পেশা নাকি পছন্দ (পর্ব-২)
চলচ্চিত্রিক মানসিকতা : পেশা নাকি পছন্দ (পর্ব-১) এর পর থেকে-
পীর সাহেব হওয়ার উদ্দেশ্য আমার কোনো দিনও ছিল না। তবে একটা ভালো চলচ্চিত্র শিক্ষালয় প্রতিষ্ঠা করার ইচ্ছা আমার অনেক দিনের। তাই সহযোগিতা চাইতে আসা সবাইকেই আমার ছোট্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটাতে ভর্তি হওয়ার অনুরোধ জানাই। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তাদের উত্তর হয়, ‘কোর্স তো ভাইয়া আরও হবে, আমি পরের ব্যাচে ভর্তি হব।’ পরের ব্যাচ যায়, তারও পরের ব্যাচ যায়। কিন্তু তারা ভর্তি হয় না। না আমার এখানে, না অন্য কোনো প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানে। (আমার প্রতিষ্ঠানটাকে এখনো ভুঁইফোড় প্রতিষ্ঠানই বলা যায়)। মোট কথা, তারা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে শিখতে রাজি না। ঠিক যেমন, আমার আব্বা কোনো কন্সট্রাকশন ফার্মের হাতে তার বাড়ি বানানোর দায়িত্ব না দিয়ে রাজমিস্ত্রির সাথে পরামর্শ করেছিল, তেমনি এরাও কোনো কোর্স করে পুরোটা একবারে জেনেবুঝে নিতে রাজি নয়। নিজে নিজেই সব কাজ করতে গিয়ে আটকে গেলে শুধু তখনই আমার মতো কোনো রাজমিস্ত্রির পরামর্শ নিতে আগ্রহী। তিক্ত হলেও সত্য, এদের দিয়ে আর যা-ই হোক, অ্যাভেটার বা অ্যাভেঞ্জার্স তো হবেই না, চাষী নজরুল ইসলামের ‘ওরা ১১ জন’ বা শহিদুল ইসলাম খোকনের ‘লড়াকু’-ও হবে না।
এই সমস্ত সিনেমাপাগলের প্রতি আমার উপদেশ- নিউটন সাহেব আপেলগাছতলায় বসে থেকে মাধ্যাকর্ষণ শক্তির অস্তিত্ব আবিষ্কার করেছিল। নিউটনের সেই আবিষ্কার ক্লাসের বই পড়ে শিখতে যদি আপনাদের আপত্তি থাকে, তবে বাংলাদেশে তো তেমন একটা আপেলগাছ নেই, ভরা মৌসুমে আপনারা কাঁঠালগাছতলায় বসে দেখতে পারেন। মাথায় কাঁঠাল ভাঙলেও ভাঙতে পারে।
আমার এমন কড়া বক্তব্যে জানি অনেকেই অপমানিত বোধ করছেন। বিশ্বাস করেন, আপনাদের অপমানিত করার কোনো উদ্দেশ্যই আমার নেই। আমার উদ্দেশ্য বাংলাদেশে অনেক অনেক, ভালো ভালো আর্ন্তজাতিক মানের সিনেমা তৈরি হোক। তাই আমার বক্তব্যটা আরেকবার একটু ভিন্নভাবে বোঝানোর চেষ্টা করি। আমি নিয়মিতভাবে আমার বউ-বাচ্চার ওপরে ডাক্তারি করে থাকি। জ্বর হলে প্যারাসিটামল, সর্দি হলে হিস্টাসিন, পেট খারাপ হলে মেট্রোনিডাজল, ডায়রিয়া হলে টেট্রাসাইক্লিন, গ্যাসের সমস্যা হলে অ্যান্টাসিড বা অমিপ্রাজল, কেটে গেলে ডেটল, পুড়ে গেলে বার্নল, মুখের ভেতরে ছড়ে গেলে সিভিট ইত্যাদি