বউ কথা কও
আজীজ সাহেবকে দেখে কখনও মনে হয় না তিনি পশ্চিম পাকিস্তানি। ততটা লম্বাও নন; ফর্সাও নন। আর যখন বাংলায় কথা বলেন তখন তো সন্দেহের কিয়দংশও অবশিষ্ট রাখেন না। পুলিশের চাকরি নিয়ে সেই দেশ ভাগের আগ থেকে ঢাকায় তিনি। আর এখন ‘৪৭।
আর এতেই কিনা তিনি রীতিমত বাংলায় কথা বলেন। সহকর্মীরা তার এ গুণ দেখে ভেবে পান না, তার প্রমোশন না হয়ে থাকে কি করে? কিন্তু আজীজ সাহেব জানেন, বাংলায় তিনি খুব একটা ভাল নন। যুক্তাক্ষর তো দূরের কথা শ, ষ, স এর পার্থক্যই ধরতে পারেন না। অনেক চেষ্টা করেছিলেন শেখার। কিন্তু ব্যর্থ হয়েছেন। তাই ঘেন্না ধরেছে এমন হিন্দুয়ানী ভাষার উপর। নাজুক আজীজ সাহেব তারপরও বাংলা শিখেছেন। কারণ বাঙালিদের কাছে এটি ঘুষ চাইতে সহায়ক। আর এদিক থেকে তিনি তার পশ্চিম পাকিস্তানি সহকর্মীদের থেকে এগিয়ে আছেন।
অবশ্য বাংলা শিখতে গিয়ে আজীজ সাহেব বুঝেছিলেন যে, তিনি আসলে উর্দুকে কত ভালবাসেন! তাই ভাষা নিযে তার মধ্যে দু’একটা স্বপ্নও যে তৈরি হয়নি তা নয়। একই তো দেশ পাকিস্তান! অথচ সামান্য ভাষা আজ তাদের মানসিকভাবে আলাদা করছে। পূর্ব পাকিস্তানের ভাষাও যদি উর্দু করা যেত তাহলে সেই দূরত্বটুকু ঘুঁচে যেত। তার প্রিয় একটি কল্পনা, এক বিশাল জনসভা হচ্ছে। সেখানে তিনি উর্দুতে ভাষণ দিচ্ছেন আর সমস্ত বাঙালি তার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনছে।
শুধু স্বপ্ন দেখেই আজীজ সাহেব ক্ষান্ত হননি। তিনি চিঠিও পাঠিয়ে দিলেন প্রেসিডেন্টের কাছে। চিঠির মূলভাব- `পূর্ব পাকিস্তানের ভাষাও উর্দু করা হোক’ ধরণের।
তাই জিন্নাহ সাহেব যেদিন ঘোষণা দিলেন যে, উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা, সেদিন আনন্দে তিনি সবাইকে মিষ্টি থাওয়ালেন। তিনি নিশ্চিত, জিন্নাহর এ ঘোষণা আর কিছুই নয়, তারই চিঠির ফল।
এক সুন্দর সকালে আজীজ সাহেবের ঘুম ভাঙল পাখির ডাকে। জিন্নাহর ঘোষণার পর এমনিই তার ভাল ঘুম হয় না মিছিলের টেনশনে। তবে তিনি জানেন, আম জনতার মিটিং মিছিলে হুকুম নড়া শক্ত। লাঠির মুখে বাঙালিদের যে উর্দুতে কথা বলতেই হবে! বাধ্য।
তবে পাখিটা দ্বিতীয়বার ডাকতেই কিন্তু তার ঘুমোত্তর আড়মোড়া মাঝপথে থেমে গেল। চমকে উঠলেন তিনি। আরো কানখাড়া করে শুনলেন। নাহ্। ঠিকই শুনেছেন। পাখিটা অবিকল ডাকছে `বউ কথা কও’।
সর্বনাশ!
