সিনেমা, দর্শক ও পরিচালক (পর্ব-১)
চলচ্চিত্রিক মানসিকতা : পেশা নাকি পছন্দ (পর্ব-২) এর পর থেকে-
বাংলাদেশের চলচ্চিত্র নিয়ে যারা ভাবেন, তাদের মুখে প্রায়ই শোনা যায়, আমাদের দেশে নাকি ভালো বা শিল্পসম্মত সিনেমার দর্শক নেই এবং যারা সিনেমা দেখেন, তারাও মোটামুটি এই সব চলচ্চিত্রবোদ্ধাদের কথায় সায় দিয়ে নিজেরাও ছোটখাটো একজন চলচ্চিত্রবোদ্ধা হয়ে যেতে চান। তাদের এই বক্তব্যের পক্ষে যে যুক্তিটি সাধারনত তুলে ধরা হয়, তা অতি দৃশ্যমান। বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি শহরেরই একটা-দুটো করে সিনেমা হল ভেঙে ফেলা হচ্ছে। যে সিনেমা হলের নামে ঢাকার অন্যতম ব্যস্ততম এলাকা ‘গুলিস্তান’-এর নাম, সেই গুলিস্তান সিনেমা হল তো কবেই মার্কেটে পরিণত হয়েছে। একের পর এক সিনেমা হলগুলোর মার্কেট কমপ্লেক্সে পরিণত হওয়া দেখে মনে হয় যেন মার্কেট নামক কোনো এক ভয়াবহ ভাইরাস এই দেশের সব সিনেমা হলকে একটু একটু করে গিলে খাচ্ছে। এ যেন এক মহামারি।
হলগুলো সব মার্কেট হয়ে যাচ্ছে, তার অর্থ হলো ‘হল’ ব্যবসা ভালো চলছে না। এটা অনস্বীকার্য যে চলচ্চিত্র প্রদর্শনী একটি ব্যবসা। আর ব্যবসায় লাভ হবে, এটাই সবার আকাঙ্ক্ষা। লস দিয়ে কোনো ব্যবসাই বেশি দিন পরিচালনা করা সম্ভব নয়। প্রশ্ন হলো, কী কারণে হল ব্যবসা বর্তমানে আর লাভজনক নয়?
এই ব্যবসার দুটি অংশ। একটি হচ্ছে সিনেমা, অন্যটি দর্শক এবং বর্তমানে দর্শকেরাই বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে। যদিও ৮০-র দশক থেকে শুরু করে বেশ লম্বা একটি সময় পর্যন্ত চলচ্চিত্রের গুণগত মান তথা অশ্লীলতাই প্রধান আসামি হিসেবে বিবেচিত হতো। বেশ কিছু পরিচালক তাদের চলচ্চিত্র দিয়ে প্রমাণ করেছেন যে অশ্লীলতা ছাড়াও বাংলাদেশে চলচ্চিত্র নির্মাণ ও প্রদর্শন সম্ভব। তারপর থেকেই বলতে গেলে হল ব্যবসায় ধসের সমস্ত দায়ভার একা দর্শকদেরই বহন করতে হচ্ছে।
সমস্যা হলো, দর্শক যে সিনেমা দেখে না, তার জলজ্যান্ত প্রমাণ সিনেমা হলগুলোর মার্কেট কমপ্লেক্সে পরিণত হওয়া। অপর দিকে যার কাছেই জানতে চাই, সেই বলে ‘আজ অ্যাভেঞ্জার্স এজ অব এলট্রন দেখলাম। কাল ইমতিয়াজ আলীর তামাশা দেখছি। কয়েকটা ফাটাফাটি কোরিয়ান সিনেমা ডাউনলোড করে রাখছি। কালকে থেকে সেগুলো দেখা শুরু করব। ইরানি পরিচালকেরা তো এক একটা বস।’ শুধু তা-ই নয়, আগবাড়িয়ে বরং অনেকে বলে, ‘এই সিনেমাটা দেখছেন? ওই সিনেমাটা দেখেন নাই, মিস করছেন। পেন ড্রাইভ আছে? দেন, আপনাকে দিয়ে দিই।’ এমনকি কার হার্ড ড্রাইভে কত গিগা মুভি আছে, সেই নিয়ে প্রতিযোগিতাও চলে ছেলেপেলেদের মাধ্যে।
বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি শহরেরই একটা-দুটো করে সিনেমা হল ভেঙে ফেলা হচ্ছে। যে সিনেমা হলের নামে ঢাকার অন্যতম ব্যস্ততম এলাকা ‘গুলিস্তান’-এর নাম, সেই গুলিস্তান সিনেমা হল তো কবেই মার্কেটে পরিণত হয়েছে। একের পর এক সিনেমা হলগুলোর মার্কেট কমপ্লেক্সে পরিণত হওয়া দেখে মনে হয় যেন মার্কেট নামক কোনো এক ভয়াবহ ভাইরাস এই দেশের সব সিনেমা হলকে একটু একটু করে গিলে খাচ্ছে। এ যেন এক মহামারি।
অর্থাৎ বর্তমান প্রজন্ম প্রতিদিন দুই-তিনটা করে হলিউডি, বলিউডি নয়তো কোরিয়ান বা ইরানি সিনেমা দেখতে পারে, অথচ মাসে একটা করে বাংলাদেশের সিনেমাও দেখতে পারে না। শুধু বাড়িতে বসে ল্যাপটপে দেখলেও হতো, তারা রীতিমতো সিনেপ্লেক্সে গিয়েও বয়ফ্রেন্ড বা গার্লফ্রেন্ডের সাথে পপকর্ন খেতে খেতে টারমিনেটর জেনেসিস অথবা কুংফু পান্ডা দেখে। কিন্তু বাংলাদেশি সিনেমা নয়। তাহলে? তবে কি ধরে নিতে হবে যে এই দেশের তরুণসমাজের অধিকাংশই আমেরিকার সিআইএ, ভারতের র, নয়তো কোরিয়ান অথবা ইরানি সিক্রেট সার্ভিস, যাদের নাম আমার জানা নেই, তাদের এজেন্ট হয়ে গেছে এবং তাদের মিশন হলো বাংলাদেশের চলচ্চিত্র অঙ্গনকে ধ্বংস করে সেখানে হলিউড, বলিউড, কোরিয়ান এবং ইরানি সিনেমার বাজার তৈরি করা?
মীর জাফর, মীর কাশেম বা জগৎ শেঠের মতো বেইমান, দেশদ্রোহীরা যে যুগে যুগে আমাদের দেশে বসবাস করছে, দুঃখজনক হলেও সে কথা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। দেশ স্বাধীন হওয়ার প্রায় পর থেকেই তো আমাদের মধ্যে স্বাধীনতার পক্ষ-বিপক্ষ বলে দুটি স্রোত বিদ্যমান। একটি স্রোতে রুশ-ভারত এবং আরেকটি স্রোতে আমেরিকা-পাকিস্তানের আধিপত্যও অনস্বীকার্য। কিন্তু কোরিয়া বা ইরানের তাঁবেদারি শুরু করার মাজেজাটা কী? আরও অবাক কাণ্ড, যে পাকিস্তানের আইএসআইয়ের এজেন্ট আমাদের দেশের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বাসা বেঁধে আছে বলে অভিযোগ রয়েছে, সেই পাকিস্তানি সিনেমাকে কিন্তু আমাদের এই তরুণ মীর জাফররা মোটেও প্রমোট করছে না! তাহলে কি সমস্যাটা ভিন্ন জায়গায়?
বিষয়টাকে তবে একটু তলিয়ে দেখা যাক। যেহেতু বিষয়টা দর্শকসংক্রান্ত, তাই প্রথমেই আমাদের বুঝে দেখা দরকার ‘দর্শক’ জিনিসটা আসলে কী? ব্যাকরণগতভাবে যে দর্শন করে, সে-ই দর্শক। বলে রাখা ভালো, এটা অ্যারিস্টটল বা সক্রেটিস-জাতীয় দর্শন নয়, এটা ‘দেখা’ শব্দটির সাধু রূপ। তো, প্রশ্ন হচ্ছে, দর্শক আসলে কী দেখে এবং কেন দেখে?