ইত্যাদি। বলতে পারেন আমার চিকিৎসাসেবায় আমার পরিবার মোটামুটি নিরোগ জীবন যাপন করছে। কিন্তু আমার মেরুদণ্ডের গোড়ায় যখন প্রচণ্ড ব্যথা হয় অথবা থাইরয়েডের সমস্যার কারণে আমার বউয়ের হাত-পা যখন ফুলে যায়, তখন আমার আর কিছু করার থাকে না। কারণ, আমি ডাক্তার নই। ডাক্তার হতে পাক্কা চার বছরের সেশন শেষ করে তারপর বছরখানেক ইন্টার্ন করতে হয়। ৫ বছরের লম্বা সাধনা করার পরই একজন মেডিকেল ছাত্রকে রোগীর চিকিৎসা করার লাইসেন্স দেওয়া হয়। এরপর বিশেষজ্ঞ ডাক্তার হতে গেলে আরও কয়েক বছরের পড়াশোনার ধাক্কা।
এতক্ষণ রোগের লক্ষণগুলো নিয়ে কথা বললাম। এবার রোগের কারণ নিয়ে বলি। অনেক সরকারি আমলা টেনিস খেলতে পছন্দ করেন। অফিসার্স ক্লাবে গিয়ে নিয়মিত টেনিস খেলেন। বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় বিজয়ীও হন। অর্থাৎ তিনি টেনিস খেলা পছন্দ করেন। শুধু পছন্দই করেন না, টেনিসের ব্যাপারে তিনি ড্যাম সিরিয়াস। কিন্তু দিনের শেষে তিনি কেবলই একজন আমলা, টেনিস তারকা নন।
মোদ্দা কথা, এর-ওর কাছ থেকে জেনে জ্বর-সর্দি-কাশি আপনি সারাতেই পারবেন। কিন্তু পুরো ডাক্তার হতে পারবেন না। ঠিক তেমনি, নিয়মিত হলিউডি সিনেমা দেখে, মোবাইল ফোনের এফএম রেডিওতে চলচ্চিত্রসংক্রান্ত টক শো শুনে, আপনি ফেসবুক কাঁপানোর মতো শর্টফিল্ম অবশ্যই বানাতে পারবেন, কিন্তু সিনেমা হলের বক্স অফিস কখনোই কাঁপাতে পারবেন না। কান, বার্নিল বা ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসব তো দূরের কথা। আবারও বলছি সিনেমা আবেগের ব্যাপার নয় যে মনের জোরেই সবকিছু পারবেন। এটা টেকনিক্যাল ব্যাপার এবং শুধু একটা নয়, অনেকগুলো টেকনিক্যাল ব্যাপারের সমষ্টি। লাইট, ক্যামেরা, সাউন্ড, এডিটিং- অনেক ধরনের টেকনোলজি সম্পর্কে আপনাকে ধারণা নিতে হবে। সেই সাথে এই টেকনোলজির প্রয়োগ কীভাবে আবেগীয় ক্ষেত্রে করতে হবে, তার ফর্মুলাও জানতে হবে। যদি এই সবের কোনোটাই ভালোমতো না শিখে আপনি ‘অ্যাভেটর’, ‘মুন্নাভাই এমবিবিএস’ বা ‘রঞ্জনা আমি আর আসব না’র মতো সিনেমা বানাতে পারেন, তো কথা দিলাম, আপনার বয়স যা-ই হোক, আমি আপনার বাসায় গিয়ে আপনার পা ছুঁয়ে সালাম করে আসব।