এই বোকা পাখিটা ভয়ংকর সর্বনাশ করে ফেলবে। সমস্ত বাঙালিরা ক’দিন পরেই `বাপ বাপ’ করে উর্দুতে কথা বলতে শুরু করবে, আর এই পাখিটা তখনও কিনা বাংলায় কথা বলবে? অসম্ভব!
আবার চিঠি পাঠালেন তিনি। বিষয়- শুধু মানুষ নয়, পশুপাখির ভাষাও উর্দু করা হোক। কিন্তু এবারের চিঠির কোন ফল তিনি দেখতে পেলেন না। জিন্নাহ সাহেব পশুপাখি সংক্রান্ত নতুন আর কোন ঘোষণা দিলেন না।
আজীজ সাহেব ভেবেছিলেন কাজটা বুঝি খুব সোজা। ভেবেছিলেন বাঙালিদের পথ ধরে- তারা পাখিদের ধরে ধরে বাংলা শিখিয়েছে। তিনি শেখাবেন উর্দু। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল কাজটি ভারি কঠিন। তিনি যেই বলেন ,`বোল, পাকিস্তান জিন্দাবাদ’, তখন পাখিটা বড্ড উদাস দৃষ্টিতে তাকায়। আজীজ সাহেবের মেজাজ যায় খিঁচড়ে। তবু ধৈর্য্যের সাথে আবার চেষ্টা করেন।
আজীজ সাহেব অবশ্য এতে তেমন বিচলিত হলেন না। এটা পাকিস্তানের জাতীয় প্রশ্ন, সবার বোধগম্য হবার কথাও নয়। বিশেষত প্রেসিডেন্টর সহকারীদের। কারণ তারা কম বুদ্ধির বলেই না এখনও ভাষা নিয়ে টালবাহানা চলছে। তিনি হলে কবেই এর একটা বিহিত করে ফেলতেন! হ্যাঁ, এই ব্যাপারে অন্তত তাকেই বিহিত করতে হবে। তিনি পুলিশ মানুষ। শান্তি শৃংখলা রক্ষায় উপরের নির্দেশের বাইরেও তার কিছু করণীয় রয়েছে। এবং তিনি তা করবেন। অবশ্যই করবেন।
তার রুমমেট বাঙালি। আজীজ সাহেবের বাংলা শিক্ষার গুরু। তিনি তাকেই ধরলেন।
– মহিন সাহেব, আপনারা বাঙালিরাতো খুব বুদ্ধিমান?
মহিন সাহেব অবাক হন। তিনি কোমরের বেল্টটা ঠিক করছিলেন। ঘাড় বাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
– হঠাৎ?
– আপনারা পাখিদের……।
আজীজ সাহেব মাঝপথে থেমে গেলেন। বলাটা ঠিক হচ্ছে না।
বাঙালিরা বুদ্ধি করে পাখিদের ভাষা শিখিয়ে রেখেছে যাতে তারা মৃত্যু ভয়ে উর্দু বললেও বাংলা ভাষার যেন মৃত্যু না হয়। কিন্তু তিনি বুদ্ধিটা ধরে ফেলেছেন। এখন যদি বোকার মত বলে ফেলেন তখন নতুন আবার কোন বুদ্ধি বের করে কে জানে? তারচে’ এটার ব্যবস্থা তিনি একাই করবেন।
চৌদ্দ পনের বছরের একটা ছেলে আজীজ সাহেবের রুমে চা নিয়ে আসত। মহিন সাহেব তখন রুমে ছিলেন না। ওয়ারীতে ডিউটি দিচ্ছেন। ছেলেটি তার চা পানোত্তর ফিরতি কাপ নিতে এসেছিল। আজীজ সাহেব কোনমতে বললেন, `মজু……..’।
মইজুদ্দিন চটপটে ছেলে। তার জবাবও তাই চটপটে- `জে স্যার?’
`তুমি কি কথা বলা পাখিটা দখেছে?’
