ভ্রু, চোখ, গালিব, ফয়েজ ও অন্যান্য
ফয়েজ আহমদ ফয়েজের একটা কবিতা আছে– জরসে গুল কি সদা, মানে ফুলের ঘন্টাধনি। ফুল দেখতে তো ঘন্টার মতো। আর আগের কালে যাত্রিদল পথে বিশ্রাম শেষে চলা শুরু করতে ঘন্টা বাজিয়ে ডাকা হতো। ফয়েজ ফুলের ডাক শুনতে পেতেন। এই কবিতার শেষ স্তবক এরকম:
যখনি প্রিয়র দরজার ভ্রু ডাক পাঠাবে
যে মরুতেই থাকি, চলে আসবো
যদি দ্বার খোলা পাই, হয়তো আবার দেখবো তোমাকে
বন্ধ পেলে, ডাক দিয়ে যাব চলে
‘প্রিয়র দরজার ভ্রু’? এর মানে কী? জোড়া ভ্রু দেখতে অবিকল ধনুকের মতো। যখন সে বিরক্তি নিয়ে ভ্রু কুঁচকে তাকায়, সে ভ্রু দেখতে তীর ছুড়তে প্রস্তুত ধনুকের মতো। ভ্রুর নিচে যে চোখ, সেই হচ্ছে ফয়েজের প্রিয়র দরজা। সেই দরজার কাছে ভ্রু হচ্ছে ধনুক হাতে প্রহরী।
ভ্রু আর চোখ নিয়ে গালিবের দেখা অন্য রকম:
তার ভ্রু’র নিচে যেমন টলটলে চোখ দেখি
মসজিদের গম্বুজের নিচে তেমন পানশালা থাকা উচিত
(মসজিদ কে যেরে সায়া খারাবাত চাহিয়ে
ভঁও পাস কিবলায়ে হাজাত চাহিয়ে)
আল্লামা ইকবাল চোখ নয়, দৃষ্টি নিয়ে বললেন:
হাজারোঁ সাল নার্গিস আপনি বেনুরি পে রোতি হ্যায়
বড়ি মুশকিল সে হোতা হ্যায় চমন মেঁ দিদাবর প্যায়দা
(হাজার বছর ফুল নিজের রূপহীনতায় কাঁদে
অনেক কষ্টে তাঁকে ফুলবাগানে তাঁকে দেখার চোখ জন্মায়)
সাগর সিদ্দিকি ছিলেন ইংরেজি সাহিত্যের ঝকঝকে নামি ছাত্র। ১৯৪৭’র পর ভারতের আমাবালা হতে লাহোর এলেন। নামি কবি, সিনেমায় গান জনপ্রিয়। কী হলো সব ছেড়ে এক কম্বল গায়ে লাহোরের ফুটপাথবাসী হলেন। সংসার বলতে স্টোভ, চায়ের সরঞ্জাম আর একজন কুকুর। ফুটপাথেই কবিতার আসর বসাতেন। মেহেদি হাসান সাহেব, ম্যাডাম নুরজাহান পথের পাশেই তাঁর সঙ্গে বসে মিনতি করে গজল লিখিয়ে নিতেন। যাক সে কথা, এই সাগর সিদ্দিকি লিখলেন:
ম্যায়নে পলকোঁ সে দরে য়ার পে দস্তক দি হ্যায়
ম্যায় ও সায়িল হুঁ জিসে কোয়ি সাদা য়াদ নেহি
(আমি চোখের পলক দিয়ে প্রিয়র দরজায় কড়া নেড়েছি
আমি সেই ভিক্ষুক যে সব ডাক ভুলে গেছে)
আমার চোখের পলক দিয়ে আমি কোথায় কড়া নাড়তে পারি? নিজেরই চোখে। তাহলে যে প্রিয়র খোঁজে সব ডাক ভুলেছি, সে তো আমারই চোখে থাকে! সাগর নিশ্চয়ই কবির দাসের এই দোহা জানতেন:
নয়নোঁ কি করি কোঠরি পুতলি পালং বিছায়ে
পলকো কি চিক ডারকে পি কো লিয়া রিঝায়ে
(নয়ন করেছি ঘর, বিছিয়েছি তাতে চোখের মনির বিছানা
তারপর চোখের পলকের পর্দা টেনে, প্রিয়কে নিয়ে আছি সুখে)
অলমিতি বিস্তরেণ!