আরেক ধরনের সিনেমাপাগল আছে আমাদের দেশে। এবার তাদের কথা বলি। জেলা শহরগুলোতে সে সময় তেমন একটা কন্সট্রাকশন ফার্ম ছিল না। থাকলেও আমার আব্বার কন্সট্রাকশন ফার্মের শরণাপন্ন হওয়ার সামর্থ্য ছিল না। তাই আব্বা নিজেই যা পেরেছে, সাধ্যমতো করেছে। বর্তমানে বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ফিল্ম মেকিং নিয়ে পড়াশোনা হচ্ছে। আমার আব্বার মতো অনেকেই আছে, যারা সিনেমার ব্যাপারে সিরিয়াস কিন্তু সেখানে পড়াশোনা করার সামর্থ্য নেই। অর্থাৎ সাধ আছে, সাধ্য নেই। কতটুকু সাধ্য নেই, সেটা জানলে বিস্মিত হতে হয়। আমার ছোট্ট ফিল্ম স্কুলটিতে কোর্স ফি মাত্র তিন হাজার টাকা। ছয় সপ্তাহের কোর্স, ১২টি ক্লাস, তিন হাজার টাকা। খুব বেশি নয়। (অবশ্য আমি বিখ্যাত কেউ নই। তাই এর বেশি কোর্স ফি রাখাও সম্ভব নয় আমার পক্ষে। তবে বিখ্যাত হলেও কোর্স ফি খুব বেশি বাড়াব না, কথা দিচ্ছি)। তো, আমার কোর্স ফি তিন হাজার টাকার চেয়ে কম নয় কেন, এর উত্তর দিতে দিতে আমার জান বেরিয়ে যাওয়ার দশা। কেউ কেউ রিকোয়েস্ট করে কোর্স ফি কম করে দেওয়ার জন্যে। আবার কেউবা আমাকে অর্থলোভী পিশাচ বলে আক্রমণ করে বসে।
তো, এতক্ষণ রোগের লক্ষণগুলো নিয়ে কথা বললাম। এবার রোগের কারণ নিয়ে বলি। অনেক সরকারি আমলা টেনিস খেলতে পছন্দ করেন। অফিসার্স ক্লাবে গিয়ে নিয়মিত টেনিস খেলেন। বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় বিজয়ীও হন। অর্থাৎ তিনি টেনিস খেলা পছন্দ করেন। শুধু পছন্দই করেন না, টেনিসের ব্যাপারে তিনি ড্যাম সিরিয়াস। কিন্তু দিনের শেষে তিনি কেবলই একজন আমলা, টেনিস তারকা নন। গ্রান্ড মাস্টার নিয়াজ মোর্শেদ একবার একটা গানের ক্যাসেট বের করেছিলেন। গান তিনি সাংঘাতিকভাবে পছন্দ করেন বলেই তা করেছিলেন। কিন্তু গান তার পেশা নয়। তার পেশা হলো দাবা খেলা। কিছুদিন আগে রুনা লায়লা তার ডিজাইন করা একটা বুটিক শপ চালু করেছেন। অর্থাৎ ফ্যাশন ডিজাইনে তার আগ্রহ আছে। কাজটা তিনি পছন্দ করেন। কিন্তু তিনি পেশাদার ডিজাইনার নন। তিনি পেশাদার সংগীতশিল্পী। মাসুদ রানার স্রষ্টা কাজী আনোয়ার হোসেন একসময় রেডিওতে নিয়মিত রবীন্দ্রসংগীত গাইতেন। সুভাষ দত্তের ‘সুতরাং’ সিনেমায় তার গাওয়া একটা গান খুব জনপ্রিয়ও হয়েছিল। তার মানে গানের ব্যাপারে তিনি সিরিয়াস ছিলেন। কিন্তু গানকে তিনি পেশা হিসেবে বেছে নেননি। তিনি পেশায় একজন লেখক ও প্রকাশক।
ঠিক আছে, মেনে নিলাম সিনেমার লোকেরা সবাই লম্পট। প্রশ্ন হচ্ছে আপনার এলাকার ওয়ার্ড কমিশনার, সে লম্পট নয়? কোনো করপোরেট অফিসের কর্মকর্তা, সে লম্পট নয়? ডাক্তাররা নার্সদের সাথে প্রেম করে না? প্লেনের পাইলটরা এয়ার হোস্টেসদের সাথে প্রেম করে না? তাহলে শুধু নায়ক, নায়িকা আর পরিচালকদেরই দোষ কেন?
