অক্ষরবন্দি জীবন-১২
কবির সাথে পরিচয়ের দিনগুলি
কবি শামসুর রাহমান ও তাঁর কীর্তিরাজি এতই বর্ণাঢ্য, বিশাল ও প্রভাবশালী যে ঠিক কবে থেকে তাঁকে জানি তা ভেবে বের করা কঠিন। এই মুহূর্তে মনে পড়ছে নবম শ্রেণীতে পড়ার সময় একুশের কবিতা প্রতিযোগিতায় আমার একটি কবিতা মনোনীত হয়েছিল একুশের ভোরে শহিদ মিনারে পাঠের জন্য। কিন্তু দেখা গেল আগের দিন বিকেলে আমি অমনোনীত একটা লেখা ঘসামাজায় ব্যস্ত, কেননা মনোনীত কবিতাটি ছিল ‘বাংলাদেশ কেঁদে ওঠে’ যা কিনা ‘বাংলাদেশ স্বপ্ন দ্যাখে’ কবিতাটির অনুরণন বললেও কম বলা হবে। এর পরপরই সন্ধানী প্রকাশনী থেকে বের হওয়া ‘পদাবলী’ গোষ্ঠীর কবিদের একটি সঙ্কলন হাতে পাই দশম শ্রেণিতে উঠে। ওই সঙ্কলনের ‘বাচ্চু তুমি, বাচ্চু তুই, চলে যাও, চলে যা সেখানে/ ছেচল্লিশ মাহুত টুলির খোলা ছাদে’ (দুঃসময়েমুখোমুখি) কবিতাটি আমার সামনে কবিতার রহস্যময়তার দিকটি প্রথম তুলে ধরল, এর আগে পর্যন্ত নজরুল আর সুকান্তের যে কবিতাগুলো পড়েছি, তাতে এই ধরনের রহস্যময়তা ছিল না। বালক মন রাহমানীয় জগতের রহস্য না বুঝলেও তুমি রূপী বাচ্চু, তুই রূপী বাচ্চু আর ৪৬ নম্বর মাহুত টুলির ঠিকানা খুঁজতে খুঁজতে ‘স্মৃতিরশহরে’ গিয়ে পড়লো একেবারে ‘বাচ্চুআপনি (!)’র সামনে!
এই সময় থেকে আরো দুবছর পর আমি পড়তে শুরু করব ‘সোনারতরী’, জীবনানন্দ, আবুল হাসান, নির্মলেন্দু গুণ এবং অন্যান্য। ইতোমধ্যে ‘উদ্ভট উটের পিঠে … ’, ‘বিধস্ত নীলিমা’, ‘প্রতিদিন ঘরহীন ঘরে’, ‘রৌদ্র করোটিতে’ এই নামগুলোর সাথে পরিচিত হচ্ছি। আরো কিছুদিন পর সন্ধ্যাবেলায় ‘কবিতার সঙ্গে গেরস্থালি’ আর ‘নিজ বাস ভূমে’ বইদুটো পাঠ্যবই গুলোকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাতে শুরু করল।
এর কিছুদিন বাদে আমাকে দেখা যাবে দৈনিক বাংলা আর সংবাদ পত্রিকার সাপ্তাহিক সাহিত্যের পাতায় বুঁদ হয়ে থাকতে, যার প্রধান আকর্ষণ অবশ্যই তিনি, কেননা কে না জানে, সে সময় তিনি বাংলা সাহিত্যে রাজত্ব করছিলেন। আমার জীবনে পঁচাশি সালের একুশের বইমেলা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য; প্রায় প্রতিদিনই মেলায় গেছি আর মেলা শেষে ঘরে জমেছিল বইয়ের এবং আনন্দময় স্মৃতির এক সম্ভার। একদিন পেলাম ‘টেবিলে আপেলগুলো হেসে ওঠে’ তো আরেকদিন পেলাম ‘শিরোনাম মনে পড়ে না’; একদিন ভেসে বেড়ালাম ‘ইকারুসের আকাশে’ তো পরের দিন ডুবে থাকলাম ‘যে অন্ধ সুন্দরী কাঁদে’ নিয়ে। কবির লেখা উপন্যাস ‘নিয়ত মন্তাজ’ আর দু’একটা ছোটগল্প পড়তে পড়তে তাঁর কাছ থেকে রুচির পাঠ নেয়া যায় নির্দ্বিধায় এ ব্যাপারে সম্মত হয়েছিলাম; তিনি আমার সামনে একজন মার্জিত রুচির মানুষের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন বলেই হয়তোবা আরো বেশি করে অনুসরণ যোগ্য হয়ে উঠছিলেন। সেই সাথে রেডিও-টিভিতে সেই বিখ্যাত মার্জিত উচ্চারণে সাক্ষাৎকার শোনা, আবৃত্তি শোনার অভিজ্ঞতা। এ সবের সমান্তরালে হুমায়ূন আজাদ কী প্রবচন লিখছেন তা তখন জানবার প্রয়োজন ছিল না।