মইজুদ্দনি যেন উত্তর দেয়ার জন্য তৈরিই ছিল। কোন পাখি, কি পাখি এসব জিজ্ঞেস করার কোন প্রয়োজন সে অনুভব করল না। সে বলল, `দেখছি স্যার! ওর নাম ময়না। আমগোর গ্যারামের মাইনকাগো একটা আছিল। শুদ্ধ কথা কইত- মানিক ভাত খাব।’
হি হি করে হেসে ফেলে মজু। আজীজ সাহেব কিন্তু চমকেই ওঠেন। তিনি খোজ খবর নিয়ে দেখেছেন এই পাখিটা শুধু ‘বউ কথা কও’ই বলে। এখন শুনছেন আরেকটা বলে `ভাত খাব’
কি সর্বনাশ!
এরপর নিশ্চয়ই একটা পাখি চিৎকার করবে, “রাষ্ট্রভাষা”, অন্য পাখিরা চ্যাচাবে, “বাংলা চাই”।
খুবই অবশ্যম্ভাবী ব্যাপার। নাহ! আশু এর প্রতিকার না করলেই নয়। তার কণ্ঠ খাঁদে নামে, যেন ষড়যন্ত্র করছেন এমন ভঙ্গিতে বলেন, `মজু, তুমি এরকম একটা কথা বলা পাখি এনে দিতে পারবে।
মজু মাথা নাড়ে। সম্ভব না। কিন্তু আজীজ সাহেব নাছোড় বান্দা। বললেন, `একশ টাকা দেব। শুধু …’
মজুর চটপটে মাধা দ্রুত উপর নিচ হয়।
`সম্ভব’।
একটা পাখি ধরতে একশ টাকা! তাও তার! একশ টাকা মানে . . . তার কয়েকটা জামাপ্যান্ট, জুতা, আরও আরও . . .।
বেশি ভাবতে পারে না মজু। জান গেলেও তার পাখি আনা চাই।
দিন পাঁচেক পরেই আজীজ সাহেবের রুমের বারান্দায় একটা খাঁচা ঝুলতে দেখা গেল। শুধু খাঁচা নয়, খাঁচা অন্তস্থ পাখিও দেখা গেল। ব্যাটা হঠাৎ হঠাৎ ইতস্তত উচ্চারণ করে `বউ কথা কও’।
আজীজ সাহেব ভেবেছিলেন কাজটা বুঝি খুব সোজা। ভেবেছিলেন বাঙালিদের পথ ধরে- তারা পাখিদের ধরে ধরে বাংলা শিখিয়েছে। তিনি শেখাবেন উর্দু। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল কাজটি ভারি কঠিন। তিনি যেই বলেন ,`বোল, পাকিস্তান জিন্দাবাদ’, তখন পাখিটা বড্ড উদাস দৃষ্টিতে তাকায়। আজীজ সাহেবের মেজাজ যায় খিঁচড়ে। তবু ধৈর্য্যের সাথে আবার চেষ্টা করেন।
কিন্তু তার চেষ্টা ফলদায়ক হয় না মোটে। বিরক্ত হয়ে চিমটি কাটেন পাখির গায়ে। তখন মুখে বোল ফোটে পাখির-`বউ কথা কও’।
ডিউটি শেষ করে একদিন আজীজ সাহেব ফিরে আসলেন রুমে। খাকি শার্ট খুলে হ্যাঙ্গারে রাখতে গিয়ে হঠাৎ চোখ যায় বারান্দায় খাঁচার দিকে। মুহূর্তে চমকে ওঠেন তিনি। খাঁচার ভিতর সটান শুয়ে আছে পাখিটা। মরে গেল নাকি? প্রাণের আশায় আজীজ সাহেব পাখিটার চোখের দিকে তাকান। টলমল করছে, যেন এখুনি জল গড়াবে।
এমন করে দিন যায়, মাস যায়, ঘুরে আসে বছরও। একদিকে মিছিল দাবড়ানো অন্য দিকে চুপি চুপি পাখিকে প্রাথমিক শিক্ষাদান ইত্যাদি নিয়ে ভালই ব্যস্ত হয়ে পড়লেন আজীজ সাহেব। কিন্তু শান্তি আর মেলে না। পাখিটাকে আর বুঝি উর্দু শেখানো গেল না।
এতদিনের আপ্রাণ চেষ্টার পর বাঙালিদের প্রতি তার শ্রদ্ধা বেড়ে গেল। কি অসীম ধৈর্য্য নিয়েই না তারা এই অসম্ভবকে সম্ভব করেছে! কিন্তু যে ইতিহাস গড়তে চায় তাকে কি হার মানলে চলে?