অর্থাৎ কোনো কিছুকে সিরিয়াসলি পছন্দ করলেই যে সেটাকে আপনি পেশা হিসেবে নেবেন, এর কোনো নিশ্চয়তা নেই। একটি ছেলে বিবিএ পড়তে পড়তে দু-চারটা শর্টফিল্ম বানাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে বিবিএ তার ভবিষ্যৎ পেশা, চলচ্চিত্র স্রেফ পছন্দমাত্র। যত যা-ই বলেন, ফ্যামিলির চাপেই হোক আর নিশ্চিত জীবনের আকাঙ্ক্ষাতেই হোক, পাস করার পরে সে কোনো মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানিতেই জয়েন করবে এবং একটু একটু করে কাজের চাপে চলচ্চিত্র থেকে অনেক দূরে সরে যাবে। এটাই বাস্তবতা। আপনি যে কাজটা ভালোমতো জানেন, সেটাই ভালোমতো করতে পারবেন। আর সেখান থেকেই আপনার উপার্জন হবে। বাপের হোটেল থেকে বের হয়ে একদিন নিজের হোটেল দাঁড় করাবেন। তখন যদি বউ বলে বসে, ‘খাওয়াতে পারো না তো বিয়ে করছ ক্যান? থাকো তুমি তোমার সিনেমা নিয়ে। আমি চললাম। হয় তোমার সিনেমা, নয়তো আমি। ডিসিশন নাও।’ তখন কিন্তু গার্লফ্রেন্ডের সাথে যত সহজে ব্রেকআপ করেছিলেন, তত সহজে বউকে ডিভোর্স দিতে পারবেন না।
অর্থাৎ পছন্দ যা-ই হোক, মানসিক বা সামাজিকভাবে যেটাকে আপনি ভবিষ্যৎ পেশা হিসেবে বিশ্বাস করবেন, আপনি শেষ পযর্ন্ত তা-ই করবেন। এবং এতে কোনো অপরাধ নেই। সিনেমা বানানোর জন্যে না খেয়ে থাকার তো কোনো মানে হয় না। বেঁচে থাকতে হলে খেতে পরতে তো হবেই। প্রশ্ন হলো সিনেমাটা আপনাদের কাছে শুধু পছন্দ হয়েই থেকে যাচ্ছে কেন? সেটা কেন আপনার সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ পেশা হয়ে উঠছে না? সিনেমা থেকে আপনারা রোজগার করতে পারবেন, সেই বিশ্বাসটা কেন আপনাদের মাঝে আসছে না? একসময় মাছ বা মুরগির খামার করাটাকে কোনো পেশা হিসেবে ধরা হতো না। এখন অনেক মানুষ শুধু হ্যাচারির ব্যবসা করেই গাড়ি হাঁকিয়ে বেড়ায়। টেক্সটাইল ইনস্টিটিউট যখন চালু হয়, তখন সেখানে ছাত্র পাওয়া কষ্টকর ছিল। কেউ দরজি হতে চাইত না। এখন এই সাবজেক্টের সাংঘাতিক ডিমান্ড। চলচ্চিত্রশিল্প বেকায়দায় থাকলেও টিভি মিডিয়ার তো এখন রমরমা অবস্থা, তাহলে নাটক বা চলচ্চিত্র নির্মাণকে কেন এখনো আমরা মন থেকে পেশা হিসেবে মানতে পারছি না?
হয়তো বলবেন, এই পেশায় নিশ্চয়তা কম। ভাই রে, কোর্ট-কাচারিতে গিয়ে দেখেন, কালো রং জ্বলতে জ্বলতে লালচে হয় যাওয়া কোট পরে কত উকিল বটতলায় বসে আছে। তাদের কোনো মক্কেল নাই। তারপরও মানুষ উকিল হতে রাজি আছে। ওকালতি একটা পেশা। স্টক মার্কেটে কতবার ভরাডুবি হচ্ছে, তারপরও মানুষ শেয়ার কিনছে। অথচ একবার একটা সিনেমা ডুবে গেলেই আপনাদের মন তিতা হয়ে যায়। আসলে নাটক-সিনেমা নিয়ে আমাদের মনে ধর্মীয় ও সামাজিক একটা ট্যাবু কাজ করে। যারা এই লাইনে যায়, তাদের চরিত্র ঠিক থাকে না, সিনেমার লোকেরা সব লম্পট হয় ইত্যাদি ইত্যাদি। ঠিক আছে, মেনে নিলাম সিনেমার লোকেরা সবাই লম্পট। প্রশ্ন হচ্ছে আপনার এলাকার ওয়ার্ড কমিশনার, সে লম্পট নয়? কোনো করপোরেট অফিসের কর্মকর্তা, সে লম্পট নয়? ডাক্তাররা নার্সদের সাথে প্রেম করে না? প্লেনের পাইলটরা এয়ার হোস্টেসদের সাথে প্রেম করে না? তাহলে শুধু নায়ক, নায়িকা আর পরিচালকদেরই দোষ কেন?
