লাইভ ফ্রম ঢাকা ও আমাদের সিনেমা বাস্তবতা
স্বগতলগ্নের জমাট স্তব্ধতা
ঘুম পেলে ক্ষতি কি?
তোমার চোখের গভীর বিশ্বাস
হারালে ক্ষতি কি?
-অভিমান (ব্ল্যাক)
Live From Dhaka is a fiction based on Dystopian theorem. আব্দুল্লাহ মোহাম্মাদ সাদের পরিচালনায় নির্মিত দৃশ্যকল্প, এক কথায়, বিমূর্ততায় জাগতিক অনুভূতির বহিঃপ্রকাশের প্রয়াস।
প্রথমেই পরিষ্কার করে বলা দরকার, এই সিনেমার দর্শক সবাই না এবং সেটা সংগত কারণেই। আর সেটা সঙ্গতি রাখে যার/যাদের জীবনের সাথে, তারা খুব সহজেই একে পড়তে, বুঝতে পারবে বলেই আমার বিশ্বাস। জানি না, লাইভ ফ্রম ঢাকা‘র মার্কেটিং টিম কিভাবে বলছে, তবে সাধারণ দর্শকের চোখে সিনেমাটি দেখে আমার অনুভূতি বলছে, বেশসংখ্যক দর্শক এই সিনেমার বিশ্লেষণ করতে ব্যর্থ হবে।
গতানুগতিক সিনেমার বিচারে ফেলে বলেও দেবে, “ইহা একটি সিনেমা হয়ে ওঠে নি।” বস্তুত, ইহাই সিনেমা, আর এর ভাষাই সিনেমার ভাষা। ঢাকাকে নিয়ে অথবা বলা যায়, গোটা বাংলাদেশকে নিয়ে আমাদের গর্বের আদি-অন্ত নেই। কিন্তু, Statistical Data Analysis করে এ কথা অকপটে বলে দেয়া যায় যে, It’s a dead city for years now.
সেই মৃতশহরে বাস করে সাজ্জাদ, রেহানা, মাইকেল, শাহেদ, উজ্জ্বলসহ আমরা অনেকে। লক্ষণীয় যে, সিনেমার এই চরিত্রগুলো আমাদের আশেপাশে থেকেই নেয়া। তাই এখানে, Bertolt Brecht-এর Distantiation, Alienation-এর বিষয়কে উপেক্ষা করে বরং দর্শককে সাথে নিয়ে সিনেমা সামনে এগিয়েছে।
Initiation, Rising action, Climax & Anti-climax, falling action ইত্যাদি Plot Structural Elements পাওয়া গেলেও চলচ্চচিত্রবোদ্ধাদের দাবিকৃত ‘Resolution’-এর দেখা মেলে না। মেলে না বাস্তবে, মেলে না সিনেমায় সংগত কারণেই। পরিচালকের কাজ সমস্যা চিহ্নিত করে দেয়া। মগজে চাপ ফেলে চিন্তা-ভাবনা এবং উপাত্ত ভিত্তিতে যুক্তির সিঁড়ি বেয়ে বেরিয়ে আসার পথ খুঁজে দেবার দায়, চলচ্চিত্র পরিচালকের নয়।
সিনেমার সারসংক্ষেপ হল, ঢাকাস্থ কিছু মানুষজনের রোজকার জীবনের টানাপোড়েন এবং এই টানাপোড়েন থেকে বেরিয়ে আসার আপ্রাণ চেষ্টার ব্যর্থ হাঁসফাঁস। জীবনকে কাঁচের শোপিস না করে রেখে বরং ক্যামেরাকে নামিয়ে আনা হয়েছে, সাধারণের কাতারে। এখানেই বোধ করি, জিতে গেছে সিনেমা, শিল্প।
সিনেমার সারসংক্ষেপ হল, ঢাকাস্থ কিছু মানুষজনের রোজকার জীবনের টানাপোড়েন এবং এই টানাপোড়েন থেকে বেরিয়ে আসার আপ্রাণ চেষ্টার ব্যর্থ হাঁসফাঁস। জীবনকে কাঁচের শোপিস না করে রেখে বরং ক্যামেরাকে নামিয়ে আনা হয়েছে, সাধারণের কাতারে। এখানেই বোধ করি, জিতে গেছে সিনেমা, শিল্প।
