পরিচালনা সমাচার (পর্ব-২)
চলচ্চিত্রিক মানসিকতা : পরিচালনা সমাচার (পর্ব-১) এর পর থেকে-
শ্যুটিং মানে হল, আপনি এত দিন ধরে যা রিহার্সেল করিয়েছেন, আগে থেকে লোকেশন বা সেট ঘুরে দেখে যেভাবে যেভাবে লাইটিং করবেন বলে ভেবেছেন, যেভাবে ক্যামেরা অপারেশন করানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, যেদিন যে দৃশ্য শ্যুটিং করলে কাজটা নিখুঁততর এবং দ্রুততর হবে বলে বিবেচনা করেছেন- চোখ কান নাক মুখ সব বন্ধ করে সেই ভাবে কাজগুলো করে যাওয়া। যদি শ্যুটিংয়ের দিনে আপনি আপনার শিল্প সত্ত্বার কারিশমা দেখানো শুরু করেন, তো নিশ্চিত ইন্নালিল্লাহ। যে শ্যুটিং দশ দিনে হওয়ার কথা তা দশ মাসেও শেষ হবে কি না সন্দেহ। অর্থাৎ বাজেট বেড়ে যাবে। আর যদি সেই শ্যুটিং দশ দিনেই শেষ করতে যান তো এডিটিং করতে বসে দেখবেন একটি শটের সাথে আরেকটি শট কোন ভাবেই জোড়া লাগানো যাচ্ছে না। কন্টিনিউটি ব্রেক করছে। তাই শ্যুটিংয়ের সময় কিভাবে কি করবেন তা নিয়ে না ভেবে আগে থেকে সব কিছু ঠিক করে নেয়াই ভাল। যদিও আমাদের দেশে বর্তমানে বেশির ভাগ পরিচালকই সেটে এসে ক্যামেরা ওপেন করার পরই ভাবতে বসে কি করা যায়। আর তার ফলাফল তো আপনারা প্রতিনিয়ত দেখতেই পাচ্ছেন।
আরেকটা সমস্যা আছে, আপনি যদি শ্যুটিংয়ের সময় ভাল ম্যানেজমেন্ট করতে না পারেন তো আপনার ইউনিটের সবাই আপনার পদটা কেড়ে নেয়ার চেষ্টা করবে। সহকারী পরিচালক, ক্যামেরাম্যান, নায়ক, নায়িকা এমন কি লাইটম্যান বা প্রোডাকশন ম্যানেজারও পরিচালক বনে যাবে। সবাই যার যার মত করে ডিরেকশন দিতে শুরু করবে। মাঝখান থেকে আপনার সাধের সিনেমার চোদ্দ দু’গুনে আঠাশ গুষ্টি উদ্ধার হয়ে যাবে। তাই প্রি-প্রোডাকশনে সিদ্ধান্ত নেন কি করবেন আর শ্যুটিংয়ের সময় সেই সিদ্ধান্তগুলো সফল ভাবে বাস্তবায়ন করেন, ব্যস। বলা হয়ে থাকে, প্রয়োজনে বছর খানেক সময় নিয়ে প্রি-প্রোডাকশন করেন, কিন্তু শ্যুটিং করেন যতটা পারা যায় কম সময়ে। কারণ চিন্তা করতে খরচ নেই। কিন্তু শ্যুটিং করতে খরচ আছে। লম্বা শ্যুটিং মানেই লম্বা বাজেট। সেই সাথে কঠিনতর এডিটিং।