শুধু তা-ই নয়, এই শহরের বহুতলবিশিষ্ট ফ্ল্যাটগুলোতে হাজবেন্ড অফিসে চলে গেলে হাউজওয়াইফরা কেউই কি পরকীয়ায় লিপ্ত হয় না? সবাই সতী-সাবিত্রী? স্টার্টিং বেতন মাসে ত্রিশ হাজার টাকা, অফিস থেকে মোবাইল, ল্যাপটপ আর ট্রান্সপোটেশন সুবিধা, এমনকি ফ্ল্যাটবাড়িও সে সুন্দরী তরুণীকে করপোরেট অফিস থেকে দেওয়া হয়, তার কাজ যে কোম্পানির ক্লায়েন্টদের সন্তুষ্ট করা, সেটা কি মেয়েটা চাকরি নেওয়ার সময় জানত না? এ রকম অগণিত উদাহরণ দেওয়া যায় বিভিন্ন ক্ষেত্রে মানুষের লাম্পট্য আর অবৈধ যৌন জীবনের। তাহলে আঙুল শুধু কেন চলচ্চিত্রজগতের দিকেই ওঠে? দুঃখজনক হলেও সত্য, শুধু চরিত্র নষ্ট হবে বলে আমরা অনেকেই সিনেমাকে খুব করে পছন্দ করি কিন্তু পেশা হিসেবে নিতে চাই না। যদিও বয়ফেন্ড বা গার্লফ্রেন্ডের সাথে একা একটা ঘরে ঘনিষ্ঠ মেলামেশাকে একেবারেই খারাপ কিছু বলে মনে করি না।
প্রশ্ন হলো সিনেমাটা আপনাদের কাছে শুধু পছন্দ হয়েই থেকে যাচ্ছে কেন? সেটা কেন আপনার সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ পেশা হয়ে উঠছে না? সিনেমা থেকে আপনারা রোজগার করতে পারবেন, সেই বিশ্বাসটা কেন আপনাদের মাঝে আসছে না? একসময় মাছ বা মুরগির খামার করাটাকে কোনো পেশা হিসেবে ধরা হতো না। এখন অনেক মানুষ শুধু হ্যাচারির ব্যবসা করেই গাড়ি হাঁকিয়ে বেড়ায়। টেক্সটাইল ইনস্টিটিউট যখন চালু হয়, তখন সেখানে ছাত্র পাওয়া কষ্টকর ছিল। কেউ দরজি হতে চাইত না। এখন এই সাবজেক্টের সাংঘাতিক ডিমান্ড।
অনিশ্চয়তা আর চরিত্রহীনতা, এই দুই জটিলতাসংক্রান্ত মানসিকতায় আটকে আছে আমাদের চলচ্চিত্রর পেশা হয়ে ওঠা, না ওঠা। দুটোই স্পর্শকাতর বিষয় এবং ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তের ব্যাপার। তা-ই আপনাকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে এটাকে আপনি পেশা হিসেবে মেনে নেবেন কি না। যদি করেন, তবে ডাক্তারি পড়ার জন্যে যেমন প্রয়োজনে জমিজমা বিক্রি করেন, তেমনি সিনেমা বানানো শেখার জন্যেও পয়সা খরচ করতে শেখেন। ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার জন্যে যেমন পড়াশোনার পেছনে বেশ অনেকগুলো বছর নির্দ্বিধায় ব্যয় করেন, তেমনি চলচ্চিত্র নির্মাণ শিখতেও কয়েক বছর নিষ্ঠার সাথে ব্যয় করেন। এমবিএতে যেমন গোল্ড মেডেল পেতে চান, তেমনি সিনেমার খুঁটিনাটিতেও সর্বজ্ঞ হওয়ার চেষ্টা করেন। আগেই বলেছি, যেটা আপনি ভালোমত পারবেন, সেটা থেকেই আপনার উপার্জন হবে। দায় সারা সাধনায় কেবল দায়সারা ফলাফলই আশা করা যায়।
তর্কের খাতিরে ধরে নিচ্ছি, আপনি গোল্ড মেডেল পাওয়ার মতো মেধাবী নন। সে ক্ষেত্রে স্বাভাবিকভাবেই আপনি পাস করার সঙ্গে সঙ্গে চাকরি পাবেন না। আপনাকে কয়েক বছর এই অফিস, সেই অফিস ধরনা দিয়ে বেড়াতে হবে এবং সেটা আপনার কাছে স্বাভাবিক বলে মনে হয়। কিন্তু সিনেমায় পরিচালক বা সহিকারী পরিচালক হিসেবে কাজ পাওয়ার জন্যে মাত্র এক বছর কোনো প্রযোজক বা কোনো পরিচালকের পিছে পিছে ঘোরাটাকেও আপনি সময়ের অপচয় বলে মনে করেন। কেন? কেন? কেন?
