্ত্রণার কথা, শহরের আরেক নারীর সঙ্গে প্রেম আছে জেনে ইয়াসমিন তা সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করে। আত্মহত্যার চিহ্ন হয়ে ঝুলতে থাকা ছোট্ট একটুকরো দড়ির প্রান্ত, অরুণকে ওর ঘরের সামনে বসে থাকা পাশের ফ্ল্যাটের স্থবির বৃদ্ধার মতো স্থবির করে দেয়। জীবন থেকে বারবার পালাতে থাকা অরুণ ইয়াসমিনের স্মৃতিজড়ানো ঘর ছেড়ে আবার পালায়।
ঠিকানা বদলে ফেলা অরুণকে শাই খুঁজে বেড়ায়। ঈর্ষান্বিত মুন্না ঠিকানা দেবে কি দেবে নার দোলাচলে দুলতে দুলতে ঝট করে পকেট থেকে বের করে এনেছিল অরুণের বদলে যাওয়া ঠিকানা।
অরুণের চিত্রশিল্প, শাইর সাদাকালো ফটোগ্রাফি, ইয়াসমিনের ভিডিও ডায়েরি এবং মুন্নার স্বপ্ন- একটি মালার পুঁতির মতো এক সুতোয় গাঁথা হলেও এ সবকিছু নিঃসঙ্গ শহরটিকে কেন্দ্র করে ডালপালা মেলতে থাকে। তেমনি এই সব কটি চরিত্র ভালোবাসায় যেমন বাঁচতে চায়, তেমনি নিঃসঙ্গতায়ও ক্রমাগত ডুবতে থাকে।
লাঞ্চবক্স
এক অসম প্রেমের গল্প লাঞ্চবক্স। দুজন অসম চরিত্র, অসম বয়স এবং অপরিচিত মানুষের মধ্যে গড়ে ওঠা প্রেমের গল্প বলে লাঞ্চবক্স। না দেখে, না চিনে কী করে দুজন মানুষ এত কাছাকাছি চলে আসে এবং পরস্পর পরস্পরের ওপর নির্ভর করে উপেক্ষিত হয়ে ওঠা জীবন বা অবসরের অপেক্ষায় দিন গোনা জীবন পেছনে রেখে পুনরায় বেঁচে ওঠার আত্মবিশ্বাস ফিরে পাবার কথা বলে লাঞ্চবক্স। ছবিটি দেখে মনে হয় না এটি পরিচালক রিতেশ বাত্রার প্রথম তৈরি সিনেমা। সিনেমাটি দেখতে দেখতে আমরা একদম ঠিকঠাক পরিচালকের মেসেজ কটি পেয়ে যাই, ভুল ট্রেনে চেপেও সঠিক গন্তব্যে পৌঁছানো অনেক সময় সম্ভব হয়। কিংবা সম্পর্ক তৈরির জন্য পরিচয়, বয়স বা দেখা হওয়া জরুরি কোনো ব্যাপার নয়, পারস্পরিক ভাবনার, আশ্বাস বা সহানুভূতির ভেতর দিয়ে দুজন মানুষের বন্ধুত্ব গড়ে উঠতে পারে। সিনেমাটি দেখতে গিয়ে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া ‘পত্রমিতালী’র কথাও মনে পড়ে যায়।
সিনেমাটির কাহিনিবিন্যাসে দর্শক যা দেখে, তা অনেকটা এই রকম, ইলা সাধারণ গৃহবধূ; এক সন্তানের মা; স্বামীর মনোযোগ পাচ্ছে না বলে স্বামীর ভালোবাসা ফিরে পাবার আশায় প্রতিবেশী দেশপাণ্ডে আন্টির পরামর্শে স্বামীর জন্য দুপুরের লাঞ্চে নতুন রেসিপিতে রান্না করা খাবার পাঠায় অফিসে, ডিব্বাওয়ালার ভুলে সে লাঞ্চবক্স বা ডিব্বা অন্য অফিসে কর্মরত বিপত্নীক সাজান ফার্নান্ডেজের কাছে পৌঁছায়। ইলার পাঠানো খাবার বহুদিন পর বয়স্ক সাজান ফার্নান্ডেজ অমৃতজ্ঞানে খেয়ে নেয় পুরোটাই। লাঞ্চবক্স ফেরত এলে ইলা ভাবে, নতুন রেসিপিতে রান্না করা খাবার স্বামীর পছন্দ হয়েছে কিন্তু রাতে স্বামী ফেরার পর ইলা ভুল বুঝতে পারে। পরদিন ইলা কী এক মোহে সে ভুলের পুনরাবৃত্তি করে, তবে এবার খাবারের সঙ্গে একটি ছোট্ট চিঠিও পাঠায়, যেখানে সে সাজানকে পুরোটা খাবার খাওয়ার জন্য ধন্যবাদ জানায় এবং আর সেদিনের খাবার কেমন হয়েছে, জানতে চায়। সাজান খুব বেশি কিছু না লিখে শুধু জানায়, খাবার সল্টি হয়েছে। এভাবে ইলা আর সাজান ফার্নান্ডেজের মাঝে চিঠি-চালাচালি শুরু হয় এবং ইলা প্রতিদিন যত্ন করে রান্না করে তা লাঞ্চবক্সের মাধ্যমে অচেনা-অজানা সাজানের জন্য পাঠাতে থাকে। যদিও স্বামীর প্রতি রয়েছে ইলার ভালোবাসা (হয়তো স্বামীকে ভালোবাসতে হয়, ভারতীয় নারীর এই বোধ থেকে ইলার এই ভালোবাসার উৎপত্তি), স্বামীর শার্ট ধুতে গিয়ে সে হঠাৎই বুঝে যায়, স্বামীর অন্য আর এক নারীর সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে, যা জেনেও ইলা চুপ করে থাকে; কারণ, তার ধারণা, প্রতিবাদ করেই বা সে কোথায় যাবে?
