:
Days
:
Hours
:
Minutes
Seconds
Author Picture
পলিয়ার ওয়াহিদ

কবি, গদ্যকার

ভোলানাথ সরকার ও একটি ভাঙা সিংহের সকাল

ভোলানাথ সরকার ও একটি ভাঙা সিংহের সকাল

শরতের সকাল। আড়মোড়া ভাঙতে তাই আসলেমি। তার ওপর রোদ খুব কড়া। নড়াচড়া করাও যেন দায়। ভোলা স্যারের বাড়িতে আজ যাবই। পুরনো জলপাই রঙের হিরো সাইকেলটা বের করা হলো। বউ বাগড়া দিচ্ছে। এখন যেতে হবে না। কাল যেয়ো। আমি নাছোড়বান্দা। আজ যেতেই হবে।

এখুনি আসছি বলেই পথে বেরিয়ে গেলাম। বহুদিন বাদে সাইকেল। বেশ ফুরফুরে লাগছে। মোটরসাইকেল ঘরে রেখে কেন আমি বাইসাইকেলে চাপি, এ নিয়ে পরের তীব্র আপত্তি! আমি জানি কোনটার ভেতর কী!

হু হু করে সাইকেল ছুটছে। আমিও। আমি যেন পক্ষীরাজে চড়েছি। মসৃণ পিচের রাস্তায় দৌড়াচ্ছি। বিশাল পানের বরজ পেরিয়ে বাঁশবন। তার ভেতর দিয়ে দেখা যাচ্ছে চৌগাথা প্রাইমারি স্কুল। এখানেই আমার শৈশবের মোহর ছড়ানো। কী সেই সোনারঙা সকাল। কেমনে যে কাটিয়ে দিতাম রাঙাদুপুর। বালক বিকেল। আর ক্লান্ত সন্ধে নিয়ে ঘরে ফিরতাম আমি। কত রঙের স্মৃতির আসবাসে যে আমি বসে আছি এখন। সাইকেলের ওপর আমি আর আমার ওপর তাগড়া স্মৃতিগুলো চেপে বসল।

ওই তো ভোলা স্যার! কিলাসে আসছে। আমি স্যারের পিছু নিয়েছি।
এ স্যার এ স্যার। কিলাস নিবিনে?
স্যার পেছন ফিরে আমাকে মিষ্টি করে হেসে বলছে। ক্লাসে যাও। আমি আসব এখনি।
আমি কি এখনো স্যারের কিলাসে? হয়তোবা। নয়তো কড়া রোদের কিলাসে চালাচ্ছি বাইসাইকেল।

দেখতে দেখতে স্কুলটা পার হয়েছি। মনেই নেই। জেলেপাড়া পার হয়ে গেছি। নাপিতপাড়ার মাঝবরাবর। সত্য আর নিত্যের কথা মনে পড়ল। কাকাতো ভাই ওরা। নিত্য চলে গেছে। একেবারে। কেথায়? তা বলতে পারব না। আমি এখনো মেনে নিতে পারিনি। নিত্য নেই এটা আমি স্বীকার করতে পারি না আজও। শেষবার যখন নিত্যকে দেখতে গেলাম, নিত্যর মা আমাকে জড়িয়ে ধরে বললে, বাবা, তোরা আসিস না কেন? তোরাও তো আমার ছেলে, নাকি? আমি বোবা হয়ে যেতাম। নিত্যের মায়ের চোখে তখন জল শুকিয়ে গেছে। আর কাঁদতে পারত না। একটামাত্র ছেলে নিত্য। চলে যাচ্ছে। কেউ ঠেকাতে পারছে না। নিশ্চিত এই খবর কী করে মানবেন মা? তবু তিনি খুব স্বাভাবিক হলেন। মুড়ি দিলেন। খেজুরের পাটালিসমেত। আমি খাচ্ছি না দেখে আরও চিৎকার করে, খা রে বাবা, খা। নিত্য চলে যাবে আমি জানি। কষ্ট নেই কোনো। ভগবান নিলে আর ঠেকায় কে?

সাইকেল চলছে। আমি আর চড়তে পারছি না যেন। ছোট ছোট দূর্বা ঘাসের বুক চিরে এই পিচঢালা পথ। দুপাশে বড় বড় বিল। বিলের দুপাশে গ্রাম। এক পাশে ভোলা স্যারের বাড়ি। রাস্তার পাশে মানকচুর ডাগর ডাগর ডানাগুলোর ছাপটানি দেখি। কিন্তু নিত্য থেকে বের হতে পারি না। বিলের দিকে মুখ করলে আমার চোখ দিয়ে জল চলে আসে। আমি কাঁদি না তবু! কতবার ভেবেছি ওর মাকে একবার দেখে আসব। সাহস হয়নি আমার!