ভাই, সিনেমা নিয়ে পাগলামি তো অনেক করেছেন। শুধু পাগলামি দিয়ে কিছু হয় না। বিষয়টাকে পেশা হিসেবে নেওয়ার চেষ্টা করেন। অন্য সব পেশার মতো প্রথমে ধৈর্য ধরে এবং যৌক্তিক পরিমাণে অর্থ ব্যয় করে বিষয়টাকে ভালোমতো শেখেন। তারপর কিছুদিন আর দশটা পেশার মতো বেকারত্বের স্বাদ গ্রহণ করেন অথবা ছোট কোথায়, ছোট ছোট কাজের মাধ্যমে অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। নিজের বায়োডাটাটাকে একটু ভারী করেন। তারপর বড় কোনো কাজের সাথে যুক্ত হন।
টিভি সেক্টরটাকে আপনি অন্যান্য চাকরির মতো করে ভাবতে পারেন। আর চলচ্চিত্রকে ব্যবসা হিসেবে ভাবেন। তারপর ছাত্রজীবন থেকেই পরিকল্পনা করতে থাকেন কীভাবে আপনি অমুক টিভি চ্যানেলে অথবা অ্যাড ফার্মে সুই হয়ে ঢুকে ফাল হয়ে বের হবেন। অথবা কীভাবে আপনার সিনেমা নামক প্রোডাক্টটাকে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক মানুষের কাছে পৌঁছে দেবেন। সব পেশার মানুষই ছাত্রজীবন থেকে পরিকল্পনা করতে থাকে তার কর্মজীবনটাকে সে কীভাবে সাজাবে। শুধু সিনেমাপাগলরাই ভবিষ্যতের কথা ভাবতে গিয়ে ভক্তদের অটোগ্রাফ দেওয়া আর পুরস্কার নেওয়ার কথাই ভাবে। বিষয়টা হতাশাজনক এবং হাস্যকর। মানুষ কেন যেন অকারণেই বিশ্বাস করে নাটক-সিনেমার জগতে হঠাৎ করেই অনেক কিছু হয়ে যাওয়া যায়। সব উচ্চতায় যে সিঁড়ি বেয়েই উঠতে হয়, এটা তারা ভুলে যায়। বোধ করি বিষয়টা তাদের স্রেফ পছন্দের, তাই তারা দিবাস্বপ্নে নিমজ্জিত হয়।
সবশেষে একটা বিষয় পরিষ্কার করি। আমি শিখবার ব্যাপারে জোর দিচ্ছি। তা সে আপনি কোনো প্রতিষ্ঠান থেকেই শেখেন আর কারও পিছে ঘুরে ঘুরেই শেখেন- শিখলেই হলো। তবে কোনো পরিচালকের সাথে থেকে শেখাটা বেশ কষ্ট সাধ্য এবং সময়সাপেক্ষ। পরিচালক সিনেমা বানাবে, না আপনাকে তার কাজের খুঁটিনাটি বুঝিয়ে দেবে? তাই আমি কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে শিখবার পক্ষপাতী। শেখার পরে আপনি ইন্টার্ন সেশন হিসেবে কারও সহকারী হিসেবে কাজ করেন। তাতে করে আপনার জানাটা পোক্ত হবে। আত্মবিশ্বাস বাড়বে নিজের কোনো কাজ শুরু করার জন্যে। কেবল তখনই আপনি পারবেন এই দেশের চলচ্চিত্র অঙ্গনকে সত্যিকারের কিছু দিতে।
সমাপ্ত
অলংকরণ : রাজীব রায়