খেয়াল করে দেখবেন, মৃত শহরের স্বপ্নের রঙও সাদাকালো; আর এর মাঝের সব ধূসর। ২০১৯ এ এসে সাদাকালো ফিল্ম দেখবো কেন? দেখবেন এই কারণে যে, Subject matter defines the treatment of the film rather than the taste of the audience, who watches the film. সিনেমার Text এবং Subtext-এ যা বলা হচ্ছে, তা সাদাকালোতে যেভাবে বলা সম্ভব, তা কোনদিনই রঙিন সিনেমার চাকচিক্যে তোলা সম্ভব নয়।
ক্যামেরার কি জ্বর হয়েছিলো? না ঠাণ্ডা লেগেছিল? অমন করে বুড়োদের মতন করে কাঁপছিল? -না, অমন কোন কিছুই হয় নি। স্রেফ Cinematic Reality-র একটা প্রচ্ছন্ন প্রভাব যাতে দর্শকের মনস্তত্ত্বের ওপরে এসে পরে, সেকারণে এমন টেকনিক সিনেমা ইতিহাসে বহুল ব্যবহৃত, বলতে পারেন সনাতনী পদ্ধতি। এতে চমকে উঠবার, ধিক্কার দেবার সুযোগ খোঁজার কোন মানেই হয় না।
ফ্রেমে গ্রেইন ছিল, ঝাপসা ছবি তোলা হল কেন? ধীরে বৎস, ধীরে! স্বল্পালোকে তুললে এমনটা হয়েই থাকে। সিনেমার বাজেট নিয়ে কথা না বলতে চাইলেও বলতে হচ্ছে, মাত্র ৮,০০,০০০/- টাকায় নির্মিত এই সিনেমা। (দেখছোস, বলসিলাম না, এই শালা এই সিনেমার দালাল!, অয় ক্যামনে জানে কত টাকা লাগসে?) IMDB সাইটে গেলেই পেয়ে যাবেন, সেসব তথ্য। থাক সে কথা। ঝাপসা ছবি, হ্যাঁ, এতক্ষণে একটা বিচক্ষণ অবজারভেশন। বিষয়টা সিনেমাটি দেখবার সময় চোখকে বেশ অস্বস্তিতে ফেলে।
পুরো সিনেমায় চরিত্রসংখ্যা যেমন খুব বেশি নয়, তেমনি তাদের মধ্যে Sub-plot খুব একটা বেশি দেখা যায় না। চরিত্রের জট তাই পাক খায় না। Simple, Linear Story telling সত্ত্বেও সিনেমাটি খুব হালকা সিনেমা নয় মোটেই।
সিনেমা একটি Time & Space malleable art form. সে অর্থে, সময়ের ভাঙ্গাগড়া এখানে অনুপস্থিত। স্থানিক কিছু magical moment বেশ মনে থাকবার মতন। টেকনিক্যাল জটিলতা পরিহার করলেও বাচিক ভঙ্গিমার ভিন্নতার কারণে সিনেমাটির পাঠ কিছুটা চাপ সৃষ্টি করে মস্তিস্কে।
সাবলীল অভিনয়, সংলাপ এবং সর্বোপরি সহজ উপস্থাপনে এ এক অনবদ্য সিনেমাটিক উপাখ্যান। দ্বৈতমত সৃষ্টি হবে এই সিনেমার আলোচনায়, সেটা অবশ্যম্ভাবী। তবে নির্জলা শিল্পের মাঝে ঢাকার সত্যিকারের চেহারার উপস্থাপন (সবুজ বুড়িগঙ্গার পানি নয়) অহেতুক কৌতুক পরিহারের মানসিকতা এবং সত্যকে সত্যের মধ্যে রাখার সিনেমা- লাইভ ফ্রম ঢাকা।
সিনেমাটি Close Ended হয়েও open for interpretations. বোধ করি, এই কারণেই সিনেমাটি অনন্যতার দাবি রাখে।
সংলাপে কিছু খিস্তি আছে, থাকাটা জরুরি এবং সংগত। বিশেষ মুহূর্তের ভাষা বিশেষ হবে, এটাই প্রত্যাশিত। সে অর্থে, Antagonist as person সিনেমাতে না থাকলেও গোটা সমাজ, রাষ্ট্রতন্ত্র, ধর্মের দাপট, সীমাহীন দুর্নীতি, সিনেমাটিক Antagonist হিশেবে বেশ ভালোভাবেই উতরে যায়।
