মনে হয় উন্মাদ আছি
সারাদিন ঘুমঘুম ঝিমঝিম অনুভূতি নিয়ে কোন কোন দিন আসে। যেন দিনের ভীষণ ভারী বোঝা চেপে বসে বুকের উপরে। তারপর গ্রীবায় ক্লান্তি জমে ওঠে। অস্থির লাগে। ব্যথা আর অবসাদ ঘিরে ধরে ক্রমে। প্রতিটা দিন যেন একরঙা, একই ছাঁচের। প্রহরে প্রহরে চেনা হাহাকার। বাতাসে শব্দ ভেসে আসে, কারোর কণ্ঠ, কারোর আর্তি! তারপর সবকিছুর সঙ্গে একটা সমঝোতা হয়ে যায়। সেই আঁতাতের মধ্যে বারান্দার ঝুলকালির মতন ঝুলে থাকা বিষাদ টের পাই। সারাবাড়ি এঘর ওঘর করি তবু কোন ঘরে শান্তি নেই, আশ্রয় নেই, আছে ক্লান্তি আর বেরিয়ে আসবার টান। বের হতে ভীষণ পিপাসা জাগে! কিন্তু কোথায় যাবো, কার কাছে? এতো যায়গা তবু এরকম দিনে কোথাও ঠাঁই জোটে না। কার সঙ্গে আলাপ করবো? সব মুখগুলো ক্লান্তিকর মনে হয়। অন্যের অস্থির গল্পে নিজেকে ডোবাতে ইচ্ছে করেনা কিংবা কারোর বাহাসে জড়াতে জোস পাওয়া যায় না মনে। থমকে স্থির হয়ে ম্যাড়ম্যাড়ে থাকতে ইচ্ছে হয়। কিন্তু ইচ্ছে জাগলে যে তা হয় না তাও টের পাওয়া যায়।
এই অস্থিরতার মধ্যে নিজেকে ভাসিয়ে রেখে মনে হয়, মর্গের লাশ এক, ফর্মালিনের চৌবাচ্চায় খাবি খাচ্ছি একা। তবু বেঁচে থাকবার নাম জীবন। সেই জীবনকে বয়ে নেবার ভার সবাই বইতে পারে না বলেই ভালোবেসে মৃত্যুকে ঠোঁটে তুলে নেয়া আছে। বারান্দার রোদ যেন সূর্যঘড়ির চিহ্ন হয়ে ঝরকার ফাঁক বদল করে। তারপর সকালের জল শুকিয়ে গেলে টবে টবে ক্লান্ত দুপুর বসে পড়ে। কারোর বারান্দায় ভেজা কাপড় শুকায়। সেই ভেজা কাপড়ের দিকে তাকালেই মনে হয় ঐ কাপড়ে যার শরীর আড়াল হয় সেই মানুষটিও কি আমার মতন অস্থির বোধ করছে স্নানশেষে কি করবে তাই ভেবে ভেবে? রোজ সেই একই ভাত খাবার কসরত সেরে মনে হয় আর কতো খাবারের পর কারোর স্নেহে মাখানো ভাতের স্বাদ ফিরে পাবো? দমবন্ধের মতো চারদিকে দেয়াল দালান। একটু সবুজ পেতে বহুদূর যেতে হয়। তারপর সেইখানে বিনিময়মূল্যে বসবার সুযোগ মেলে। তখন প্রাণ পাওয়া যায় না সেখানে। যেন ঘড়িবাঁধা এই আয়োজিত ভালোলাগা। হয়তো তখন কোন গাছের বাকল চিরে ‘আছলাম+আয়শা’ লেখা চোখে পড়ে! কি এক আশ্চর্য ম্যাজিকের মতো মন ফুরফুরে হয়ে ওঠে। কি মন্ত্রে আঁকা সেই নাম দুটি? সারল্যের কাঁটাকম্পাস দিয়ে চেরা, তাই?