এখানে বলে রাখা ভাল, কোন কিছু শ্যুটিং করার সময় এডিট প্যানেলে যেন সেই ফুটেজগুলো একটার সাথে আরেকটাকে জোড়া দিয়ে কাহিনিকে ফুটিয়ে তোলা যায় সেই চিন্তা মাথায় রাখাটা রীতিমত ফরজে আইন। আমি বেশ কিছু সিনেমার কথা জানি, যাদের ব্যাপক সমারোহে শ্যুটিং হয়েছে কিন্তু পরবর্তিতে সেই সিনেমার কাজ সমাপ্ত করা হয়নি। কারণ সেখানে একটি শটের সাথে আরেকটি শট জোড়া দিয়ে কোন কাহিনি দাঁড় করানো যায়নি। সুতরাং, শ্যুটিং কোন ভাবেই শিল্প চর্চা নয়। এটা পিওর ম্যানেজমেন্টের ব্যপার। এবং এখানে আপনার একটাই লক্ষ্য হওয়া উচিৎ, আর তা হল দ্রুততর সময়ে নিখুঁততর ভাবে পুরো কাজটাকে তুলে আনা।
শ্যুটিংয়ের পরে এডিটিং, ডাবিং, ফলি সাউন্ড, কালার গ্রেডিং এসব টেকনিকাল ব্যাপার। তবে যেহেতু আপনার সিনেমাটাকে সুদৃশ্য ও শ্রুতি মধুর করার জন্যই এতো সব আয়োজন, তাই পোস্ট প্রোডাকশনের এইসব টেকনিক্যাল কাজ একজন শিল্প মনষ্ক লোকের অধীনে হওয়াই উত্তম। সুতরাং এখানে পরিচালক হিসাবে আপনাকে আবারও শিল্প বোদ্ধা হতে হবে। নয়ত এত সব পরিশ্রম সবই পানিতে পড়বে। তবে এডিটিং সুপারভাইজার বলে একটা পদ রয়েছে চলচ্চিত্র জগতে। এই ভদ্রলোকের কাজ হল পরিচালকের চাহিদা অনুযায়ী শিল্পসম্মত ভাবে এডিটিং সমাপ্ত করা।
আপনি যদি শ্যুটিংয়ের সময় ভাল ম্যানেজমেন্ট করতে না পারেন তো আপনার ইউনিটের সবাই আপনার পদটা কেড়ে নেয়ার চেষ্টা করবে। সহকারী পরিচালক, ক্যামেরাম্যান, নায়ক, নায়িকা এমন কি লাইটম্যান বা প্রোডাকশন ম্যানেজারও পরিচালক বনে যাবে। সবাই যার যার মত করে ডিরেকশন দিতে শুরু করবে। মাঝখান থেকে আপনার সাধের সিনেমার চোদ্দ দু’গুনে আঠাশ গুষ্টি উদ্ধার হয়ে যাবে। তাই প্রি-প্রোডাকশনে সিদ্ধান্ত নেন কি করবেন আর শ্যুটিংয়ের সময় সেই সিদ্ধান্তগুলো সফল ভাবে বাস্তবায়ন করেন, ব্যস।
বাকি থাকল সংগীত। সংগীত নিঃসন্দেহে শিল্প, এতে কোন দ্বিমত নেই। আর সংগীত মানুষের মনের উপরে যে কি পরিমাণ প্রভাব বিস্তার করতে পারে তা চলচ্চিত্র নির্মাণের সাথে যারা যুক্ত নন, তারা সহজে বুঝবেন না। এক কাজ করেন, আপনার কম্পিউটারে একটা সিনেমা চালু করেন। তারপর সেটা একবার মিউট করে দেখেন, আরেকবার আওয়াজ দিয়ে। তফাৎটা অনেকখানি ধরতে পারবেন।
সিনেমাটা কোন কোন হলে যাবে। বাংলাদেশ বেতারের বিজ্ঞপন তরঙ্গে হেঁড়ে গলায় ‘হ্যাঁ ভাই অমুক প্রযোজিত, তমুক পরিচালিত, সুপারস্টার প্রমূখ অভিনীত সম্পূর্ণ রঙিন পারিবারিক এ্যাকশন ছবিটি দেখতে ভুলবেন না’, জাতীয় কোন বিজ্ঞাপন হবে কি না – চলচ্চিত্র পরিবেশনার এসব যে নিতান্তই মার্কেটিংয়ের বিষয় তা নিশ্চয় কাউকে বুঝিয়ে বলতে হবে না।