নিত্য নেই এটা আমি স্বীকার করতে পারি না আজও। শেষবার যখন নিত্যকে দেখতে গেলাম, নিত্যর মা আমাকে জড়িয়ে ধরে বললে, বাবা, তোরা আসিস না কেন? তোরাও তো আমার ছেলে, নাকি? আমি বোবা হয়ে যেতাম। নিত্যের মায়ের চোখে তখন জল শুকিয়ে গেছে। আর কাঁদতে পারত না। একটামাত্র ছেলে নিত্য। চলে যাচ্ছে। কেউ ঠেকাতে পারছে না। নিশ্চিত এই খবর কী করে মানবেন মা? তবু তিনি খুব স্বাভাবিক হলেন। মুড়ি দিলেন। খেজুরের পাটালিসমেত।

পাল্টে গেছে সব। প্রযুক্তি আর বিজ্ঞানের অভিশাপে আমাদের পাল্টে গেছে স্মৃতি। পাল্টে গেছে আমাদের স্বাদের জীবন। শুকনো কলাপাতার মতো পাল্টে যাচ্ছে যাপন। আমাদের এত কিছু পাল্টে যায় কিন্তু সত্যিকারের দুঃখ পাল্টায় না। কষ্টরা পাল্টায় না। আমাদের বেদনা দূর হয় না। জলকাদা মাখা রাস্তা পাকা হওয়ার সাথে সাথে মাগার আমাদের দুখেরা পাকা হয়ে ওঠে! আমাদের কপালের চারপাশে রোম জন্মে। নতুন নতুন পাকা পাকা কষ্টের রোম। আমরা হাসি। কাঁদি। আমাদের বন্ধুরা চলে যায়। বিজ্ঞান হাসে। এগিয়ে যায়। আমাদের নতুন নতুন রোগও হাজির হয়। প্রযুক্তি আঙুল চোষে। আমি এই বিজ্ঞান আর প্রযুক্তির দুভাইকে অভিশাপ দেব চিরকাল!

জলের ওপর শুয়ে আছে লাউয়ের মাচান। আমিও যেন একটা ঝুলে থাকা লাউ! শুয়ে থাকা স্থির মাচান। তার দিয়ে বেঁধে দেওয়া শক্ত বাঁধন। আমি আসলে ছিঁড়ে পড়া জল। টলটল। সাইকেল চলছে। মৃদু ছায়াঘেরা গ্রাম পেরিয়ে আরেক গ্রাম। মনোহরনগর পাড়ি দিয়ে বাগডাঙ্গা। মুসলমান ডিঙিয়ে হিন্দু। জল পেরিয়ে পানি। মসজিদ ছুঁয়ে মন্দির। আমিও পেরিয়ে যাই। লম্বা বুড়ো খেজুরগাছের ছায়া। বয়স্ক শিরীষগাছের পাতার দুলুনি।

বাগের উত্তর। মানে উত্তরবাগ। উত্তরের বাগান বা বিল। বাগের উত্তরের এই উঁচু বিলেও ছেয়ে গেছে মাছের ঘের। সবাই পয়সাওয়ালা। এক-একটা মাছের ঘেরকে এক-একটা উষ্কখুষ্ক কচ্ছপ মনে হচ্ছে। শরতের রোদে তারা পিঠ পেতে ঘুমিয়ে আছে। ঘেরের বাঁধের ওপর কলাগাছ আর পেঁপেগাছের সারি। কেউ লাগিয়েছে লকলকে পুঁইশাক। পুঁইশাকের চ্যাপ্টা যৌবন দেখে কী করে আর ঘরে ফিরি? আমি সাইকেল থেকে নেমেই পড়ি। একটু জিড়িয়ে নিই।

ঝিরঝিরে বাতাস। যতই বিলের মধ্যে আসি, আরও বাতাসের তেজ বাড়ে। মাথার ওপর নীল আকাশ। সাদা মেঘের কোনো বালাই নেই। শরৎকে মনে হচ্ছে চৈত্র মাস। ঋতু আর রং সব বদলে গেল। কই, আপনাদের জ্ঞান-বিজ্ঞান-প্রযুক্তির কাজটা কী? সে শুধু বদলে দেয়, কাজের কাজ পারে না কিছুই। মানুষ আর কতকাল সেরা থাকবে, জানি না। তবু মনে হচ্ছে মানুষের যুগ শেষ। এখন যুগ হলো প্রযুক্তির। আর সে কারণে খোঁড়া হব আমরা। আমাদের লাঠি এগিয়ে দেবে না বিজ্ঞান। আমি তা হলফ করে বলতে পারি।

স্যার এখনো তেমনটাই যেন আছেন। আকাশ-নীল পাঞ্জাবি। সাদা ধুতিতে যেন সেই ভোলানাথ সরকার। ছবি : পলিয়ার ওয়াহিদ