সাবলীল অভিনয়, সংলাপ এবং সর্বোপরি সহজ উপস্থাপনে এ এক অনবদ্য সিনেমাটিক উপাখ্যান। দ্বৈতমত সৃষ্টি হবে এই সিনেমার আলোচনায়, সেটা অবশ্যম্ভাবী। তবে নির্জলা শিল্পের মাঝে ঢাকার সত্যিকারের চেহারার উপস্থাপন (সবুজ বুড়িগঙ্গার পানি নয়) অহেতুক কৌতুক পরিহারের মানসিকতা এবং সত্যকে সত্যের মধ্যে রাখার সিনেমা- লাইভ ফ্রম ঢাকা।
সিনেমাটির সম্পাদনারীতি Jump Cut পদ্ধতির। শব্দের সংমিশ্রণে L-Cut & J-Cut-এর যথাযথ, পরিমিত ব্যবহার, Handheld jerking camera এবং Documentary like footage usage পরিচালকের 3rd Cinema-র প্রতি ভালোবাসা বুঝিয়ে দেয়। সুযোগ পেলে তীব্র রাজনৈতিক বাদানুবাদের সিনেমা সে তিনি তুলতে সমর্থ হবেন, সেটা আশা করাই যায়।
সিনেমাটিক অন্ধকার আর সিনেমার অন্ধকার এক জিনিস নয়। সাদের ছবিতে বারংবার অন্ধকার সাবটেক্সট থেকে সিনেমাটিক ভিসুয়ালে ইনফর্মেশন হিশেবে আবির্ভূত হয়ে দর্শককে অভিভূত করেছে।
শিল্পনির্দেশনা, পোশাকপরিকল্পনা ও অঙ্গসজ্জা কোথাও অতি’রিক্ত’ মনে হয়নি। পরিশীলিত ব্যবহার করা হয়েছে সিনেমাটিক টুলসের।
খুব বেশি মেটাফর ব্যবহার করা হয়নি, ফলে সিনেমাটি বাহুল্যদোষ বর্জন করে অর্জন করে নিতে পেরেছে পরিশীলিত চলচ্চিত্রনির্মাণের নবতর পথিকৃতের আসনের প্রথম সারির একটি আসন।
সিনেমাটি দেখে একটা বিষয় উপলব্ধিতে এসেছে, তা হল- নিজের বক্তব্য এবং তার ভঙ্গি ঠিকঠাক বেছে নিতে পারলে সিনেমাটিক দৃশ্যকল্পের গঠনে এবং একই সাথে দর্শকের মনস্তত্তের সংগঠনে বিশেষ বেগ পেতে হয় না।
দিনশেষে, পরিচালক মাত্রই মাত্রাজ্ঞান প্রখর হওয়া প্রয়োজন, কিভাবে শুরু করে কোথায় থামতে হবে সেটা না জানা থাকলে অনেক ভালো প্লটও নষ্ট হয়ে যেতে বাধ্য। সাদের ব্যাপারে বলা যায়, মাত্রাজ্ঞানের পরিধি তার মাত্রার ভেতরেই যথেষ্ট বিদ্যমান।
খুব সূক্ষ্ম কিছু দৃশ্যের উপস্থাপন এবং শব্দের সমাবেশে সিনেমাটিক ভাষা নিয়ে নিরীক্ষার জন্য পরিচালক ধন্যবাদের দাবিদার।
গল্পটা ধীরগতির হলেও সামগ্রিকতা বিচারে “Live from Dhaka” ঢাকার জীবনের গতির পেছনের স্থবিরতা, মানবিকতার বিকাশের বিকলাঙ্গতা ও উলঙ্গ ঢাকার চেহারা আমাদের সামনে তুলে ধরেছে। নতুন প্রজন্মের পরিচালক ও চিত্রনাট্যরচয়িতারা যদি তাদের সমসাময়িক বিষয়ে সিনেমা নির্মাণে আগ্রহী হয়ে ওঠেন, তবে হয়তো “সমাজের দর্পণ” বলে সিনেমা আবারও আমাদের সমাজে স্থান করে নেবে।
২৩/০৩/২০১৯
ট্রেইলার দেখতে ক্লিক করুন- Live from Dhaka
আরো পড়ুন-