অক্ষরবন্দী জীবন-১০
‘প্রীতি উপহার’
মননশীল পুরস্কার–এর পর থেকে-
ছোটবেলায় যে বইয়ের সম্ভারের সাথে বেড়ে উঠছিলাম, তার সিংহভাগই ছিল বাবা-মায়ের বিয়েতে পাওয়া সেকালের ‘প্রীতিউপহার’। আজকাল তো বিয়ে বা সামাজিক অনুষ্ঠানে উপহার হিসেবে বই দেয়ার চল উঠেই গিয়েছে। সে বইগুলোর সব নাম মনে নাই তবে ‘নজরুল কাব্য সঞ্চয়নে’র কথা আগেও বলেছি, আজ বলা যাক ‘নজরুলপরিচিতি’র কথা। এই বইটিতে ষাটের দশকের নামী লেখকদের রেডিও পাকিস্তানে নজরুল বিষয়ক কথিকা গ্রন্থিত আছে। এই গ্রন্থের একটি ঐতিহাসিক মূল্য আছে; সে সময়ে নজরুলকে ইসলামি লেখক হিসেবে দেখানোর একটা সাধারণ প্রবণতা ছিল। আব্বাস উদ্দিনের লেখাটা পড়ে তাঁর প্রত্যক্ষ স্মৃতিগুলো তো জেনেইছিলাম, আরও পেয়েছিলাম কয়েকটা নজরুলের গানের হদিস, পরবর্তীতে যে গানগুলো আমি রেকর্ড করে নিয়েছিলাম। বইটিতে নজরুলের অনেক ছবি আর বাংলা-উর্দু পাণ্ডুলিপির ছবিও ছিল। বইয়ের সেই ভাণ্ডারে ছিল বেশ কিছু উপন্যাস, যেগুলোর প্রচ্ছদে চড়া রঙে নায়ক-নায়িকার মুখ আঁকা ছিল, এর একটি বই ‘দানের মর্যাদা’। নজিবুর রহমান সাহিত্যরত্নের বিখ্যাত উপন্যাস ‘আনোয়ারা’ তো ছিলই; কাকতালীয় ভাবে আমার কাকা ‘নুরুল ইসলাম’ও কাকী হিসেবে নিয়ে এলেন ‘আনোয়ারা বেগম’কে! তখন এই গ্রন্থের চরিত্র বাস্তবে চলে আসা মিলিয়ে নিতে হিমশিম খেয়েছিলাম।
এসএসসি পরীক্ষায় রেজাল্টের পর ছোট মামার বিশ্ববিদ্যালয়ের এক বন্ধু কয়েকটা ইসলামি বই উপহার দিয়েছিলেন; একটা বইয়ের নাম ‘তলোয়ারে নয়, উদারতায়’। সে সময় এই বইয়ের প্রাসঙ্গিকতা ছিল না; আজ বড় প্রাসঙ্গিক। তবে যে বয়সে একটা বই উপহার পাওয়া মানে ছিল আসমানের চাঁদ হাতে পাওয়া, সে বয়সে তত বই পেয়েছিলাম বলে স্মৃতি সাক্ষ্য দেয় না।
কলেজ জীবনে টিবলু নামের এক বন্ধু প্রায়ই বাসায় আসত, সোবহানবাগে এক গণিত স্যারের বাসায় প্রাইভেটও পড়েছি একসাথে। সেই টিবলু (কাজী আতিফ ইকবাল) যেদিন আমাকে ওর বাসায় নিয়ে গেল, ওর বাবা আমাকে নিজের অনুবাদ করা বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত বেগুনি রঙের প্রচ্ছদের ‘প্লেগ’ (আলবেয়ারকামু) উপহার দিয়েছিলেন। বইটা নাই, অনুবাদকের নাম মনে করতে গিয়ে চুল ছিঁড়ছি।
হুমায়ুনের টিভি নাটকের (বহুব্রীহি) বোকা ডাক্তার আফজাল হোসেনের চরিত্রটিকে সহ্য করতে না পেরে হোস্টেলবাসীরা রাতেই একটা প্রতিবাদ মিছিল করেছিল এবং পরদিন ক্যাম্পাসে হুমায়ূনের কুশপুত্তলিকা দাহ করেছিল। সেই কুশপুত্তলিকার মুখটি ‘এলেবেলে’ বইয়ের প্রচ্ছদ থেকে আমিই এঁকে দিয়েছিলাম।