আবার সাইকেলে চড়েছি। নিমগাছের পাতা দেখে লোভ হলো। তবু আর নামি না। ওই তো স্যারের বাড়ির সাদা বুদ্ধ রংটা দেখা যাচ্ছে। সামনে চিকন ঢোঁড়া সাপের মতো আঁকাবাঁকা খালটা পেরিয়ে গেলেই হলো। কিন্তু একি! খালটাকেও জ্যান্ত থাকতে দেয়নি মানুষ। জেলেপল্লির বদমাশগুলো তার সরু শরীরে বসিয়েছে নানান ফিকির। মানুষ যেন সব খাবে। জল খাবে। খাল খাবে। বিল খাবে। শালার মানুষ!! মানুষও খাবে।

স্যারের বাসায় কাছে গিয়ে ভড়কে গেলাম। ও মা, একি? এটা তো স্যারের বাসা না?
এক পথচারীকে স্যারের নাম বলতেই বললেন, নতুন এসেছেন, বাপু?
আমি কাঁচুমাচু করে বললাম, জি, অনেক দিন পর তো…
উনিও লম্বা করে ওওওওওওওওওওওওও বলে নড়বড়ে আঙুল তুলে দেখিয়ে দিলেন।
আমি ওনাকে ধন্যবাদ দিতেই এগিয়ে এলেন।
তা তুমি কই থেকে এলে?
আমি ওমুকের ভাইপো! বলতেই চওড়া হাসি দিয়ে আমাকে পিঠ চাপটে দিলেন। শহরে থাকো তো শুনেছি। তা আমাদের ভুলে গেলে চলবে বাপু…। কত বড় হয়েছ। কত ছোট দেখেছি তোমাকে। বাপের সাথে মাঠে আসছ। ঠিক বলিনি?
আমি তো হা! আমরা ভুলে গেলে তারা আমাদের মনে রাখবে কেন?

স্যার বাড়িতে আছেন? কয়েকবার বললাম। কোনো উত্তর নেই। সাদা বাড়িটার বয়স হয়েছে। ধানের গোলাটা গলা বাড়িয়ে হেলে পড়েছে একদিকে। একটু ঝুঁকে পড়েছে বাড়ির আঙিনা। একটা লম্বা শিশুগাছের ছায়া এসে আমাকে সঙ্গী করেছে। ছায়াটা ক্ষণে ক্ষণে দুলছে। আমার তোফাজ্জেল কাকার কথা মনে পড়ছে। কাকাকে এখন মিস করি। দেখা কোম হয়। অথচ একই শহরে থাকি। একসময় কাকার প্রতি বিরক্ত হতাম। এখন নিজের প্রতি বিরক্ত হই। কাকাকে মিস করি। খুব মিস করি। স্যার নিশ্চয় কাকার কথা জিগাবেন। আমি তখন কী বলব?

ছোট্ট একটা কচি মুখ দরজা ফাঁক করে ফিক করে হেসে দিল। আমি তাকে ডাকতেই দাদু দাদু বলেই চিৎকার পড়ে গেল। স্যার শুয়ে আছেন সকালের আহার সেরে। আমি গিয়ে বসলাম বেতের মোড়ায়। স্যারের পাশে। স্যারের গায়ের গন্ধও আগের মতো! মানুষের গায়ের গন্ধ আমার ভালো লাগে। ঘামে জবজবে শরীরের গন্ধ আরও ভালো লাগে। প্রেমিকারা এই কথা শোনার পর আমাকে ঘেন্না করেছে। ছ্যাদাড়ে বলে গাল দিয়েছে। আমি হেসেছি। আহারে মানুষের শরীরের গন্ধ কী যে মধুর! স্যার যেন ঘুমের ঘোরেও হাসছেন। মুখে সেই ‍শিশুসুলভ হাসিটা এখনো অবিকল। বিছানাটা এলোমেলো। একটু আগেও বোধ হয় শিশুদের হাত-পায়ের অত্যাচারের চিহ্ন ধরে আছে। তাদের জোরজবরদস্তি বিছানার সমস্তটা জুড়ে।

স্যার? স্যার? দুবার ডাকতেই তিনি চোখ খুললেন।
তুমি? কখন এলে, বাবা?
আমি যেন আলাদিনের সেই দৈত্যটার সামনে দাঁড়ানো।
তোমার নামটা কিন্তু আমি ভুলিনি।
তুমি ওহিদুল না?
কেন মনে আছে, জানো?
না স্যার।
তোমার কাকার সাথে বাজারে বেতন তুলতে গেলে প্রায় দেখা হয়। তোমার কাকার নাম শহিদুল। সেখান থেকে শহিদুল্লাহ। আমি তোমাকে অহিদুল্লাহ বলে ডাকতাম।
জি স্যার।

আমি ওমুকের ভাইপো! বলতেই চওড়া হাসি দিয়ে আমাকে পিঠ চাপটে দিলেন। শহরে থাকো তো শুনেছি। তা আমাদের ভুলে গেলে চলবে বাপু…। কত বড় হয়েছ। কত ছোট দেখেছি তোমাকে। বাপের সাথে মাঠে আসছ। ঠিক বলিনি?
আমি তো হা! আমরা ভুলে গেলে তারা আমাদের মনে রাখবে কেন?