কবির লেখা উপন্যাস ‘নিয়ত মন্তাজ’ আর দু’একটা ছোটগল্প পড়তে পড়তে তাঁর কাছ থেকে রুচির পাঠ নেয়া যায় নির্দ্বিধায় এ ব্যাপারে সম্মত হয়েছিলাম; তিনি আমার সামনে একজন মার্জিত রুচির মানুষের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন বলেই হয়তোবা আরো বেশি করে অনুসরণ যোগ্য হয়ে উঠছিলেন।
সামনে উচ্চমাধ্যমিক আর পেছনে আমার কবিতার খাতা। প্রতিদিনই সেই খাতা ভরে উঠছে মূলত রাহমানীয় ভাষায় লেখা অক্ষরবৃত্তে। এই করতে করতে একটা কবিতা লিখেছিলাম একদিন, যার প্রতিপাদ্য হচ্ছে- শামসুর রাহমান আর নির্মলেন্দু গুণের টাগ অফ ওয়ারে (বাংলায় ‘রশি টানাটানি’ লিখলে মূল ভাবটা ক্ষুণ্ণ হয় মনে হচ্ছে) আমার কী দশা- সেটা । শেষ লাইন ছিল এরকম- ‘আপনারা টানুন টানুন/ টেনে হিঁচড়ে আমায় একদম কবি বানিয়ে ছাড়ুন!’ খাতাটির প্রবেশিকায় লেখা ছিল কবির অমর দুটি লাইন:
“যদি তুমি চাও অমরতা
তবে সংহত কর বাক, থামাও প্রগলভতা”;
এই লাইন দুটো আমার লেখালিখির মূলনীতি হয়ে দাঁড়িয়েছিল। আসলে কবিরাই কবিদের শ্রেষ্ঠ শিক্ষক। এই বইগুলো থেকে আমি আমার মতো করে শিখে ফেললাম- ক) উপমাই কেন কবিতা এবং উপমার সহজাত প্রয়োগ খ) পয়ার ছন্দে অবিরল লিখে যাবার আনন্দ গ) কবিতায় পুরাণের ব্যবহার অত্যাবশ্যকীয় ঘ) রাহমানীয় শব্দকোষের নাগাল পাওয়া এবং ঙ) আমিও লিখতে পারি -এই কথা জানা ইত্যাদি।
সম্ভবত আমি উচ্চ শিক্ষা নিতে যাবার আগেই তাঁর মাস্টারপিস কবিতাগুলো লেখা হয়ে গেছে, তখনো অবশ্য সরকারি কাগজ- ছেড়ে- দেয়া একালের বিদ্রোহীকে দেখা বাকি, তাঁর লেখা বাকি রয়ে গেছে ‘একটি মোনাজাতের খসড়া’, ‘দেশদ্রোহী হতে ইচ্ছে করে’ এসকল কবিতায় জলপাই যুগের বিপরীতে আমাদের কবির শিল্পিত প্রতিরোধ; কখন যেন কবির বুক হয়ে উঠল ‘বাংলাদেশের হৃদয়’ – কবি হয়ে উঠলেন বাংলাদেশের বিবেক। উচ্চ শিক্ষার বছরগুলোতে আমি আরো কবিতামগ্ন হয়েছি, রাজনীতিলগ্নও ছিলাম যথেষ্ট পরিমাণে। কবি তখন আমাদের মানসের প্রতিধ্বনি করছিলেন রূপালি জাদুকরের মত, হুডিনি হয়ে।
এইতো গেল কবির সাথে আমার এক দশকের প্রাথমিক পরিচয়। মনে হয় কবিকে খুব বেশি ভালোবেসে ফেলার পর যখন দেখা গেল আমার জন্যে তাঁর নিছক কোনও পক্ষপাত নাই, তিনি সার্বজনীন ও বহুপ্রজ এক স্বত্তা, তখন থেকেই হয়ত তাঁকে আরেকটু দূরে গিয়ে দেখতে শুরু করেছি। এ ছাড়াও ক্রমশ বয়স বেড়েছে কমবয়স্ক পাঠকটির, প্রিয় কবির পাই চার্টে বাংলার অন্যান্য কবিকুল নিজেদের প্রাপ্য জায়গাগুলো নিয়ে নিচ্ছেন।
পুনশ্চ – মাধ্যমিক পরীক্ষার ফলাফলের পর স্কুল থেকে যে কয়েকটি বই পুরস্কার পেয়েছিলাম তার একটি হচ্ছে ‘কবিতার সঙ্গে গেরস্থালি’। বইটি নির্বাচন করেছিলেন নিশ্চয়ই সুযোগ্য কোনো শিক্ষক। কাইয়ুম চৌধুরীর নান্দনিক প্রচ্ছদ সমেত এই বইটি আজও আমার অন্যতম প্রিয় একটি কবিতার বই। এই বইকে কেন্দ্র করে শামসুর রাহমানের সাথে নিবিড় পরিচয়ের প্রস্তুতির কথাটুকু না বলা থাকলে এই রচনাটি অসম্পূর্ণ থেকে যেত।