অর্থাৎ বর্তমান প্রজন্ম প্রতিদিন দুই-তিনটা করে হলিউডি, বলিউডি নয়তো কোরিয়ান বা ইরানি সিনেমা দেখতে পারে, অথচ মাসে একটা করে বাংলাদেশের সিনেমাও দেখতে পারে না। শুধু বাড়িতে বসে ল্যাপটপে দেখলেও হতো, তারা রীতিমতো সিনেপ্লেক্সে গিয়েও বয়ফ্রেন্ড বা গার্লফ্রেন্ডের সাথে পপকর্ন খেতে খেতে টারমিনেটর জেনেসিস অথবা কুংফু পান্ডা দেখে। কিন্তু বাংলাদেশি সিনেমা নয়।
যা বুকের মধ্যে আবেগ সৃষ্টি করে, উত্তেজনা জাগায় অথবা মনের মাঝে একটা প্রশান্তির আবেশ ছড়িয়ে যায়, কোনো বোধের উদয় ঘটায়, আবার কখনো কখনোবা অসম্ভবকে সম্ভব করার অনুপ্রেরণা জাগায়, দর্শক তা-ই দেখে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, লেটারস টু জুলিয়েট, নাটিং হিল, ওয়েডিং প্লানার, এই-জাতীয় সিনেমাগুলো আমাদের মনে প্রেমময় আবেগ তৈরি করে। দক্ষিণ ভারতের অ্যাকশন সিনেমা আমাদের উত্তেজিত করে, নিজেদের সুপারম্যান ভাবতে শেখায়। দ্য আল্টিমেট গিফট, রং দে বাসন্তি বা থ্রি ইডিয়ট আমাদের মধ্যে জীবনকে নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে বাধ্য করে। চাক দে ইন্ডিয়া, লগন বা জীবন থেকে নেয়া আমাদের মধ্যে অসম্ভবকে সম্ভব করার অনুপ্রেরণা জাগায়।
এবার আসা যাক কেন দেখে? উত্তরটা অতিমাত্রায় সোজা। বিনোদিত হওয়ার জন্য। বিনোদন অবশ্য সবার কাছে এক রকম নয়। কেউ ডিজে পার্টির হই-হুল্লোড়ে বিনোদন খুঁজে পায়, কেউবা আবার ঢিমে ত্রি তালের উচ্চাঙ্গ সংগীতে। কেউ সাহিত্যবিষয়ক আলোচনায়, তো কেউ গাঁজার ধোঁয়ায়। মোটকথা, আমাদের বিনোদিত হওয়ার সব চেষ্টা সব সময় সফল হয় কি না, এই নিয়ে লম্বা আলোচনার সুযোগ থাকলেও এ কথা অনস্বীকার্য যে জীবিকার বাইরে আমরা যা কিছুই করি, তা কোনো না কোনোভাবে বিনোদিত হওয়ার জন্যই করে থাকি। সুতরাং সিনেমাও যে আমরা বিনোদিত হওয়ার জন্যই দেখে থাকি, এতে কোনো সন্দেহ নেই।
তো, এ কথা বোধ হয় বলা যেতেই পারে যে আমরা বর্তমানে যেসব হলিউডি, বলিউডি, কোরিয়ান বা ইরানি সিনেমা দেখি, সেগুলোতে পূর্ণমাত্রায় বিনোদিত হই বলেই দেখি। সেই বিচারে সম্ভবতঃ এ কথা বললেও ভুল হবে না যে এই বিনোদন বা তৃপ্তিটুকু আমাদের দেশীয় সিনেমায় অনুপস্থিত। খুব স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে, এই দেশের বর্তমান দর্শকেরা তাহলে আমাদের দেশের পরিচালদের কাছ থেকে ঠিক কী ধরনের চলচ্চিত্র আশা করেন।
চলবে…
অলংকরণ : রাজীব রায়