মহিন সাহেব অনেক আগে একবার বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞেস করেছিলেন, `আজীজ সাহেবের হঠাৎ পাখি পোষার শখ হল যে!’
আজীজ সাহেব বিচলিত হেসেছিলেন। বলেছিলেন,`ইয়ে. . . শখ . . . আর কি’
– ‘শখ তাই বলে এই রকম একটা পাখি। টিয়া হলেও না হয় কথা ছিল’।
পরে অবশ্য আর কিছু বলেননি।
আরো দিন যায় তবু পাখির শিক্ষা গ্রহণে কোন উন্নতি দেখা যায় না।
আজীজ সাহেবের আর ধৈর্যে কুলায় না। এখন তিনি প্রায়ই টর্চার করেন পাখিটাকে। চিমটি, খামচি, টোকা কোনটাই বাদ যায় না। এমনকি মাঝে মাঝে খাঁচা ঝাকাঝাকিও করেন। একদিন তো রাগ করে একটা ডানাই ভেঙে দিলেন। তবু আশা আলো দেয় না। শেষে খাবার, পানি দিলেন বন্ধ করে।
ডিউটি শেষ করে একদিন আজীজ সাহেব ফিরে আসলেন রুমে। খাকি শার্ট খুলে হ্যাঙ্গারে রাখতে গিয়ে হঠাৎ চোখ যায় বারান্দায় খাঁচার দিকে। মুহূর্তে চমকে ওঠেন তিনি। খাঁচার ভিতর সটান শুয়ে আছে পাখিটা। মরে গেল নাকি? প্রাণের আশায় আজীজ সাহেব পাখিটার চোখের দিকে তাকান। টলমল করছে, যেন এখুনি জল গড়াবে। আজীজ সাহেব খাঁচার কাছে যেতেই দুর্বল শরীর নিয়েও সরে যাবার আপ্রাণ চেষ্টা করে পাখি। কিন্তু এগুতে পারে না একটুও। কেবল থরথর করে কেঁপে ওঠে শরীর। সচল এক ডানা একটু উপরে উঠে আবার সেটে যায় শরীরে।
আজীজ সাহেবের কি যে হল! দ্রুত পাখির খাবার প্লেটে খাবার দিলেন, পানির পাত্রে জল। তারপর একরাশ লজ্জা আর তীক্ষ্ণ গ্লানি নিয়ে ভাবলেন কিছুক্ষণ। বুঝলেন, তিনি একটি বোকা পাখিকে উর্দু শেখাতে ব্যর্থ হয়েছেন।
তাহলে জিন্নাহ সাহেব কেমন করে এতগুলো বুদ্ধিমান মানুষকে উর্দু শেখাবেন?
আবার কি একটা চিঠি জরুরি নয়? হয়ত! কিন্তু তারচেয়েও বেশি জরুরি পাখিটাকে এই মুহূর্তে মুক্তি দেয়া। খাবার, জলের পর পাখি কিছুটা প্রাণ ফিরে পেয়েছে। আজীজ সাহেব দ্রুত খাঁচা খুলে উড়িয়ে দিলেন। পড়ি পড়ি করেও পড়ল না পাখি, সোজা উড়তে থাকল আকাশের সীমানার দিকে- এক ডানায়, বড় অদ্ভুদ ভাবে। কষ্টকর তবু তো সে উড়ছে মুক্তির দিকে, স্বাধীনতার দিকে, ইচ্ছেমতো বলার দিকে।