তো স্যার বুড়ো হলেও এখনো তেমনটাই যেন আছেন। আকাশ-নীল পাঞ্জাবি। সাদা ধুতিতে যেন সেই ভোলানাথ সরকার। শক্ত আর খড়খড়ে এখনো। পিটপিট করে বললেন, শোনো, এখনো কিন্তু চশমা ছাড়া দেখতে পাই বুঝলে। ওই দ্যাখো তোমাদের চোখে চশমা উঠে গেছে। বেশ, তা কেমন আছ, বলো?
জি স্যার, ভালো আছি।
বেশ। তোমার হাতে ওটা কী?
জি স্যার, আমি একটু-আধটু লিখি তো!
আহা, সে তো খুশির খবর। লজ্জায় পাওয়ার কী আছে? তা কী লেখো?
স্যার কবিতা।
বাহ্, তুমি তাহলে কবিই হলে?
স্যার, এটা আমার কবিতার বই। আমার তিনজন প্রিয় শিক্ষকের নামও উৎসর্গে আছে। আপনি তাদের একজন।
আহা রে কী সৌভাগ্য আমার। দেখি দেখি তোমার বইটা। লোভ ধরিয়ে দিলে যে তুমি!

স্যার এখন আর স্যার নেই। যেন আমার ছোট্টবেলাটির গুরু। শিক্ষগুরু। তিনি এখন আমাকে আর নাম ধরে ডাকতে সাহস পাচ্ছেন না। বইয়ের ওপর ‘সময়গুলো ঘুমন্ত সিংহের’ পাশাপাশি ‘পলিয়ার ওয়াহিদ’ নামটা দেখে আমার দিকে আরেকবার চাইলেন।
তুমি….
জি স্যার।
তুমি পুরো বদলে গেছ। ঠিক তোমার নামটা যেমন বদলে গেছে।
বুঝিনি স্যার।
তুমি না বুঝলেও আমি বুঝেছি। বুঝতে পারছি সারা জীবন শুধু ছাগল-গরুর পেছনে সময় ব্যয় করিনি। দু-একটা মানুষও ছিল তার ভেতরে।

স্যারের চোখ ছলছল করছে। অনেকগুলো নামের ভিড়ে স্যার নিজের নামটা পেয়ে আনন্দে যেন মাতোয়ারা। শিশুর মতো এবার তিনি কাঁচুমাচু করছেন।
আমি লজ্জা পাচ্ছি।
আমার নিশ্চুপ জড়তা ভেঙে বলে উঠলেন, নজরুল তোমার প্রিয় কবি? নাজিম হিকমতও? কী দারুণ মিশেল। বেশ।

আমরা এবার কনফুসিয়াসে ঢুকে পড়ি। স্যার গল্প করতে করতে…বলতে বলতে আমাকে যেন শিশু বানিয়ে দিলেন। আমি ওনার মুখের দিকে তাকিয়ে শুনছিলাম। উনি কতক্ষণ বাদে জানি না, একবার বলে উঠলেন, ওই দেখো, এখনো সেই বকবক করার নেশা গেল না। দুজনেই আমরা হেসে উঠি।

সূর্যের তেজ বেড়ে গেল। স্যারের ছোট ছোট দাদুরা আমাদের ভিড় করে রইলেন। তারপর স্যারকে প্রণাম করে যখনই বিদায় নেব, স্যার আমাকে বুকে জড়িয়ে নিলেন। আমার গর্ব হচ্ছে অহিদুল্লাহ। তুমি পলিয়ার ওয়াহিদই হয়ে ওঠো আরও।

‘অহিদুল’ থেকে ‘অহিদুল্লাহ’, তারপর ‘অহিদুজ্জামান।’ এরপর কীভাবে কখন ‘পলিয়ার ওয়াহিদ’ হলাম, সে গল্প আগামী পর্বে …শোনার আজান রেখে গেলাম।

 

গত পর্বে পড়ুন-
 আব্দুল্লাহ মুন্সি ও লাল তাবিজের অসুখ 


অলংকরণ : রাজীব রায়

Meghchil   is the leading literary portal in the Bengali readers. It uses cookies. Please refer to the Terms & Privacy Policy for details.