:
Days
:
Hours
:
Minutes
Seconds
Author Picture
মফিজ ইমাম মিলন

প্রাবন্ধিক

জসীম উদ্‌দীন : আমাদের ‘সাধু’ কবি
প্রচ্ছদ: রাজিব রায়

জসীম উদ্‌দীন : আমাদের ‘সাধু’ কবি

‘পৃথিবী থেকে ধীরে ধীরে নক্সী কাঁথার মাঠ অবুলপ্ত হয়ে যাচ্ছে, মুছে যাচ্ছে আল্পনার দিন, নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে পুঁথি-পাঠের আসর এবং বিদায় নিয়ে যাচ্ছে এই সব সনাতন ধারার বাহক বহু শিল্পী কবি এবং সাহিত্যিক’–এই চিরায়ত সত্যগুলো নতুন করে মনের ভেতর মোচড় খেয়ে ওঠে পল্লীকবি জসীম উদ্‌দীনের ১১৬তম জন্মোৎসবে। আজ থেকে ৪২ বছর আগে তিনি ইহলোক ত্যাগ করেন।

জসীম উদ্‌দীনের জন্মস্থান ফরিদপুরেই আমার জন্ম। তাঁর সঙ্গে প্রথম পরিচয় ঘটে শৈশবে পাঠ্যপুস্তকের পাতায়। ‘কবর’ কবিতার প্রথম আট লাইন মুখস্থ করা অথবা ‘নিমন্ত্রণ’ শব্দার্থ লেখা–এ ধরনের প্রথাগত পড়াশোনার মধ্য দিয়েই জসীম উদ্‌দীনের সাথে ঘনিষ্ঠতা। কবি কিংবা কবিতা নিয়ে ভাববার বয়স হয়নি। শুধু ‘কবর’ কবিতা সিলেবাসে অন্তর্ভূক্ত থাকায় বার বার পড়তে হয়েছে। এ কবিতাটির সাথে নিদারুণ কষ্টের এক গল্পের আমেজ থাকায় আরো বেশি করে পড়া হয়েছে।

এরপর মধুমালা, বেদের মেয়ে, সোজন বাদিয়ার ঘাট, নক্সী কাঁথার মাঠের সঙ্গে পরিচয় ঘটে ধীরে ধীরে। জসীম উদ্‌দীনকে চেনা-জানার পথটিকে সহজ করেছিলেন আমার মা। মায়ের একটি ‘এনইসি’ ট্রানজিষ্টার ছিল। সপ্তাহে কোন কোন দিন কোন সেণ্টারে কি নাটক হবে, তা ছিল আমার মা ও নানীর মুখস্থ। বেদের মেয়ের ছোট বাইদানীর কষ্টে মা কাঁদতেন। চোখের কান্না কখনো মিথ্যে হয় না। সত্যি সত্যিই জসীম উদ্‌দীন মানুষকে কাঁদাতে পারতেন। নিজেও ব্যক্তিজীবনে সহজ-সরল ছিলেন। অপরের দুঃখে হাউ-মাউ করে কাঁদতেন।

এরপর মধুমালা, বেদের মেয়ে, সোজন বাদিয়ার ঘাট, নক্সী কাঁথার মাঠের সঙ্গে পরিচয় ঘটে ধীরে ধীরে। জসীম উদ্‌দীনকে চেনা-জানার পথটিকে সহজ করেছিলেন আমার মা। মায়ের একটি ‘এনইসি’ ট্রানজিষ্টার ছিল। সপ্তাহে কোন কোন দিন কোন সেণ্টারে কি নাটক হবে, তা ছিল আমার মা ও নানীর মুখস্থ। বেদের মেয়ের ছোট বাইদানীর কষ্টে মা কাঁদতেন। চোখের কান্না কখনো মিথ্যে হয় না। সত্যি সত্যিই জসীম উদ্‌দীন মানুষকে কাঁদাতে পারতেন। নিজেও ব্যক্তিজীবনে সহজ-সরল ছিলেন। অপরের দুঃখে হাউ-মাউ করে কাঁদতেন।

আমি তখন ফরিদপুর ময়েজউদ্দীন হাই স্কুলের ছাত্র। প্রধান শিক্ষকের নাম বালাগাত উল্লাহ। এসিস্ট্যান্ট হেড মাষ্টার শ্রী শ্রীশ চন্দ্র ঘোষ। একদিন ক্লাস রুমের পার্টিশন তুলে দিয়ে লম্বা হল রুম বানানো হলো। কিছুক্ষণ পর শ্রীশ স্যার পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললেন, “আমার এ বন্ধুর ডাক নাম ‘সাধু’ ভাল নাম জসীম উদ্‌দীন।’ আমরা সমস্বরে আনন্দে চিৎকার করে উঠলাম, কবি এসেছে কবি এসেছে। লম্বা একহারা চেহারা, পরনে সাদা পাজামা-পাঞ্জাবী। পা দু’খানা লম্বা, –বড় বড় পা ফেলে হাঁটছিলেন আর পড়ছিলেন ‘কবর’ কবিতা। কিছুক্ষণ পরেই কবি কাঁদতে লাগলেন। আমরাও সকলে ‘কবর’ কবিতা কবির স্বকণ্ঠে শুনে কেঁদেছিলাম।

অনেকদিন পর কবিকে আরেকবার দেখলাম ফরিদপুরের ‘চেরাগ আলী বুক ডিপো’-তে। সেখানে একজন চেয়ারে বসে আছেন, কাঁধে মশারি। জানলাম, তিনিই কবি জসীম উদ্‌দীন, আর ভুল করে চাদর ভেবে মশারি নিয়ে এসেছেন। ঘটনা দু’টি উল্লেখ করলাম এ কারণে যে, এতে জসীম উদ্‌দীনের চরিত্রের একটি বিশেষ দিক স্পষ্ট হয়। তিনি ছিলেন সোজা সরল কথা বলা ও সাদা মনের মানুষ। সারাজীবনই মৌলিকত্বের অন্বেষায় কাটিয়েছেন, খুঁজে আনতে চেষ্টা করেছেন সবচেয়ে আদিম মনের রঙ, তাঁর সাদামাটা স্বাভাবিক চেহারা, নির্ভেজাল অনুভূতির নির্যাস।

মানুষের জাগতিক দুঃখের রূপকার ছিলেন কবি জসীম উদ্‌দীন। গ্রামবাংলার হিন্দু-মুসলমান উভয় সমাজের জীবনপ্রবাহ যিনি উপস্থাপন করেছেন সমান দরদ দিয়ে। লোকজীবন থেকে সংগ্রহ করেছেন তাঁর কাব্যের উপকরণ।

কবি জসীম উদ্‌দীনের মতো করে গ্রামের আল পথে, ধানখেতে, গ্রামের রোদ-হাওয়া গায়ে মেখে বেদের বহরের হাসি-কান্নায় সুর মেলাতে আর কোনো কবি আবার কখনও বাংলায় আসবে কিনা তা ভবিষ্যতই বলতে পারে। কেননা, পৃথিবী থেকে ধীরে ধীরে নক্সী কাঁথার মাঠ বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে, হারিয়ে যাচ্ছে মাটির গন্ধমাখা উদার মন-মানসিকতাও। আসুন, জসীম উদ্‌দীনের কাব্যের সেই গাঁ-গ্রামে যাই, যেখানে দল নয়, মানুষ বড়।

Meghchil   is the leading literary portal in the Bengali readers. It uses cookies. Please refer to the Terms & Privacy Policy for details.