লাঞ্চবক্স সিনেমাটিও আমাদের শেষ করতে হয় মনের ভেতর এক অনিশ্চয়তা নিয়ে, ইলা কি সাজানের ঠিকানা খুঁজে পাবে বা সাজান কি কখনো ইলার সামনে দাঁড়ানোর মতো মানসিক জোর পাবে নিজের ভেতর? দুজন নিঃসঙ্গ মানুষের ভালোবাসার ভেতর দিয়ে দর্শককে ছবিটি শেষ করতে হয় কাহিনির এমন এক মোচড়ে এসে, যেখানে দর্শকের মনে আশার হাওয়া দোলা দিয়ে যায়, আবার যায় না। সাজান আর ইলার শেষ পর্যন্ত দেখা হবে কি হবে নার মাঝে।
পরবর্তী সময়ে আমরা দেখতে পাই, ইলার মা তার দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ স্বামীর মৃত্যুর পর হঠাৎ করে নিজের ইচ্ছা-অনিচ্ছার স্বাধীনতা পেয়ে যান, তিনি মেয়েকে জানান; তার খুব পরোটা খেতে ইচ্ছে করছে। মার এই কথা থেকে ইলা নিজেও স্বাধীনতার স্পৃহা খুঁজে পায় আর এই সব কিছু সাজান জানতে পারে ইলার চিঠির মাধ্যমে। যখন ইলা স্বামী-সংসার-সন্তানের কাছ থেকে চলে যেতে চায়, অন্য দিকে বন্ধনহীন একাকী সাজান ফার্নান্ডেজ; ঠিক হয়, ওরা দেখা করবে। সিনেমার শেষ প্রান্তে এসে দর্শক যখন ভাবতে শুরু করে, ওদের মিলন হতে আর কোনো বাধা নেই; তখনই দর্শক আরেক অনিশ্চয়তার মাঝে নিক্ষিপ্ত হয়। কারণ, দেখা করবার মতো মানসিক জোর ইলার থাকলেও সাজানের থাকে না, বেরোবার আগমুহূর্তে নিজেকে আয়নায় দেখে সাজানের বৃদ্ধ ঠাকুরদার মতো লাগে নিজেকে। আবার নিজেকে ঠাকুরদার মতো লাগলেও ইলাকে দেখার লোভ সামলাতে পারে না সে, তাই লুকিয়ে ইলাকে দেখে তার মনে হয়; ইলা অনেক বেশি তরুণ আর খুব বেশি সুন্দর, ইলার পাশে নিজেকে বেমানান ভেবে সে নিজেকে ইলার কাছ থেকে সরিয়ে নিতে চায়। ছবিটির আরেক চরিত্র শেখের কাছে নিজের কাজের জায়গাটুকু ছেড়ে দিয়ে সাজান ফিরে যায় নিজের পুরোনো বাড়িতে। আর ইলা তার স্বপ্নের দেশ ভুটান যাবার জন্য নিজের গয়না বেঁচে প্রস্তুতি নেয়।
লাঞ্চবক্স সিনেমাটিও আমাদের শেষ করতে হয় মনের ভেতর এক অনিশ্চয়তা নিয়ে, ইলা কি সাজানের ঠিকানা খুঁজে পাবে বা সাজান কি কখনো ইলার সামনে দাঁড়ানোর মতো মানসিক জোর পাবে নিজের ভেতর? দুজন নিঃসঙ্গ মানুষের ভালোবাসার ভেতর দিয়ে দর্শককে ছবিটি শেষ করতে হয় কাহিনির এমন এক মোচড়ে এসে, যেখানে দর্শকের মনে আশার হাওয়া দোলা দিয়ে যায়, আবার যায় না। সাজান আর ইলার শেষ পর্যন্ত দেখা হবে কি হবে নার মাঝে।
এই যে সেলুলয়েড জগতের হাজার রকম চরিত্র, সব চরিত্র মন কাড়ে না; আবার কিছু চরিত্র মনের গভীরে নোঙর করে বসে চিরকালের জন্য। চরিত্রদের এই সব নাটকীয়তায় দর্শকদের কখনো কখনো আসল নকলের তফাত করতেও ভ্রম হয়। আর উল্লিখিত এই সব চরিত্র দেখে আমাদের একটি কথাই মনে হতে পারে, মানুষ সব সময় একা, যেমন তার জন্মমুহূর্তে কিংবা মৃত্যুকালে। আবার জন্ম-মৃত্যুর মাঝের কিছু সময়ও তাকে একা আর নিঃসঙ্গ পথ চলতে হয়। চরিত্রের এই নিঃসঙ্গতায় দর্শকও চরিত্রে নিমজ্জিত হয়ে নিঃসঙ্গ হয়ে যায়।