তো, পুরো বিষয়টা প্রথম থেকে আরেকবার ঝালাই করে নেয়া যাক। স্ক্রিপ্ট রাইটিং – শিল্প। শিল্পী ও কলাকুশলী নিয়োগ – ব্যবসায়িক বিবেচনা। রিহার্সেল – কিছুটা শিল্প, কিছুটা ম্যানেজমেন্ট। শট ডিভিশন – শিল্প। কোন ধরনের ক্যামেরা বা লাইট ব্যবহার হবে – প্রযুক্তিগত বিবেচনা। সেট র্নিমাণ বা আর্ট ডিরেকশন – শিল্প। স্যুটিং – ম্যানেজমেন্ট এবং কেবলমাত্র ম্যানেজমেন্ট। এডিটিং, ডাবিং, ফলি সাউন্ড, কালার গ্রেডিং – কিছুটা প্রযুক্তি, কিছুটা শিল্প। আবহ সংগীত – শিল্প। পরিবেশনা – ব্যবসায়িক বিবেচনা।
অর্থাৎ চলচ্চিত্র মানে হল শিল্প, প্রযুক্তি, ম্যানেজমেন্ট এবং ব্যবসা-এর সমন্বয়। আর একজন পরিচালককে সদা সর্বদা চলচ্চিত্রের এই সবগুলো বিষয়ের উপরে নিয়ন্ত্রণ রাখতে হয়। তবে চলচ্চিত্র যেহেতু টিম ওয়ার্ক তাই পরিচালকে সব বিষয়ে বিশেষজ্ঞ না হলেও চলবে। মূলতঃ পুরো টিমটাকে নিয়ন্ত্রণে রাখার ক্ষমতাটুকু থাকলেই হবে। বলতে পারেন, পরিচালক হল অনেকটা কর্পোরেট বস-এর মত। যে নিজে হয়ত কোন বিষয়েই বিশেষজ্ঞ নয় কিন্তু তার অধীনস্ত ডিপার্টমেন্ট বা প্রজেক্টটিকে নিজ নিয়ন্ত্রণে রেখে সফল ভাবে কার্য সম্পাদনের ক্ষমতা তার আছে। আর যদি সে কোন বিষয়ে বিশেষজ্ঞ হয়েই থাকে, তো সোনায় সোহাগা।
বুঝতে পারছি অনেকেই ভাবতে শুরু করেছেন, বাহ্, পরিচালক হওয়া তো খুবই সহজ। ম্যানেজমেন্ট আর ব্যবসা বুদ্ধি, সে তো আমার আছেই। ভাই, আপনার গাড়িতে একটু ব্রেক মারেন। আগে আমার একটা প্রশ্নের উত্তর দেন। যদি আপনাকে হোটেল সোনারগাঁও-এর ম্যানেজারের দায়িত্ব দেয়া হয়, তবে হোটেলের সবাইকে ম্যানেজ করার জন্যে আপনাকে কি কি বিষয় সর্ম্পকে ন্যূনতম ধারনা রাখতে হবে? উত্তরটা বলে দিচ্ছি। ফুড এন্ড বেভারেজ, লন্ড্রি, কাস্টমারের মানসিকতা, হোটেলের রুম এবং হল কয়টি এবং কি মানের ইত্যাদি ইত্যাদি। যদি আপনাকে মিরপুর চিড়িয়াখানার ম্যানেজার তথা কিউরেটর বানানো হয়, তবে? পশু খাদ্য, পশু স্বাস্থ্য, পশু আবাস, দর্শকদের নিরাপত্তা ইত্যাদি সম্পর্কে অবশ্যই ধারণা রাখতে হবে।
এবার তাহলে বলেন, যদি আপনাকে একটা পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র র্নিমাণ প্রজেক্টের ম্যানেজার বানানো হয়, তবে আপনাকে কি কি বিষয়ে নুন্যতম ধারনা রাখতেই হবে? উত্তরটা আশা করি আপনি এতক্ষণে এই লম্বা ও বিরক্তিকর লেখাটা পড়ে জেনে গেছেন। তো, আর দেরী কিসের? যদি পরিচালক হতেই চান তো যা যা জেনে নেবার, জানতে শুরু করে দেন।
সমাপ্ত
প্রচ্ছদ : রাজিব রায়