কার্টুনিস্ট আহসান হাবীব একবার ‘দিনরাত্রি’ নামে একটা প্রকাশনা সংস্থা শুরু করলেন। তাঁর সাথে আমার যোগাযোগ শুরু হয়েছিল ক্লাশ টেন থেকে, কার্টুন করার সুবাদে। সেখান থেকে হুমায়ূনআহমেদের ‘নৃপতি’ বা ‘সম্রাট’, মুহম্মদ জাফর ইকবালের ‘আকাশ বাড়িয়ে দাও’ ইত্যাদি বেরিয়ে গেছে তখন। আমাকে তিনি উপহার দিয়েছিলেন তাঁর বিমান প্রকৌশলী বন্ধু মহিবুল আলমের কবিতার বই ‘এ কোন বৃষ্টি ঝরাও’। সেই বইয়ের আদলেই আমার প্রথমকবিতার বইটির গেটআপ করা হয়েছিল।
হোস্টেল জীবনে বড় সারপ্রাইজ ছিল হাজার পরীক্ষা থাক কিংবা থাকুক মিটিং মিছিলের বা ভোটের রেষারেষি, কারো জন্মদিন থাকলে রাত বারোটার মাহেন্দ্রক্ষণে তাঁর জন্যেকিছু একটা কাণ্ড-কীর্তি থাকবেই। একবার আমরা অগোছালো এক বন্ধুর অনুপস্থিতিতে তাঁর ব্যবহৃত জিনিসপত্র দিয়ে একটা প্রদর্শনী আয়োজন করেছিলেম, বিভিন্ন ব্লকের ছাত্ররা সেই প্রদর্শনী দেখতে আসত। রাত বারোটার জন্মদিনের অনুষ্ঠানে কেউ কেউ হাজির হত একটা বই নিয়ে, সাধারণত কবিতার বই কিংবা সুনীল-সমরেশ- শীর্ষেন্দু। আমিও জন্মদিনে বই উপহার পেয়েছি, কিন্তু সেসব বই আবার আমাদের যৌথ খামারের অংশ হয়ে যাওয়াতে আলাদা ভাবে আর উল্লেখ করা মুশকিল। সেটা ছিল হুমায়ুন যুগের শুরু, তখন থেকেই আমি ছিলাম হুমায়ূনের নিবিষ্ট পাঠক। হুমায়ুনের টিভি নাটকের (বহুব্রীহি) বোকা ডাক্তার আফজাল হোসেনের চরিত্রটিকে সহ্য করতে না পেরে হোস্টেলবাসীরা রাতেই একটা প্রতিবাদ মিছিল করেছিল এবং পরদিন ক্যাম্পাসে হুমায়ূনের কুশপুত্তলিকা দাহ করেছিল। সেই কুশপুত্তলিকার মুখটি ‘এলেবেলে’ বইয়ের প্রচ্ছদ থেকে আমিই এঁকে দিয়েছিলাম। খবরটি পত্রিকায় আসে সচিত্র এবং হুমায়ূন সেই ছবি ‘এলেবেলে’র পরের সংস্করণে ছেপেছিলেন। কিছুদিন পর এক বৃষ্টিমুখর হরতালের দিনে হুমায়ুন এক অনুষ্ঠানে আমাদের ছাত্র সংসদেআসেন। আসামীরা সেদিন আত্মসমর্পন করেছিলাম। সেদিন আমি হুমায়ূন আহমেদের সফরসঙ্গী কবি নির্মলেন্দু গুণকে নিজের কবিতার বই উপহার দিয়েছিলাম।
সাফায়েতের বিয়েতে আমি বিক্রম শেঠের ‘এ সুইট্যাবল বয়’ সহ আরো তিনটা ইংরেজি বই উপহার দিয়েছিলাম। সে অনেক ইংরেজি নভেল পড়ত, ক্রিকেট বিষয়ক বই পড়ত। বইগুলো বাকিতে কিনেছিলাম চট্টগ্রামের জিইসি মোড়ের চারুপাঠ থেকে। আমার কারণেই কিনা কে জানে, চারুপাঠ উঠেই গেল!
আমি সবচেয়ে বেশি বই উপহার পেয়েছি কবিদের কাছ থেকে। কবিরা দিয়েছেন নিজেদেরই বই। সেসব বইয়ের বৃত্তান্ত লিখতে গেলে আস্ত একটা পর্বই লেখা হয়ে যাবে।
চলবে…