যেই ছেদ টেনে এসেছিলাম আজ কি তার পঁচনের যন্ত্রণায় কাৎরাচ্ছি? ঘাড়ের শিরায় টান লাগে, মাথার মধ্যে এক কোণঠাসা ভার। এইসব নিয়ে ঘরে ঘরে ঘুরে ঘুরে নিজে নিজে হাহাকার করি। নিজেকে নগ্ন করে আয়নায় দেখি। খুঁচে খুঁড়ে শুঁকে টের পাই বিগত বসন্তের শোক আমার সমগ্র বসন্তের শরীরে মেখে গেছে। তবে কি উন্মাদ হয়ে যাচ্ছি? নাকি এক উন্মাদ সময়ের সওয়ারি আমি?
যে হিসেবি জীবনের আত্মকেন্দ্রিকতার ঘেরাটোপে থাকি, সেখানে দম ফেলতে হয় হিসেব করে। সস্তা সহজ হবার উপায় থাকে না কখনো। এক অদ্ভুত নিপুণ মুখোশ মুখোশ জীবন। কুয়াশার মতন পাতলা অবরুদ্ধতার আচ্ছাদনের মধ্যে থেকে থেকে বুকে জমে ওঠে অস্থিরতার এক সুপ্ত ক্রোধ। তোমাকে হাতের মুঠোয় পেয়েও মনে হয় ফসকে যাবে। তাই চারদিকে গ্রীল, তালা, শৃঙ্খল। অবিশ্বাসকে পাহারা দিতে দারোয়ান দুয়ারে দুয়ারে। তবু বুকের মধ্যে এক লম্বা নদীর পিপাসা। যে জলের শান্তি পেতে মরুদস্যুর মত থাকি। তবু নদীর নৈকট্য কাছে ফেরে না। নাকি পৌঁছাতে পারি না? যেই ছেদ টেনে এসেছিলাম আজ কি তার পঁচনের যন্ত্রণায় কাৎরাচ্ছি? ঘাড়ের শিরায় টান লাগে, মাথার মধ্যে এক কোণঠাসা ভার। এইসব নিয়ে ঘরে ঘরে ঘুরে ঘুরে নিজে নিজে হাহাকার করি। নিজেকে নগ্ন করে আয়নায় দেখি। খুঁচে খুঁড়ে শুঁকে টের পাই বিগত বসন্তের শোক আমার সমগ্র বসন্তের শরীরে মেখে গেছে। তবে কি উন্মাদ হয়ে যাচ্ছি? নাকি এক উন্মাদ সময়ের সওয়ারি আমি? যে জন্মের ঋণ শোধ হবে অবসাদের তরলে নিমজ্জিত থেকে?
তখন হয়তো শুনতে পাই কারোর আত্মহত্যার সংবাদ। দোষ দেবো কাকে? চিন্তার কুঠুরিতে হাতুড়ি পড়লে টের পাই চারপাশটা ভেঙে পড়াই কাম্য আজ। নাকি যেই অবাধ্য বাস্তবতা আমাদের ছায়াসঙ্গি তার কারিকুরিতেই এই সব ফলন ঘটছে? আকাশচুম্বী দালান উঠছে আর ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে ভেতর। দূর থেকে দূরতর অবস্থানে বসত করছি আমরা পরস্পরের চোখে চোখ রেখে। সেই ব্যাধির চিহ্ন তবে কি আমাকেও গ্রাস করেছে? আমাদের এই ক্লান্তির শেষ কোথায়? অতৃপ্তির শেষ যেইখানে সেখানে পৌঁছালে পরে একটা নদীর দেখা কি পাওয়া যায়? এই বিষাদের বিকেল ফুরালে ফুলের গন্ধ জেগে ওঠে, ঘিরে ফেলে মফঃস্বলের চৌহদ্দি। তখন ফিরে যেতে ইচ্ছে করে, পরম আপন একটা হাতের ওমের মধ্যে নিজেকে সঁপে দিয়ে ভেজা চোখের রেখায় তরবারির মতন ঝলকে ওঠা নদীর গল্প রেখে আমি ফানুশ হয়ে সন্ধ্যাতারার সঙ্গে সঙ্গত করতে আসমানে ডানা মেলি, যেখানে সহস্র উন্মাদের ক্লান্তি নিভে গেছে; সময়ের সব বেরিগেট গলে নদী হয়ে গেছে।
প্রচ্ছদ : রাজিব রায়